হিংসা

প্রফেসার ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

মানব মনের রোগসমূহের মধ্যে একটি কঠিন রোগের নাম হ’ল ‘হিংসা’। যা মানুষকে পশুর চাইতে নীচে নামিয়ে দেয়। হিংসার পারিভাষিক অর্থ تَمَنَّى زَوَالَ نِعْمَةِ الْمَحْسُوْدِ ‘হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মতের ধ্বংস কামনা করা’। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسُلِّطَ عَلَى هَلَكَتِهِ فِى الْحَقِّ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْحِكْمَةَ ، فَهْوَ يَقْضِى بِهَا وَيُعَلِّمُهَا ‘দু’টি বস্ত্ত ভিন্ন অন্য কিছুতে হিংসা সিদ্ধ নয়। ১. আল্লাহ যাকে মাল দিয়েছেন। অতঃপর সে তা হক-এর পথে ব্যয় করে। ২. আল্লাহ যাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন। সে তা দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শিক্ষা দেয়’।[1] 

এটিকে মূলতঃ হিংসা বলা হয় না, বরং ঈর্ষা বলা হয়। ইমাম রাযী বলেন, যখন আল্লাহ তোমার কোন ভাইকে কোন নে‘মত দান করেন, আর তুমি যদি তার উক্ত নে‘মতের ধ্বংস কামনা কর, তাহ’লে সেটি হ’ল হিংসা (الْحَسَدُ )। আর যদি তুমি নিজের জন্য অনুরূপ নে‘মত কামনা কর, তাহ’লে সেটি হ’ল ঈর্ষা (الْغِبْطَةُ)। হিংসা নিষিদ্ধ এবং ঈর্ষা সিদ্ধ, বরং আকাংখিত। উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটাই বলতে চেয়েছেন। ইমাম নববী বলেন, হিংসা দু’প্রকারের: প্রকৃত (حقيقي ) ও রূপক (مجازي )। প্রকৃত হিংসা হল,تمنى زوال النعمة عن صاحبها ‘ব্যক্তির নে‘মত দূর হয়ে যাওয়ার কামনা করা’। এটি সর্বসম্মতভাবে হারাম। পক্ষান্তরে রূপক হ’ল ঈর্ষা (الغبطة )। যা অন্যের অনুরূপ নে‘মত কামনা করে, তার নে‘মত দূর হওয়ার কামনা ছাড়াই। এরূপ ঈর্ষা করা দুনিয়াবী ব্যাপারে ‘মুবাহ’ এবং দ্বীনী ব্যাপারে ‘মুস্তাহাব’। যেমন ইবাদতে রাত্রি জাগরণে প্রতিযোগিতা করা, দান-ছাদাক্বায় প্রতিযোগিতা করা ইত্যাদি।[2]

উদাহরণ স্বরূপ তাবুকের যুদ্ধে গমনের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সকলের নিকট দান চাইলেন, তখন ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন যে, আমি আমার অর্ধেক মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হ’লাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আজ আমি আবুবকরকে ছাড়িয়ে যাব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, مَا أَبْقَيْتَ لأَهْلِكَ؟ ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ? বললাম, অতটা। এরপর আবুবকর এলেন তার সব মাল-সম্পদ নিয়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন, أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ ‘আমি তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। তখন আমি বললাম, لاَ أُسَابِقُكَ إِلَى شَىْءٍ أَبَدًا ‘কোন ব্যাপারেই আমি কখনো আপনার সাথে পেরে উঠিনি’।[3]
এটা ছিল আখেরাতে নেকী অর্জনের প্রতিযোগিতা। তাই এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু যখন এটি দুনিয়াবী সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা হবে। সেখানে প্রথমে হিংসা না থাকলেও পরে তা পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষে রূপ নেবে। যেমন আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বললেন, إِذَا فُتِحَتْ عَلَيْكُمْ فَارِسُ وَالرُّومُ أَىُّ قَوْمٍ أَنْتُمْ যখন তোমরা পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্য জয় করবে, তখন তোমরা কেমন হবে? আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বললেন, যেমন আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেনأَوْ غَيْرَ ذَلِكَ، تَتَنَافَسُونَ ثُمَّ تَتَحَاسَدُونَ ثُمَّ تَتَدَابَرُونَ ثُمَّ تَتَبَاغَضُونَ أَوْ نَحْوَ ذَلِكَ বরং অন্য কিছু। তোমরা প্রতিযোগিতা করবে। অতঃপর পরস্পরে হিংসা করবে। অতঃপর পরস্পরকে পরিত্যাগ করবে। অতঃপর পরস্পরে বিদ্বেষ করবে বা অনুরূপ করবে’।[4] তিনি বলেন, فَوَاللهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ وَلَكِنِّى أَخْشَى أَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا فَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের দরিদ্রতাকে ভয় পাইনা। বরং আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই যে, তোমাদের উপর দুনিয়াবী প্রাচুর্য আসবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর এসেছিল। অতঃপর তোমরা প্রতিযোগিতা করবে। যেমন তারা করেছিল। অতঃপর প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করেছিল’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে,وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ ‘তোমাদেরকে উদাসীন করে দিবে, যেমন তাদেরকে উদাসীন করেছিল’। [6]  
উক্ত হাদীছে যে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার দু’টি দিক রয়েছে। এক- যদি উক্ত প্রাচুর্যকে ধ্বংস করার চিন্তা কারু মাথায় আসে, তবে সেটা হবে ‘হিংসা’। যা নিন্দনীয়। দুই- যদি তার হেদায়াত কামনা করে এবং নিজেও অনুরূপ প্রাচুর্যের কামনা করে, তবে সেটা হবে বৈধ ও প্রশংসনীয়। যাকে কুরআনে ও হাদীছে ‘তানাফুস’ (التنافس) বা প্রতিযোগিতা বলা হয়েছে।


[1]. বুখারী হা/৭৩; মিশকাত হা/২০২ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম শরহ নববী হা/৮১৬-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[3]. আবুদাঊদ হা/১৬৭৮; তিরমিযী হা/৩৬৭৫; মিশকাত হা/৬০২১।
[4]. মুসলিম হা/২৬৬২; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৬।
[5]. তিরমিযী হা/২৪৬২, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৭।
[6]. বুখারী হা/৬৪২৫; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩।

