আল্লাহ মানুষকে তার ইখলাছের উপর সম্মানিত অথবা লাঞ্চিত করেন। ইখলাছ সঠিক করুন সম্মানিত হবেন, ইনশাআল্লাহ। যারা নিজেদের ঈমান-বিশবাস, ইবাদত-বন্দেগীকে আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ করে নিবে, সবকিছু যখন শুধু আল্লাহর জন্যই নিবেদন করবে, তখন তাদের বিভ্রান্ত করতে শয়তান কোন পথ খুঁজে পাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِيْ لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ، إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ- ‘শয়তান বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন সেজন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভন করে দিব এবং আমি তাদের সকলকে বিপথগামী করব, তবে তাদের ব্যতীত, যারা আপনার মুখলেছ (ইখলাছ অবলম্বনকারী/একনিষ্ঠ) বান্দা’ (হিজর ১৫/৩৯-৪০)।
ইখলাছ কী?
ইখলাছ হ’ল দৃঢ়তা, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা প্রভৃতি। দৃঢ় ও একনিষ্ঠ ব্যক্তিকে মুখলেছ বলে।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,الإخلاص : هو إفراد الحق سبحانه بالقصد في الطاعة- ‘স্বেচ্ছায় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত নিবেদনকে ইখলাছ বলে’।[মাদারিজুস সালিকীন, ২/৯১ পৃঃ] কেউ বলেছেন,الإخلاص تصفية الأعمال من الكدورات، ‘আমল বা কাজকে দূষণমুক্ত করাই ইখলাছ’।[আত-তা‘রীফাত, পৃঃ ২৮]
হুযায়ফা আল-মার‘আশী (রহঃ) বলেছেন,الإخلاص استواء أفعال العبد في الظاهر والباطن- ‘বান্দার কাজ ভেতর-বাহির থেকে এক রকম হওয়াকে ইখলাছ বলে’।[আত-তিবইয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন, পৃঃ ১৩] কেউ কেউ বলেছেন, الإخلاص أن لا تطلب على عملك شاهدا غير الله ولا مجازيا سواه- ‘নিজের আমলের উপর আল্লাহ ছাড়া কাউকে সাক্ষী এবং প্রতিদানদাতা হিসাবে না মানার নাম ইখলাছ’।[মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২]
আল্লাহর ইবাদতে এই ইখলাছ থাকা অতিব জরুরী। অল্প আমল আখেরাতে পরিত্রণ দিবে যদি তা ইখলাছের সাথে পালন করা হয়। ইখলাছ অবলম্বন করে চলা বড় কঠিন কাজ। ইখলাছই সকল ইবাদতের সার ও প্রাণ। কোন ইবাদত কবুল হওয়া না হওয়া ইখলাছের উপর নির্ভর করে। এটি অন্তরের আমল সমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবার উপরে এবং সকলের মূলভিত্তি। যুগে যুগে আগত নবী-রাসূলদের দাওয়াতের চাবিকাঠি ছিল ইখলাছ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)। তিনি আরও বলেন,أَلاَ لِلَّهِ الدِّيْنُ الْخَالِصُ، ‘সাবধান, খালেছ দ্বীন বা ইবাদত কেবল আল্লাহর’ (যুমার ৩৯/৩)।
আল্লাহর প্রতি ইখলাছ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে মানুষের অবস্থান চারটি পর্যায়ভুক্ত। যথা-
(১) কারো কারো ইখলাছ নেই, রাসূলের আনুগত্যও নেই, সে ব্যক্তি মুশরিক, কাফের।
(২) কারো কারো ইখলাছ আছে, কিন্তু রাসূলের আনুগত্য নেই, সে ব্যক্তি বিদ’আতকারী।
(৩) কারো কারো ইখলাছ নেই, কিন্তু রাসূলের আনুগত্য আছে (প্রকাশ্যে), সে ব্যক্তি আক্বীদাগত মুনাফেক্ব ।
(৪) কারো কারো ইখলাছও আছে এবং রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণও আছে, সে ব্যক্তি হ’ল প্রকৃত মুমিন’ (তাজরীদুত তাওহীদিল মুফীদ)।
ইখলাছ হ’ল অন্তরের একনিষ্ঠ নিয়াত :
ইখলাছ হ’ল ক্বলব বা হৃদয়ের মাঝে সর্বোচ্চ স্তরের। এটাই বান্দার কর্মের উদ্দেশ্য ও পরিমাণে মর্যাদায় সর্ববৃহৎ। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহিঃ) বলেন, যদি অঙ্গ-প্রতঙ্গের দ্বারা দাসত্ব করা হয় কিন্তু অন্তর ইখলাছ ও তাওহীদ থেকে শূন্য থাকে তবে সে যেন একটি মৃতদেহ, যার কোন রূহ নেই। নিয়ত হ’ল অন্তরের আমল (ইবনুল কাইয়িম, বাদাইয়ুল ফাওয়ায়েদ)। অন্যত্র তিনি বলেন, “নিয়ত হচ্ছে, কোন কিছু করার ইচ্ছা পোষণ ও সংকল্প করা। নিয়ত নির্ধারণের স্থান হচ্ছে অন্তরে, মুখে উচ্চারণের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণে না তো রাসূল (ছাঃ) হতে আর না কোন ছাহাবী হতে নিয়তের শব্দ বর্ণিত হয়েছে”। [ইগাসাতুল্ লাহ্ফান, ১/২১৪]
