সূরা ফাতিহার ফযীলত

(‘ফযীলতপূর্ণ দো‘আ ও যিকির’ বই থেকে নেয়)
সূরা ফাতিহা (মুখবন্ধ) সূরা-১, মাক্কী :
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
اَلْحَمْدُ لِلہِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَﭐﺫ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِﭑﺫ مٰلِکِ یَوْمِ الدِّیْنِﭒﺚ اِیَّاکَ نَعْبُدُ وَاِیَّاکَ نَسْتَعِیْنُﭓﺚ اِھْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَﭔﺫ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْھِمْﺃ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْھِمْ وَلَا الضَّا۬لِّیْنَﭖﺟ
উচ্চারণ : (১) আল হামদু লিল্লা-হি রাব্বিল আলামীন (২) আর রাহমা-নির রাহীম (৩) মা-লিকি ইয়াওমিদ্দ্বীন (৪) ইয়্যাকা না‘আবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন (৫) ‘ইহ্দিনাছ ছিরা-ত্বাল মুস্তাক্বীম (৬) ছীরা-তাল্লাযীনা আন‘আমতা ‘আলাইহিম (৭) গাইরিল মাগযূবি ‘আলাইহিম ওয়ালায্যল্লীন’।
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্র নামে (শুরু করছি)
অনুবাদ : (১) ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগত সমূহের প্রতিপালক’। (২) ‘যিনি করুণাময় কৃপানিধান’। (৩) ‘যিনি বিচার দিবসের মালিক’। (৪) ‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং একমাত্র আপনার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি’। (৫) ‘আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’! (৬) ‘এমন লোকদের পথ, যাঁদেরকে আপনি পুরস্কৃত করেছেন’। (৭) ‘তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে’। আমীন! (হে আল্লাহ! আপনি কবূল করুন)।

ফযীলত : (১) ‘আব্দুুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, একদিন জিব্রীল আমীন (আঃ) নবী (ছাঃ)-এর কাছে বসে ছিলেন। এ সময় উপরের দিক হ’তে দরজা খোলার শব্দ তিনি শুনলেন। তিনি উপরের দিকে মাথা উঠালেন এবং বললেন,‘আসমানের এ দরজাটি আজ খোলা হ’ল। এর আগে আর কখনো তা খোলা হয়নি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, এ দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা নামলেন। তখন জিব্রীল (আঃ) বললেন, যে ফেরেশতা আজ জমিনে নামলেন, আজকে ছাড়া আর কখনো তিনি জমিনে নামেননি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তিনি সালাম করলেন। অতঃপর আমাকে বললেন, আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। এটা আপনার আগে আর কোন নবীকে দেয়া হয়নি। আর তাহ’ল সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারাহ’র শেষাংশ (শেষ তিন আয়াত)। আপনি এ দু’টি সূরার যে কোন বাক্যই পাঠ করুন না কেন নিশ্চয়ই আপনাকে তা দেয়া হবে’। (মুসলিম হা/৮০৬; নাসাঈ হা/৯১২; মিশকাত হা/২১২৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৬)।

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কথাটি তিনবার বলেন। রাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, যখন আমরা ইমামের পিছনে থাকি? জওয়াবে তিনি বলেন, إِقْرَأْ بِهَا فِىْ نَفْسِكَ ‘তখন তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার এবং আমার বান্দার মধ্যে ছালাতকে (সূরা ফাতিহাকে) ভাগ করে নিয়েছি’। তোমরা সূরা ফাতিহা পাঠ করো। বান্দা যখন বলে, ‘আল হামদু লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আলামীন’ তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘আর রাহমা-নির রাহীম’ তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণগান করেছে। বান্দা যখন বলে, ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন’ তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমাকে সম্মান প্রদর্শন করেছে। অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে সীমিত এবং আমার বান্দা যা প্রার্থনা করেছে তাই তাকে দেওয়া হবে। অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘ইহ্দিনাছ ছিরা-ত্বাল মুস্তাক্বীম, ছীরা-ত্বাল্লাযীনা আন‘আমতা ‘আলাইহিম, গাইরিল মাগযূবি ‘আলাইহিম ওয়ালায্যল্লীন’ তখন আল্লাহ বলেন, এর সবই আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দা আমার কাছে যা চেয়েছে, তাকে তাই দেয়া হবে’। (মুসলিম হা/৩৯৫, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২৩।)

(৩) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একবার উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ছালাতে কিভাবে কুরআন পড়ো? জওয়াবে ঊবাই ইবনে কা‘ব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সূরা ফাতিহা পাঠ করে শুনালেন। অতঃপর সূরা ফাতিহার তিলাওয়াত শুনে রাসূল (ছাঃ) বললেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا أُنْزِلَتْ فِى التَّوْرَاةِ وَلاَ فِى الإِنْجِيلِ وَلاَ فِى الزَّبُورِ وَلاَ فِى الْفُرْقَانِ مِثْلُهَا وَإِنَّهَا سَبْعٌ مِنَ الْمَثَانِى وَالْقُرْآنُ الْعَظِيمُ الَّذِى أُعْطِيتُهُ. ‘আল্লাহ্র কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জীল ও কুরআনে এ সূরার তুলনীয় কোন সূরা নেই। এ সূরা হ’ল সাব্‘উল মাছানী (পুনরাবৃত্ত সাতটি আয়াত) ও মহিমান্বিত কুরআন, যা আমাকে দেওয়া হয়েছে। (বুখারী হা/৪৭০৩; আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২১৪২; হাদীসটি হাসান ও ছহীহ।)