হিংসার প্রতি নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা

কুরআন থেকে :
(১) হিংসুকদের অনিষ্টকারিতা হ’তে বাঁচার জন্য আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা করতে বলেছেন- وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‘(হে আল্লাহ!) আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই হিংসুকের অনিষ্টকারিতা হতে যখন সে হিংসা করে’ (ফালাক্ব ১১৩/৫)। ইমাম রাযী বলেন, আল্লাহ মানুষের সকল নষ্টের মূল হিসাবে এখানে ‘হিংসা’ দিয়ে সূরা শেষ করেছেন। যেমন শয়তানের সকল অনিষ্টের মূল হিসাবে ‘মনে খটকা সৃষ্টি’ (ওয়াসওয়াসা) দিয়ে সূরা নাস শেষ করেছেন’। যা তারতীরের দিক দিয়ে কুরআনের শেষ সূরা। এর মাধ্যমে মানুষকে মানুষের হিংসা থেকে এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। কেননা এ দু’টি থেকে বাঁচার অন্য কোন উপায় নেই আল্লাহর রহমত ব্যতীত। হুসাইন বিন ফযল বলেন, আল্লাহ এই সূরাতে যাবতীয় মন্দকে একত্রিত করেছেন এবং ‘হিংসা’ দিয়ে শেষ করেছেন এটা বুঝানোর জন্য যে এটাই হ’ল সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব’।
বস্ত্ততঃ যে সমাজে হিংসার প্রসার যত বেশী, সে সমাজে অশান্তি তত বেশী। সমাজে অতক্ষণ যাবত কল্যাণ ও শান্তি বিরাজ করে, যতক্ষণ সেখানে হিংসার প্রসার না ঘটে। যামরাহ বিন ছা‘লাবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا لَمْ يَتَحَاسَدُوْا ‘মানুষ অতক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরে হিংসা না করবে’।[1]
(২) আল্লাহ নিজেই হিংসাকে নিন্দা করেছেন। যেমন তিনি আহলে কিতাবদের বদস্বভাব বর্ণনা করে বলেন, أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللهُ  مِن فَضْلِهِ ‘তবে কি তারা লোকদের (মুসলমানদের) প্রতি এজন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ হতে কিছু দান করেছেন? (নিসা ৪/৫৪)। অত্র আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী বলেন, وَالْحَسَدُ مَذْمُومٌ وَصَاحِبُهُ مَغْمُومٌ وَهُوَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ‘হিংসা নিন্দনীয় এবং হিংসুক ব্যক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। হিংসা সকল নেকী খেয়ে ফেলে যেমন আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে’ (কুরতুবী)।
হাদীছ থেকে :
(১) হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন وَلاَ تَبَاغَضُوْا ولاَ تَحَاسَدُوْا وَلاَ تَدَابَرُوْا وَلاَتَقَاطَعُوْا وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا ‘তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিংসা করো না, একে অপরকে পরিত্যাগ করো না, একে অপরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পরস্পরে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[2] অত্র হাদীছে মানবতাকে হত্যাকারী কয়েকটি দুরারোগ্য ব্যাধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইসলামী সমাজকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এখানে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হলেও তা মূলতঃ একটি থেকে উৎসারিত। আর তা হ’ল ‘হিংসা’। এই মূল বিষবৃক্ষ থেকেই বাকীগুলি কাঁটাযুক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ডাল-পালার ন্যায় বেরিয়ে আসে। হাসান বাছরী বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে হিংসা রয়েছে। যতক্ষণ সেটি অবাধ্যতা ও যুলুমের দিকে সীমা অতিক্রম না করে, ততক্ষণ তা মানুষের কোন ক্ষতি করে না’।[3]
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَفِيْ رِوَايَةٍ : تُعْرَضُ الأَعْمَالُ فِى كُلِّ يَوْمِ خَمِيسٍ وَاثْنَيْنِ فَيَغْفِرُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِى ذَلِكَ الْيَوْمِ لِكُلِّ امْرِئٍ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا إِلاَّ امْرَأً كَانَتْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ ارْكُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا ارْكُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা সমূহ খোলা হয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ দু’দিন বান্দার আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। অতঃপর আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি এমন সবাইকে মাফ করা হয়। কেবল ঐ দু’জন ব্যতীত যাদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বিদ্যমান রয়েছে। বলা হয়, এদের ছাড়, যতক্ষণ না এরা আপোষে মীমাংসা করে নেয়’।[4]
যে ব্যক্তি মানুষের  প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, তার ঈমান হয় ত্রুটিপূর্ণ। হিংসা তার সমস্ত নেকীকে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন ধীরে ধীরে কাঠকে খেয়ে ফেলে। এভাবে সে নিজের আগুনে নিজে জ্বলে-পুড়ে মরে। পরিণামে তার পূর্বে কৃত সৎকর্মসমূহের নেকীগুলিও ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। ঐ অবস্থায় তার মৃত্যু হ’লে সে নিঃস্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে চলে যায়।
সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য সমূহ :
(১) হযরত মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, كُلُّ النَّاسِ أَسْتَطِيْعُ أَنْ أَرْضِيَهُ إِلاَّ حَاسِدُ نِعْمَةٍ، فَإِنَّهُ لاَ يُرْضِيْهِ إِلاَّ زَوَالُهَا ‘সকল মানুষকে আমি খুশী করতে সক্ষম, কেবল হিংসুক ব্যতীত। কেননা সে অন্যের নে‘মত দূর না হওয়া পর্যন্ত খুশী হয় না’।[5]
(২) তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন, দুনিয়াবী কোন ব্যাপারে আমি কোন ব্যক্তিকে হিংসা করি না। কেননা সে ব্যক্তি যদি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহ’লে আমি কিভাবে দুনিয়াবী বিষয়ে তাকে হিংসা করব? অথচ জান্নাতের তুলনায় দুনিয়া অতীব তুচ্ছ। আর যদি ঐ ব্যক্তি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহ’লে আমি কিভাবে তাকে দুনিয়াবী বিষয়ে হিংসা করব? অথচ ঐ ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে?[6]
(৩) অন্যতম তাবেঈ হাসান বাছরী (২১-১১০ হিঃ) বলেন, হিংসুকের চাইতে বড় কোন যালেমকে আমি দেখিনি যে মযলূমের মতোই। কেননা সে বেঁচে থাকে। অথচ দুঃখ তার অবশ্যম্ভাবী এবং দুশ্চিন্তা তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী’।[7]
(৪) আবু হাতেম দারেমী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ) বলেন, জ্ঞানীর উপর ওয়াজিব হ’ল সর্বাবস্থায় হিংসা হ’তে দূরে থাকা। কেননা হিংসার সবচাইতে নীচু স্তর হ’ল তাক্বদীরের উপর সন্তুষ্টি পরিত্যাগ করা এবং আল্লাহ স্বীয় বান্দার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তার বিপরীত কামনা করা। তিনি বলেন,الحسدُ من أخلاقِ اللِّئَامِ، وتركُه من أفعال الكِرام، ولكلِّ حريقٍ مُطْفِئٌ، ونارُ الحسدِ لا تَطْفَأُ হিংসা হ’ল নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্র এবং তা পরিত্যাগ করা হ’ল মর্যাদাবান ব্যক্তিদের কর্ম। আর প্রত্যেক আগুনের নির্বাপক আছে। কিন্তু হিংসার আগুন নির্বাপিত হয় না’।[8]
(৫) আবুল লাইছ সমরকন্দী (মৃঃ ৩৭৩ হিঃ) বলেন, হিংসাকৃত ব্যক্তির আগেই হিংসুকের নিকট পাঁচটি শাস্তি পৌঁছে যায়। (ক) দুশ্চিন্তা, যা বিচ্ছিন্ন হয় না। (খ) কষ্ট, যার কোন পুরস্কার পাওয়া যায় না। (গ) তিরষ্কার, যাকে প্রশংসা করা হয় না (ঘ) আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করা এবং (ঙ) তার জন্য (কল্যাণ কর্মের) তাওফীকের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া।[9]



[1]. ত্বাবারাণী হা/৮১৫৭; ছহীহাহ হা/৩৩৮৬।
[2]. বুখারী, ফাৎহুলবারী, হা/৬০৭৬; মুসলিম হা/২৫৫৯; মিশকাত হা/৫০২৮।
[3]. ফাৎহুল বারী হা/৬০৬৫।  
[4]. মুসলিম হা/২৫৬৫; মিশকাত হা/৫০২৯-৩০।
[5]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশ্ক্ব ৫৯/২০০ পৃঃ।
[6]. বায়হাক্বী, যুহ্দ আল-কাবীর ৩১৫ পৃঃ।
[7]. ইবনু আব্দি রবিবহী, আল-ইক্বদুল ফারীদ ২/২৭০ পৃঃ।
[8]. আবু হাতেম দারেমী, রওযাতুল উক্বালা ১৩৪ পৃঃ।
[9]. শিহাবুদ্দীন আবশীহী, আল-মুসতাত্বরাফ ২২১ পৃঃ।

হিংসার পরিণাম

(ক) দুনিয়াবী পরিণতি :
হিংসুক ব্যক্তি অন্যকে ক্ষতি করার আগে সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা (১) শুরুতেই সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। হিংসা দূর না হওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য স্থায়ী দুনিয়াবী শাস্তি। (২) তার চেহারা সর্বদা মলিন থাকে। তার সাথে তার পরিবারে হাসি ও আনন্দ থাকে না। (৩) অন্যের ক্ষতি করার চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে সে সর্বদা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে। নিশুতি রাতে বাঁশঝাড়ে কঞ্চির শব্দে কল্পিত জিনের ভয়ে হার্টফেল করার মত হিংসুক ব্যক্তিও সর্বদা কল্পিত শত্রুর ভয়ে আড়ষ্ট থাকে। (৪) তারই মত লোকেরা তার বন্ধু হয়। ফলে সৎ সঙ্গ থেকে সে বঞ্চিত হয়। (৫) ঘুণ পোকা যেমন কাঁচা বাঁশকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়, হিংসুক ব্যক্তির অন্তর তেমনি হিংসার আগুন কুরে কুরে খায়। এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়, যেমন ঘুণে ধরা বাঁশ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে শেষ হয়ে যায়।
বিশ্বে যত অশান্তি তার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল পারস্পরিক হিংসা ও প্রতিহিংসা। হিংসা ও বিদ্বেষ মানবতাকে হত্যা করে। হিংসুক ব্যক্তি কোন অবস্থায় শান্তি পায় না। তার কোন সৎবন্ধু জোটে না। সে কখনোই সুপথপ্রাপ্ত হয় না। তার হৃদয়-মন থাকে সর্বদা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মত। যেখান থেকে সর্বদা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, ধোঁকা ও মিথ্যাচারের দুর্গন্ধযুক্ত স্ফুলিঙ্গ সমূহ নির্গত হয়। সে সর্বদা নিজেকে বিজয়ী ভাবে। অথচ সেই-ই সবচেয়ে পরাজিত। সে নিজেকে বীর ভাবে, অথচ সেই-ই সবচেয়ে ভীরু। ভীত-চকিত সর্পের ন্যায় সে তার কল্পিত প্রতিপক্ষকে ছোবল মারার জন্য সর্বদা ফণা উঁচিয়ে থাকে। এভাবে আমৃত্যু সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যকে হত্যা করার আগে হিংসুককে হত্যা করে। এদিক দিয়ে বিচার করলে হিংসাকেই বড় ন্যায় বিচারক বলতে হয়। কেননা সে সর্বাগ্রে হিংসুককে শাস্তি দেয়, অতঃপর অন্যকে। হিংসুক ব্যক্তি শত চেষ্টায়ও তা গোপন রাখতে পারে না। কেননা শত্রুকে ঘায়েল করার পূর্বে সে নিজেই ঘায়েল হয়। যার নমুনা তার চেহারায় ও কর্মে  ফুটে ওঠে। জনৈক কবি তাই বলেন,

