দুনিয়াতে জীবনোপকরণের স্বাচ্ছন্দ সৎ ও আল্লাহর প্ৰিয়পাত্র হওয়ার আলামত নয়। পক্ষান্তরে অভাব-অনটন ও দারিদ্রতা কারু জন্য প্রত্যাখ্যাত ও লাঞ্ছিত হওয়ার দলীল নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপার সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে থাকে। সীরাতুন নাবী অধ্যায়ন করলে অবগত হওয়া যায় যে, কোন কোন নবী-রাসূলগণ জীবন-যাপনে কঠিন ক্ষুধা ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। আবার কোনও কোনও আল্লাহদ্রোহী আরাম-আয়েশে জীবন অতিবাহিত করে দিয়েছেন। [ইবন কাসীর] অতএব, ধন-সম্পদ যেমন বান্দার জন্য পরীক্ষা। অনুরূপ অভাব-অনটন ও দারিদ্রতাও বান্দার জন্য পরীক্ষা মাত্র। রাসূল (ছা.) পেট ভর্তি করে খেতেন না। অনাহার অর্ধাহারে জীভন-যাপন করতেন। আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সা.) -এর পরিবারবর্গ লাগাতার দু’দিন যবের রুটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হননি এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মৃত্যু হয়েছে। (বুখারী হা/ ৫৪১৬, মুসলিম হা/২৯৭০, মিশকাত হা/৫২৩৭) । অপর হাদীসে এসেছে, ফাযালা বিন উবায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কিছু লোক অসহনীয় ক্ষুধার জ্বালায় ছালাতে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেত। তারা ছিল ছুফফার সদস্য। তাদের অবস্থা দেখে বেদুঈনরা বলত, এরা পাগল নাকি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত শেষে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেন,لَوْ تَعْلَمُونَ مَا لَكُمْ عِنْدَ اللهِ لأَحْبَبْتُمْ أَنْ تَزْدَادُوا فَاقَةً وَحَاجَةً ‘আল্লাহর কাছে তোমাদের যে কি মর্যাদা তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’লে তোমরা আরো ক্ষুধার্ত, আরো অভাব অনটনে থাকতে পসন্দ করতে’(তিরমিযী হা/২৩৬৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৬৯)।
(১) খাদ্য দানে বিরত ব্যক্তি মুমিন নয় :
ক্ষুধার্তকে না খাওয়ানো ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয় এবং দুনিয়া-আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে। ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতকে অস্বীকারকারী যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে না এবং খাদ্য দান করতে উৎসাহিত করে না। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ، فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ، وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ- ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে বিচার দিবসে মিথ্যারোপ করে? সে হ’ল ঐ ব্যক্তি, যে ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহিত করে না’ (মাঊন ১০৭/১-৩)।
মুমিন কখনো ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান না করে থাকতে পারে না। আর যে এটা করে সে প্রকৃত মুমিন নয়। তাইতো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্পষ্টভাবে বলেছেন, «لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالَّذِي يَشْبَعُ وَجَارُهُ جَائِع إِلَى جنبه» . ‘ঐ ব্যক্তি অবশ্যই মুমিন নয় যে নিজে পেট ভর্তি করে খায় আর তার গরীব প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’। [বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩৩৮৯; হাকেম হা/২১৬৬; মিশকাত হা/৪৯৯১; ছহীহাহ হা/১৪৯।]
(২) দুনিয়াতেই তারা আযাব ভোগ করবে :
ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে না এমন ব্যক্তি দুনিয়াতেই আল্লাহর পক্ষে থেকে শাস্তি বা গযবের সম্মুখীন হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اَمَّاۤ اِذَا مَا ابۡتَلٰىهُ فَقَدَرَ عَلَیۡهِ رِزۡقَهٗ ۬ فَیَقُوۡلُ رَبِّیۡۤ اَهَانَنِ – کَلَّا بَلۡ لَّا تُکۡرِمُوۡنَ الۡیَتِیۡمَ- وَ لَا تَحٰٓضُّوۡنَ عَلٰی طَعَامِ الۡمِسۡکِیۡنِ‘আর তার রূযী সংকুচিত করেন, তখন সে বলে যে, আমার প্রভু আমাকে হেয় করেছেন। কখনোই এরূপ নয়। বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না। এবং অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না’ (ফজর ৮৯/১৬-১৮)।
