পাঁচ. মদ রিপু :
মদ হলো দম্ভ গর্ব, অহংকার, দর্প, মদ্য, প্রমত্ততা, বিহবলভাব ইত্যাদি। যে কোন ধর্মীয় বিধানে মদের কোন স্থান নেই; সে দম্ভ বা মদ্য যাই হোক। মদ মানুষকে তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বিকৃত করে দেয়। তার আসল রূপটি লোপ পায়। মদান্ধ মানুষদের অধিকাংশই আত্মশ্লাঘায় ভোগে। এ আত্মশ্লাঘায় বা আত্মম্ভরিতা তার নিজের মধ্যে নিহিত আত্মবোধ বা আত্মদৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে পৃথিবীর সবকিছুই তুচ্ছ মনে করে ধরাকে সরাজ্ঞান করে থাকে। জীবনের অর্জিত বা সঞ্চিত যাবতীয় সম্পদকে সে এক ফুৎকারে ধ্বংস করে দিতে পারে।
প্রবাদে আছে, ‘অহংকার পতনের মূল’। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ অনেক সাধনা করে, ত্যাগ-তিতিক্ষা করে যা কিছু অর্জন করে তা সে অহংকারের কারণে ধরে রাখতে পারে না। তার অহংকার ধীরে ধীরে তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। মদান্ধ মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য খুব বেশী পীড়াপীড়ি করে থাকে। সর্বত্রই চায় তার সর্বোচ্চ সাফল্য এবং তাতে আত্মঅহংকারে স্ফীত হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করার প্রাণান্ত চেষ্টায় বিভোর-বিহবল হয়ে পড়ে। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি তো পায়ই না; উপরন্তু হীন ও ক্ষুদ্র বলেই স্বীকৃতি পায়। এতে তার যে স্পর্ধার বিকাশ ঘটে তা তাকে নগ্ন, নির্লজ্জ ও বেসামাল করে তুলে। আর তখনই তার অনিবার্য পতন হয়ে থাকে।
গর্ব-অহংকার যেমনি মানব জীবনকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে তেমনি বিনয়, ভদ্রতা-নম্রতা মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণে সাহায্য করে। সর্বপ্রথম অহংকার করেছিল ইবলীস শয়তান। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ ‘আর যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অসবীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’(বাক্বারাহ ২/৩৪)। ইবলীস ঐ সময় নিজের পক্ষে যুক্তি পেশ করে বলল, ‘আমি ওর চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে’। আল্লাহ বললেন, তুই বের হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত, তোর উপরে
আমার অভিশাপ রইল পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬-৭৮; আ‘রাফ ৭/১২)।
ক. অহংকারের নিদর্শন সমূহ : যে অহংকারী সে অভিশপ্ত, নীচুতম ব্যক্তি ও সম্মান বিভ্রাট ধিক্কার পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি। মহান আল্লাহ তাকে (শয়তানকে) বললেন, তুমি নেমে যাও এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাও। তুমি নীচুতমদের অন্তর্ভুক্ত। এখানে তোমার অহংকার করার অধিকার নেই’ (আ‘রাফ ৭/১৩)।
অহংকারী দাম্ভিক ব্যক্তিকে যেমন কেউ পসন্দ করে না, তেমনি তাকে আল্লাহর ভালবাসেন না। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ ‘যমীনে গর্বভরে চল না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন অহংকারী দাম্ভিককে ভালবাসেন না’ (লোক্বমান ১৮)।
অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَيَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِّنْ كِبْرٍ. ‘যার অন্তরে বিন্দুমাত্র অহংকার থাকে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’।[1] নিম্নে দাম্ভিকদেও কিছু নিদর্শন উল্লেখ করা হ’ল।
১. দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা : এটি করা হয়ে থাকে মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থের নিরিখে। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, ‘অহংকার হ’ল ‘সত্যকে দম্ভের সাথে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[2]
২. নিজেকে অন্যের চাইতে বড় মনে করা : যেমন ইবলীস আদমের চাইতে নিজেকে বড় মনে করেছিল এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। সে যুক্তি দিয়েছিল, أَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِيناً ‘আমি কি তাকে সিজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? (ইসরা ১৭/৬১)।
৩. অন্যের আনুগত্য ও সেবা করাকে নিজের জন্য অপমানজনক মনে করা : এই প্রকৃতির লোকেরা মনে করে সবাই আমার আনুগত্য ও সেবা করবে, আমি কারো আনুগত্য করব না। এরা ইহকালে অপদস্থ হয় এবং পরকালে জানণাত থেকে বঞ্চিত হবে মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا ‘পরকালের ঐ গৃহ আমরা তৈরী করেছি ঐসব লোকদের জন্য, যারা এ দুনিয়াতে উদ্ধত হয় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