يا حاسداً لي على نعمتي + أتدري على من أسأتَ الأدبْ
أسأتَ على الله في فعلهِ   +    لأنكَ لم ترضَ لي ما قسمْ 
فأخزاكَ ربي بأنْ زادني   +    وسدَّ عليكَ وجوهَ الطلبْ

(১) ‘হে হিংসুক ব্যক্তি! যে আমার নে‘মতে হিংসা করে থাক। তুমি কি জানো তুমি কার সাথে মন্দ আচরণ করো? (২) তুমি আল্লাহর কর্মকে মন্দ বলে থাক। কেননা তিনি আমাকে যা (রহমত) বণ্টন করেছেন তুমি তাতে সন্তুষ্ট নও। (৩) অতএব আমার প্রভু তোমাকে লাঞ্ছিত করুন এ কারণে যে তিনি আমাকে রহমত বেশী দিয়েছেন। আর তোমার উপরে তা বন্ধ করেছেন’।[1]
সৎকর্মশীল ঈমানদ্রন্যর হিংসার শিকার হন। তারা আসামী হন, কিন্তু সহজে বাদী হন না। যুগে যুগে এটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এজন্য প্রবাদ বাক্য হয়ে রয়েছে, هل مَاتَ الْبُخَارِيُّ غَيْرَ مَحْسُوْدٍ ؟ ‘ইমাম বুখারী কি হিংসুকের হামলা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করতে পেরেছেন’? অন্য একজন পন্ডিত বলেন, الناسُ حاسدٌ ومحسودٌ، ولكلِّ نعمةٍ حَسودٌ ‘মানুষ হিংসুক ও হিংসাকৃত। আর প্রত্যেক নে‘মতের জন্যই হিংসুক রয়েছে’। এর পরেও প্রকৃত মুমিনগণ পাল্টা হিংসা করেন না। বিদ্বেষ করেন না। বরং প্রতিপক্ষের হেদায়াত কামনা করেন। কবি কুমায়েত আল-আসাদী বলেন,

إن يحسدونني فإني غيرُ لائمهم  +  قبلي من الناس أهلُ الفضل قد حُسِدُوا
فدام لي ولهم ما بي وما بهم     +     ومات أكثرُنا غيظاً بما يجدُ
أنا الذي يجدوني في صدورهم  +  لا أرتقي صدراً منها ولا أرِدُ

(১) তারা যদি আমাকে হিংসা করে, পাল্টা আমি তাদের নিন্দা করব না। কেননা আমার পূর্বে বহু কল্যাণময় ব্যক্তি হিংসার শিকার হয়েছেন। (২) অতএব আমার ও তাদের সঙ্গে (আল্লাহর রহমত) যা ছিল, তা থাকবে। অথচ আমাদের অধিকাংশ মানুষ মারা গেছে যা সে পেয়েছে তাতে ক্রুদ্ধ অবস্থায়। (৩) আমি সেই ব্যক্তি যে, তারা আমাকে সর্বদা তাদের বুকের মধ্যে পাবে। যেখান থেকে আমি না ফিরে গেছি, না অবতরণ করেছি’।[2]
(খ) আখেরাতের পরিণতি :
মৃত্যুর পর কবরে তাকে গ্রাস করে ভয়াবহ আযাব। অতঃপর কিয়ামতের দিন সে উঠবে ভীত-নমিত ও মলিন চেহারায় অধোমুখি হয়ে। আল্লাহ বলেন, وَوُجُوْهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ- تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ- أُوْلَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ‘অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধূলি-ধূসরিত’। ‘কালিমালিপ্ত’। তারা হ’ল অবিশ্বাসী পাপিষ্ঠ’ (‘আবাসা ৮০/৪০-৪২)। তাদেরকে দেখে যেমন দুনিয়াতে চেনা যেত। আখেরাতেও তেমনি চেনা যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيمَاهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِيْ وَالْأَقْدَامِ ‘অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে কপালের চুল ও পা ধরে’ (রহমান ৫৫/৪১)।



