যে ব্যক্তি চুপ থাকল, সে নাজাত পেল। বর্তমানে কিছু বক্তা বের হয়েছে যারা কথা বলতে বলতে এমন পর্যায়ে চলে গেছেন যে, এখন তার কথা শুনার রুচী কমে গেছে সাধারণের। কথা বললে সত্য, কল্যাণকর ও উত্তম কথা বলা উচিৎ। ভাইরাল হওয়ার জন্য মিথ্যে কথা বা আষাঢ়ে গল্প বলা মিথ্যুকের শামিল। আর মিথ্যুকের নিকট থেকে কোন ইলম গ্রহণ করা জায়েজ নয়। কেননা তারা সত্য গোপন করে মিথ্যে বলে ভুল শিখাতে পারে। তাছাড়া ভিডিও গুলোর থাম্বেলে বা শিরোনামে আকাশে তোলা অবিশ্বাস্য লেখা দেখে নিজেকেই লজ্জায় পড়তে হয়। তিনদিন বক্তব্য দিয়ে মুফতি, শায়েখ, হুজুর লকব লাগিয়ে নিজের নামে প্রশংসা শুনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে যাচ্ছেন দলমত নির্বিশেষে অধিকাংশ অপরিণামদর্শী বক্তারা। আখিরাতে আপনার আমার প্রত্যেকের সকল কথা-কর্মগুলোর হিসেব দিতে হবে।
অতএব, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে তারা যেন ভাল ও সত্য কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا يُؤْذِ جَارَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ» . ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানের সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই ভালো কথা বলে, নতুবা যেন চুপ থাকে। অপর এক বর্ণনায় ’’প্রতিবেশী’’র স্থলে রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই আত্মীয়ের হক আদায় করে’(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪২৪৩)।
কোন ব্যক্তি তার আখলাক বা চরিত্রকে সৌন্দর্য্য মন্ডিত করতে ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে সে যেন দীর্ঘ ক্ষণ চুপ থাকেন। একদিন তিনি আবু যার গিফারী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তুমি উত্তম চরিত্রবান হও এবং দীর্ঘ সময় চুপ থাক’ (মুসনাদ আবু ইয়া‘লা, মিশকাত হা/৪৮৬৭; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৯৩৮, সনদ হাসান।)।
যে ব্যক্তি চুপ থাকে তার তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায় এবং অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করে থাকেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আবি যাকারিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘যার কথা বেশী হবে, তার ভুল-ভ্রান্তি বেশী হবে, আর যার ভুল-ভ্রান্তি বেশী হবে, তার তাক্বওয়া হ্রাস পাবে, আর যার তাক্বওয়া কমে যাবে, আল্লাহ তা’ আলা তার অন্তরকে নিষ্প্রাণ বানিয়ে দিবেন’ (হিলয়াতুল আউলিয়া ৫/১৪৯)।
তর্কের মাধ্যমেও বেশী কথা বলা যাবে না :
ভালো সত্য কথা বলা উচিৎ এবং মিথ্যা বানোয়াট কথা বলা থেকে বিরত থাকা অতিব জরুরী। তাছাড়া তর্ক সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলা উচিৎ যদিও আপনি সত্যবাদী তথা হক্বের উপর অবিচল রয়েছেন। যদিও মানুষ তর্ক প্রিয় জীব। এরা বিতর্ক বুঝে না। কেননা, তর্কবাগীশ মূর্খতার বশ্যতা স্বীকার করে, কিন্তু বিতর্ক মানুষকে জ্ঞানী করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَكَانَ الإِنْسَانُ أَكْثَرَ شَىْءٍ جَدَلاً ‘মানুষ অধিকাংশ ব্যাপারেই বিতর্ক প্রিয়’ (ক্বাহাফ : ৫৪)।
রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ইলম শিখে এজন্য যে, তার দ্বারা সে আলেমদের সাথে বিতর্ক করবে ও মূর্খদের সঙ্গে ঝগড়া করবে কিংবা মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন (তিরমিযী হা/৩১৩৮, মিশকাত হা/২২৫)। আর প্রয়োজনে শারঈ বিষয়ে দলীলের ভিত্তিতে শালীনতা বজায় রেখে তর্ক-বিতর্ক করা যায়। আল্লাহ বলেন,‘তাদের সাথে বিতর্ক কর উত্তম পন্থায়’ (নাহল ১৬/১২৫)।