৪. নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করা : আবু জাহল এরূপ অহংকার করেছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তার অভিজ্ঞ পরিষদবর্গ ও শক্তিশালী জনবলের ভয় দেখিয়েছিল। জবাবে আল্লাহ বলেছিলেন, فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ، سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ ‘ডাকুক সে তার পরিষদবর্গকে’। ‘অচিরেই আমরা ডাকব আযাবের ফেরেশতাদেরকে’ (‘আলাক্ব ৯৬/১৭-১৮)। পরিণতি কি হয়েছিল, সবার জানা। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, كَلاَّ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى، أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى ‘কখনই না। মানুষ অবশ্যই সীমালংঘন করে’। ‘কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-৭)। আল্লাহ একেক জনকে একেক মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াতে সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রত্যেক মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কেউ অভাবমুক্ত নয়। তাই মানুষের জন্য অহংকার শোভা পায় না। আল্লাহ কেবল ‘মুতাকাবিবর’ (অহংকারী)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন আল্লাহ বলেন, الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِيْ ‘অহংকার’ আমার চাদর এবং ‘বড়ত্ব’ আমার পরিধেয়। অতএব যে ব্যক্তি ঐ দু’টির কোন একটি আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য টানাটানি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব’।[3]
৫. লোকদের কাছে বড়ত্ব যাহির করা ও নিজের ক্রটি ঢেকে রাখা : মূসা (আঃ) যখন ফেরাঊনকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর নিদর্শন দেখালেন, তখন ফেরাঊন ভীত হ’ল। কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢেকে রেখে সে তার লোকদের জমা করল। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বলল,أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى- فَأَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْآخِرَةِ وَالْأُولَى ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’। ‘ফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৩-২৪)। এরূপ নিজের দোষ স্বীকার করা দৃষ্টান্ত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে এসেছে। তিনি তাঁর পিছনে অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, لَوْ تَعْلَمُونَ ذُنُوبِي مَا وَطِئَ عَقِبِي رَجُلاَنِ وَلَحَثَيْتُمْ عَلَى رَأْسِي التُّرَابَ، وَلَوَدِدْتُ أَنَّ اللهَ غَفَرَ لِي ذَنْبًا مِنْ ذُنُوبِي– ‘আমার যে কত পাপ রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’লে দু’জন লোকও আমার পিছনে হাঁটতে না এবং অবশ্যই তোমরা আমার মাথায় মাটি ছুঁড়ে মারতে। আমি চাই আল্লাহ আমার গোনাহসমূহ মাফ করুন’।[4]
৬. অন্যকে নিজের তুলনায় ছোট মনে করা : মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন তাওহীদের দাওয়াত দিলেন তখন ফেরাঊন বলেছিল, فَقَالُوا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ ‘আমরা কি এমন দু’ব্যক্তির উপরে বিশ্বাস স্থাপন করব যারা আমাদেরই মত মানুষ এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’? (মুমিনূন ২৩/৪৭)। অন্যকে হেয় গণ্যকারী ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তারা ঐসব দুর্বল শ্রেণীর লোকদের পায়ের নীচে থাকবে। এটি হবে তাদেরকে দুনিয়ায় হেয় জ্ঞান করার বদলা স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِى صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِى جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُولَسَ تَعْلُوهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ الْخَبَالِ ‘অহংকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের চেহারা বিশিষ্ট পিঁপড়া সদৃশ। সর্বত্র লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের ‘বূলাস’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদেরকে ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামীদের পোড়া দেহের গলিত পুঁজ-রক্তে পূর্ণ ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক নদী থেকে পান করবে।[5]
