আশুরায়ে মুহাররমের ফযীলত

ইসলামের নামে প্রচলিত অনৈসলামী পর্ব সমূহের মধ্যে একটি হ’ল ১০ই মুহাররম তারিখে প্রচলিত আশূরা পর্ব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এ পর্বের কোন অস্তিত্ব ছিল না। আল্লাহর নিকটে বছরের চারটি মাস হ’ল ‘হারাম’ বা মহা সম্মানিত (তওবা ৯/৩৬)। যুল-ক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম একটানা তিন মাস এবং তার পাঁচ মাস পর ‘রজব’, যা শা‘বানের পূর্ববর্তী মাস’।(বুখারী হা/৫৫৫০; মুসলিম হা/১৬৭৯; মিশকাত হা/২৬৫৯।)  জাহেলী যুগের আরবরা এই চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না।(বুখারী হা/৫৩; মুসলিম হা/১৭; মিশকাত হা/১৭।) দুর্ভাগ্য যে, মুসলমান হয়েও আমরা অতটুকু করতে পারি না।

আশূরার গুরুত্ব ও কারণ : হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের ১০ম তারিখকে ‘আশূরা’ (يَوْمُ عَاشُورَاءَ) বলা হয়। এদিন আল্লাহর হুকুমে মিসরের অত্যাচারী সম্রাট ফেরাঊন সসৈন্যে নদীতে ডুবে মরেছিল এবং মূসা (আঃ) ও তাঁর সাথী বনু ইস্রাঈলগণ ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে মূসা (আঃ) এদিন ছিয়াম রাখেন’।[3] সেকারণ এদিন নাজাতে মূসার শুকরিয়ার নিয়তে ছিয়াম রাখা মুস্তাহাব। যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম নিয়মিতভাবে পালন করতেন।

ইসলাম আসার পূর্ব থেকেই ইহূদী, নাছারা ও মক্কার কুরায়েশরা এদিন ছিয়াম রাখায় অভ্যস্ত ছিল। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিজে ও তাঁর হুকুম মতে সকল মুসলমান এদিন ছিয়াম রাখতেন (ঐ, শরহ নববী)। অতঃপর ২য় হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হ’লে তিনি বলেন, ‘এখন তোমরা আশূরার ছিয়াম রাখতেও পার, ছাড়তেও পার। তবে আমি ছিয়াম রেখেছি’।[4] ইহূদীদের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের চাইতে আমরাই মূসার (আদর্শের) অধিক হকদার ও অধিক নিকটবর্তী’।[5] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, লোকেরা বলল, ইহূদী-নাছারাগণ আশূরার দিনকে খুবই সম্মান দেয়। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ ছিয়াম রাখব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আগামীতে বেঁচে থাকলে আমি অবশ্যই ৯ই মুহাররম সহ ছিয়াম রাখব’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম মাস আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়’।[6] ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, ‘তোমরা আশূরার দিন ছিয়াম রাখ এবং ইহূদীদের খেলাফ কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বের দিন অথবা পরের দিন ছিয়াম রাখ’।[7] আলবানী বলেন, হাদীছটি মওকূফ ছহীহ (ঐ)। তবে ৯ ও ১০ দু’দিন রাখাই উত্তম। কেননা রাসূল (ছাঃ) ৯ তারিখ ছিয়াম রাখতে চেয়েছিলেন।

১. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ- ‘রামাযানের পরে সর্বোত্তম ছিয়াম হ’ল মুহাররম মাসের ছিয়াম অর্থাৎ আশূরার ছিয়াম এবং ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাতের নফল ছালাত’ অর্থাৎ তাহাজ্জুদের ছালাত।[মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৯ ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৯৪১।]

২. আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وصِيَامُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ، ‘আশূরা বা ১০ই মুহাররমের ছিয়াম আমি আশা করি আল্লাহর নিকটে বান্দার বিগত এক বছরের (ছগীরা) গোনাহের কাফফারা হিসাবে গণ্য হবে’।[মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৯৪৬।]

৩. আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘জাহেলী যুগে কুরায়েশগণ আশূরার ছিয়াম পালন করত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা পালন করতেন। মদীনায় হিজরতের পরেও তিনি পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করতে বলেছেন। কিন্তু (২য় হিজরী সনে) যখন রামাযান মাসের ছিয়াম ফরয হ’ল, তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা কর আশূরার ছিয়াম পালন কর এবং যে ব্যক্তি ইচ্ছা কর তা পরিত্যাগ কর’।[বুখারী ফাৎহুল বারী সহ (কায়রোঃ ১৪০৭/১৯৮৭), হা/২০০২ ‘ছাওম’ অধ্যায়।]

