হালাল রুযী তারাই গ্রহণ করবে যারা মুমিন বান্দা। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলেন, إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ- ‘অথচ মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হ’তে পারে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)।
ধনী-গরীবের মধ্যকার ব্যবধান আল্লাহ তা‘আলারই ব্যবস্থাপনা। তিনি যাকে খুশী অঢেল সম্পদ দিয়ে থাকেন। এটা মেনে নেয়া তাকদীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর ধনাঢ্যতা ও দারিদ্রতা উভয়ই বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা যাকে যতটুকু সম্পদ দিয়েছেন, এতে সন্তুষ্ট থেকে হালাল জীবিকা গ্রহণ করা উচিৎ। এ দিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,انْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوْا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوْا نِعْمَةَ اللهِ ‘তোমাদের চাইতে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে তাকাও এবং তোমাদের চাইতে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্নদের দিকে তাকিও না। আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে তুচ্ছ মনে না করার জন্যে এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা’ (তিরমিযী হা/২৫১৩; ইবনু মাজাহ হা/৪১৪২, সনদ ছহীহ)।
আল্লাহর উপর ভরসা করা ও হালাল জীবিকার উপর সর্বদা অটল থাকা উচিৎ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ ‘তোমরা আল্লাহর উপরই ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হও’ (মায়েদাহ ৫/২৩)। তিনি আরো বলেন,وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেন’ (তালাক ৬২/৩)।
স্বহস্তে উপার্জন সর্বোৎকৃষ্ট রুযী। যারা হালাল পন্থায় নিজ হাতে আয় করে ভক্ষণ করে তারা দাউদ (আঃ)-এর মত জীবিকা গ্রহণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ- ‘কারো জন্য স্বহস্তের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আর আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ করতেন’ (বুখারী, মিশকাত হা/২৭৫৯)।
সাহল বিন আব্দুল্লাহ বলেন, النجاة في ثلاثة : أكل الحلال، وأداء الفرائض، والاقتداء بالنبي صلى آله عليه وسلم. ‘নাজাত তিনটি জিনিসে। তাহ’ল ১. হালাল খাবার গ্রহণ করা, ২. ফরয সমূহ আদায় করা এবং ৩. নবী করীম (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা। অন্যত্র সাঈদ বিন ইয়াযীদ বলেন,
خمس خصال بها تمام العلم، وهي: معرفة الله عز وجل، ومعرفة الحق وإخلاص العمل لله، والعمل على السنة، وأكل الحلال، فإن فقدت واحدة لم يرفع العمل.
‘পাঁচটি গুণে ইলমের পূর্ণতা রয়েছে। আর তা হ’ল আল্লাহকে চেনা, হক বুঝা, আল্লাহর জন্য ইখলাছপূর্ণ আমল করা, সুন্নাহ মোতাবেক আমল ও হালাল খাদ্য গ্রহণ করা। আর এর একটি নষ্ট হ’লে আমল কবুল হবে না’(তাফসীরে কুরতুবী, ২/২০৮, সূরা বাক্বারাহ ১৬৮নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ)।
নবী-রাসূলগণের উপার্জনের পেশা :
আদম (আঃ) :
মানব জাতির আদি পিতা আদম (আঃ) ছিলেন একজন কৃষক। যিনি জমিতে ফসল ফলাতেন এবং নিজ হাতে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরী করতেন। আর এ কাজে তাঁর স্ত্রীও সাহায্য করতেন। তিনি একজন রাজ মিস্ত্রীও ছিলেন (ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবহাত ফি তালবির রিযক, পৃঃ ৬৪) ।
দাউদ (আঃ) :
রাসূল্ল্লুাহ (ছাঃ) বলেন, وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ ‘আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন’ (বুখারী, হা/২০৭২)।
ইবনু আববাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত আছে যে, كَانَ دَاوُدُ زَرَّادًا وَكَانَ آدَمُ حَرَّاثًا وَكَانَ نُوحٌ نَجَّارًا وَكَانَ إِدْرِيسُ خَيَّاطًا وَكَانَ مُوْسَى رَاعِيًا ‘দাঊদ (আঃ) ছিলেন বর্ম নির্মাতা, আদম (আঃ) ছিলেন কৃষক, নূহ (আঃ) ছিলেন কাঠ মিস্ত্রী, ইদ্রীস (আঃ) ছিলেন দর্জি, মূসা (আঃ) ছিলেন রাখাল’ (ফাৎহুল বারী ২০৭২নং হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كَانَ زَكَرِيَّاءُ نَجَّارًا ‘যাকারিয়া (আঃ) ছিলেন কাঠ মিস্ত্রী (মুসলিম হা/২৩৭৯)।
ইদ্রীস (আঃ) :
সর্বপ্রথম ইদ্রীস (আঃ) প্রথম ব্যক্তি যিনি সুতার তৈরী সেলাইযুক্ত পোষাক তৈরী করেন।
নূহ (আঃ) :