একদিন ছাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ) নিগ্রো মুক্তদাস বেলাল (রাঃ)-কে তার কালো মায়ের দিকে সম্বন্ধ করে কিছু বললে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন, يَا أَبَا ذَرٍّ أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ ‘হে আবু যর! তুমি তাকে তার মায়ের নামে তাচ্ছিল্য করলে? তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে’।[6] আবু যর গিফারীর ন্যায় একজন নিরহংকার, বিনয়ী ছাহাবীর একদিনের একটি সাময়িক অহংকারকেও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বরদাশত করেননি।
৭. মানুষের সাথে অসদ্ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি কঠোর হওয়া : এটি অহংকারের অন্যতম লক্ষণ। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হ’ল। তিনি বললেন, তোমরা ওকে অনুমতি দাও। সে তার গোত্রের কতই না মন্দ ভাই ও কতই না মন্দ পুত্র! অতঃপর যখন লোকটি প্রবেশ করল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সাথে অতীব নম্রভাবে কথা বললেন। পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলেন। আবার সুন্দর আচরণ করলেন, ব্যাপারটা কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আয়েশা! إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْ تَرَكَهُ النَّاسُ اتِّقَاءَ فُحْشِهِ ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি যাকে লোকেরা পরিত্যাগ করে ও ছেড়ে যায় তার ফাহেশা কথার ভয়ে’।[7]
৮. শক্তি বা বুদ্ধির জোরে অন্যের হক নষ্ট করা : এটি অহংকারের একটি বড় নিদর্শন। আল্লাহ কাউকে বড় করলে সে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন ও যিনি তাকে বড় করেছেন সেই বান্দা ও আল্লাহকে সে ভুলে যায়। সে এই কথা ভেবে অহংকারী হয় যে, আমি আমার যোগ্যতা বলেই বড় হয়েছি। ফলে সে আর অন্যকে সম্মান করে না। সে তখন শক্তির জোরে বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্যের হক নষ্ট করে। এই হক সম্মানের হ’তে পারে বা মাল-সম্পদের হ’তে পারে। অন্যায়ভাবে কারো সম্মানের হানি করলে ক্বিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তিকে পিঁপড়া সদৃশ করে লাঞ্ছনাকর অবস্থায় হাঁটানো হবে।[8] অথবা তাকে ঐ মাল-সম্পদ ও মাটির বিশাল বোঝা মাথায় বহন করে হাঁটতে বাধ্য করা হবে’।[9]
৯. অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা ও তাদেরকে নিকৃষ্টভাবে খাটানো : অহংকারী মালিকেরা তাদের অধীনস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতি এরূপ আচরণ করে থাকে। যা তাদের জাহান্নামী হবার বাস্তব নিদর্শন। এই স্বভাবের লোকেরা এভাবে প্রতিনিয়ত ‘হাক্কুল ইবাদ’ নষ্ট করে থাকে। আর বান্দা ক্ষমা না করলে এ হক আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ ‘তুমি মযলূমের দো‘আ থেকে বেঁচে থাক। কেননা মযলূমের দো‘আ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই (অর্থাৎ সাথে সাথে কবুল হয়ে যায়)’।[10] الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যুলুম কিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে’[11] তিনি একদিন বলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? সবাই বলল, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সে-ই ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত নিয়ে হাযির হবে। অতঃপর লোকেরা এসে অভিযোগ করে বলবে যে, তাকে ঐ ব্যক্তি গালি দিয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, তার মাল গ্রাস করেছে, হত্যা করেছে, প্রহার করেছে। অতঃপর তার নেকী থেকে তাদের একে একে বদলা দেওয়া হবে। এভাবে বদলা দেওয়া শেষ হবার আগেই যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন বাদীদের পাপ থেকে নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[12] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই হকদারকে তার হক আদায় করে দেয়া হবে। এমনকি শিংওয়ালা ছাগল যদি শিংবিহীন ছাগলকে গুঁতো মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে, সেটারও বদলা নেওয়া হবে (মানুষকে ন্যায়বিচার দেখানোর জন্য)’।[13]
১০. মিথ্যা বা ভুলের উপর যিদ করা : এটি অহংকারের অন্যতম নিদর্শন। নবীগণ যখন লোকদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন, তখন তারা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করত এবং নিজেদের ভুল ও মিথ্যার উপরে যিদ করত। যদিও শয়তান তাদেরকে (এর মাধ্যমে) জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহবান করে (লোকমান ৩১/২১)।