[1]. মুছত্বফা হাশেমী, জাওয়াহিরুল আদব ২/৪৮৭।
[2]. জাওয়াহিরুল আদব ২/২৭০।

হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার উপায় সমূহ

(১) আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা : হিংসা হ’ল শয়তানী আমল। শয়তান সর্বদা মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তাই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শয়তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা আবশ্যক। অতএব যখনই কারু প্রতি হিংসার উদ্রেক হয়, তখনই আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রজীম বলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করবে এবং বাম দিকে তিনবার থুক মারবে ।[1] আল্লাহ বলেন, وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘অতঃপর শয়তান যখনই তোমাকে কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৬)।
() হিংসার বুদ্বুদ হৃদয়ে উত্থিত হওয়ার সাথে সাথে তা মুছে ফেলা এবং অন্যদিকে মন দেওয়া। কেননা এটি মনের মধ্যে গোপনে আসে ও দ্বীনকে শেষ করে দেয়। যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِىَ الْحَالِقَةُ لاَ أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعْرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ- وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ ‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের রোগ তোমাদের মধ্যে গোপনে প্রবেশ করবে। আর তা হ’ল হিংসা ও বিদ্বেষ, যা সবকিছুর মুন্ডনকারী। আমি বলছি না, চুল মুন্ডনকারী। বরং তা হবে দ্বীনকে মুন্ডনকারী। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না ঈমান আনবে। আর তোমরা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের খবর দিব না, কোন বস্ত্ত তোমাদের মধ্যে ভালবাসাকে দৃঢ় করবে? তোমরা পরস্পরে বেশী বেশী সালাম কর’।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِيَّاكُمْ وَسُوءَ ذَاتِ الْبَيْنِ فَإِنَّهَا الْحَالِقَةُ- قَالَ أَبُو عِيسَى يَعْنِى الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ ‘তোমরা পারস্পরিক বিদ্বেষের মন্দ হ’তে বেঁচে থাক। কেননা এটি দ্বীনের মুন্ডনকারী’।[3]
(৩) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ বান্দাকে নে‘মত দেন তাকে পরীক্ষার জন্য। মুমিন এতে খুশী হয় ও শুকরিয়া আদায় করে। সে বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং এর উত্তম প্রতিদান কামনা করে। কিন্তু কাফির-মুনাফিক এতে ক্রুদ্ধ হয় এবং অন্যকে হিংসা করে। আল্লাহ বলেন, أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضاً سُخْرِيّاً وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ ‘তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করে? আমরাই পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা বণ্টন করি এবং তাদেরকে একে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি। যাতে তারা পরস্পরে কাজ নিতে পারে। আর তারা যা জমা করে, তার চাইতে তোমার প্রতিপালকের রহমত অনেক উত্তম’ (যুখরুফ ৪৩/৩২)।
(৪) আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা : যত কষ্টই হৌক বা যত কঠিনই হৌক, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে নিয়ে হিংসা থেকে নিবৃত্ত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর। আর যা থেকে নিষেধ করেন, তা বর্জন কর’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন, وَمَن يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)। কেননা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে তার রহমত লাভ করা পার্থিব সকল কিছুর চাইতে উত্তম। আল্লাহ বলেন, هُنَالِكَ الْوَلاَيَةُ لِلَّهِ الْحَقِّ هُوَ خَيْرٌ ثَوَاباً وَخَيْرٌ عُقْباً ‘সবকিছুর অভিভাবকত্ব আল্লাহর। যিনি সত্য। পুরস্কার দানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই শ্রেষ্ঠ’ (কাহফ ১৮/৪৪)।
(৫) হিংসার জ্বলন সম্পর্কে চিন্তা করা : হিংসুক ব্যক্তি হিংসার আগুনে নিজেই জ্বলে মরে এবং সে কেবল নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তার অন্তরে সুখ বলে কিছু থাকে না। সর্বদা অন্যের ধ্বংস চিন্তায় বিভোর থাকায় নিজেকেই সে ধ্বংস করে ফেলে। সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা তাকে দৈহিক ও মানসিক রোগীতে পরিণত করে। কোন ব্যাপারেই সে স্বাভাবিক ও সুন্দর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আশপাশের সবাইকে সে তার শত্রু ভাবতে থাকে। হিংসায় বুঁদ হওয়ার ফলে সে সর্বদা অস্বাভাবিক আচরণ করে। আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلاَّ بِأَهْلِهِ ‘কুট চক্রান্ত কেবল তার মালিককেই পরিবেষ্টন করে থাকে’ (ফাত্বির ৩৫/৪৩)। তিনি বলেন, قُلْ مُوْتُوْا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ ‘(হে নবী) তুমি বল, তোমরা নিজেদের আক্রোশে জ্বলে-পুড়ে মরো। আল্লাহ অন্তরের বিষয়ে সম্যক অবগত’ (আলে ইমরান ৩/১১৯)। এভাবে হিংসায় যে কোন ফায়েদা নেই সেটা চিন্তা করলে মানুষ এই নোংরা স্বভাব থেকে ফিরে আসবে।
(৬) লোকে তাকে ঘৃণা করে, এটা উপলব্ধি করা : হিংসা ভিতরের বস্ত্ত। যা দেখা যায় না। কিন্তু সেটি প্রকাশ পায় মানুষের কর্মে ও আচরণে। যেমন আল্লাহ বলেন, قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ ‘তাদের মুখ দিয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। আর যা তাদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তা আরও অনেক বেশী’ (আলে ইমরান ৩/১১৮)। অতএব হিংসুক ব্যক্তি যত দ্রুত তার প্রতি মানুষের ঘৃণা বুঝতে পারবে, সে তত দ্রুত ফিরে আসবে।
(৭) আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হিংসা বর্জন করা : যখন মানুষ জানবে যে, হিংসায় জাহান্নাম ও তা পরিত্যাগে জান্নাত, তখন সে চিরস্থায়ী জান্নাত পাওয়ার আশায় ক্ষণস্থায়ী তুচ্ছ বস্ত্ত পরিত্যাগ করবে। আল্লাহ বলেন,وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى- فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى ‘আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হ’তে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৪০-৪১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ ‘যা তোমার উপকারে আসবে, সেদিকে তুমি প্রলুব্ধ হও’।[4]
(৮) সকল কাজের বিনিময় আল্লাহর নিকটে কামনা করা : মুসলমানকে আল্লাহর পথে সংগ্রামে পরস্পরকে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় থাকতে বলা হয়েছে (ছফ ৬১/৪)। এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত মনে আমরা পরস্পরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারব এবং এর বিনিময় স্রেফ আল্লাহর নিকটে কামনা করব। যেমন প্রত্যেক নবী বলেছেন, وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না। আমার বিনিময় তো কেবল বিশ্বপালক আল্লাহর নিকটেই রয়েছে’ (শো‘আরা ২৬/১০৯, ১২৭. ১৪৫, ১৬৪, ১৮০)।
(৯) এছাড়া নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া আবশ্যক। যা আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিখিয়ে দিয়েছেন, رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيْمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلاَّ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوْفٌ رَحِيْمٌ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের সেইসব ভাইকে তুমি ক্ষমা কর, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর তুমি আমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ সঞ্চার করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল ও দয়াবান’ (হাশর ৫৯/১০)।



[1]. মুসলিম হা/২২০৩; মিশকাত হা/৭৭, ঈমান অধ্যায় ‘মনের খটকা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. তিরমিযী হা/২৫১০, মিশকাত হা/৫০৩৯, হাদীছ হাসান।
[3]. তিরমিযী হা/২৫০৮; মিশকাত হা/৫০৪১।
[4]. মুসলিম হা/২৬৬৪, মিশকাত হা/৫২৯৮।

হিংসুকের অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায় সমূহ

(১) হিংসায় ছবর করা ও পাল্টা হিংসা না করা : আল্লাহ বলেন,وَإِنْ تَصْبِرُوْا وَتَتَّقُوْا لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا‘যদি তোমরা ছবর কর ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন কর, তাহ’লে ওদের চক্রান্ত তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’ (আলে ইমরান ৩/১২০)। শিশু ইউসুফকে বাঘে খেয়েছে বলে তার মিথ্যা রক্ত মাখানো জামা দেখানোর পর পিতা ইয়াকূব (আঃ) ছেলেদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা (মিথ্যা) কাহিনী বানিয়ে দিয়েছে। অতএব এখন ছবর করাই উত্তম। আর তোমরা যেসব কাহিনী শুনাচ্ছ, সে বিষয়ে আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল’ (ইউসুফ ১২/১৮)। আল্লাহ ইয়াকূরেব দো‘আ কবুল করেছিলেন এবং কূয়ায় সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে উঠিয়ে আল্লাহ ইউসুফকে মিসরের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন।
(২) আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করা : আল্লাহ বলেন, وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْراً ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন। আল্লাহ তার আদেশ পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বস্ত্তর পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন’ (তালাক ৬৫/৩)। বস্ত্ততঃ এটাই হল সবচেয়ে বড় উপায়।
(৩) হিংসুক ব্যক্তির প্রতি সদাচরণ করা : আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ ‘ভাল ও মন্দ সমান নয়। তুমি ভাল দিয়ে মন্দকে প্রতিরোধ কর। তাহ’লে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। আবুদ্দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ؟ صَلاَحُ ذَاتِ الْبَيْنِ فَإِنَّ فَسَادَ ذَاتِ الْبَيْنِ هِىَ الْحَالِقَةُ ‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম-ছাদাক্বা ও ছালাতের চেয়েও উত্তম কোন বিষয়ের খবর দিব? আর তা হ’ল পারস্পরিক বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া। কেননা পরস্পরের বিবাদ দ্বীনকে মুন্ডনকারী’।[1]
(৪) গোনাহ থেকে তওবা করা : বিপদাপদ বান্দার নিজের কারণেই এসে থাকে (আলে ইমরান ৩/১৬৫)। সে নিজের অজান্তেই অনেক গোনাহ করে থাকে। অথবা জেনেশুনে কিংবা বাধ্য হয়ে করে। আর বান্দা যা জানে, তার চাইতে বহুগুণ বেশী গোনাহ তার রয়েছে, যা সে জানে না। অমনিভাবে যেসব গোনাহের কথা তার স্মরণে আছে, তার চাইতে বহুগুণ বেশী গোনাহ তার স্মরণে থাকে না। তাই সর্বদা বান্দাকে জানা-অজানা সকল পাপের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয় এবং খালেছ অন্তরে তওবা করতে হয়। তাতে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে হিংসুক ব্যক্তির অনিষ্ট হতে তাকে রক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ثُمَّ نُنَجِّي رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آمَنُواْ كَذَلِكَ حَقّاً عَلَيْنَا نُنجِ الْمُؤْمِنِينَ ‘অতঃপর আমরা নাজাত দিয়ে থাকি আমাদের রাসূলদের এবং একইভাবে মুমিনদের। কেননা আমাদের উপর হক হ’ল মুমিনদের নাজাত দেওয়া’ (ইউনুস ১০/১০৩)। তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا تُوْبُوْا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوْحاً عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لاَ يُخْزِي اللهُ النَّبِيَّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ نُوْرُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধভাবে তওবা কর। যাতে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপ সমূহ মোচন করে দেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করান, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। যেদিন আল্লাহ স্বীয় নবী ও তার সাথী মুমিনদের লজ্জিত করবেন না। তাদের নূর তাদের সম্মুখে ও ডাইনে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (তাহরীম ৬৬/৮)।
কিয়ামতের দিন পুলছেরাত পার হবার সময় স্ব স্ব নেক আমল অনুযায়ী মুমিনদের সম্মুখে জ্যোতি থাকবে এবং তাদের ডান হাতে আমলনামা থাকবে। যেখানে জান্নাতের সুসংবাদ থাকবে। এ সময় মুনাফিকদের সম্মুখে জ্যোতি নিভে যাবে। তখন মুমিনগণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, যেন পুলছেরাত পার হওয়া পর্যন্ত তাদের জ্যোতি অব্যাহত থাকে। আর এটা তারা ঐসময় বলবে, যখন মুনাফিকরা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলবে, ‘তোমরা একটু থামো। আমরা তোমাদের থেকে কিছু জ্যোতি নিয়ে নিই। বলা হবে, তোমরা পিছনে ফিরে গিয়ে জ্যোতি তালাশ কর’… (হাদীদ ৫৭/১৩)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের জন্য জ্যোতিকে অব্যাহত রাখবেন।[2] আর এসবই হবে তাদের খালেছ তওবার ফল হিসাবে। আনাস (রাঃ) বলেন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী এবং ভুলকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল তওবাকারীগণ’।[3]
(৫) সকল চিন্তাকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া : হিংসা কারু কোন ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। যেমন তিনি বলেন, وَإِن يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِن يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلاَ رَآدَّ لِفَضْلِهِ يُصَيبُ بِهِ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيْمُ ‘যদি আল্লাহ তোমার কোন অকল্যাণ করেন, তবে তা দূর করার কেউ নেই তিনি ব্যতীত। আর যদি তিনি তোমার প্রতি কল্যাণের ইচ্ছা করেন, তবে তার অনুগ্রহকে ফিরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে যা চান তাকে তা দান করে থাকেন। বস্ত্ততঃ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইউনুস ১০/১০৭)।
ওহোদ যুদ্ধে দান্দান মুবারক শহীদ হলে মুখের রক্ত মুছতে মুছতে রাসূল (ছাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন,يْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا وَجْهَ نَبِيِّهِمْ ‘ঐ জাতি কিভাবে সফলকাম হবে যারা তাদের নবীর চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে’? এছাড়াও তিনি সেদিন চারজন কাফের নেতার নাম ধরে তাদের বিরুদ্ধে লা‘নত করেছিলেন। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বলেন, لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ‘তিনি তাদের ক্ষমা করবেন না শাস্তি দিবেন, সে ব্যাপারে তোমার কিছুই করার নেই। কারণ ওরা সীমালংঘনকারী’ (আলে ইমরান ৩/১২৮)। পরে দেখা গেল ঐ চারজন নেতাকে আল্লাহ ইসলাম কবুলের তাওফীক দান করেন এবং মৃত্যু অবধি তাদের ইসলাম সুন্দর ছিল’।[4]
উপরোক্ত আয়াত নাযিলের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-কে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ যে যালেমদের শাস্তি দিবেনই, সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা কুনূতে নাযেলাহ পাঠ নিষেধ করা হয়নি। কেননা ওহোদের ঘটনার পরের বছর ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে সংঘটিত রাজী‘ ও বি’রে মা‘ঊনার মর্মন্তুদ ঘটনায় বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে যথাক্রমে ১০ জন ও ৭০ জন শ্রেষ্ঠ ছাহাবীর অসহায়ভাবে শাহাদাত বরণের পর তিনি হত্যাকারী সম্প্রদায়গুলির বিরুদ্ধে একমাস ব্যাপী প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।[5] আল্লাহ অবশ্যই হিংসুক যালেমকে শাস্তি দিবেন দুনিয়াতে ও আখেরাতে। দুনিয়াতে মযলূমের জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর পরে এ শাস্তি হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় হিংসুক আবু জাহলরা শাস্তি পেয়েছে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ভন্ডনবী মুসায়লামা কাযযাব আবুবকর (রাঃ)-এর সময় ইয়ামামার যুদ্ধে নিহত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ  ‘(আখেরাতে) কঠিন শাস্তি দেওয়ার আগে আমরা অবশ্যই (দুনিয়াতে) তাদেরকে লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব। যাতে তারা ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার কোন প্রিয় বান্দার (مَنْ عَادَى لِىْ وَلِيًّا) সাথে দুশমনী করল, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের (فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ) ঘোষণা দিলাম’।[6] অতএব মুমিনের প্রতি হিংসাকারীর শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। তিনি হেদায়াত করবেন, যেমন ওহোদ যুদ্ধের কাফের নেতাদের করেছিলেন। অথবা ইহকালে ও পরকালে চরম শাস্তি দিবেন, ‘যেরূপ শাস্তি কেউ দিতে পারে না’ (ফজর ৮৯/২৫-২৬)