নূহ (আঃ) নিজ কওমের ছাগল চরাতেন। তিনি কাঠ মিস্ত্রীও ছিলেন। তিনি প্লাবনের পূর্বে স্বহস্তে কাঠের নৌকা তৈরী করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَيَصْنَعُ الْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌ مِنْ قَوْمِهِ سَخِرُوا مِنْهُ ‘সে নৌকা নির্মাণ করতে লাগল, আর যখনই তার কওমের প্রধানদের কোন দল তার নিকট দিয়ে গমন করত, তখনই তার সাথে উপহাস করত’ (হূদ ১১/৩৮)।
ইউসুফ (আঃ) :
ইউসুফ (আঃ) ছিলেন মিসরের অর্থমন্ত্রী। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন,قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ ‘ইউসুফ বলল, আপনি আমাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। নিশ্চয়ই আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও (এ বিষয়ে) বিজ্ঞ’ (ইউসুফ ১২/৫৫)।
মূসা (আঃ) :
মূসার দৈহিক শক্তি ও আমানতদারিতার কারণে আট বা দশ বছর শো‘আয়েব (আঃ)-এর ছাগল চরানোর বিনিময়ে তার কন্যাকে বিবাহ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ ‘নিশ্চয়ই কর্মচারী হিসাবে উত্তম হবে সে ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত’(কাছাছ ২৮/২৬; ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবহাত ফি তালবির রিযক, পৃঃ ৬৪)।
হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) :
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীর ছাগল চরাতেন। এ বিষয়ে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا بَعَثَ اللهُ نَبِيًّا إِلاَّ رَعَى الْغَنَمَ ‘আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি, যিনি বকরী চরাননি। তখন তাঁর ছাহাবীগণ বলেন, আপনিও? তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি কয়েক কীরাতের (মুদ্রা) বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম’(বুখারী হা/২২৬২)।
খোলাফায়ে রাশেদীন :
১. আবুবকর (রাঃ) :
আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) ছিলেন জাহেলী যুগ থেকেই একজন সৎ ব্যবসায়ী। কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। ইসলাম কবুল করার পর তার সম্পদ গোলাম আযাদ ও ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করেন। কিন্তু যখন তিনি খলীফা নিযুক্ত হন, তখনও কাপড় নিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য বের হন। পরে ওমর ও আবু ওবায়দার পরামর্শক্রমে ভাতা নির্ধারণ করলে তা থেকে সংসার চালান (ফাৎহুল বারী হা/২০৭১নং হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
২. ওমর ফারূক (রাঃ) :
ওমর (রাঃ) ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। এর মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন (ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবুহাত ফি চলাবির রিযক, পৃঃ ৬৮)।
৩. ওছমান (রাঃ) :
ওছমান (রাঃ) জাহেলী যুগে ও ইসলামী যুগে কাপড় বিক্রয় করতেন এবং এর মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন (ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবুহাত ফি চলাবির রিযক, পৃঃ ৬৮)।
৪. আলী (রাঃ) :
আলী (রাঃ) নিজ হাতে কাজ করতেন। তিনি খেজুরের বিনিময়ে কুপ থেকে পানি তুলে অন্যের জমিতে সেচ দিতেন। তার কষ্ট এমন পর্যায়ে পৌঁছতো যে হাতে রশির দাগ পড়ে যেত (ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবুহাত ফি চলাবির রিযক, পৃঃ ৬৮)।
অন্যান্য ছাহাবীগণ :
খাববাব ইবনে আরত ছিলেন কর্মকার, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসূদ (রাঃ) ছিলেন রাখাল, সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তীর প্রস্ত্ততকারী ছিলেন, জোবায়ের ইবনে আওয়াম দর্জী, বেলাল ইবনে রাবাহ ও আম্মার ইবনে ইয়াসির গোলাম ছিলেন। সালমান ফারসী ক্ষুরকার ও খেজুর গাছে পরাগায়নের কাজ করতেন। বারা ইবনে আযেব ও যায়েদ বিন আরকাম ছিলেন ব্যবসায়ী (ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবুহাত ফি চলাবির রিযক, পৃঃ ৬৮)।
পরিশেষে এটা মনে রাখা উচিৎ, পরকালে আল্লাহ মানুষের উপার্জিত সকল সম্পদের হিসাব গ্রহণ করবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَا أَنْفَقَهُ ‘তার সম্পদ সম্পর্কে (জিজ্ঞেস করা হবে) সে কোথা থেকে উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে’(তিরমিযী হা/২৪১৬; ইবনু মিশকাত হা/৫১৯৭, সনদ ছহীহ)। আর হারাম উপায়ে উপার্জিত রুযী খেয়ে পরিপুষ্ট দেহ জাহান্নামের জ্বালানী হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِالْحَرَامِ ‘হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৭৮৭; ছহীহাহ হা/২৬০৯)।