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, «إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوٰى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهٗ إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِه فَهِجْرَتُهٗ إِلَى اللهِ وَرَسُولِه وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهٗ اِلٰى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهٗ إِلٰى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ». ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পায়’। মানুষ তার নিয়্ত অনুযায়ী ফল পাবে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থপ্রাপ্তির জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহের জন্য হিজরত করবে সে হিজরত তার নিয়্যাত অনুসারেই হবে যে নিয়্ত সে হিজরত করেছে’। [বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১]…….. এই হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহিমাহুল্লাহ এটিকে এক তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক দ্বীন’ বলে অভিহিত করেছেন। এটিকে ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর গ্রন্থ সহিহ বুখারিতে সাত জায়গায় বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেক স্থানে এই হাদীসটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল কর্মের বিশুদ্ধতা ও কর্মের প্রতিদান নিয়াতের সাথে সম্পৃক্ত- সে কথা প্রমাণ করা।
নিয়াতের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহিমাহুল্লাহ বলেন— رب عمل صغير تعظمه النية، ورب عمل كبير تصغره النية. ‘নিয়াত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে, নিয়াত অনেক বৃহৎ আমলকেও ক্ষুদ্র আমলে পরিণত করে দেয়’।
ইয়াহইয়া ইবনু আবু কাছীর বলেছেন, তোমরা কিভাবে নিয়ত করতে হয় তা শেখ। কেননা তা আমলের থেকেও বেশী গুরুত্ব বহন করে।[হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৭০; জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩]
নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا يُبْعَثُ النَّاسُ عَلَى نِيَّاتِهِمْ ‘মানুষ কেবলই তাদের নিয়ত অনুসারে উত্থিত হবে’।[ইবনু মাজাহ হা/৪২২৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩]
যুবাইদ আল-ইয়ামী (রহঃ) বলেছেন, প্রতিটি কথায় ও কাজে আমার আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত থাকা আমি খুব পসন্দ করি, এমনকি খাদ্য-পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রেও।[আল-ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাত, পৃঃ ৬২]
রিয়া বা লৌকিকতা মুক্ত থাকার নাম ইখলাছ :
ইখলাছ সঠিক করতে হলে শুরুতে নিয়াত সঠিক করা এবং তাওহীদবাদী হওয়া জরুরী। আর সকল ইবাদতে রিয়া বা লৌকিকতা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকা। কেননা রিয়া প্রদর্শন করা শিরকে আছগার বা ছোট শিরক বলা হয়। আর আল্লাহ বিচার দিবসে এমন ব্যক্তিদেরকে তাড়িয়ে দিবেন। মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً. ‘আমি তোমাদের জন্য যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হ’ল শিরকে আছগর (ছোট শিরক)। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেসা করলেন ‘হে আল্লাহ্র রাসূল ছোট শিরক কি?’ তিনি জওয়াবে বললেন ‘রিয়া’ লোক দেখানো বা জাহির করা। কারণ নিশ্চয়ই শেষ বিচারের দিনে মানুষ তার পুরস্কার গ্রহণের সময় আল্লাহ বলবেন, ‘বস্তুজগতে যাদের কাছে তুমি নিজেকে জাহির করেছিলে তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের নিকট হ’তে কোন পুরস্কার পাও কি না’। [আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫৩৩৪]