[1]. তিরমিযী হা/২৫০৯; আবুদাঊদ হা/৪৯১৯; মিশকাত হা/৫০৩৮।
[2]. ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হাদীদ ১২-১৩ এবং তাহরীম ৮ আয়াত।
[3]. তিরমিযী হা/২৪৯৯, ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; মিশকাত হা/২৩৪১।
[4]. আহমাদ হা/১৪১০৪, তিরমিযী হা/৩০০২-০৫; ঐ চারজন ছিলেন আবু সুফিয়ান, হারেছ বিন হিশাম, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া (তিরমিযী হা/৩০০৪) এবং সুহায়েল বিন আমর (বুখারী হা/৪০৭০)।
[5]. বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১২৮৯-৯১ ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ।
[6]. বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬।

মুসলমানদের উন্নতির কারণ

ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানদের উন্নতি ও বিশ্ব বিজয়ের মূলে কারণ ছিল তাদের পারস্পরিক মহববত-ভালোবাসা ও বিদ্বেষমুক্ত হৃদয়ের সৃদৃঢ় বন্ধন। তারা অন্যের দুঃখ-বেদনাকে নিজের সাথে ভাগ করে নিতেন। তারা অন্যের জন্য সেটাই ভালবাসতেন, যেটা নিজের জন্য ভালবাসতেন। হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্ত্ত ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’।[1] এ বিষয়ে মক্কার মুহাজির মুসলমানদের জন্য মদীনার আনছারগণের অনন্য ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلاَ يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘যারা (মক্কা হ’তে মুহাজিরদের আগমনের) পূর্ব থেকেই মদীনায় বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল, তারা (আনছাররা) মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে যা (সম্পদ ও উচ্চ সম্মান) দেওয়া হয়েছে, তা পাওয়ার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনরূপ প্রয়োজন অনুভব করে না। আর তারা নিজেদের উপরে তাদের অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদের নিজেদেরই ছিল অন্নকষ্ট। বস্ত্ততঃ যারা হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু পথযাত্রী মুসলিম সৈনিক তৃষ্ণার্ত অন্য সৈনিকের স্বার্থে নিজে পানি পান না করেই প্রাণত্যাগ করে মৃত্যুর দুয়ারে মানবতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন। যেমন ইয়ারমূকের যুদ্ধে ঘটেছিল।[2] ইতিহাসে এর কোন তুলনা নেই।
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বসে আছি। এমন সময় তিনি বললেন, يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে’। অতঃপর আনছারদের একজন ব্যক্তি আগমন করল। যার দাড়ি দিয়ে ওযূর পানি টপকাচ্ছিল ও তার বাম হাতে জুতা জোড়া ছিল। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন রাসূল (ছাঃ) একই রূপ বললেন এবং পরক্ষণে একই ব্যক্তির আগমন ঘটলো। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মজলিস থেকে উঠলেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ তাঁর পিছু নিলেন। …আনাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন যে, আমি তার বাসায় একরাত বা তিন রাত কাটাই। কিন্তু তাকে রাতে ছালাতের জন্য উঠতে দেখিনি। কেবল ফজরের জন্য ওযূ করা ব্যতীত। তাছাড়া আমি তাকে সর্বদা ভাল কথা বলতে শুনেছি। এভাবে তিনদিন তিনরাত চলে গেলে আমি তার আমলকে হীন মনে করতে লাগলাম(كِدْتُ أَنْ أَحْتَقِرَ عَمَلَهُ)। আমি তখন ঐ ব্যক্তিকে বললাম, আপনার সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) এই কথা বলেছিলেন এবং আমিও আপনাকে গত তিনদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি। কিন্তু আপনাকে বড় কোন আমল করতে দেখলাম না (فَلَمْ أَرَكَ تَعْمَلُ كَبِيْرَ عَمَلٍ)। তা’হলে কোন বস্ত্ত আপনাকে ঐ স্থানে পৌঁছিয়েছে, যার সুসংবাদ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে শুনিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি যা করি তাতো আপনি দেখেছেন। অতঃপর যখন আমি চলে আসার জন্য পিঠ ফিরাই, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, مَا هُوَ إِلاَّ مَا رَأَيْتَ غَيْرَ أَنِّىْ لاَ أَجِدُ فِىْ نَفْسِىْ لِأَحَدٍ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ غِلاًّ وَلاَ أَحْسُدُ أَحَداً عَلَى خَيْرٍ أَعْطَاهُ اللهُ إِيَّاهُ ‘আপনি যা দেখেছেন, তাতো দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিমের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ রাখি না এবং আমি কারু প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কোন কল্যাণের উপর হিংসা পোষণ করি না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আমর বললেন, هَذِهِ الَّتِىْ بَلَغَتْ بِكَ وَهِىَ الَّتِىْ لاَ نُطِيْقُ ‘এটিই আপনাকে উক্ত স্তরে পৌঁছেছে। এটি এমন এক বস্ত্ত যা আমরা করতে সক্ষম নই।[3]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَجْتَمِعَانِ فِىْ قَلْبِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالْحَسَدُ‘কোন বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না’।[4] অর্থাৎ মুমিনের অন্তরে হয় ঈমান থাকবে, নয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মুমিন নয়। হিংসা মুমিনদের পরস্পরে ভাই হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এই বাধা দূর না করা পর্যন্ত মুমিন সমাজ আপোষে ভাই ভাই হ’তে পারবে না।
মুমিন সর্বদা অন্যের শুভ কামনা করে। যেমন সে সর্বদা নিজের শুভ কামনা করে। যেমন তামীম দারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الدِّينُ النَّصِيْحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’।[5] অর্থাৎ এখলাছ। যা পরস্পরের শুভ কামনা ও অকল্যাণ প্রতিরোধের মাধ্যমে অর্জিত হয়। হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করেছিলাম ছালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য শুভ কামনার উপর’।[6]
বস্ত্ততঃ প্রথম যুগের মুসলমানেরা ছিলেন পারস্পরিক ভালোবাসায় একটি দেহের ন্যায়। যারা পরস্পরকে সাহায্য করতেন। পরস্পরের দোষ গোপন করতেন। পরস্পরের ব্যথায় সমব্যথী হ’তেন। নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তুমি মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা ও স্নেহকে দেখবে একটি দেহের ন্যায়। যার এক অঙ্গ ব্যথাতুর হলে সর্বাঙ্গ ব্যথাতুর হয় অনিদ্রা ও জ্বরের মাধ্যমে’।[7] নিঃসন্দেহে তারা ছিলেন আল্লাহর পথে সংগ্রামে পারস্পরে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন (ছফ ৬১/৪)। এযুগেও মুসলিম উম্মাহর উন্নতি ও অগ্রগতির সেটাই হ’ল আবশ্যিক পূর্বশর্ত।