৪. মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাঃ) মদীনার মসজিদে নববীতে খুৎবা দানকালে বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,إِنَّ هَذَا يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ ولَمْ يَكْتُبِ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ وأَنَا صَائِمٌ فَمَنْ شَاءَ فَلْيَصُمْ ومَنْ شَآءَ فَلْيُفْطِرْ- ‘আজ আশূরার দিন। এদিনের ছিয়াম তোমাদের উপরে আল্লাহ ফরয করেননি। তবে আমি ছিয়াম রেখেছি। এক্ষণে তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছা কর ছিয়াম পালন কর, যে ইচ্ছা কর পরিত্যাগ কর’।[বুখারী, ফাৎহসহ হা/২০০৩; মুসলিম, হা/১১২৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।]

৫. (ক) আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশূরার ছিয়াম রাখতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, ‘এটি একটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ পাক মূসা (আঃ) ও তাঁর কওমকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরা‘আঊন ও তার লোকদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আঃ) এ দিন ছিয়াম পালন করেছেন। অতএব আমরাও এ দিন ছিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের চাইতে আমরাই মূসা (আঃ)-এর (আদর্শের) অধিক হকদার ও অধিক দাবীদার। অতঃপর তিনি ছিয়াম রাখেন ও সকলকে রাখতে বলেন’ (যা পূর্ব থেকেই তাঁর রাখার অভ্যাস ছিল)। [মুসলিম হা/১১৩০।]

(খ) আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, আশূরার দিনকে ইহুদীরা ঈদের দিন হিসাবে মান্য করত। এ দিন তারা তাদের স্ত্রীদের অলংকার ও উত্তম পোষাকাদি পরিধান করাতো’।[মুসলিম হা/১১৩১; বুখারী ফাৎহ সহ হা/২০০৪।]

(গ) ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ইহুদী ও নাছারাগণ ১০ই মুহাররম আশূরার দিনটিকে সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ ছিয়াম রাখব’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়।[মুসলিম হা/১১৩৪।]

৬. আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,صُوْمُوْا يَوْمَ عَاشُوْرَآءَ وَخَالِفُوا الْيَهُوْدَ وَصُوْمُوْا قَبْلَهُ يَوْمًا أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا- ‘তোমরা আশূরার দিন ছিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের খেলাফ কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন ছিয়াম পালন কর’।[বায়হাক্বী ৪র্থ খন্ড ২৮৭ পৃঃ। বর্ণিত অত্র রেওয়ায়াতটি ‘মারফূ’ হিসাবে ছহীহ নয়, তবে ‘মাওকূফ’ হিসাবে ‘ছহীহ’। দ্রঃ হাশিয়া ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২০৯৫, ২/২৯০ পৃঃ। অতএব ৯, ১০ বা ১০, ১১ দু’দিন ছিয়াম রাখা উচিত। তবে ৯, ১০ দু’দিন রাখাই সর্বোত্তম।]

উপরোক্ত হাদীছ সমূহ পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন-

(১) আশূরার ছিয়াম ফের‘আঊনের কবল থেকে নাজাতে মূসার (আঃ) শুকরিয়া হিসাবে পালিত হয়।

(২) এই ছিয়াম মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদী শরী‘আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশূরার ছিয়াম পালিত হ’ত।

(৩) ২য় হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ছিয়াম সকল মুসলমানের জন্য পালিত নিয়মিত ছিয়াম হিসাবে গণ্য হ’ত।

(৪) রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পরে এই ছিয়াম ঐচ্ছিক ছিয়ামে পরিণত হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত এই ছিয়াম ঐচ্ছিক হিসাবেই পালন করতেন। এমনকি মৃত্যুর বছরেও পালন করতে চেয়েছিলেন।

(৫) এই ছিয়ামের ফযীলত হিসাবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। এত বেশী নেকী আরাফার দিনের নফল ছিয়াম ব্যতীত অন্য কোন নফল ছিয়ামে নেই।

(৬) আশূরার ছিয়ামের সাথে হুসায়েন বিন আলী (রাঃ)-এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসায়েন (রাঃ)-এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কূফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে হয়।[ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ আল-ইস্তী‘আব সহ (কায়রোঃ মাকতাবা ইবনে তায়মিয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৩৮৯/১৯৬৯), ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৮, ২৫৩।]

মোটকথা আশূরায়ে মুহাররমে এক বা দু’দিন স্রেফ নফল ছিয়াম ব্যতীত আর কিছুই করার নেই। শাহাদতে হুসায়েনের নিয়তে ছিয়াম পালন করলে ছওয়াব পাওয়া যাবে না। কারণ কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহি-র আগমন বন্ধ হয়ে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top