আর এই রিয়া প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শিরকও বলা হয়। এই শিরক দাজ্জালের ফেৎনার চেয়েও ভয়াবহ। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা দিলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ؟ قَالَ قُلْنَا بَلَى، فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর একটি বিষয় সম্পর্কে বলব না? আমরা বললাম, জি বলুন। তিনি উত্তর দিলেন, সেটা হ’ল গুপ্ত শিরক। (অর্থাৎ) যখন কেউ ছালাত আদায় করতে উঠে ছালাত সুন্দর করার জন্য চেষ্টা করে এই ভেবে যে লোকেরা তার প্রতি চেয়ে আছে, সেটাই গুপ্ত শিরক’। [ইবনে মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩] ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই বাস্তবতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘চন্দ্রবিহীন রাত্রে একটা কালো পাথর বেয়ে উঠা একটা কালো পিঁপড়ার চেয়েও গোপন হ’ল শিরক’। [ছহীহুল জামি‘ হা/৩৭৩০]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللَّهُ بِهِ . ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমাল করে আল্লাহ তা’আলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকেদেরকে জানিয়ে ও শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কোন নেক কাজ করে, আল্লাহ তা’আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকেদের মাঝে ফাঁস করে দিবেন। [বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬; আহমাদ হা/২০৪৭০]
ইবনু রজব হাম্বালী (৭৩৬-৭৯৫হি.) (রহিঃ) বলেন, وَرَائِحَةُ الْرِيَاءِ كَدُخَانِ الْحِطَبِ، يَعِلُوْ إِلَى الْجَو ثُمَّ يَضْمِحَل وَتَبْقِى رَائحته الكَرِيْهَة ‘রিয়া বা লৌকিকতার ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল কয়লার ধুঁয়োর ন্যায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার দূর্গন্ধ কেবল অবশিষ্ট থাকে’। [মাজমূঊর রাসায়িল, পৃষ্ঠা-৭৫৮]
রিয়া প্রদর্শনকারী ব্যক্তি সকল জাহান্নামী হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা লোক দেখানে কোন ইবাদত কবূল করেন না। যেমন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম ব্যক্তি কিয়ামতের দিন যার ওপর ফয়সালা করা হবে, সে ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে, অতঃপর তাকে আল্লাহ্র নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ. আপনার জন্য জিহাদ করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لأَنْ يُقَالَ جَرِىءٌ. فَقَدْ قِيلَ. ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি এ জন্য জিহাদ করেছ যেন তোমাকে বীর বলা হয়, অতএব তা বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আবারও আলিম ব্যক্তিকে আনা হবে, যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছে। অতঃপর তাকে তার নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ. আমি ইলম শিখেছি ও শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ. وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ. فَقَدْ قِيلَ. ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি ইলম শিক্ষা করেছ যেন তোমাকে আলিম বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন তোমাকে ক্বারী বলা হয়। অতএব তা-ই বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
পুনরায় আরও এক ব্যক্তিকে আনা হবে, যাকে আল্লাহ সচ্ছলতান সাথে সকল প্রকার ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কী আমল করেছ?’ সে বলবে, مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا আপনি পছন্দ করেন এমন কোন খাত নেই, যেখানে আমি আপনার জন্য দান করিনি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ. فَقَدْ قِيلَ ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি দান করেছ যেন তোমাকে দানশীল বলা হয়। অতএব বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’। [মুসলিম হা/১৯০৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৫১৮; ছহীহুল জামি হা/২০১৪]
অন্তরে ইখলাছ ধারনের ফযীলত :
