মানব সৃষ্টি : ইসলাম ও বিজ্ঞানের আলোকে

ভূমিকা :

পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টির মূল উপাদান
পানি। এই মৌলিক উপাদান পৃথিবীর সকল জীবদেহের মধ্যে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ‘আর প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি হ’তে’ (আম্বিয়া ২১/৩০)। জীব বিজ্ঞানের মতে, সাগরের অভ্যন্তরের পানিতে যে প্রোটোপ্লাজম বা জীবনের আদিম মূলীভূত উপাদান রয়েছে তা থেকেই সকল জীবের সৃষ্টি। আবার সকল জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। আর এই কোষ গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি। ভিন্নমতে, পানি অর্থ শুক্র (কুরতুবী)। তাছাড়া আকাশ ও পৃথিবী বন্ধ ছিল অর্থাৎ পূর্বে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হ’ত না এবং যমীনে তরুলতা জন্মাত না। আল্লাহর ইচ্ছায় বৃষ্টি বর্ষিত হ’ল এবং মাটি তা থেকে উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করল (ইবনে আববাস)[1] পৃথিবীর জীব কোষের মূল উপাদান যেমন পানি, তেমনি এই পানিই মাটির উৎপাদন ক্ষমতা লাভের প্রধান উপাদান। মহান আল্লাহ এই ধরণীতে মাটি থেকে একজন প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন এবং তারপর তা থেকে ক্রমশঃ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই মানব জাতি। মহান আল্লাহর ভাষায়,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا   ‘হে মানবমন্ডলী! আমরা তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করতে পার’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে ‘মানব ক্লোন’। এই ক্লোন পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে গেলে পুরুষের জীব কোষের প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন পুরুষের জীব কোষ বা শুক্রাণু ব্যতীত একজন নারী সন্তান জন্ম
দানে অক্ষম। কেননা নারীর ডিম্বাণু ক্রমোজম (XX) ও পুরুষের শুক্রাণু ক্রমোজম (XY) পুত্র-কন্যা সন্তান গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানে হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন হ’তে পারে, কিন্তু মহান আল্লাহ এ প্রশ্নের সমাধান পবিত্র কুরআনে যথাযথভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেন, إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকটে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মত। তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অতঃপর তাকে বলেছিলেন, হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল’ (আলে ইমরান ৩/৫৯)। আদি মানব-মানবী ও তাদের সন্তান সৃষ্টির পূর্ব ও পরের গূঢ় রহস্য কথা নিয়ে নিমেণ আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

মানব সৃষ্টির আদি কথা :

আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন বস্ত্তবাদী গবেষক, দার্শনিক নানা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। যেমন- আদি মানব সম্প্রদায় বানর ছিল। কালের আবর্তনে পর্যায়ক্রমে বানর থেকে মানবে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হ’ল বর্তমান যুগে কি বিশ্বের কোথাও একটি বানর মানবে রূপান্তরিত হয়ে জীবন যাপন করছে? কিংবা কোন বানরের গর্ভ থেকে মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে ও বেঁচে আছে? এর জবাব হ’ল নেতিবাচক। এটা সকলের জানা। আদি মানব কি বস্ত্ত থেকে সৃষ্টি তা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা (সাজদাহ ৩২/৭), আমি মানবকে পঁচা কাদা থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি (হিজর ১৫/২৬), এঁটেল মাটি (ছাফ্ফাত ৩৭/১১), পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি’ (আর-রহমান ৫৫/১৪)। আল্লাহ তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) এবং তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২) আদম একাই শুধুমাত্র মাটি থেকে সৃষ্টি। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট’ (সাজদাহ ৩২/৭-৯)

হযরত আদম (আঃ) মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি। কিন্তু মা হাওয়া (আঃ) কি দিয়ে সৃষ্টি সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি তার (আদম) থেকে তার যুগল (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন’ (যুমার ৩৯/৬)। তিনি আরও বলেন, ‘তিনি তার (আদম) থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ’ (নিসা ৪/১)। অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীকে, তোমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন’ (রূম ৩০/২১)