[1]. বুখারী হা/১৩, মুসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/৪৯৬১।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/১১।
[3]. হাকেম পৃঃ ৩/৭৯ হা/৪৩৮০, হাকেম ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। আহমাদ হা/১২৭২০, আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন; আলবানী প্রথমে ছহীহ পরে যঈফ বলেছেন (তারাজু‘আতুল আলবানী হা/৪৮)।
[4]. নাসাঈ হা/৩১০৯, সনদ হাসান।
[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৬৬।
[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৯৬৭।
[7]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৩।

হিংসুকদের চটকদার যুক্তিসমূহের কিছু নমুনা

হিংসুক ব্যক্তি তার চাকচিক্যপূর্ণ কথা ও আকর্ষণীয় যুক্তির মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা বলে ও মিথ্যাকে সত্য বলে। এ বিষয়ে (১) ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর শিষ্য খ্যাতনামা তাবেঈ ইকরিমা (মৃঃ ১০৭ হিঃ) বিগত যুগে বনু ইস্রাঈলদের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, তাদের মধ্যে তিনজন বিখ্যাত কাযী বা বিচারপতি ছিলেন। পরে তাদের একজন মারা গেলে অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি বিচারকার্য চালাতে থাকলেন। এমন সময় একদিন আল্লাহ জনৈক ফেরেশতাকে পাঠালেন। যিনি ঘোড়ায় চড়ে একজন ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যে ব্যক্তি বাছুরসহ তার গাভীকে পানি পান করাচ্ছিল। ফেরেশতা বাছুরটিকে তার দিকে ডাক দিলেন। তাতে বাছুরটি ঘোড়ার পিছে পিছে চলল। তখন ঐ লোকটি ছুটে এসে তার বাছুরটিকে ফিরিয়ে নিতে চাইল এবং বলল, হে আল্লাহর বান্দা! এটি আমার বাছুর এবং আমার এই গাভীর বাচ্চা। ফেরেশতা বললেন, বরং ওটা আমার বাছুর এবং আমার এই ঘোড়ার বাচ্চা। কেউ দাবী না ছাড়লে অবশেষে তারা কাযীর কাছে গেলেন। বাছুরের মালিক বলল, এই লোকটি আমার বাছুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে ডাকল, আর বাছুরটি তার পিছে পিছে চলে গেল। অথচ বাছুরটি আমার। কিন্তু এখন সে আমাকে ফেরৎ দিচ্ছে না। উত্তরে বিবাদী ফেরেশতা বললেন এমতাবস্থায় যে, তার হাতে তিনটি বেত ছিল। যার অনুরূপ কোন বেত সচরাচর দেখা যায় না। তার মধ্যে একটি বেত তিনি বিচারকের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এটা দিয়ে আমাদের মাঝে ফায়ছালা করুন। বিচারক বললেন, কিভাবে? বিবাদী বললেন, আমরা বাছুরটাকে ঘোড়া ও গাভীর পিছনে ছেড়ে দিব। অতঃপর বাছুরটি যার পিছে পিছে যাবে, সেটি তার হবে। বিচারক সেটাই করলেন। দেখা গেল যে, বাছুরটি ঘোড়ার পিছু নিল। তখন বিচারক বাছুরটি ঘোড়ার বলে রায় দিলেন।
বাছুরের মালিক এ রায় মানল না। সে বলল, আমি আরেকজন বিচারকের কাছে যাব। সেখানে গিয়ে উভয়ে পূর্বের মত বাছুরটিকে নিজের বলে দাবী করল এবং আগের মত যুক্তি প্রদর্শন করল। সেখানেও একই রায় হ’ল। তখন বাদী তাতে রাযী না হয়ে তৃতীয় বিচারকের কাছে গেল। বিবাদী তাকে এবার তৃতীয় বেতটি দিলেন। কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, আমি আজকে তোমাদের বিচার করব না। তারা বলল, কেন করবেন না? তিনি বললেন, কেননা আমি আজ ঋতুবতী। বিবাদী ফেরেশতা একথা শুনে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! পুরুষ লোক কখনো ঋতুবতী হয়? তখন বিচারক বললেন, ঘোড়া কখনো গরুর বাছুর জন্ম দেয়? অতঃপর তিনি বাছুরটিকে গাভীর মালিককে দিয়ে দিলেন। এবার ফেরেশতা বললেন, আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করেছেন। তিনি তোমার উপর খুশী হয়েছেন এবং ঐ দুই বিচারকের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন’।[1]
(২) মক্কার নেতাদেরকে শয়তান যুক্তি শিখিয়ে দিল। সেমতে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে গিয়ে প্রশ্ন করল, মৃত বকরীকে কে হত্যা করে? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ। তখন শয়তান বলল, দেখ তোমরা যেটা যবহ কর, সেটা হালাল। আর আল্লাহ যেটা যবহ করেন, সেটা হারাম। তাহ’লে তোমরাই আল্লাহর চেয়ে উত্তম। তখন আয়াত নাযিল হ’ল, وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ ‘যে সব পশু (যবহের সময়) তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না, সেগুলি থেকে তোমরা খেয়োনা। নিশ্চয়ই এটি পাপ। আর শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কুমন্ত্রণা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করে। (মনে রেখ) যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১; তাফসীর ইবনু কাছীর)।