দুর্বল, অসহায়, দুস্থ, বিধবা ও ইয়াতিমের প্রতি সদয় ব্যবহার করা জরুরী। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, “জন্নাতে আমি ও ইয়াতীমের তত্ত্বাবধানকারী এভাবে থাকবে” এটা বলে তিনি তার মধ্যমা ও তর্জনী আংগুলদ্বয় একসাথ করে দেখালেন’ (বুখারী হা/৬০০৫)।
অতএব ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান না করলে এবং তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য মানুষকে উৎসাহিত না করলে মহান আল্লাহ যে দুনিয়াতে আমাদের নে‘মত কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। অতীতেও তিনি এমন ব্যক্তিদের দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘কয়েকজনের একটি বাগান ছিল। যখন বাগানের ফলগুলি পাড়ার উপযুক্ত হয়েছিল। তারা রাতের বেলা বলল, আমরা অবশ্যই সকালে ফলগুলি সংগ্রহ করব, তারা ইনশাআল্লাহ বলল না এবং তারা সিদ্ধান্ত নিল বাগানে কোন ক্ষুধার্তকে ঢুকতে দিবে না এবং খাদ্য দান করবে না। সারা রাত তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইল। সেই রাতেই আল্লাহর গযবে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। পরদিন যখন তারা বাগানে পৌঁছল, তারা বলল, আমরা পথ ভুল করিনি তো? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা বুঝতে পারল। তারা মহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করল এবং বাগানের মালিকেরা বাগানটি ধ্বংসের জন্য একে অপরকে দোষারপ করতে লাগল। কেননা তারা ক্ষুধার্তকে খাবার না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় ছিল (ক্বালাম ৬৮/১৭-৩১)।
আল্লাহ তাদেরকে ধন-মাল দান করেছিলাম। যাতে তারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, কুফরী ও অহংকার করার জন্য নয়। কিন্তু তারা কুফরী এবং অহংকারের পথ অবলম্বন করেছিল। ফলে আমি তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি দিয়ে পরীক্ষা করি। নবী (সাঃ)-এর অভিশাপের কারণে তাতে তারা কিছু দিন ভুগেছিল। বাগানের মালিক তা হতে উৎপন্ন ফল-মূল থেকে গরীব মিসকীনদের উপরও খরচ করত। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যখন তার সন্তানরা তার উত্তরাধিকারী হল, তখন তারা বলল যে, এ থেকে আমাদের সংসারের খরচই তো কোন রকম বের হয়। তাই আমরা বাগানের উপার্জিত ফসল হতে গরীব ও অভাবীদেরকে কিরূপে দান করব? সুতরাং মহান আল্লাহ সেই বাগানটিকে ধ্বংস করে দিলেন। বলা হয় যে, এই ঘটনা ঈসা (সাঃ)-কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার কিছু দিন পর ঘটেছিল। (ফাতহুল ক্বাদীর)
(৩) পরকালে আযাবের ফেরেশতাগণ প্রশ্নবিদ্ধ করবে :
ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে না এমন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করবে। জাহান্নামের পাহারাদার আযাবের ফেরেশতার কঠিন প্রশ্নের ও সম্মুখীন হবে ঐ ব্যক্তি। মহান আল্লাহ বলেন, مَا سَلَکَکُمۡ فِیۡ سَقَرَ- قَالُوۡا لَمۡ نَکُ مِنَ الۡمُصَلِّیۡنَ- وَ لَمۡ نَکُ نُطۡعِمُ الۡمِسۡکِیۡنَ- ‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধে তোমরা সাকারে (জাহান্নাম) এসেছ। জাহান্নামীরা বলবে, আমরা তো মুছল্লী ছিলাম না। আর আমরা ক্ষুধার্তকে খাওয়াতাম না’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৪২-৪৪)। কোন অভাবী মানুষকে সামর্থ থাকা সত্বেও খাবার না দেয়া বা সাহায্য না করা মানুষের দোযখ যাওয়ার কারণসমূহের মধ্যে একটা কারণ। [ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী]
(৪) অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করবে :