মহান আল্লাহ হযরত আদম (আঃ)-এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ أَعْلاَهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيْمُهُ كَسَرْتَهُ،
وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ، فَاسْتَوْصُوْا بِالنِّسَاءِ-  ‘নারী জাতিকে পাঁজরের বাঁকা হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে একেবারে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। যদি তা সোজা করতে যাও, ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তা ছেড়ে দাও, তবে সব সময় বাকাই থাকবে। সূতরাং তোমরা নারীদের সাথে উত্তম ও উপদেশমূলক কথাবার্তা বলবে’।[2]

পৃথিবীতে প্রথম মানব আদম (আঃ) মাটি থেকে এবং প্রথম মানবী হাওয়া (আঃ) আদমের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি। এতদ্ব্যতীত সকল মানব-মানবী এক ফোঁটা অপবিত্র তরল পদার্থ (বীর্য) থেকে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন,فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلاً- ‘অতঃপর আমরা তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণ আকৃতি ও অপূর্ণ আকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমরা নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর শিশু অবস্থায় বের করি’ (হজ্জ ২২/৫)। এভাবে আজও মানব বংশবিস্তার অব্যাহত আছে বিবাহ-বন্ধন ও স্বামী-স্ত্রীর মিলন ব্যবস্থার মাধ্যমে। যাতে করে মহান আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্য সফল হয়।

গর্ভে সন্তান গঠনের গূঢ় রহস্য :

গর্ভে সন্তান গঠনের চক্র সাধারণতঃ দীর্ঘ ২৮০ দিন যাবৎ চলতে থাকে। যা ৪০ দিন অন্তর সুনির্দিষ্ট ৭ টি চক্রে বিভক্ত। নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সময় নারীর ডিম্বনালীর ফানেলের মত অংশে ডিম্বাণু নেমে আসে এবং ঐ সময় পুরুষের নিক্ষিপ্ত বীর্যের শুক্রাণু জরায়ু বেয়ে উপরে উঠে আসে ও তা ডিম্বনালীতে প্রবেশ করে। প্রথমে একটি শক্তিশালী শুক্রাণু ডিম্বাণুটির দেহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে অন্য কোন শুক্রাণু প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে নারীর ডিম্বাণুটি নিষিক্ত (Fertilization) হয় এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুতে নেমে প্রোথিত (Embedded) হয়।[3] তাছাড়া নারীর ডিম্বাণুর বহিরাবরণে প্রচুর সিয়ালাইল-লুইস-এক্সসিকোয়েন্স্ নামের চিনির অণুর আঠালো শিকল শুক্রাণুকে যুক্ত করে পরস্পর মিলিত হয়।[4] আর এই শুক্রাণু দেখতে ঠিক মাথা মোটা ঝুলে থাকা জোঁকের মত। জোঁক যেমন মানুষের রক্ত চুষে খায়, শুক্রাণু ঠিক তেমনি ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে মায়ের রক্তে থাকা প্রোটিন চুষে বেড়ে উঠে। নিষিক্ত ডিম্বাণুটি সন্তান জন্মের রূপ নিলে সাধারণতঃ নিম্নে ২১০ দিন ও উর্ধ্বে ২৮০ দিন জরায়ুতে অবস্থান করে এবং ঐ সময়ের মধ্যে ডিম্বাশয়ে নতুন করে আর কোন ডিম্বাণু প্রস্ত্তত হয় না।[5] এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِيْنٍ ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِيْ قَرَارٍ مَكِيْنٍ، ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ-  ‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্র বিন্দুকে জমাট রক্ত রূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিন্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপিন্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করেছি’ (মুমিন ২৩/১২-১৪)। তিনি আরো বলেন, إِلَى قَدَرٍ مَعْلُوْمٍ، فَقَدَرْنَا فَنِعْمَ الْقَادِرُوْنَ ‘এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত, অতঃপর আমরা একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমরা কত সুনিপুন স্রষ্টা’ (মুরসালাত ৭৭/২২-২৩)। ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন এবং তাতে রূহ সঞ্চার করেন’ (সাজদাহ ৩২/৯)