কেবল কাফেরদের মধ্যে নয়, বরং মুসলমানদের মধ্যেও উক্ত দোষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন শিরক ও বিদ‘আতে অভ্যস্ত লোকেরা বিভিন্ন অজুহাতে উক্ত পাপের উপর টিকে থাকে। অমনিভাবে বিচারক ও শাসক শ্রেণী তাদের ভুল ‘রায়’ থেকে ফিরে আসেন না। বরং একটি অন্যায় প্রবাদ চালু আছে যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। অথচ মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। খলীফা ওমর (রাঃ) যখন আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে কূফার গর্ভণর করে পাঠান, তখন তাকে লিখে দেন যে, তুমি গতকাল কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকলে সেখান থেকে ফিরে আসতে কোন বস্ত্ত যেন তোমাকে বাধা না দেয়। কেননা الرُّجُوعُ إِلىَ الْحَقِّ خَيْرٌ مِنَ التَّمَادِى فِى الْبَاطِلِ ‘মিথ্যার উপরে টিকে থাকার চাইতে সত্যের দিকে ফিরে আসা অধিক উত্তম’।[14]
খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৯৯-১০১ হিঃ) বলতেন, مَا مِنْ كِتَابٍ أَيْسَرُ عَلَىَّ رَدًّا مِنْ كِتَابٍ قَضَيْتُ بِهِ ثُمَّ أَبْصَرْتُ أَنَّ الْحَقَّ فِى غَيْرِهِ فَفَسَخْتُهُ ‘আমি সিদ্ধান্ত দিয়েছি এমন কোন বিষয় বাতিল করা আমার নিকটে সবচেয়ে সহজ, যখন আমি দেখি যে তার বিপরীতটাই সত্য।[15] আব্দুর রহমান বিন মাহদী (৩৫-১৯৮ হিঃ) বলেন, আমরা এক জানাযায় ছিলাম। যেখানে ওবায়দুল্লাহ বিন হাসান উপস্থিত ছিলেন, যিনি তখন রাজধানী বাগদাদের বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। আমি তাঁকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি ভুল উত্তর দেন। তখন আমি বললাম, أصلحك الله، القول في هذه المسألة كذا وكذا ‘আল্লাহ আপনাকে সংশোধন হওয়ার তাওফীক দিন! এ মাসআলার সঠিক উত্তর হ’ল এই, এই। তখন তিনি কিছুক্ষণ দৃষ্টি অবনত রাখেন। অতঃপর মাথা উঁচু করে দু’বার বলেন, إذًا أرجع وأنا صاغر ‘এখন আমি প্রত্যাবর্তন করলাম এবং আমি লজ্জিত’। অতঃপর বললেন, لأن أكون ذنبا في الحق أحب إلي من أن أكون رأسا في الباطل ‘ভুল স্বীকার করে হক-এর পুচ্ছধারী হওয়া আমার নিকট অধিক প্রিয় বাতিলের শিরোমনী হওয়ার চাইতে’।[16]
খ. অহংকার পতনের মূল : অহংকার পতনের মূল। গর্ব-অহংকার যেমনি মানব জীবনকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। সর্বপ্রথম ইবলীস আল্লাহর সামনে অহংকার করেছিল। মহান আল্লাহ বলেন, وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ أَبَى ‘সে (ইবলীস) নির্দেশ পালন করতে অসবীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (বাকারাহ ২/৩৪)। আর এভাবেই সর্বপ্রথম পতন ঘটে অভিশপ্ত ইবলীসের। মহান আল্লাহ বলেন, আল্লা্হ তাকে বলেন, فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ ‘বের হয়ে যাও এখান থেকে। কেননা তুমি অভিশপ্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)। অহংকারী দাম্ভিক ব্যক্তিকে যেমন কেউ পসন্দ করে না, তেমনি তাকে আল্লাহ ভালবাসেন না। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ ‘যমীনে গর্বভরে চল না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন অহংকারী দাম্ভিককে ভালবাসেন না’ (লোক্বমান ১৮)। যমীনে দাম্ভিকতার সাথে চলাফেরার পরিণাম অতীব করুন। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ النَّبِىَّ بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِى فِىْ حُلَّةٍ، تُعْجِبُهُ نَفْسُهُ مُرَجِّلٌ جُمَّتَهُ، إِذْ خَسَفَ اللهُ بِهِ، فَهْوَ يَتَجَلَّلُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ.হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘(অতীত কালে) কোন এক ব্যক্তি মূল্যবান পোশাক পরিধান করে আত্মম্ভরিতার সাথে হেঁটে যাচ্ছিল। এতে সে নিজেকে খুবই আনন্দিত ও গর্বিত অনুভব করছিল। সে মাথায় সিঁথি কেটে ও চাল-চলনে অহংকারী ভাব প্রকাশ করে চলছিল। হঠাৎ আল্লাহ তাকে ধসিয়ে দিলেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত সে যমীনের নিচে ধসে যেতে থাকবে’। [17]