[1]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২৫৬।

হিংসুকদের কিছু দৃষ্টান্ত

(১) ইবলীসের হিংসা : আদম (আঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা দেখে ইবলীস হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। সে নিজেকে আদমের চাইতে শ্রেষ্ঠ দাবী করে তাঁকে সম্মানের সিজদা করেনি। সে যুক্তি দিয়ে বলেছিল, خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ ‘আল্লাহ তুমি আমাকে আগুন দিয়ে তৈরী করেছ এবং আদমকে তৈরী করেছ মাটি দিয়ে’ (আ‘রাফ ৭/১১-১২)। অতএব আগুন কখনো মাটিকে সিজদা করতে পারে না। তার এই যুক্তিবাদের ফলে সে অভিশপ্ত হয় এবং জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়। এভাবে আসমানে প্রথম হিংসা করে ইবলীস এবং সেই-ই প্রথম আদম ও হাওয়াকে বিভ্রান্ত করে। ফলে তারাও জান্নাত থেকে আল্লাহর হুকুমে নেমে যান। আদমের ও তার সন্তানদের প্রতি ইবলীসের উক্ত হিংসা আজও অব্যাহত রয়েছে। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (আরাফ ৭/১৩-১৫; হিজর ১৫/৩৩-৩৮)।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, الحاسد شبيه بإبليس، وهو في الحقيقة من أتباعه؛ لأنه يطلب ما يحبه الشيطان من فساد الناس وزوال نعم الله عنهم، كما أن إبليس حسد آدم لشرفه وفضله، وأبى أن يسجد له حسدا، فالحاسد من جند إبليس ‘হিংসুক ব্যক্তি ইবলীসের ন্যায়। সে শয়তানের অনুসারী। কেননা সে শয়তানের চাহিদা মতে সমাজে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় এবং অন্যের উপর আল্লাহর নে‘মতসমূহের ধ্বংস কামনা করে। যেমন ইবলীস আদমের উচ্চ মর্যাদা ও তার শ্রেষ্ঠত্বকে হিংসা করেছিল এবং তাকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি ইবলীসের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত।[1]
(২) হাবীলের প্রতি কাবীলের হিংসা :
আদম-পুত্র কাবীল তার ছোট ভাই হাবীলকে হত্যা করেছিল হিংসা বশে। কারণ আল্লাহভীরু হাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেছিলেন। কিন্তু দুনিয়াদার কাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেননি। অথচ এতে হাবীলের কিছুই করার ছিলনা। এতদসত্ত্বেও কাবীল তাকে হত্যা করে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) তুমি লোকদের নিকট আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সত্য সহকারে বর্ণনা কর। যখন তারা কুরবানী পেশ করে। অতঃপর একজনের কুরবানী কবুল হয়, কিন্তু অপর জনের কুরবানী কবুল হয়নি। তখন সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। জবাবে সে বলল, আল্লাহ তো কেবল মুত্তাক্বীদের কুরবানী কবুল করে থাকেন’। ‘যদি তুমি আমার দিকে হাত বাড়াও আমাকে হত্যা করার জন্য, আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দিকে হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৭-২৮)।
বলা বাহুল্য, এটাই ছিল মানবেতিহাসের প্রথম হত্যাকান্ডের ঘটনা। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত হত্যাকান্ড হবে, তার পাপের একটা অংশ ক্বাবীলের আমলনামায় লেখা হবে। কেননা সেই-ই প্রথম এর সূচনা করেছিল।[2] এভাবে আসমানে প্রথম হিংসা করেছিল ইবলীস এবং যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল ক্বাবীল। তাই ভাল-র প্রতি হিংসা চিরন্তন।
(৩) ইউসুফের প্রতি তার ভাইদের হিংসা :
নবী ইউসুফের ১০ জন বিমাতা ভাই ছিল। যারা ছিল তার আপন খালার সন্তান। ইউসুফ ও বেনিয়ামীনের মা মারা যাওয়ায় মাতৃহারা দুই শিশুপুত্রের প্রতি পিতা নবী ইয়াকূবের পিতৃস্নেহ স্বভাবতই বেশী ছিল। তন্মধ্যে ইউসুফের প্রতিই তাঁর আসক্তি ছিল বেশী তার অলৌকিক গুণাবলীর কারণে। তদুপরি শিশুকালে ইউসুফের দেখা স্বপ্নবৃত্তান্ত শোনার পর পিতা তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং অজানা আশংকায় তাকে সর্বক্ষণ চোখের উপর রাখতেন। ফলে বিমাতা ভাইয়েরা তার প্রতি হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং শিশু ইউসুফকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত বিষয়ে সূরা ইউসুফ নাযিল হয়। যাতে পূরা ঘটনা সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে (দ্রঃ নবীদের কাহিনী ১ম খন্ড)।
(৪) ইহূদী-নাছারাদের হিংসা :
এরাই ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি সবচেয়ে বেশী হিংসাকারী। তাদের বংশ বনু ইসহাক থেকে শেষনবী না হয়ে বনু ইসমাঈলের কুরায়েশ বংশ থেকে হওয়ায় তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি হিংসায় অন্ধ ছিল। অথচ তাদের কিতাব তাওরাত-ইনজীলে শেষনবী হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ও তাঁর পূর্ণ পরিচয় আগেই বর্ণিত হয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। কিন্তু তারা তাঁর উচ্চ মর্যাদাকে বরদাশত করতে পারেনি। ফলে তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসারী মুমিনদের চাইতে মক্কার কাফিরদের অধিকতর হেদায়াতপ্রাপ্ত বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। যেমন আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوْتُوْا نَصِيْبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَيَقُوْلُوْنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَؤُلاَءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَبِيلاً– أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيْرًا- ‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে, যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’। ‘এদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাৎ করেন, তার জন্য তুমি কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (নিসা ৪/৫১-৫২)।
মুমিনদের প্রতি হিংসা ছাড়াও তারা তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করে ইহূদী-নাছারাদের দলভুক্ত হওয়ার আকাংখা পোষণ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَدَّ كَثِيرٌ مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُم مِّن بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّاراً حَسَداً مِّنْ عِندِ أَنفُسِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ فَاعْفُواْ وَاصْفَحُواْ حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরেও অন্তর্নিহিত বিদ্বেষ বশতঃ আহলে কিতাবদের অনেকে তোমাদেরকে ঈমান আনার পরেও কাফির বানাতে চায়। এমতাবস্থায় তোমরা ওদের ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চল আল্লাহর আদেশ না আসা পর্যন্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর উপরে ক্ষমতাবান’ (বাক্বারাহ ২/১০৯)।
ইবনু কাছীর বলেন, অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আহলে কিতাবদের রীতি-নীতি অনুসরণ করা হ’তে বিরত থাকার ব্যাপারে মুমিনদের সাবধান করেছেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে তারা যে সর্বদা মুসলমানদের শত্রুতা করবে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন। মুসলমানদের ও তাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা জানা সত্ত্বেও তারা এটা করে থাকে স্রেফ হিংসার বশবর্তী হয়ে’ (ঐ, তাফসীর)। আল্লাহ বলেন,وَلَن تَرْضَى عَنكَ الْيَهُودُ وَلاَ النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم بَعْدَ الَّذِي جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللهِ مِن وَلِيٍّ وَلاَ نَصِيْرٍ ‘ইহূদী ও নাছারাগণ কখনোই তোমার উপরে খুশী হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসারী হবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। এখানে শেষনবী (ছাঃ)-কে বলা হ’লেও তা মূলতঃ উম্মতে মুহাম্মাদীকে বলা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রতি ইহূদী-খ্রিষ্টান অপশক্তির অতীত ও বর্তমান আচরণ অত্র আয়াতের বাস্তব প্রমাণ বহন করে।
(৫) কুরায়েশ কাফিরদের হিংসা :
আল্লাহ স্বীয় নবী মুহাম্মাদকে নবুঅত ও রিসালাত দ্বারা সম্মানিত করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজ বংশ কুরায়েশ নেতারা হিংসায় জ্বলে ওঠে তাঁর এই উচ্চ মর্যাদার কারণে। তাদের ধারণা মতে নবুঅতের সম্মান তাদের মত নেতাদের পাওয়া উচিৎ ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَقَالُوا لَوْلاَ نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ- أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ؟ ‘আর তারা বলে যে, এই কুরআন কেন নাযিল হলো না দুই জনপদের কোন বড় নেতার উপরে? (অর্থাৎ মক্কার নেতা আবু জাহল অথবা ত্বায়েফের নেতা ওরাওয়া ইবনু মাসঊদের উপর)’? ‘তবে কি তোমার প্রতিপালকের রহমত তারাই বণ্টন করবে?’ (যুখরুফ ৪৩/৩১-৩২)।