এখানে মানব সৃষ্টির ৭টি স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। স্তরগুলো হ’ল মাটির সারাংশ, বীর্য, জমাট রক্ত, গোশতপিন্ড, অস্থি পিঞ্জর, অস্থিতে গোশত দ্বারা আবৃতকরণ ও সৃষ্টির পূর্ণত্ব অর্থাৎ রূহ সঞ্চারণ।[6]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাতৃগর্ভে মানব শিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে এভাবে বলেছেন, إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِىْ بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا، ثُمَّ يَكُوْنُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَكُوْنُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللهُ مَلَكًا، فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ، وَيُقَالُ لَهُ اكْتُبْ عَمَلَهُ وَرِزْقَهُ وَأَجَلَهُ وَشَقِىٌّ أَوْ سَعِيْدٌ ثُمَّ يُنْفَخُ فِيْهِ الرُّوْحُ  ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিযিক্ব, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ সব লিপিবদ্ধ কর। অতঃপর তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয়’।[7]

অন্যত্র এসেছে, إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَكَّلَ بِالرَّحِمِ مَلَكًا يَقُولُ يَا رَبِّ نُطْفَةٌ، يَا رَبِّ عَلَقَةٌ، يَا رَبِّ مُضْغَةٌ. فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَقْضِىَ خَلْقَهُ قَالَ أَذَكَرٌ أَمْ أُنْثَى شَقِىٌّ أَمْ سَعِيْدٌ فَمَا الرِّزْقُ وَالأَجَلُ فَيُكْتَبُ فِىْ بَطْنِ أُمِّهِ ‘আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন, হে রব! এখনো তো ভ্রূণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিন্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান, তখন ফেরেশতাটি বলেন, হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে, পাপী না নেক্কার, রিযিক্ব কি পরিমাণ ও আয়ুষ্কাল কত হবে? অতএব এভাবে তার তাক্বদীর মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়’।[8] নারী ও পুরুষের বীর্যের সংমিশ্রণ ঘুরতে থাকে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর চতুর্দিকে একটি আবরণের সৃষ্টি হয়। যাতে করে ভ্রূণটি ধ্বংস হ’তে না পারে। এরপর আস্তে আস্তে এক বিন্দু রক্তকণায় পরিণত হয় এবং সেই রক্তকণা গোশতপিন্ডে ও অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়, এভাবেই সৃষ্টি হয় মানব শিশু।[9] মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃজঠরের তিনটি পর্দা বা স্তরের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। যথা- পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রূণের আবরণ বা ভ্রূণের ঝিল্লি গর্ভফুল (Placenta)।[10] এই তিন স্তর সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে’ (যুমার ৩৯/৬)

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কুরআনে যে, ‘ত্রিবিধ অন্ধকারের’ কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি অন্ধকার হ’ল- ১. রেহেম, ২. মাশীমা (المشيمة) বা গর্ভফুল এবং ৩. মায়ের পেট।[11] রেহেমে রক্তপিন্ড ব্যতীত সন্তানের আকার-আকৃতি কিছুই তৈরী হয় না। আর গর্ভফুল (Placenta)  ভ্রূণ বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখে। গর্ভফুল মায়ের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে নানা পুষ্টি ভ্রূণের দেহে বহন করে, খুব ধীর গতিতে রেচন পদার্থ মায়ের দেহের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। গর্ভফুলের সাহায্যে ভ্রূণ অক্সিজেন (O2) গ্রহণ ও কার্বনডাই অক্সাইড (CO2) ত্যাগ করে মায়ের ফুসফুসের মাধ্যমে, জীবাণু (Infection) থেকে ভ্রূণকে রক্ষা করে। এছাড়া  ভ্রূণটি ঠিকমত জরায়ুতে আটকে রাখা, পুষ্টি সঞ্চয়, সম্পর্ক রক্ষা, হর্মোন সৃষ্টি ইত্যাদি কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখে।[12] এভাবে ভ্রূণটি জরায়ুতে বেড়ে উঠতে থাকে ও ১২০ দিন অতিবাহিত হ’লে শিশুর রূহ ফুঁকে দেয়া হয়। আর শিশু নড়েচড়ে উঠে ও আঙ্গুল চুষতে থাকে[13]এবং পূর্ণ-পরিণত হওয়ার পরে সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেওয়া হয় (আবাসা ৮০/১৮-২০)। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ঠেলে দেয়া হয়’। অর্থাৎ ২১০ দিন পর একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হবার উপযুক্ত হয়। আর সন্তানটির যখন ভূমিষ্ঠ হবার উপযুক্ত সময় হয়ে যায়, তখন Overy-Placenta থেকে এক প্রকার গ্রন্থিরস নিঃসৃত হয়, যা প্রসব পথ পিচ্ছিল ও জরায়ুর মুখ ঢিলা করে দেয়। আর মানব সন্তান ঐ সময় বিভিন্নভাবে নড়াচড়া করতে থাকে এবং প্রসব পথ পিচ্ছিল থাকায় বাচ্চা অনায়াসে বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে মজার কথা হ’ল মানবশিশুর যে অঙ্গ সর্বপ্রথম গঠিত হয় তা হ’ল কর্ণ। আর সন্তান গর্ভে ধারণের ২১০ দিন পর চক্ষু গঠিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়।

