জ্ঞানীর জন্য ইশারা, সকলের জন্য উপদেশ

(১) মানুষ চুপ থাকলে অনেক সময় অনেক বড় ফেৎনা থেকে রক্ষা পেতে পারে। তাছাড়া সবখানে কথা বলাও জরুরী নয়। সুতরাং মাঝে মাঝে কথা বলা পূর্বে হেকমাত অবলম্বনে এড়িয়ে যাওয়াও উচিৎ। আর এটা জ্ঞানীদের জন্য অতিব ওয়াজিব।
.
(২) বর্তমান জামানা একটি ধোঁকাব্যঞ্জকের জামানা চলছে। আমানতদারকে খেয়ানতকারী আর খেয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হচ্ছে। মানুষ প্রকৃত জ্ঞানীদের বাদ দিয়ে ইউটিউব সেলিব্রেটি বক্তাদের খুঁজছে। মানুষ পিওরিটির চেয়ে পপুলারিটিকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
.
(৩) প্রকৃত জ্ঞানীদেরকে অসম্মান করার কোন সুযোগ নেই। সকল জ্ঞানীদেরকে যথাযথ সম্মান করা উচিৎ। যারা তা করতে অস্বীকৃতি জানাবেন ধরে নিবেন তাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে। এসব কুটিলতা থেকে বেঁচে থাকাও জরুরী।
.
(৪) আমরা বাঙ্গালী জাতি। পৃথিবীর মধ্যে একটি অন্যতম এররোখা তাক্বলীদ প্রিয় জাতি। আবার নিজের দোষ-ত্রুটি শুনতে অপছন্দ করি। আর আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমরা শ্রেষ্ঠ আবেগী জাতি। যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে উত্তম মনে করি তার কোন দোষ-ত্রুটি দেখেও তা দোষ বলে মনে করি না। এসব অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ থেকে আমাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে বেরিয়ে আসা উচিৎ। কেননা আবেগে জ্ঞানীর বিবেক নষ্ট। আবেগকে কবর দিতে হবে এবং প্রতিদিন অল্প করে হলেও ইলমের পথ অবলম্বন করতে হবে। ইলম ব্যতীত আমরা পদে পদে অপমানিত হতে হবে।
.
(৫) উদারতা মানুষকে পরিশুদ্ধ হতে সহযোগীতা করে। শত্রু, বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়ে। পক্ষান্তরে হিংসা-বিদ্বেষ ইলমকে ক্ষীণ করে এবং হটকারিতার জন্ম দেয় এবং দিনে দিনে শত্রুতা বৃদ্ধি হতে থাকে।
.
(৬) বর্তমান অধিক লেকচার, বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা কখনও জ্ঞানের মানদণ্ড নয়। জ্ঞানীর মানদণ্ড হলো ‘তাক্বওয়া’। কেননা, জ্ঞানীরা ইলমের খেয়ানত বা গোপন করে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতে শুনেছি, وَمِلَاكُ الدِّينِ الْوَرَعُ ‘দ্বীনের মূল হ’ল তাক্বওয়া’(ছহীহুল জামি‘ হা/১৭২৭; সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/২৫৫)। দ্বীনের মূল আল্লাহভীতি তথা হারাম ও সন্দেহ-সংশয় থেকে বেঁচে থাকা,
তাছাড়া রাসূল (ছা.) বলেছেন, শেষ জামানায় ইলম বা কলমের জোর বেড়ে যাবে। বর্তমানে আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি। সকলে ইলমের অধিকারী কিন্তু তাক্বওয়ার অধিকারী অল্প কিছু ব্যক্তি। যেমন ধরুন, বক্তৃতা বা কথা বলার পূর্বে চিন্তা করা উচিৎ আমার এ কথা কি কোন ক্যাওয়াচ তৈরী করবে বা ফাসাদের জন্ম দিবে?
.
(৭) অজ্ঞতাবশতঃ কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার জন্য ভুল ধরে অপমান বা রদ করার না। বরং যথা সাধ্য সামনা-সামনি বা গোপনে ভুলকারীকে অবগত করুন এবং তা সম্মানের সাথে করা উচিৎ।রাসূল (ছা.) বলেন, وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَيَحْقِرُهُ ‘কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে না অপমান করবে, আর না তুচ্ছজ্ঞান করবে’(মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৯)।
.
(৮) আপনার ভুল-ত্রুটি ধরে দিলে তাকে বুকে টেনে নিবেন। কেননা সে আপনার একান্ত বন্ধু। ভুলেও তাকে শত্রু মনে করবেন না। সাথে সাথে সেই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো শোধরিয়ে নিবেন। কেননা তা দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য তা কল্যাণকর হবে।
.
(৯) ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে চুপথাকা, মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা, জ্ঞানানুসারে আমল করা এরপরে প্রচারে আত্মনিয়োগ করা, এসব ধাপগুলো মান্য করা উচিৎ। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘ইলমের প্রথম ধাপ হ’ল চুপ থাকা। দ্বিতীয় ধাপ হ’ল মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং তা মুখস্ত রাখা। তৃতীয় ধাপ হ’ল ইলম অনুযায়ী আমল করা। চতুর্থ ধাপ হ’ল ইলম অন্যকে শিক্ষা দেয়া এবং তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা’(হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৬২)।
.
(১০) পরিশেষে আদর্শবান মুমিনের পরিত্যাগযোগ্য কিছু বিষয়ে একটি হাদীছ স্মরণ করে দিতে চাই। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
১. তোমরা পরস্পর হিংসা করো না,
২. পরস্পর ধোঁকাবাজি করো না,
৩. পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না,
৪. একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অগোচরে শত্রুতা করো না
৫. একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না।
৬. তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে থাকো।
৭. এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।
৮. সে তার উপর অত্যাচার করবে না,
৯. তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না।
তাক্বওয়া এখানে, এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার স্বীয় বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন।
১০. একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে।
১১. কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইয্যত-আব্রু হারাম’ (মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৮৫)।
অন্যত্র বলেন, إِنَّ مِنْ أَرْبَى الرِّبَا اسْتِطَالَةَ الْمَرْءِ فِي عِرْضِ أَخِيهِ. ‘সবচেয়ে বড় সূদ হ’ল অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের মানহানি করা’ (আবূদাঊদ হা/৪৮৭৬; ছহীহাহ হা/১৪৩৩, ৩৯৫০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২০৩, ২৫৩১; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৩৩)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top