কুরায়েশ নেতারা কিরূপ শ্রেষ্ঠত্বের কাঙাল ছিল যে, নিজেদের বংশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীকে পেয়েও তারা সর্বদা তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করেছে। তারা তাঁর বিরুদ্ধে নানা  অপবাদ দিয়েছে ও যুদ্ধ করেছে কেবল উক্ত মর্যাদা নিজেরা না পাওয়ার হিংসা থেকেই।
(৬) মুনাফিকদের হিংসা :
মুনাফিকরা ইসলাম যাহির করে ও কুফরীকে অন্তরে লালন করে। তাদের হৃদয় সর্বদা খাঁটি মুমিনদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ও কপটতায় পূর্ণ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لاَ يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيْطٌ ‘তোমাদের কোন কল্যাণ স্পর্শ করলে তারা নাখোশ হয়। আর তোমাদের কোন অমঙ্গল হলে তারা খুশী হয়। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও আল্লাহভীরু হও, তাহলে ওদের চক্রান্ত তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে, সবই আল্লাহর আয়ত্তাধীনে রয়েছে’। (আলে ইমরান ৩/১২০)।
মক্কায় মূলতঃ কাফির ও মুসলমানদের সংঘর্ষ ছিল। কিন্তু মদীনায় গিয়ে যোগ হয় ইহূদী ও মুনাফিকদের কপটতা। যা ছিল কাফিরদের ষড়যন্ত্রের চাইতে মারাত্মক। ৩য় হিজরীতে ওহোদের যুদ্ধে গমনকারী এক হাযার মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে সাড়ে তিনশ’ মুনাফিকের পশ্চাদগমন ছিল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আল্লাহভীরু নেতাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে অমূল্য উপদেশ ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। অথচ সর্বদা মুনাফিকরা ভাবে যে, তারাই লাভবান। যদিও প্রকৃত অর্থে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ভাবে তাদের চতুরতা কেউ ধরতে পারবে না। অথচ তারাই সবচেয়ে বোকা। কেননা দেরীতে হলেও তাদের কপটতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَنْ لَنْ يُخْرِجَ اللهُ أَضْغَانَهُمْ- وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيْمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ- وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِيْنَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ-  
‘যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তাদের হৃদয়ের গোপন বিদ্বেষ কখনোই প্রকাশ করে দেবেন না’? ‘আমরা চাইলে তোমাকে তাদের দেখাতাম। তখন তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারতে এবং তাদের কথার ভঙ্গিতে তুমি তাদের অবশ্যই বুঝে নিতে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তোমাদের কর্মসমূহ সম্যক অবগত’। ‘আর আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা নেব। যতক্ষণ না আমরা (প্রমাণসহ) জানতে পারব তোমাদের মধ্যে কারা সত্যিকারের মুজাহিদ এবং কারা সত্যিকারের ধৈর্যশীল। বস্ত্ততঃ আমরা তোমাদের অবস্থা সমূহ যাচাই করে থাকি’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৯-৩১)।
পরপর তিনটি আয়াতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মুনাফিকদের গোপন বিদ্বেষ সাময়িকভাবে চাপা থাকলেও তা অবশেষে প্রকাশিত হয়। আর এর মাধ্যমেই আল্লাহ তার পথের প্রকৃত মুজাহিদ ও দৃঢ়চিত্ত বান্দাদের পরীক্ষা নেন। এভাবে তিনি সর্বাবস্থায় মুমিন ও মুনাফিকের কার্যক্রম যাচাই করে থাকেন।
বস্ত্ততঃ মুনাফিকদের কপটতা মুমিনদের সরলতা ও স্বচ্ছতার প্রতি হিংসা থেকে উদ্ভূত হয়। আর মুমিনদের প্রতি মুনাফিকদের এই হিংসা চিরন্তন।
(৭) নেতৃত্বের প্রতি হিংসা :
নেতৃত্বের প্রতি হিংসা করা ও তার বিরুদ্ধে অন্যকে উসকে দেওয়া শয়তানের অন্যতম প্রধান কাজ। কারণ এর ফলেই সমাজে বিভক্তি ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। আর সেটাই হ’ল শয়তানের প্রধান কাম্য। ইসলামী নেতৃত্ব নির্বাচনে এর কোন সুযোগ নেই। কারণ এখানে যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল ব্যক্তিদের মাধ্যমে দল ও প্রার্থীবিহীনভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হয়। এখানে নেতৃত্বের জন্য আকাংখী হওয়া যায় না, লোভ করা যায় না বা প্রার্থী হওয়া যায় না।[3] নেতা পরামর্শ নিবেন। কিন্তু পরামর্শ মানতে তিনি বাধ্য নন (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। তিনি শরী‘আত বিরোধী কোন নির্দেশ দিতে পারেন না।[4] নেতার কোন কাজ অপসন্দনীয় হ’লে ছবর করবে। কেননা যদি কেউ জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ বের হয়, অতঃপর মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে সে জাহেলী মৃত্যু বরণ করবে’।[5] ফলে ইসলামী সমাজে অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের কোন সুযোগ নেই। এর অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল আমীরের ইসলামী নির্দেশ পালনের মধ্যে নেকী পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللهَ ، وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى ، وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِى ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল…।[6] এরপরেও শয়তান সেখানে কাজ করে এবং নানা অজুহাত বের করে সংগঠনে ও সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে।
(৮) ভাল-র প্রতি হিংসা :
মানুষ অনেক সময় ভাল-র প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। যেমন নবী-রাসূলগণের প্রতি, ইসলামের প্রতি, কুরআন ও হাদীছের প্রতি, সমাজের সত্যসেবী দ্বীনদারগণের প্রতি এবং বিশেষ করে সমাজ সংস্কারক মুত্তাক্বী আলেমগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা পাপাচারী মানুষের স্বভাবগত বিষয়।  যেমন (ক)সৃষ্টির সূচনায় প্রথম পাপ ছিল আদম (আঃ)-এর প্রতি ইবলীসের হিংসার পাপ। আদমের উচ্চ সম্মান দেখে সে হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। তাকে আদমের প্রতি সম্মানের সিজদা করতে বলা হলে সে করেনি। ফলে সে জান্নাত থেকে চিরকালের মত বিতাড়িত হয় (বাক্বারাহ ২/৩৪-৩৮)। অনুরূপভাবে (খ) আদম-পুত্র কাবীল তার ভাই হাবীলকে হত্যা করে হিংসা বশে। কারণ পশুপালক হাবীল ছিল মুত্তাকী পরহেযগার ও শুদ্ধ হৃদয়ের মানুষ। সে আল্লাহকে ভালবেসে তার সর্বোত্তম দুম্বাটি আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানীর জন্য পেশ করে। অথচ তার কৃষিজীবী ভাই ক্বাবীল তার ক্ষেতের ফসলের নিকৃষ্ট একটা অংশ কুরবানীর জন্য পেশ করে। ফলে আল্লাহ তারটা কবুল না করে হাবীলের উৎকৃষ্ট কুরবানী কবুল করেন এবং আসমান থেকে আগুন এসে তা উঠিয়ে নিয়ে যায়। এতে ক্বাবীল হিংসায় জ্বলে ওঠে ও হাবীলকে হত্যা করে (মায়েদাহ ৫/২৭-৩০)। পরবর্তীকালে (গ) ইহূদী-নাছারাগণ শেষনবীকে চিনতে পেরেও এবং তাঁকে শ্রেষ্ঠ জেনেও মানেনি স্রেফ হিংসা বশে (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।
(ঘ) আবু জাহল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য বলে স্বীকার করেও মেনে নেয়নি তার বনু মখযূম গোত্রে জন্ম না হয়ে বনু হাশেম গোত্রে জন্ম হওয়ার কারণে এবং নিজেদের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে।[7]
(ঙ) যুগে যুগে অসংখ্য সত্যসেবী আলেম ও নেতা নির্যাতিত হয়েছেন স্রেফ কুচক্রীদের হিংসার কারণে। তারা নিজেদের হিংসা গোপন করার জন্য ভাল-র বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা রটনা করে। তাকে নানাভাবে কষ্ট দেয়, এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করে ও হত্যার চেষ্টা করে। যেমন শেষনবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধীরা করেছিল। অথচ তিনি এজন্য আদৌ দায়ী ছিলেন না। যদিও প্রবাদ আছে যে, ‘এক হাতে তালি বাজে না’। ‘যা রটে, তার কিছু না কিছু ঘটে’। ‘দশ যেখানে আল্লাহ সেখানে’। অথচ নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের নিখাদ অনুসারী সৎকর্মশীল নেতা ও  নেককার মুমিন নর-নারীদের বিরুদ্ধে যাবতীয় ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত একপক্ষীয় হয়ে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব রটানো হয়, সবই মিথ্যা। সকল যুগে এর অসংখ্য নযীর রয়েছে। বর্তমান যুগেও এমন নযীরের কোন অভাব নেই।



[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম, বাদায়ে‘উল ফাওয়ায়েদ ২/২৩৪।
[2]. বুখারী হা/৩৩৩৫, মুসলিম হা/১৬৭৭; মিশকাত হা/২১১ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
[3]. বুখারী হা/২২৬১, মুসলিম হা/১৭৩৩; মিশকাত হা/৩৬৮৩ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[4]. মুসলিম হা/১৮৩৮, মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[5]. বুখারী হা/৭১৪৩, মুসলিম হা/১৮৪৯; মিশকাত হা/৩৬৬৮ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[6]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১ ’নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[7]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।
(হিংসা ও অহংকার: বই থেকে নেয়া)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top