দরসে কুরআন : আল্লাহর আহ্বান

আমাদের উচিৎ ফিলিস্তিন মুসলিমদের আত্মচিৎকার শ্রবণ করা এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَا لَکُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ هٰذِهِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَهۡلُهَا ۚ وَ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ وَلِیًّا ۚۙ وَّ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ نَصِیۡرًا ‘আর তোমাদের কী হ’ল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী (নিসা ৪/৭৫)।’
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা এবং ছোট শিশুরা কাফেরদের যুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু’আ করতেন। তাই মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, তোমরা ঐ অসহায়-দুর্বল মুসলিমদেরকে কাফেরদের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ কেন কর না? এই আয়াতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে আলেমগণ বলেছেন, মুসলিমরা যদি এই ধরনের যুলুম-অত্যাচারের শিকার হয় এবং কাফেরদের বেষ্টনে অবরুদ্ধ থাকে, তাহলে তাদেরকে কাফেরদের যুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ করা অন্য মুসলিমদের উপর ফরয হয়ে যায়। এটা হল জিহাদের দ্বিতীয় প্রকার। আর প্রথম প্রকার হল, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, প্রচার-প্রসার এবং তাকে জয়যুক্ত করার জন্য জিহাদ করা।
.
মক্কা নগরীতে এমন কিছু দুর্বল মুসলিম রয়ে গিয়েছিলেন, যারা দৈহিক দুর্বলতা এবং আর্থিক দৈন্যের কারণে হিজরত করতে পারছিলেন না। পরে কাফেররাও তাদেরকে হিজরত করতে বাধাদান করেছিল এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে আরম্ভ করেছিল, যাতে তারা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। যেমন ইবন আব্বাস ও তার মাতা, সালামা ইবন হিশাম, ওলীদ ইবন ওলীদ, আবু জান্দাল ইবন সাহল প্রমূখ। এসব সাহাবী নিজেদের ঈমানী বলিষ্ঠতার দরুন কাফেরদের অসহনীয় উৎপীড়ন সহ্য করেও ঈমানের উপর স্থির থাকেন। অবশ্য তারা এসব অত্যাচার উৎপীড়ন থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য বরাবরই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দো’আ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তাদের সে প্রার্থনা মঞ্জুর করে নেন এবং মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেন যাতে তারা জিহাদের মাধ্যমে সেই নিপীড়িতদেরকে কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি ও আমার মা অসহায়দের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। [বুখারী ৪৫৮৭]
.
আবদুল্লাহ ইবনু আবূ আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহযাব যুদ্ধের সময় মুশরিকদের জন্য বদ্দু’আ করে বলেছিলেন,  «اللَّهُمَّ مُنْزِلَ الْكِتَابِ سَرِيعَ الْحِسَابِ اللَّهُمَّ اهْزِمِ الأحزابَ اللهُمَّ اهزمهم وزلزلهم» ’’আল্ল-হম্মা মুনযিলাল কিতা-বি, সারী’আল হিসা-বি, আল্ল-হুম্মা আহযিমিল আহযা-বা, আল্ল-হুম্মা আহযিমহুম, ওয়া যালজিলহুম’’ অর্থাৎ- ’হে কিতাব নাযিলকারী ও তড়িৎ বিচার ফায়সালাকারী [হিসাব গ্রহণকারী] আল্লাহ! হে আল্লাহ! তুমি শত্রুর সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করো। হে আল্লাহ! তাদেরকে তুমি পরাজিত করো এবং তাদেরকে পর্যদস্ত-বিচলিত করে দাও’ (বুখারী হা/ ২৯৩৩; মিশকাত হা/২৪২৬)।
‘আল্লামা আসকালানী (রহঃ) বলেনঃ উল্লেখিত দু‘আয় তিনটি নিয়ামতের মাহাত্ম্যের উপর সতর্কবাণী রয়েছে।
১. আল্লাহর কিতাব নাযিল হওয়ার মাধ্যমে পরকালীন নিয়ামত অর্জন হয়েছে।
২. মেঘ চলমানের কারণে দুনিয়াবী নিয়ামত অর্জন হয়েছে। যথা-জীবিকা।
৩. বহুজাতিক বাহিনী পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে দু’টি নিয়ামতের (মক্কা-মদীনাহ্) সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে।
আমরা আশা রাখি আজও এই দোআ করতে পারি বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষার জন্য।

