দরসে হাদীস : ঈমানের সাথে সিয়াম সাধনা

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, «مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ. وَمَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ. وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ» ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় রামাযান মাসে সিয়াম পালন করবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় ’ইবাদাতে রাত কাটাবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় লায়লাতুল ক্বদরে ’ইবাদাতে কাটাবে তারও আগের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে’। (বুখারী হা/১৯১০, মুসলিম হা/৭৬০, মিশকাত হা/১৯৫৮)

ব্যাখ্যা: (مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا) ‘‘বিশ্বাসের সাথে সিয়াম পালন করে’’।

(১) ঈমানের সাথে অর্থাৎ- দুনিয়া ও আখেরাতের বিশ্বাসগত বিষয়ের প্রতি যত্নশীল এবং দৃঢ় চিত্তে তাক্বওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে নিজেকে সকল প্রকার মন্দ কর্ম থেকে বিরত/ফিরিয়ে রাখা। যেমন ইবনু কাছীর বলেন, তাক্বওয়ার মূল অর্থ হ’ল التوقي ما يكره  ‘অপসন্দনীয় বিষয় থেকে বেঁচে থাকা’। ছোট ও বড় সকল পাপ পরিত্যাগ করাকে তাক্বওয়া বলে। আর আল্লাহ তা’আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম  ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’(বাক্বারাহ ২/১৮৩)।

সিয়ামের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হল তাক্বওয়া, পরহেযগারী তথা আল্লাহভীরুতা অর্জন। আর আল্লাহভীরুতা মানুষের মন্দ কর্মবিমূখ করে এবং উত্তম আমলের মাধ্যমে চরিত্র ও কর্মকে সুন্দর করার জন্য মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। ভিন্ন অর্থে-

(২) ঈমানের সাথে অর্থাৎ- ঈমান বিনষ্ট হয় এহেন কর্ম থেকে নিজেকে ফিরিয়ে রেখে দৃঢ়তার সাথে এ বিশ্বাস রাখে যে, রামাযানের সিয়াম ইসলামের অন্যতম একটি রূকন এবং আল্লাহর বিধান হিসেবে তা পালন করা ফরয। এই রামাযানের সিয়াম তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন এই জন্য যে, প্রকৃত মুমিন বান্দাগণকে তাদের নিয়াত ও কর্মের মাধ্যমে গুণাহ ক্ষমাসহ জান্নাতুল রাইয়্যান প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করবেন, যা তিনি নিজ হাতে প্রদান করবেন। আর সিয়াম পালনকারী সায়েম সদা আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করে থাকেন যে, তিনিই একমাত্র ইলাহ, ক্ষমাকারী, দয়ালু, ন্যায় বিচারক ইত্যাদি।
এর পরেই বলা হয়েছে, (احْتِسَابًا) ‘‘সাওয়াবের আশায়’’, অর্থাৎ- এ কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে সে আল্লাহ তা‘আলার নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির আশা করে। মানুষের ভয়ে বা সিয়াম পালন না করলে লজ্জিত হতে হবে এমন আশংকা থেকে নয় অথবা সিয়াম পালনের মাধ্যমে সুখ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্য থাকে না। বরং ‘‘খালিস লিওয়াজহিল্লা-হ’’ অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, সিয়াম পালন করে।

 (غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَمَا تَأَخَّرَ) তার পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, তার সগীরাহ্ কাবীরাহ্ সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। তবে জমহূর ‘আলিমদের মতে শুধু সগীরাহ্ গুনাহ উদ্দেশ্য অর্থাৎ তার সকল প্রকার সগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। কেননা কাবীরা গুনাহ তাওবা ব্যতীত ক্ষমা করা হয় না। আর এ মাসে অধিকতর তাওবা করার ফুসরত মিলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এমাসে ক্ষমা ও রহমতের দরজা খুলে দেন। আর (وَمَا تَأَخَّرَ) ‘‘তার পরবর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়’’ হাদীসের এ অংশটুকু প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, ক্ষমা করা বিষয়টি কৃত অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত। যে অপরাধ এখনও সংঘটিত হয়নি তা ক্ষমা করা হয় কিভাবে?

এর জওয়াবে বলা যায়,

(১) তার গুনাহ সংঘটিত হয় ক্ষমাকৃত অবস্থায় অর্থাৎ তার দ্বারা কোন গুনাহ সংঘটিত হলে তা ক্ষমা করে দেয়া হবে।

(২) আল্লাহ তাকে ভবিষ্যতে গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে সংরক্ষণ করবেন। ফলে তার দ্বারা কোন কাবীরা গুনাহ সংঘটিত হবে না।

(قَامَ رَمَضَانَ) ‘‘রামাযানে কিয়াম করে’’ অর্থাৎ- রামাযানের পূর্ণরাত বা রাতের অধিকাংশ সময় সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ও যিকিরের মাধ্যমে অতিবাহিত করে।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য রামাযানের রাতে তারাবীহের সালাত আদায় করা। তারাবীহের সালাত দ্বারা قيام الليل (কিয়ামুল লায়ল)-এর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়। এর অর্থ এমন নয় যে, তারাবীহ ব্যতীত قيام الليل  হয় না।

(مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ) ‘‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে কিয়াম করে’’ অর্থাৎ- এ রাতে জেগে ‘ইবাদাত করে। চাই সে তা অবহিত হোক বা না হোক।

(غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه) ‘‘তার পূর্বের কৃতগুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়’’ অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির যদি সগীরা গুনাহ থেকে থাকে তবে তা মুছে ফেলা হয়। আর যদি তার কাবীরা গুনাহ থাকে তবে তা হালকা করে দেয়া হয়। তার যদি কোন গুনাহ না তাকে তবে জান্নাতে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

পরিশেষে, দৃঢ় ঈমান রেখে তাক্বওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে সিয়াম, কিয়াম ও শেষ দশকের বিজোড় রাত্রী তালাশ করবে আল্লাহ সেই বান্দার গুণাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর এর মাধ্যমে বান্দা মুত্তাক্বী হওয়ার সূযোগ পেয়ে থাকে। যার ফলে সিয়ামের মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়। আর এভাবেই কুপ্রবৃত্তি থেকে সুপ্রবৃত্তির প্রতিস্থাপন ঘটে মান চরিত্রে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top