ইসলামের ইতিহাসে ৩৫ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে ওছমান (রাঃ) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদত বরণ করলে লোকেরা আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরাও আলী (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত নেয়। আলী (রাঃ) প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে কেউ কেউ আলী (রাঃ)-এর প্রতি রুষ্ট হন। অন্যদিকে হজ্জের মওসুম হওয়ায় রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ সহ বহু ছাহাবী হজ্জব্রত পালনে মক্কায় ছিলেন। এভাবে চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর তালহা ও যুবায়ের (রাঃ) মক্কায় গমন করেন। সেখানেই ওছমান হত্যার ক্বিছাছ গ্রহণের প্রস্ত্ততি নেওয়ার জন্য বছরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আয়েশা (রাঃ), তালহা, যুবায়ের প্রমুখ ছাহাবী বছরার পথে রওয়ানা হন।
পথিমধ্যে আয়েশা (রাঃ) বছরার নিকটবর্তী ‘হাওআব’ (ماء الحوأب) নামক স্থানে পৌঁছলে কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। তখন তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের কথা মনে পড়ে যায়। একদা রাসূল (ছাঃ) তাঁকে বলেন, كَيْفَ بِإِحْدَاكُنَّ تَنْبَحُ عَلَيْهَا كِلاَبُ الْحَوْأَبِ ‘তোমাদের মধ্যকার একজনের অবস্থা কেমন হবে, যখন হাওআবের কুকুর তার বিরুদ্ধে ঘেউ ঘেউ করবে? (হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
أَيَّتُكُنَّ صَاحِبَةُ الْجَمَلِ الْأَدْبَبِ، تَخْرُجُ فَيَنْبَحُهَا كِلَابُ حَوْأَبٍ، يُقْتَلُ عَنْ يَمِينِهَا وَعَنْ يَسَارِهَا قَتْلَى كَثِيرٌ، ثُمَّ تَنْجُو بَعْدَمَا كَادَتْ-
‘তোমাদের মধ্যে উটে আরোহণকারিনীর অবস্থা কি হবে, যখন সে বের হবে? অতঃপর তার বিরুদ্ধে হাওআবের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করবে? তার ডানে ও বামে বহু মানুষ নিহত হবে। এরপর কোন মতে সে প্রাণে রক্ষা পাবে’ (মুসনাদে বাযযার হা/৪৭৭৭; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১২০২৬, সনদ ছহীহ)। তখন আয়েশা (রাঃ) বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন। এমন সময় যুবায়ের (রাঃ) বললেন, না বরং আপনি সামনে অগ্রসর হন। লোকেরা আপনাকে দেখে হয়ত সন্ধিতে চলে আসবে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়ত বিবদমান দু’টি দলের (আলী ও মু‘আবিয়া) মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন। তখন তিনি সামনে অগ্রসর হন’ (হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪)।
অন্যদিকে তাদের এই পদক্ষেপকে আলী (রাঃ) খেলাফতের অখন্ডতার জন্য হুমকি মনে করেন এবং সেনাবাহিনী সহ বছরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অনেক প্রসিদ্ধ ছাহাবী তাঁর এই পদক্ষেপ থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। এমনকি হাসান বিন আলী (রাঃ) স্বীয় পিতাকে এ পদক্ষেপ থেকে ফিরানোর জন্য বহু চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন।
আলী (রাঃ) প্রথমে আয়েশা, তালহা ও যুবায়ের (রাঃ)-এর নিকটে কা‘কা‘ বিন আমরকে মুসলমানদের ঐক্য অটুট রাখা ও ভ্রাতৃত্বের আহবান নিয়ে প্রেরণ করেন। এসময় আয়েশা (রাঃ) জবাব দেন যে, আমরা মুসলমানদের মধ্যে মীমাংসা করতে এসেছি। কা‘কা‘ বিন আমর উক্ত সংবাদ আলী (রাঃ)-এর নিকট পেশ করলে তিনি খুশী হন। আয়েশা (রাঃ) আলীর নিকট দূত পাঠিয়ে বলেন যে, আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। বরং মীমাংসার জন্য এসেছি। এরপর আলী (রাঃ) লোকদের শান্ত করতে বিভিন্ন ঘটনা স্মরণ করিয়ে বক্তব্য দেন। যাতে তিনি বলেন, আমরা আগামীকাল চলে যাব, ওছমান হত্যায় যারা জড়িত তারা ব্যতীত সকলে আমাদের সাথে যাবে।
এতে ফিৎনাবাজ আশতার, শুরাইহ বিন আওফা, আব্দুল্লাহ বিন সাবা ও ওছমান হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আড়াই হাযার লোক ভীত হয়ে গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয় (এদের মধ্যে কোন ছাহাবী ছিলেন না)। প্রথমে তারা আলী (রাঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তা অসম্ভব দেখে অন্য ষড়যন্ত্র করে। রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তারা তালহা ও যুবায়ের (রাঃ)-এর বাহিনীর উপর হামলা করে এবং ফজরের পূর্বেই পালিয়ে যায়। এতে তাঁরা মনে করেন যে, এটি আলী (রাঃ)-এর বাহিনী করেছে। ফলে উভয় দলের মধ্যে অনাকাংখিত যুদ্ধ বেধে যায়। আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য উটের উপর আরোহণ করে ময়দানে অবতীর্ণ হন। কিন্তু খারেজীরা তাঁর বাহনের পায়ে তীর মারলে তিনি নিচে পড়ে যান। পরে তাঁকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় (আল-বিদায়াহ ৭/২২৯-২৪০)।