.
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চিই তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে দু’টি দলের মধ্যে, যারা পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দলটি কাফির। তারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে ওদের দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ নিজ সাহায্য (ফেরেশতা পাঠিয়ে) দ্বারা যাকে চান শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে রয়েছে চক্ষুষ্মানদের জন্য শিক্ষা’ (ইমরান ৩/১৩)।
আলোচ্য আয়াতে বদর যুদ্ধের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এ যুদ্ধে কাফেরদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। তাদের কাছে সাতশ উট ও একশ’ অশ্ব ছিল। অপরপক্ষে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’র কিছু বেশী। তাদের কাছে সর্বমোট সত্তরটি উট, দুটি অশ্ব, ছ’টি লৌহবর্ম এবং আটটি তরবারী ছিল। মজার ব্যাপার ছিল এই যে, প্রত্যেক দলের দৃষ্টিতেই প্রতিপক্ষ দলের সংখ্যা নিজেদের চেয়ে দ্বিগুণ প্রতিভাত হচ্ছিল। এর ফলে মুসলিমদের আধিক্য কল্পনা করে কাফেরদের অন্তর উপর্যুপরি শঙ্কিত হচ্ছিল এবং মুসলিমগণও নিজেদের অপেক্ষা প্রতিপক্ষের সংখ্যা দ্বিগুণ দেখে আল্লাহ তা’আলার দিকে অধিকতর মনোনিবেশ করছিলেন। তারা পূর্ণ ভরসা ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর ওয়াদা- “যদি তোমাদের মধ্যে একশ ধৈর্যশীল যোদ্ধা থাকে, তবে তারা দুইশ’র বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে” [সূরা আল-আনফালঃ ৬৬]-এর ওপর আস্থা রেখে আল্লাহর সাহায্যের আশা করছিলেন। কাফেরদের প্রকৃত সংখ্যা ছিল তিনগুণ। তা যদি মুসলিমদের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়ে যেত, তবে তাদের মনে ভয়-ভীতি সঞ্চার হওয়াটা ছিল সাধারণ। আবার কোন কোন অবস্থায় উভয় দলই প্রতিপক্ষকে কম দেখেছিল। [সীরাতে ইবন হিশাম]
বদর যুদ্ধ থেকে শিক্ষা :
(এক) মুসলিম ও কাফেররা যেভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল, তাতে উভয় দলের নৈতিক ও চারিত্রিক পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাদের একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছিল, অপরদল তাগুত, শির্ক ও শয়তানের পথে যুদ্ধ করছিল। আল্লাহ তার পথে যুদ্ধকারীদের অন্যদের উপর বিজয় দিয়েছিলেন। এ থেকে ইয়াহুদীরা শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। [আইসারুত তাফসীর]
(দুই) মুসলিমরা সংখ্যায় নগণ্য ও অস্ত্রে অপ্রতুল হওয়া সত্বেও যেভাবে কাফেরদের বিশাল সংখ্যা ও উন্নত অস্ত্র-সস্ত্রের মোকাবেলা করেছে, তাতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সাহায্যপুষ্ট। [সা’দী]
(তিন) আল্লাহর প্রবল প্রতাপ ও অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে গাফেল হয়ে যারা সংখ্যাধিক্য ও সমরাস্ত্রের শক্তিতে আত্মম্ভ্রিতায় মেতে উঠেছিল, আল্লাহ্‌ তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন। [মানার]
কাফেররা নিজেদের শক্তি ও সংখ্যার আধিক্যের দাম্ভিকতায় মুসলিমদের উপর আক্রমণ করার জন্য বদরের ময়দান পর্যন্ত যাত্রা করে এবং সেখানে সর্বপ্রথম এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আর যুদ্ধে মুসলিমরা আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভে ধন্য হন। এতে করে কাফেররা এমন শিক্ষামূলক পরাজয় বরণ করে যে, আগামীর জন্য তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।

সম্মানিত ভ্রাতৃগণ, উপরোক্ত দোআটি বেশী বেশী পাঠ করুন…. আল্লাহ মুসলিম জাতিকে কাফের মুশরেকের বিরুদ্ধে বিজয়ী করুন, আমীন।

1 thought on “দরসে কুরআন : আল্লাহর আহ্বান”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top