(৪) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি দল আরবের এক গোত্রের নিকট আসলেন। গোত্রের লোকেরা তাদের কোন আতিথেয়তা করল না। তাঁরা সেখানে থাকতেই হঠাৎ সে গোত্রের নেতাকে সাপে দংশন করল। তখন তারা এসে বলল, আপনাদের কাছে কী কোন ঔষধ আছে কিংবা আপনাদের মধ্যে ঝাড়-ফুঁককারী কোন লোক আছে কী? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তবে তোমরা আমাদের কোন আতিথেয়তা করনি। কাজেই আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা তা করব না। ফলে তারা তাদের জন্য এক পাল ছাগল পারিশ্রমিক দিতে সম্মত হ’ল। তখন একজন ছাহাবী ‘উম্মুল কুরআন’ (সূরা ফাতিহা) পড়তে লাগলেন এবং মুখে থুথু জমা করে সে ব্যক্তির গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। ফলে সে রোগ মুক্ত হ’ল। এরপর তারা ছাগলগুলো নিয়ে এসে বলল, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করার পূর্বে এতে স্পর্শ করব না। অতঃপর তারা এ বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা শুনে হাসলেন এবং বললেন, وَمَا أَدْرَاكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ ، خُذُوهَا ، وَاضْرِبُوا لِى بِسَهْمٍ. ‘তোমরা কিভাবে জানলে যে, এটি রোগ নিরাময় করে? ঠিক আছে ছাগলগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক ভাগ রেখে দিও’। (বুখারী হা/৫৭৩৬; মিশকাত হা/২৯৮৫; মুসলিম হা/৫৮৬৩; তিরমিযী হা/৩৯০০।)
এজন্য এ সূরাকে রাসূল (ছাঃ) ‘রুক্বইয়াহ’ (الرُّقْيَةُ) বলেছেন। কেননা এই সূরা পড়ে ফুঁক দিলে আল্লাহ্র হুকুমে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। (বুখারী হা/৫৭৩৬, মুসলিম হা/২২০১ ‘সালাম’ অধ্যায়; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর।)

সূরা ফাতিহা ব্যতীত ছালাত হয় না : অত্র হাদীছে জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠের স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। অতএব জেহরী সকল ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয।ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ছালাতের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা সবচেয়ে বড় রুকন’ (ঐ, তাফসীর সূরা ফাতিহা)।

উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘লা ছালা-তা লিমান লাম ইয়াক্বরা’ বিফা-তিহাতিল কিতা-ব’ অর্থাৎ ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না’। বুখারী হা/৭৫৬, মুসলিম হা/৩৯৪, মিশকাত হা/৮২২।

জেহরী-সের্রী সকল ছালাতে সর্বাবস্থায় ইমাম-মুক্তাদী উভয়কেই সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) মুক্তাদীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমরা উহা চুপে চুপে পড়। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, সূরা ফাতিহা আমার মাঝে ও আমার বান্দার মাঝে ভাগ করা হয়েছে। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে যা সে চায় (মুসলিম, মিশকাত হা/৮২৩, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০২)

চাওয়ার বিষয়টি সবার জন্য। ইমাম-মুক্তাদী সবাইকে আল্লাহর নিকট চাইতে হবে। একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত শেষে বললেন, তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে কি কিছু পড়ছিলে? আমরা বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, এরূপ করো না কেবল সূরা ফাতিহা ব্যতীত। কারণ যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়ে না, তার ছালাত হয় না (আবু দাউদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৮৫৪, সনদ হাসান)

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সূরা ফাতিহা ব্যতীত কোন ছালাত সিদ্ধ হবে না। আমি বললাম, যদি আমি ইমামের পিছনে থাকি? তখন তিনি আমার হাত ধরে বললেন, তুমি তা চুপে চুপে পড় (ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৭৮৬, সনদা ছহীহ)। উল্লেখিত হাদীছসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম-মুক্তাদী সকলকেই সর্বাবস্থায় সূরা ফাতিহা পড়তে হবে।

পবিত্র কুরআন মূলতঃ তিনটি বিষয়ে বিভক্ত। তাওহীদ, আহকাম ও নছীহত। সূরা ইখলাছে ‘তাওহীদ’ পূর্ণাঙ্গভাবে থাকার কারণে তা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সূরা ফাতিহাতে তিনটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে তা ‘উম্মুল কুরআন’ হওয়ার মহত্তম মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top