মহান আল্লাহর উপর ঈমানহীন, অভাবী, নিঃস্ব-ক্ষুধার্তদেরকে খাদ্য দান করতে উৎসাহ দেয় না এমন ব্যক্তি অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ঐ ব্যক্তিকে ধর এবং গলায় রশি লাগিয়ে দাও অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে, সে তো ঈমান আনেনি মহান আল্লাহর উপরে আর সে অভাবী-ক্ষুধার্তদেরকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেনি’ (হাক্কাহ ৬৯/৩০-৩৪)।
ইবাদত ও আনুগত্য দ্বারা না আল্লাহর হক আদায় করত, আর না সেই অধিকারগুলো আদায় করত যা বান্দাদের আপোসে একে অপরের প্রতি আরোপিত হয়। বুঝা গেল যে, ঈমানদার বান্দার মাঝে এই গুণের সমষ্টি পাওয়া যায় যে, সে আল্লাহর অধিকারের সাথে সাথে সৃষ্টির অধিকারও আদায় করে থাকে। ফেরেশতাদেরকে আদেশ করা হবে, এই অপরাধীকে ধর এবং তার গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। অতঃপর তাকে সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে গ্রথিত করে দাও। এ শিকল সংক্রান্ত এক বর্ণনা হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, “যদি এ শিকলের একটি গ্রন্থি আসমান থেকে দুনিয়াতে পাঠানো হয় তবে (অতি ভারী হওয়ার কারণে) রাতের আগেই যমীনে এসে পড়বে। যদিও আসমান ও যমীনের মাঝের দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ। আর সেটা যদি শিকলের মাথার অংশ হয়। তারপর যদি তা জাহান্নামে ফেলা হয় তবে সেটা তার নিম্নভাগে পৌছতে চল্লিশ বছর লাগবে” (তিরমিযী হা/২৫৮৮)।
(৫) অতিভোজ দুর্ভাগ্যের আলামত :
মুমিন খায় এক পেটে, আর তা ভাগ করে নেয় তিন ভাগে। একভাগ খাবার, দ্বিতীয় ভাগ পানি ও তৃতীয় ভাগ ফাঁকা রাখেন। কিন্তু কাফের কোন প্রকার ফাঁকা রাখে না, বরং খায় সাত পেটে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (ছা.) বলেন, “ يَأْكُلُ الْمُسْلِمُ فِي مِعًى وَاحِدٍ، وَالْكَافِرُ يَأْكُلُ فِي سَبْعَةِ أَمْعَاءٍ ” ‘মুমিন ব্যাক্তি এক পেটে আহার করে আর কাফির সাত পেটে আহার করে’ (বুখারী হা/৫৩৯৬)। অথচ নাবী (ﷺ) বলেন পেটের এক তৃতীয়াংশ ভাগ আহারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ ভাগ পানির জন্য, আর এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য। [ছহীহ্ ইবনু মাজাহ্’ হা/ ৩৩৪৯)।
ইমাম গাজ্জালী বলেন, খাদ্য লিপ্সা খারাপ চরিত্রগুলোর অন্যতম প্রধান। কারণ পাকস্থলী সকল চাহিদার উৎস। এর থেকেই যৌনাঙ্গের চাহিদা উৎসারিত। এরপর খাওয়ার চাহিদা ও সহবাসের চাহিদা যখন প্রবল রূপ ধারণ করে এর থেকে সম্পদের চাহিদা উৎসারিত হয়। যেহেতু সম্পদ ছাড়া এ দুটো চাহিদাকে পূরণ করা যায় না। সম্পদের চাহিদা থেকে যশঃখ্যাতির চাহিদা উৎসারিত হয়। আর এ দুটোর অন্বেষণ হচ্ছে অহংকার, আত্মপ্রীতি, হিংসা, সীমালঙ্ঘন ইত্যাদি সকল খারাপ চরিত্রের মূল।
যে ব্যক্তি এ সকল খারাপ গুণধারী সে উম্মতের নিকৃষ্ট ব্যক্তি। এ কারণে সালফে-সালেহীন মজাদার খাবার ও এতে অভ্যস্থ হওয়াকে চরম ভয় করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন এটি দুর্ভাগ্যের আলামত এবং এর থেকে বঞ্চিত হওয়া চরম সুখ। [ফায়যুল কাদির ৪/২০৫]
রাসূলুল্লাহ (সা.) দু’দিন একাধারে পেট পুরে খেতে পাননি, একদিন পেটপুরে খেলে অন্যদিনে উপোষ থাকতেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা জমিনের ধনভাণ্ডারের চাবি তার কাছে পেশ করেছিলেন এবং মক্কার একটি পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে তার নিকট পেশ করেছিলেন কিন্তু তিনি এ কথা বলে দরিদ্রতাকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন যে, আমি একদিন ক্ষুধার্ত থেকে সবর করব, আরেকদিন খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। কেননা ঈমান দুই অংশে বিভক্ত, এক অংশ সবরের মধ্যে, অন্য অংশ শুকরিয়ার মধ্যে; যেমন আল্লাহ বলেছেন : (اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّکُلِّ صَبَّارٍ شَکُوۡرٍ) “নিশ্চয় তাতে উপদেশ রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের জন্য।” (সূরাহ্ ইবরাহীম ১৪ : ৫, লুকমান ৩১ : ৩১, আশ শুআরা- ২৬ : ৩৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর খাদ্যাভ্যাস ও জীবন-যাপন কেমন ছিল জানতে পাঠ কুরন : https://anniyat.com/y78m