অহংকার কুফরীর প্রধান উৎস। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, فالكفر من الْكبر والمعاصي من الْحِرْص وَالْبَغي وَالظُّلم من الْحَسَد কুফরীর মূল উৎস হ’ল ‘অহংকার’। পাপকর্মের উৎস হ’ল ‘লোভ’। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হ’ল ‘হিংসা’।[18] অহংকার অত্যন্ত মন্দ বিষয় যা শিরকের চেয়েও জঘন্য। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক আল্লাহর ইবাদত করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।[19]
গ. অহংকারী জান্নাতে যাবে না : মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত কেহ জান্নাতে যেতে পারবে না। কারণ মুমিন ব্যক্তি সরল, বিনয়ী ও ভদ্র। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি হয় সরল ও ভদ্র। পক্ষান্তরে পাপী ব্যক্তি হয় ধূর্ত ও চরিত্রহীন’।[20] যারা অহংকার করে তাদেরকে আল্লাহ সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বিমুখ রাখেন। মহান আল্লাহ বলেন, سَاَصْرِفُ عَنْ اٰیٰتِیَ الَّذِیْنَ یَتَكَبَّرُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ ‘পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে, তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব’ (আ‘রাফ ৭/১৪৬)।
তাছাড়া ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারীরা জান্নাতে যাবে না। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল দুর্বল এবং যাদেরকে লোকেরা দুর্বল ভাবে। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল বাতিল কথার উপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী’।[21]
দম্ভভরে সত্যকে অস্বীকারকারী এবং অন্যকে তুচ্ছকারী জান্নাতে যাবে না। হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُوْنَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ إِنَّ اللهَ جَمِيْلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যার অন্তরে অনু পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল, কোন ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার কাপড়টা সুন্দর হোক, জুতাটা মনোরম হোক। তিনি বললেন, মহান আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যই পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করা ও লোকদের তুচ্ছ মনে করা’।[22] অন্যত্র তিনি বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَحَدٌ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرِيَاءَ ‘যার অন্তরে সরিষাদানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[23] মানুষের যত প্রকার ক্রটি আছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় ত্রুটি হ’ল আত্মগর্ব করা। আর এটা যখন কারো মধ্যে জাগ্রত হয়, তখন সে নিজেকে খুব বড় জ্ঞানী ও গুণসম্পন্ন মনে করে ও অন্যরা তাকে সর্বাপেক্ষা বড় জ্ঞানী ও যোগ্য মনে করুক এটা প্রত্যাশা করে।
ঘ. অহংকারের পরিণতি জাহান্নাম : অহংকারের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রকার হ’ল ইলমের অহংকার। কেননা তার ইলম তার কোন কাজে আসেনা। যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য জ্ঞানার্জন করে, জ্ঞান তার অহংকারকে চূর্ণ করে দেয় এবং তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। যে নিজেকে হীন মনে করে এবং সর্বদা নিজের হিসাব নিয়ে সন্ত্রস্থ থাকে। একটু উদাসীন হ’লেই ভাবে এই বুঝি ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হ’লাম ও ধ্বংস হয়ে গেলাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম শিখে গর্ব করার জন্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য, সে অন্যের উপর অহংকার করে ও তাদেরকে হীন মনে করে। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে বড় অহংকার (أَكْبَرُ الْكِبْر)। আর ঐ ব্যক্তি কখনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তর কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। লা হাওলা অলা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’।[24]
কুরআনে জাহান্নামীদের প্রধান দোষ হিসাবে তাদের অহংকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا … قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ– ‘কাফিরদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে’… ‘তখন তাদেরকে বলা হবে তোমরা জাহান্নামের দরজা সমূহে প্রবেশ কর সেখানে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য। অতএব অহংকারীদের বাসস্থান কতই না নিকৃষ্ট’ (যুমার ৩৯/৭১-৭২)। অন্যত্র বলেন, فَادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَلَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ ‘অতএব তোমরা জাহান্নামে দরজা সমূহ দিয়ে প্রবেশ কর, এতেই চিরস্থায়ীভাবে বসবাস কর। দেখ, অহংকারীদের আবাসস্থল কতই নিকৃষ্ট’ (নাহল ১৬/২৯)।
