সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) জেনে জীবনকে সঠিক পদ্ধতিতে সাজান

আরবি ভাষায় সীরাত বা সিরাত শব্দটি (আরবি: سيرة‎‎) সারা (বর্তমান কাল : ইয়াসিরু ) ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে , যার অর্থ ভ্রমণ করা বা ভ্রমণ করে আসা। একজন ব্যক্তির সীরাত হল সেই ব্যক্তির জীবন, বা জীবনী, তার জন্ম, তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, আচার-আচরণ, বৈশিষ্ট্য এবং তার মৃত্যু।

আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন (ছাফফাত ৩৭/৯, ফাতহ ৪৮/২৮)। তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সাবা ৩৪/২৮)। তিনি বলেন, ‘অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাক। কেননা তুমি উপদেশদাতা বৈ কিছুই নও। তুমি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও’ (গাশিয়া ৮৩/২১-২২)। আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন ‘ইসলাম’কে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে রাসূল (ছাঃ) অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অমানুষিক নির্যাতন ও অকথ্য নিপীড়ন নীরবে সহ্য করেছেন।

রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র-মাধুর্য :

রাসূলূল্লাহ (ছাঃ)-এর চরিত্র ও তাঁর আদর্শ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত আছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। তিনি আরো বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘অবশ্যই তুমি মহত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত’ (কলম ৬৮/৪)।

রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে ফ্রান্সের প্রফেসর সেডইউ বলেন, নবী করীম (ছাঃ) ছিলেন হাস্যমুখ ও মিশুক স্বভাবের। তিনি প্রায়ই নীরব থাকতেন এবং অধিকাংশ সময় আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকতেন। অনর্থক কথা হ’তে তিনি দূরে থাকতেন এবং অশ্লীলতাকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি ছিলেন সঠিক মত ও উত্তম জ্ঞানের অধিকারী।[কাযী সুলাইমান মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল আলামীন, অনুবাদ: ড. মু. মুজীবুর রহমান (রাজশাহী : মুহাম্মদী প্রকাশনী সংস্থা, ১৯৯৭), ১/২২৫ পৃঃ]

অধিকাংশ নবী-রাসূল বিভিন্ন প্রকার মুজিযা লাভ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্যতম মুজিযা ছিল তাঁর চরিত্র। তিনি মানুষের অন্তরসমূহ পরিবর্তন এবং আত্মাকে পবিত্র করে দিতেন চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে। এ সম্পর্কে শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহঃ) লিখেছেন, ‘কোন ব্যক্তি যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে এক বার আসত, সে ভীত হয়ে পড়ত। আর যে কেউ তাঁর পাশে এসে বসতো সে মহববতে আকৃষ্ট হয়ে যেত।[রহমাতুল্লিল আলামীন ১/২২৬ পৃঃ]

তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বে যে উত্তম চরিত্র বিদ্যমান তা অধিকাংশ নবীদের চরিত্র মাধূর্যের নির্যাস। হযরত মূসা (আঃ) এর মত শাসনকর্তা, হারুনের ন্যায় ইমামতের অধিকারী, নূহের মত দ্রুততা, ইব্রাহীমের ন্যায় অন্তরের কোমলতা, ইউসুফের মত ক্ষমাশীলতা, দাউদের ন্যায় অসংখ্য বিজয়, ইয়াকুবের মত বিনয় নম্রতা, ইয়াহইয়ার ন্যায় সাধুতা, ইসমাঈলের মত আত্মার পবিত্রতা, ইত্যাদি গুণের একত্র সমাবেশ ঘটেছিল।

সীরাত পাঠের প্রয়োজনীয়তা হলো রাসূল (ছাঃ)-এরগুণাবলী জেনে বুঝে তা নিজের জীবনে প্রতিপালন করা। তাঁর গুণাবলী ছিল- সত্যবাদিতা, সাহসিকতা, কোমলতা, দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহানুভূতি-সহমর্মিতা, কল্যাণকামিতা, বদান্যতা, ধৈর্য- সহিষ্ণুতা, স্নেহ-মমতা, পরমত সহিষ্ণুতা, আত্মসচেতনতা, আল্লাহর প্রতি পরম আস্থা, আপন কাজে নিষ্ঠা ও অবিচলতা, ন্যায়ের প্রতি আনুকূল্য, অন্যায়ের প্রতি বজ্র-কাঠিন্য, অটুট মনোবল, নিঃস্বার্থ ত্যাগ-তিতিক্ষা। মোদ্দাকথা উন্নত চরিত্রের সকল উপাদান।

রাসূলের নবুওয়াতের সার্বিক মাহাত্ম্য :

যে ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ) এর পবিত্র জীবনী নিয়ে চিন্তা গবেষনা করবে, সে তাঁর নবুওয়াতের মধ্যে সমস্ত নবীর মাহাত্ম্য দৃষ্টিগোচর হবে। তিনি ঈসা (আঃ) এর মত অবিশ্বাসকৃত ও অত্যাচারের শিকার হন এবং আল্লাহ্র ঘরের মর্যাদা নতুন ভাবে জাগিয়ে তোলেন। ইয়াহইয়ার মত লোকালয়ে ও মরুভূমিতে আল্লাহর আওয়াজ পৌঁছে দেন। আইয়্যুবের ধৈর্য্য ও সহনশীলতার সাথে শাবে আবু তালিবে তিন বছর পর্যন্ত বন্ধীত্বের জীবন যাপন করেন। নূহের মত স্বীয় সম্প্রদায়ের ধর্মদ্রোহী লোকদের কাছে গোপনে ও প্রকাশ্যে নির্জনে ও সমাবেশে , পাহাড়ে ময়দানে ইসলামের দাওয়াতে পৌছাতে থাকেন এবং জনগনের মনে তাদের দুষাকর্মের প্রতি ঘৃনা সৃষ্টি করেন। ইবরাহীম (আঃ) এর ন্যায় অবাধ্য সম্প্রদায় হতে পৃথক হয়ে যায় এবং মরুভূমি ত্যাগ করে আসলামের পবিত্র বৃক্ষ রোপনের উদ্দেশ্যে হিজরত করেন এবং দাউদ (আঃ) এর মত শত্রুদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। ইউনুস (আঃ) যেমন মাছের পেটে তিনদিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। সারে সত্তর পর্বতের গুহায় তিনদিন থেকে তিনি মদিনায় পৌঁছে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মূসা (আঃ) যেমন বনী ইসরাঈলকে মিসরের ফেরাউনের দাসত্ব হতে মুক্ত করেছিলেন, তেমনি উত্তর আরবকে তিনি কন্স্টান্টিনোপলের শাসনের নাগপাশ হতে পূর্ব আরবকে ইরানের বাদশাহ্ কিসরার গোলামী হতে মুক্ত করেন। সুলাইমান (আঃ) যেমন ফিলিস্তিনে আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঘর নির্মান করেন, তেমনি তিনিও মদীনায় আল্লাহর ঘর তৈরী করেন।

যারা সীরাত পাঠ করে তা অন্তস্থ করেছেন, তারা অন্তরজগৎকে আলোকিত, বৈষ্যয়িক জীবনকে পরিপাটি, কথায় বিশুদ্ধভাসী ও সত্যবাদিতা, আচার-আচরণে শিষ্টাচারপূর্ণতা , চারিত্রিক উৎকর্ষতার মাধুর্য্যতা, আদর্শবান নেতা ও দায়িত্ববান, শ্রেষ্ঠ্য অভিভাবক সম্পর্কে যথার্থ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top