আব্দুছ ছামাদ বিন মা‘ক্বিল (রহঃ) বলেন, আমি ওয়াহাব বিন মুনাবিবহকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,دَعِ الْمِرَاءَ وَالْجِدَالَ عَنْ أَمْرِكَ، فَإِنَّكَ لَا تُعْجِزُ أَحَدَ رَجُلَيْنِ: رَجُلٍ هُوَ أَعْلَمُ مِنْكَ، فَكَيْفَ تُمَارِي وَتُجَادِلُ مَنْ هُوَ أَعْلَمُ مِنْكَ؟ وَرَجُلٍ أَنْتَ أَعْلَمُ مِنْهُ، فَكَيْفَ تُمَارِي وَتُجَادِلُ مَنْ أَنْتَ أَعْلَمُ مِنْهُ، وَلاَ يُطِيعُكَ، فَاقْطَعْ ذَلِكَ عَلَيْكَ ‘তুমি তোমার বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হ’তে দূরে থাক। কারণ তুমি দু’জনের মধ্যে কাউকে হারাতে পারবে না। প্রথম হল সেই ব্যক্তি, যে তোমার চাইতে অধিক জ্ঞানী। আর তোমার চাইতে জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে তুমি কিভাবে তর্ক-বিতর্ক করবে? অপর ব্যক্তি হ’ল, যার চেয়ে তুমি অধিক জ্ঞানী। আর যে তোমার চেয়ে অল্প জ্ঞানী, তার সাথে তুমি কিভাবে তর্ক-বিতর্ক করবে? সে তোমার কথা কখনোই মেনে নিবে না। অতএব তর্ক বর্জনের ওপর অবিচল থাক’ (আবুবকর আল-আজুর্রী, আশ-শারী‘আহ ১/৪৫০)।
যারা বেশী কথা বলে তর্ক করে এসব মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলতে আদেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ৎوَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا “তারাই পরম দয়াময়ের দাস, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’। (ফুরক্বান : ৬৩)। অন্যত্র বলেন, ৎخُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ “তুমি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন কর, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খদেরকে এড়িয়ে চল” (আ’রাফ : ১৯৯)।
আর তর্ক এড়িয়ে চলতে অনুপ্রাণিত ক’রে মহানবী ﷺ বলেন, أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا وَبِبَيْتٍ فِي أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ ‘আমি তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নিয়ে দিতে যামিন, যে তর্ক পরিহার করে হক্ব হ’লেও। আর একটি ঘর জান্নাতের মাঝামাঝিতে নিয়ে দিতে যামিন, যে মিথ্যা পরিহার করে কৌতুক করে হ’লেও এবং আরো একটি ঘর জান্নাতের সর্বোচ্চে নিয়ে দিতে যামিন, যে তার চরিত্রকে সুন্দর করবে’ (আবূদাঊদ হা/৪৮০০; ছহীহাহ হা/২৭৩)।
মানুষ হাসানোর জন্যও বেশী কথা বলা যাবে না :
ইসলামী শরী‘আতে নির্দোষ কৌতুক নিষিদ্ধ নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সত্য কথা ও বাস্তব বিষয় নিয়ে কৌতুক ও রসিকতা করেছেন।(বুখারী হা/৬১২৯; মুসলিম হা/২১৫০; মিশকাত হা/৪৮৮৪)। কিন্তু মিথ্যা, ঘৃণ্য বা তিরস্কারমূলক ঠাট্টা ও কৌতুক হারাম। অনেকে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা হাস্যকর কথা বলে থাকে। মিথ্যা থেকে দূরে থাকতে ওগুলো সর্বোতভাবে বর্জন করা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ بِالحَدِيثِ لِيُضْحِكَ بِهِ القَوْمَ فَيَكْذِبُ، وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَه ‘সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস নিশ্চিত যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস’ (তিরমিযী হা/২৩১৫; মিশকাত হা/৩৮৩৪; গায়াতুল মারাম হা/৩৭৬, হাদীছ হাসান)।
মিথ্যা থেকে বাঁচার অন্যতম পথ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় কথা ত্যাগ করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অন্যথা চুপ থাকে’ (বুখারী হা/৬০১৮; মুসলিম হা/৪৭; তিরমিযী হা/১৯৬৭)।
পরিশেষে, চুপ থাকা একজন ব্যক্তিত্ববোধ ব্যক্তির জীবনের জন্য সম্মান বয়ে আনে। চুপ থাকলে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর। চুপ থাকা মনীষীদের উত্তম পন্থা। রাসূল (ছাঃ) তিনিও যে বিষয়ে জানতেন না সে বিষয়ে চুপ থেকেছেন অহী নাযিলের পরে তিনি তা সবায়কে জানিয়ে দিয়েছেন। অধিক কথা বলা ব্যকিরা অধিকাংশ মিথ্যুক ও আষাঢ়ে গল্পকার হয়ে থাকেন। অতএব কথা বলার পূর্বে ভেবে চিন্তা করে সঠিক ও সত্য কথা বলা উচিৎ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।