অহংকার হলো আল্লাহর চাদর। আর তা নিয়ে টানাহেঁচড়া করলে সেই ব্যক্তির পরিণাম জাহান্নাম। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ وَأَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالاَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ يَقُوْلُ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ الْعِزُّ إِزَارُهُ وَالْكِبْرِيَاءُ رِدَاؤُهُ فَمَنْ يُنَازِعُنِى عَذَّبْتُهُ. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ও হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তাঁরা বলেন, রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, মহা সম্মানিত প্রতাপশালী আল্লাহ বলেছেন, ‘মাহাত্ম্য হচ্ছে তার লুঙ্গী, আর অহংকার তার চাদর। যে ব্যক্তি এ দু’টির যে কোন একটিতেও আমার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, তাকে আমি শাস্তি প্রদান করব’।[25]
ঙ. অহংকার থেকে বেঁচে থাকুন : অহংকার দূরীকরণের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং অহংকার থেকে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের পার্থিব অবস্থানের কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে। নতুবা শয়তানের প্ররোচনায় পদচ্যুত হয়ে যেতে পারি। সুতরাং আমাদের মধ্যে জন্ম, মৃত্যু ও আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার অনুভূতি তৈরী হ’লে কোনভাবেই দাম্ভিকতা প্রশ্রয় পাবে না ইনশাআল্লাহ।
প্রথমেই নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে যে, প্রাণহীন শুক্রাণু থেকে সে জীবন পেয়েছে। আবার সে মারা যাবে। অতএব তার কোন অহংকার নেই।
অতঃপর আল্লাহ সম্পর্কে জানবে যে, তিনিই তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। তিনিই তাকে শক্তি দিয়ে মেধা দিয়ে পূর্ণ-পরিণত মানুষে পরিণত করেছেন। তাঁর দয়াতেই তার সবকিছু। অতএব প্রতি পদে পদে আল্লাহর দাসত্ব ব্যতীত তার কিছুই করার নেই। আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ ‘আমি জিন ও ইনসান সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার দাসত্ব করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। ‘মানুষ তার জন্মের সময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না’ (দাহর ৭৬/১)। অতএব নিজেকে সর্বদা আল্লাহর দাস মনে করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার দূর করার প্রধান ঔষধ’।[26]
একটি নির্দিষ্ট হায়াত শেষে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তরে অবস্থান করি না কেন এই চিরন্তন সত্য থেকে রক্ষা পেতে পারি না। মরতে হবেই একদিন। মহান আল্লাহ বলেন, أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ ‘যেখানেই তোমরা থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে গ্রাস করবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর’ (নিসা ৪/৭৮)। তিনি আরো বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ- وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ- قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ ‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি একটি শুক্রাণু হ’তে? অথচ সে এখন হয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে বিতর্ককারী’। ‘মানুষ আমাদের সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়। আর বলে, কে এই পচা-গলা হাড়-হাড্ডিকে পুনর্জীবিত করবে’? ‘তুমি বলে দাও, ওকে পুনর্জীবিত করবেন তিনি, যিনি ওটাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। বস্ত্ততঃ তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৯)।
আমরা যদি মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করি তবে আমাদের মিথ্যে অহংকার হৃদয়ে স্থান পেতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِى الْمَوْتَ ‘তোমরা স্বাদ ধ্বংসকারী বস্ত্তকে বেশী বেশী স্মরণ কর’ অর্থাৎ মৃত্যুকে’।[27]
ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন, اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا ‘তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট’ (ইসরা ১৭/১৪)। আল্লাহ মানুষের হায়াত ও মঊত সৃষ্টি করেছেন, কে তাদের মধ্যে সুন্দরতম আমল করে, সেটা পরীক্ষা করার জন্য’ (মুলক ৬৭/২)।
