যে সমস্ত ব্যাপারে গীবত করা জায়েয

গীবত করা সাধারণভাবে হারাম হলেও কিছু ক্ষেত্রে গীবত করা কোন সময় জায়েয, আবার কোন সময় ওয়াজিবও হয়ে যায়।
১। মাযলুম ব্যক্তির জন্য গীবত করা জায়েযঃ এটা কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “ কারো ব্যাপারে কোন খারাপ কথা প্রকাশ করা মহান আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যে নির্যাতিত তাঁর কথা ভিন্ন। আর আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুই শুনেন ও সব কিছুই জানেন ”
(সুরা নিসা, আয়াত-১৪৮)
২। পরিচয় দানকারীঃ অনেক সময় কোন ব্যক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে বাধ্য হয়ে তাঁর দোষ-গুণ মানুষের সামনে বলতে হয়। যেমন- বলা হয় অমুক অন্ধ হাফেয, অমুক খোঁড়া মানুষ। প্রয়োজনের তাকীদে পরিচয়ের জন্য কোন মানুষের এ ধরণের দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা জায়েয আছে। তবে শুধু পরিচয়ের জন্যেই এ ধরণের দোষ-ত্রুটি বলা যাবে। এ ছাড়া কোন প্রকারে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এ ভাবে বলা সম্পূর্ণ নিষেধ তথা হারাম হিসাবে গণ্য হবে। হাদীসে এসেছে, সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি একজন অন্ধ মানুষ ছিলেন। তিনি নামাযের আযান দিতেন না, যতক্ষণ না তাঁকে বলা হত, আপনি সকাল (ফজর) করে ফেলেছেন, আপনি সকাল (ফজর) করে ফেলেছেন। (সহীহুল বুখারী হা/ ৬১৭)
মুসলিম শরীফে এসেছে, “নাবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দুইজন মুয়াজ্জিন ছিল। একজন বিলাল (রাঃ) আর একজন অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)” (সহীহ মুসলিম হা/৩৮)। অত্র হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)-কে কেবলমাত্র পরিচিতির জন্যেই অন্ধ বলা হয়েছে।

৩। অপরকে নছীহত করাঃ কোন মানুষের কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে অন্য কোন চরিত্রহীন ও দুষ্ট লোকের অনিষ্ট বা ক্ষতি থেকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তাদের দোষ-গুণ মানুষের সামনে বলা জায়েয আছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ইসলাম ধর্ম উপদেশের উপর ভিত্তিশীল।(হাদীস বর্ণনাকারী তামীমুদ্দারী বলেন) আমরা বললাম, কাদের জন্য (এই উপদেশ)? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলমানদের ইমামের জন্য আর তাদের সাধারণ লোকদের জন্য”(সহীহ মুসলিম হা/ ১২) ।
৪। হাদীস যাচাই-বাছাই-এর ক্ষেত্রেঃ হাদীস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে মুহাদ্দেসীনদের আলোচনা-সমালোচনা করা- এটাও এক প্রকার বৈধ গীবতের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকার গীবত করা ওয়াজিব। আর এজন্যে কোন কোন মুহাদ্দিস বলতেন, আসুন আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে কিছুক্ষণ গীবত করি (হাদীস শাস্ত্রের গ্রন্থাদি দ্রঃ)। আল্লামা শাওকানী (রহ) বলেন, এই ধরণের সমালোচনা করা ওয়াজিব (দ্রঃ রফউর রী-বাহ ফী-মা ইয়াজুযূ ওয়ামা লা-ইয়াজুযূ মিনাল গী-বাহ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এই প্রকার সমালোচনা করেছেন।
নিম্নে এ বিষয়ের কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো। নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন লোক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন,
“আমার মনে হয় না যে, অমুক অমুক লোক আমাদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানে” (সহীহুল বুখারী হা/ ৬০৬৭)।
উম্মুল মু‘মিনীন আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এক ব্যক্তি আসার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, তাঁকে অনুমতি দাও। এ লোকটি তাঁর গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ লোক। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাথে খুব নরম ভাষা ব্যাবহার করলেন। তিনি বললেন, আয়েশা! নিশ্চয়ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি সেই, যাকে মানুষ পরিত্যাগ করেছে তাঁর ফাহেশা কথা ও কাজ থেকে বাঁচার জন্য। (সহীহুল বুখারী হা/ ৬০৫৬)
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রাহিঃ) বলেন, বিদ‘আতী নেতৃবৃন্দের মতই কুরআন ও হাদীসের বিরুদ্ধাচারণকারী ও ইবাদাতকারীগণের অবস্থা বর্ণনা করা এবং তাদের থেকে উম্মাতকে সতর্ক করা সর্বসম্মতিক্রমে ওয়াজিব। এমনকি ইমাম ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন ব্যক্তি রোযা রাখে, নামায পড়ে, ইতেকাফে বসে ইত্যাদি। ঐ ব্যক্তির এ সমস্ত ভাল কাজগুলি আপনার নিকট বেশী প্রিয়, নাকি এটা বেশী প্রিয় যে, সে বিদআতীদের সম্পর্কে কথা বলবে ও মানুষকে সতর্ক করবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, যদি সে নাময, রোযা, ও ইতেকাফ ইত্যাদি ইবাদাত-বন্দেগী করে তবে সেটা তাঁর জন্যেই হবে। কিন্তু যদি সে বিদআতীদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে তা সমস্ত মুসলিমদের স্বার্থে হবে। সুতরাং এটাই তাঁর চেয়ে উত্তমৃৃৃ(মাজমূউল ফাতাওয়া ২৮/২২১)