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ‘অনেক আমল এমন আছে, যা মানুষ পরিপূর্ণ ইখলাছের সাথে সম্পাদন করে। ফলে এ আমলটি ইখলাছের পূর্ণতার কারণে তার কবীরা গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। যেমন হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের এক ব্যক্তির ব্যাপারে ঘোষণা করা হবে। তার কাছে উপস্থিত করা হবে পাপকর্মের নিরানববইটি বিশাল নথি। প্রতিটি নথির ব্যপ্তি হবে দৃষ্টির দূরত্ব পরিমাণ। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি যে এ পাপকর্মগুলো করেছ তা কি তুমি অস্বীকার করবে? সে বলবে, হে প্রতিপালক! আমি এগুলো অস্বীকার করতে পারি না। আল্লাহ বলবেন, তোমার উপর যুলুম করা হবে না। এরপর হাতের তালু পরিমাণ একটা টিকেট বের করা হবে যাতে লেখা থাকবে ‘আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’। সে বলবে, এত বিশাল পাপের সম্মুখে এ ছোট টিকেটের কি মূল্য আছে? অতঃপর এ টিকেটটি একটি পাল্লায় রাখা হবে এবং তার পাপের বিশাল নথিগুলোকে রাখা হবে অপর পাল্লায়। টিকেটের পাল্লাই ভারী হবে। [তিরমিযী, হা/২৬৩৯, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৫৫৯]….. এ ব্যক্তি ইখলাছের সাথে উক্ত সাক্ষ্য দিয়েছে বলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে। অন্যথা কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তি যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দিয়েছে, তারাও জাহান্নামে যাবে। হয়ত তারা ইখলাছের সাথে কালেমা পড়েনি।
আরেকটি হাদীছ উল্লেখ করা যেতে পারে। তা হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি নিয়ত করল, আমি রাতে কিছু ছাদাক্বাহ (দান) করব। যখন রাত এল সে ছাদাক্বাহ করল। কিন্তু ছাদাক্বাহ পড়ল এক ব্যভিচারী মহিলার হাতে। সকাল হ’লে লোকজন বলতে শুরু করল, গত রাতে জনৈক ব্যক্তি এক ব্যভিচারীকে ছাদাক্বাহ দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ! ব্যভিচারীকে ছাদাক্বাহ দেয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। আমি রাতে আবার একটি ছাদাক্বাহ করব। পরের রাতে যখন সে ছাদাক্বাহ করল, তা পড়ল একজন ধনীর হাতে। যখন সকাল হ’ল তখন লোকজন বলাবলি শুরু করল, গত রাতে জনৈক ব্যক্তি এক ধনীকে ছাদাক্বাহ দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ! ধনীকে ছাদাক্বাহ দেয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। আমি রাতে আবার একটি ছাদাক্বাহ করব। যখন পরের রাতে সে ছাদাক্বাহ করল, তা পড়ল একজন চোরের হাতে। যখন সকাল হ’ল তখন লোকজন বলতে শুরু করল, গত রাতে এক ব্যক্তি এক চোরকে ছাদাক্বাহ দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ! ব্যভিচারী, ধনী ও চোরকে ছাদাক্বাহ দেয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হ’ল, তোমার সকল ছাদাক্বাহই কবুল করা হয়েছে। সম্ভবত তোমার ছাদাক্বাহর কারণে ব্যভিচারী মহিলা তার পতিতাবৃত্তি থেকে ফিরে আসবে। ধনী ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহী হবে। চোর তার চুরি কর্ম থেকে ফিরে আসবে’। [বুখারী হা/১৪২১; মুসলিম, মিশকাত হা/১৮৭৬] ….. এ ব্যক্তি তার ছাদাক্বাহ বা দান করার ব্যাপারে এতটাই ইখলাছ অবলম্বন (আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার নিয়ত) করেছিল যে, ছাদাক্বাহ প্রদানে তার অতি গোপনীয়তা কাউকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে দেয়নি। এ গোপনীয়তা রক্ষার কারণে বার বার এ ছাদাক্বাহ অনাকাংখিত লোকের হাতে পড়লেও সে তার ইখলাছ থেকে সরে আসেনি। ইখলাছ অবলম্বনে ছিল অটল। ফলে তার কোন দান ব্যর্থ হয়নি।
কবিতার ভাষায়-
জ্ঞানই শক্তি,
জ্ঞানই মুক্তি।
জ্ঞানের মাঝে
রয়েছে শাস্তি।
দ্বীনি জ্ঞানে হও বলিয়ান,
বৈষয়িক জ্ঞানে হও আগুয়ান।
ইখলাছ করে পরিশুদ্ধ,
দ্বীনের দাওয়াত করো রপ্ত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইখলাছের একাগ্রতা গ্রহণ পূর্বক মুখলেছ বান্দা হিসাবে কবূল করুন, আমীন।