পুত্র-কন্যা সন্তান সৃষ্টির রহস্য :

নারীর গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পর ২৮০ দিনের মধ্যে ১২০ দিন অতিবাহিত হ’লে পুত্র না কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন,لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُوْرَ، أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيْمًا إِنَّهُ عَلِيْمٌ قَدِيْر-ٌ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের পুত্র-কন্যা উভয় দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল’ (শূরা ৪২/৪৯-৫০)। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করলে পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আবার স্ত্রীর বীর্য পুরুষের বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করলে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়’।[14]

আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, জরায়ুতে যদি কন্যা  ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তাহ’লে করটেক্স কম্পোন্যান্টগুলি (Cortics Componant) বৃদ্ধি প্রাপ্ত হ’তে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলি (Medullar Componant) কমতে থাকে। পক্ষান্তরে জরায়ুতে যদি পুত্র  ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তাহ’লে করটেক্স কম্পোন্যান্টগুলি (Cortics Componant) কমতে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলি (Medullar Componant) বৃদ্ধি প্রাপ্ত হ’তে থাকে।[15] তাছাড়া মানুষের প্রতিটি দেহকোষে মোট ২৩ জোড়া ক্রমোজম থাকে। তন্মধ্যে ২২ জোড়া অটোজম এবং এক জোড়া সেক্স (Sex) ক্রমোজম। নারীর ডিম্বাণুতে XX ক্রমোজোম এবং পুরুষের শুক্রাণুতে XY ক্রমোজম থাকে। সুতরাং নারীর ডিম্বাণুর X ক্রমোজমকে যদি পুরুষেরশুক্রাণুর X ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে XX এবং কন্যা সন্তানের জন্ম হবে। পক্ষান্তরে নারীর ডিম্বাণুর X ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর Y ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে XY এবং পুত্র সন্তান জন্ম হবে।[16]

মোদ্দাকথা, যখন ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর জাইগোটের ক্রমোজম একই গোত্রীয় (XX) হয়, তখন কন্যা সন্তান এবং যখন ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর জাইগোটের ক্রমোজম একই গোত্রীয় (XY) না হয়, তখন পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।[17] অতএব সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ নির্ভর করে পুরুষের দেহে উৎপন্ন শুক্রাণুর উপর। আর যমজ সন্তান জন্ম দানের জন্য সবচেয়ে বেশী ভূমিকা স্ত্রীর। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নারীর ডিম্বাশয় থেকে যখন একটি ডিম্বাণু জরায়ুতে নেমে আসে, তখন একটি শক্তিশালী শুক্রাণু তাতে প্রবেশ করে একটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু যদি দু’টি ডিম্বাণু জরায়ুতে নেমে আসে, তখন দু’টি শক্তিশালী শুক্রাণু তাতে আলাদা আলাদা প্রবেশ করে। ফলে যমজ সন্তানের জন্ম হয়।[18] আবার সন্তানের আকৃতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পুরুষ যখন স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্য প্রথমে স্খলিত হয়, তাহ’লে সন্তান পিতার আকৃতি পায়। পক্ষান্তরে যদি স্ত্রীর বীর্য প্রথমে স্খলিত হয়, তাহ’লে সন্তান মায়ের আকৃতি লাভ করে’।[19] এভাবেই সন্তান সৃষ্টির গূঢ় রহস্য বেরিয়ে এসেছে।