৫। প্রকাশ্য ফাসেকীতে লিপ্ত ব্যক্তির সমালোচনা করা জায়েযঃ এটা হারাম গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন- প্রকাশ্য মদখোর, ডাকাত, গুন্ডা এধরনের লোকদের সমালোচনা করতে কোন দোষ নেই। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিঃ) বলতেন, ফাসেক লোকের ক্ষেত্রে কোন গীবত নেই অর্থাৎ তাদের করা দোষের কিছু নয়। হাসান বসরী (রাহিঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, কোন বিদ‘আতীর ব্যাপারে সমালোচনা করলে যেমন কোন গীবত নেই, এমনিভাবে প্রকাশ্য ফাসেকীতে লিপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা করলেও তাতে কোন গীবত নেই। (ইমাম লালাকাঈ, শারহু উছূলে ইতেক্বাদে আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত ১/১৪০)
৬। ফাতাওয়া তলবকারী ও সুপরামর্শ দানকারীঃ ফাতাওয়া তলব করতে গিয়ে কারো দোষ-গুণ আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিলে, তাঁর জন্য ঐ সমালোচনা করা জায়েয। তবে নিয়ত খালেছ থাকতে হবে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণিত আছে যে, হিন্দা (রাঃ) নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দরবারে এসে অভিযোগ করে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আবূ সুফিয়ান(রাঃ) (স্বীয় স্বামী) একজন কৃপণ লোক, সে আমার ও আমার সন্তানদের জন্য যে পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য অর্থাৎ খরচ খরচার প্রয়োজন তা ঠিকমত আমাদেরকে দেয় না। এমতাবস্থায় আমি যদি তাঁকে না জানিয়ে তাঁর ধন-সম্পদ হতে কোন কিছু নিয়ে ফেলি, তাহলে কি আমার গোনাহ হবে? একথা শুনে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে বললেন, তোমার ও তোমার ছেলে মেয়েদের জন্য অতিরিক্ত যে জিনিসের প্রয়োজন হয়- ঠিক সে পরিমাণ জিনিস তুমি তোমার স্বামীর ধন-সম্পদ থেকে নিয়ে নিবে।
এমনিভাবে যদি কেউ কারো কাছে কারো সম্পর্কে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে কি না এ সম্পর্কে সুপরামর্শ চায় , তবে তাঁকে অবশ্যই তাঁর দোষ-গুণ বলে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যার নিকট পরামর্শ তলব করা হয়, সে একজন আমানতদার” (সহীহুল জামে হা/ ৬৭০০)।
নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে ফাতেমা বিনতু ক্বায়েস (রাঃ) বললেন, তাঁকে মু‘আবিয়া (রাঃ) ও আবূ জাহাম (রাঃ) বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে বললেন, মু‘আবিয়া (রাঃ) হলো ফকীর। তাঁর কোন ধন-সম্পদ নেই। আর আবূ জাহাম (রাঃ) এর বৈশিষ্ট্য হলো, সে কাঁধ থেকে লাঠি (মাটিতে) রাখে না অর্থাৎ স্ত্রীদেরকে সে অধিক মার-ধর করে। বরং তুমি উসামাকে (রাঃ) বিবাহ কর (সহীহ মুসলিম হা/১৪৮০)।
৭। শারঈ বিরোধ প্রতিরোধেঃ যে ব্যক্তি শরীয়াত বিরোধী অন্যায় কাজ সমাজ থেকে দূর করার জন্য ক্ষমতাশীল লোকদের নিকট হতে সাহায্য তলব করেঃ তাঁর জন্য প্রয়োজনে অন্যের গীবত করা জায়েয। যেমন কেউ কোন মহল্লার কোন মাস্তানের উৎপাতে বিপদগ্রস্ত। এমতাবস্থায় ঐ এলাকায় মাস্তানদের সকল তৎপরতা অর্থাৎ অন্যায়-অপকর্ম বন্ধের জন্যে থানায় গিয়ে তাদের পরিচয় ব্যক্ত করা জায়েয, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
মোট কথা স্বাভাবিকভাবে অন্যের গীবত করা হারাম হলেও উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলিতে গীবত করা জায়েয আছে।
তবে একথা সকলের জেনে রাখা উচিত যে, উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলিতে অন্যের গীবত করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ২ টি শর্ত রয়েছে।
১। নিয়ত খালেছ বা সঠিক হওয়া।
২। প্রয়োজন দেখা দেওয়া।
(আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম, ২৯০)।
অর্থাৎ নিয়তের মধ্যে যদি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা উদ্দেশ্য হয়, তবে তা গীবত বলে গণ্য হবে। বিনা প্রয়োজনে অন্যের কোন বিষয় নিয়ে সমালোচনা ও পর্যালোচনা করাও গীবতের ভিতর গণ্য হবে। অতএব আমাদের সকলের উপর অপরিহার্য কর্তব্য হবে জিহবাকে সংযত রাখা। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার প্রতি আর পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাঁর উচিত হবে এটাই- সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে”।
হিংসা কিংবা বিদ্বেষ নয়, সত্য জানার জন্য গীবত করুন। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন এবং হক্ব বুঝার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top