অহংকার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করা সর্বোত্তম পন্থা। নিরহংকার হ’তে চাইলে নিম্নের দো‘আটি বেশী বেশী পাঠ করা প্রয়োজন। اللهُ أَكْبَرُ كَبِيراً وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيراً وَسَبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ- অর্থ : আল্লাহ সর্বোচ্চ, আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা, সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর প্রশংসাসহ আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা। আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হ’তে এবং তার প্ররোচনা, তার ফুঁক ও তার কুমন্ত্রণা হ’তে। উক্ত হাদীছে نَفْخُهُ বা ‘শয়তানের ফুঁক’-এর অর্থ সম্পর্কে রাবী ‘আমর বিন মুর্রা বলেন, সেটা হ’ল الْكِبْرُ অর্থাৎ ‘অহংকার’।[28]
পরিশেষে বলব, বান্দার অহংকার করার মত কোন কিছুই নেই। কারণ অহংকার সেই করবে যিনি অবিনশ্বর, কিন্তু মানুষ যে নশ্বর। স্রষ্টার চাদর নিয়ে সৃষ্টির টানাটানি করা উচিৎ নয়। জীবনে সুখী ও সুন্দর জীবন যাপন করতে চাইলে সর্বদা আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করতে হবে। তাছাড়া নিচের দিকে লক্ষ্য করলে নিজের অবস্থান সর্বদা পরিলক্ষিত হয়। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, انْظُرُوا إِلَى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ (যদি তুমি সুখী হতে চাও), তাহ’লে যে ব্যক্তি তোমার চেয়ে নীচু, তার দিকে তাকাও। কখনো উপরের দিকে তাকিয়ো না। তাহ’লে তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তুমি হীন মনে করবে না’।[29] অহংকার করার চেয়ে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত পরামর্শ।
ষড় রিপুর মধ্যে এই রিপুটি অতীব স্পর্শকাতর। কারণ অণু পরিমাণ এই রিপু কারো মধ্যে বিরাজ করলে অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে। সুতরাং অহংকার থেকে নিজেকে দূরে রাখি এবং সর্বদা কবরের কথা স্মরণ করি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক্ব দান করুন- আমীন।
(ক্রমশ)
[লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী]
[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৮।
[2]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮।
[3]. আবুদাঊদ হা/৪০৯০; মিশকাত হা/৫১১০ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।
[4]. হাকেম হা/৫৩৮২, সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী হা/১৮৬২, ২৪৯২; মিশকাত হা/৩৬৪৩, ৫১১২।
[6]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩০।
[7]. বুখারী হা/৬০৫৪; মুসলিম হা/২৫৯১; মিশকাত হা/৪৮২৯।
[8]. তিরমিযী হা/২৪৯২।
৯.আহমাদ, মিশকাত হা/২৯৫৯; ছহীহাহ হা/২৪২।
১০. বুখারী হা/১৩৯৫; মুসলিম হা/১৯; মিশকাত হা/১৭৭২।
১১. বুখারী হা/২৪৪৭, মুসলিম হা/২৫৭৯, মিশকাত হা/৫১২৩
১২. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭ ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ।
১৩. মুসলিম হা/২৫৮২; মিশকাত হা/৫১২৮।
১৪. দারাকুৎনী হা/৪৪২৫-২৬; বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ ১০/১১৪; বায়হাক্বী ১০/১১৯, হা/২০১৫৯।
১৫. বায়হাক্বী ১০/১১৯, হা/২০১৬০।
১৬. হিংসা ও অহংকার : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব (হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ : ২০১৪ খৃঃ), পৃঃ ৪০-৪৯।
১৭. বুখারী হা/৫৭৯৮।
১৮. হিংসা ও অহংকার, পৃষ্ঠা নং ৪০।
১৯. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ৩য় প্রকাশ ১৯৯৬ খৃঃ) ২/৩১৬।
২০. আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, মিশকাত হা/৫০৮৫।
২১. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ
মুসলিম হা/২৭৫।
২২. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৭।
২৪. যাহাবী, আল-কাবায়ির (বৈরূত : দারুন নদওয়াতুল জাদীদাহ পৃঃ ৭৮।
২৫. মুসলিম হা/৬৮৪৬; ছহীহ তারগীব ওয়াত-তারহীব হা/২৮৯৮।
২৬. হিংসা ও অহংকার, পৃষ্ঠা নং ৬৭।
২৭.তিরমিযী হা/২৩০৭, মিশকাত হা/১৬০৭।
২৮. ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৭৭৭; আলবানী, সনদ ছহীহ লিগাইরিহী।
২৯. বুখারী হা/৬৪৯০, মুসলিম হা/২৯৬৩, মিশকাত হা/৫২৪২।