এ যুদ্ধের মূল কারণ ছিল ওছমান হত্যার বিচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হত্যাকারীদের নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র। আয়েশা (রাঃ) এই অনাকাংখিত যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ইবনু ওমর (রাঃ)-কে বলেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আপনি আমাকে উটের যুদ্ধে যেতে বাধা দেননি কেন? উত্তরে তিনি বলেন, আপনার উপর এক ব্যক্তি (অর্থাৎ ইবনু যুবায়ের) প্রভাব বিস্তার করেছিল, এজন্য কিছু বলিনি। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আপনি নিষেধ করলে আমি যেতাম না’ (যায়লাঈ. নাছবুর রায়াহ ৪/৭০; আল-ইস্তী‘আব ১/২৭৫; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/১৯৩, ৩/২১১; ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল যে, আমাকে আমার গৃহে রাসূল (ছাঃ) ও পিতা আবুবকরের পাশে দাফন করা হবে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর আমি একটি ঘটনা ঘটিয়েছি। সেজন্য তোমরা আমাকে রাসূল (ছাঃ)-এর অন্য স্ত্রীদের সাথে দাফন করবে। অতঃপর তাঁকে বাকী‘ গোরস্থানে দাফন করা হয় (হাকেম হা/৬৭১৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/১৯৩, সনদ ছহীহ)।
আলবানী বলেন, ‘আমরা এতে নিঃসন্দেহ যে, আয়েশা (রাঃ)-এর বের হওয়াটা ভুল ছিল। আর এজন্য তিনি হাওআবে নবী করীম (ছাঃ)-এর সতর্কবাণী মনে পড়ার পর ফিরে যাওয়ার সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু যুবায়ের (রাঃ) ‘আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়ত বিবদমান দু’টি দলের (আলী ও মু‘আবিয়া) মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন’ একথা বলে তাঁকে ফিরে যেতে বাধা দেন। আমরা নিঃসন্দেহ যে, তিনিও এ ব্যাপারে ভুলকারী ছিলেন’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
অপরদিকে আলী (রাঃ) যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বলেছিলেন, হায় যদি আমি এর বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম! (হাকেম হা/৪৫৫৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫৯৯০, সনদ ছহীহ)। আলী (রাঃ) এজন্য অনুতপ্ত হন এবং বার বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন (আল-ইস্তী‘আব, আলী ক্রমিক… ১/২৯২)। অন্যদিকে যুবায়ের (রাঃ) যুদ্ধ ত্যাগ করে উপত্যকায় চলে যান। তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় আমর বিন জুরমূয হত্যা করে। আলী (রাঃ) জানতে পারলে দুঃখ করে বলেন, হে যুবায়ের-এর হত্যাকারী! তুমি জাহান্নামের দুঃসংবাদ গ্রহণ কর (হাকেম হা/৫৫৮০; আহমাদ হা/৭৯৯, সনদ হাসান)। আর তালহা (রাঃ) জনৈক ব্যক্তির তীরের আঘাতে নিহত হ’লে আলী (রাঃ) নিহতদের মধ্যে তাকে দেখতে পান। তখন তিনি তাঁর মুখমন্ডল থেকে ময়লা সরাতে সরাতে বলেছিলেন, হে আবু মুহাম্মাদ! আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। আকাশের তারকারাজির নিচে আপনাকে এ অবস্থায় দেখাটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর’ (আল-বিদায়াহ ৭/২৪৭)।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধ করেননি এবং যুদ্ধ করার জন্য বেরও হননি। বরং তিনি মুসলমানদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য বের হয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে, তার বের হওয়াতে মুসলমানদের কল্যাণ রয়েছে। পরে তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর বের না হওয়াতেই কল্যাণ ছিল। সেজন্য জঙ্গে জামালে যাওয়ার কথা স্মরণ হ’লে তিনি এতো বেশী কাঁদতেন যে, তাঁর ওড়না ভিজে যেত।…অনুরূপভাবে ত্বালহা, যুবায়ের ও আলী (রাঃ) এই অনাকাংখিত যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হন। কারণ এটি তাঁদের কারোরই এখতিয়ারাধীন ছিল না (মিনহাজুস সুন্নাহ ১/২২৮)। (বিস্তারিত দ্রঃ সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৭৪-এর আলোচনা; ইবনুল ‘আরাবী, আল-‘আওয়াছিম মিনাল ক্বাওয়াছিম ১/১৫৬-১৬২; সায়ফ বিন ওমর আসাদী, আল-ফিৎনাতু ওয়া ওয়াক্ব‘আতুল জামাল; ড. আকরাম যিয়া উমরী, ‘আছরুল খিলাফাতির রাশেদাহ পৃ. ৪৫০-৪৬১)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, ছাহাবায়ে কেরামের মতভেদগত বিষয়ে চুপ থাকাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নীতি। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমার ছাহাবীদের ব্যাপারে তোমরা চুপ থাকো (ত্বাবারাণী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৪)। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল, তারা ছাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে তাদের হৃদয় ও জিহবাকে সংযত রাখেন… এবং তাদের মাঝে মতভেদগত বিষয়ে চুপ থাকেন (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৫৪-৫৫)।