শেষ কথা :

মহান আল্লাহ তা‘আলা সুনিপুন করে সুন্দর আকৃতিতে মনোরম কাঠামোতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন গবেষণা করে আল্লাহর সৃষ্টির গূঢ় রহস্য উদঘাটন করে চলেছে। এই সব চাঞ্চল্যকর তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণ কর’ (হাশর ৫৯/২)। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে মানুষ সৃষ্টির চেয়ে মহাকাশ সৃষ্টিকে অতীব বিস্ময়কর মনে করেছেন। দিন দিন নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কারে বিস্মিত হয়েছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না’ (মুমিন ৪০/৫৭)। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার অনুমতি আছে। আমাদের সকলের উচিত আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করতঃ তাঁর (আললাহর) মহত্ত্ব ঘোষণা করা। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য উদ্ধার করছেন। অথচ অনেক আগেই এই তথ্য মানব কল্যাণে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। বলা যেতে পারে, কুরআনই এক সুশৃংখল কল্যাণকর অকৃত্রিম বিস্ময়কর এলাহী বিজ্ঞান এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বকালের যুগশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তা উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন-আমীন!!


[1].
আল-কুরআন,
(ঢাকা : ইসলামিক
ফাউন্ডেশন, ৪২তম মুদ্রণ, অক্টোবর ২০১০), টীকা নং ১০৭৭, পৃঃ ৫১৫।  

[2].
বুখারী হা/৩০৮৫;
কিতাবুল আম্বিয়া’;
রিয়াযুছ্ ছলেহীন
হা/২৭৩; 
মুত্তাফাক্ব আলাইহ্, মিশকাত হা/৩২৩৮ ‘বিবাহ’ অধ্যায়

[3].
গাইনিকলজি শিক্ষা,
পৃঃ ২২

[4].
মাসিক আত-তাহরীক,
১৫তম বর্ষ,
১ম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১১, বিজ্ঞান ও বিস্ময়, পৃঃ ৪৩

[5].
গাইনিকলজি শিক্ষা,
পৃঃ ১৫

[6].
তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন,
পৃঃ ৯১৪

[7].
বুখারী হা/২৯৬৮,
৩০৮৬; মুত্তাফাক্ব আলাইহ্, মিশকাত, হা/৮৬

[8].
বুখারী, হা/৩০৮৭ ‘কিতাবুল আম্বিয়া’।  

[9].
মুহাম্মাদ নূরুল
ইসলাম, 
বিজ্ঞান না কুরআন, পৃঃ ১০৯-১১০

[10].
বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান,
পৃঃ ২৭৭, ১নং টীকা
দ্রষ্টব্য

[11].
তাফসীর ইবনে কাছীর,
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য

[12].
গাইনিকলজি শিক্ষা,
পৃঃ ৮।  

[13].
নবীদের কাহিনী,
১/২৫ পৃঃ

[14].
মুসলিম, মিশকাত হা/৪৩৪।

[15].
গাইনিকলজি শিক্ষা,  পৃঃ ৪১।

[16].
মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান, জীব কোষের গঠন ও প্রকৃতি অধ্যায়, (ঢাকা : নব পুথিঘর প্রকাশনী), পৃঃ ১৬১।

[17].
J.N.Ghoshal, Anatomy Physcolosy, (Calcata print) P. 479.

[18].
গাইনিকলজি শিক্ষা, পৃঃ ১৫।

[19].
বুখারী, হা/৩০৮৩ ‘কিতাবুল আম্বিয়া’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top