আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) দিবসে মৃত্যুকে একটি ধূসর রঙের মেষের আকারে আনা হবে। তখন একজন সম্বোধনকারী ডাক দিয়ে বলবেন, হে জান্নাতবাসী! তখন তাঁরা ঘাড়-মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে। সম্বোধনকারী বলবে, তোমরা কি একে চিন? তারা বলবেন হ্যাঁ, এ হল মৃত্যু। কেননা সকলেই তাকে দেখেছে। তারপর সম্বোধনকারী আবার ডেকে বলবেন, হে জাহান্নামবাসী! জাহান্নামীরা মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে, তখন সম্বোধনকারী বলবে তোমরা কি একে চিন? তারা বলবে, হ্যাঁ, এ তো মৃত্যু। কেননা তারা সকলেই তাকে দেখেছে।
তারপর (সেটিকে) যবহ করা হবে। আর ঘোষক বলবেন, يَا أَهْلَ الْجَنَّةِ خُلُوْدٌ فَلَا مَوْتَ وَيَا أَهْلَ النَّارِ خُلُوْدٌ فَلَا مَوْتَ ‘হে জান্নাতবাসী! স্থায়ীভাবে (এখানে) থাক। তোমাদের আর কোন মৃত্যু নেই। আর হে জাহান্নামবাসী! চিরদিন (এখানে) থাক। তোমাদের আর মৃত্যু নেই’। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলেন- ’’তাদের সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিবস সম্বন্ধে, যখন সকল ফয়সালা হয়ে যাবে অথচ এখন তারা গাফিল, তারা অসতর্ক দুনিয়াবাসী-অবিশ্বাসী।’’(বুখারী হা/৪৭৩০)
ব্যাখ্যা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তাদেরকে যখনই ফলমূল খেতে দেয়া হবে, তখনই তারা বলবে, আমাদেরকে পূর্বে জীবিকা হিসেবে যা দেয়া হতো, এতো তারই মতো। একই রকম ফল তাদেরকে দেয়া হবে এবং সেখানে রয়েছে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিণী, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে’ (বাকারাহ ২/২৫)।
১. ‘জান্নাতের তলদেশে নদী প্রবাহিত’ বলে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, এর গাছের নীচ দিয়ে ও এর কামরাসমূহের নীচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, জান্নাতের নদী-নালাসমূহ মিশকের পাহাড় থেকে নির্গত। [সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭৪০৮] আনাস ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, ‘জান্নাতের নহরসমূহ খাদ হয়ে প্রবাহিত হবে না। [সহীহুত তারগীব] অন্য বর্ণনায় এসেছে, হাউজে কাউসারের দুই তীর লালা-মোতির গড়া বিরাট গম্বুজ বিশিষ্ট হবে। [বুখারী: ৬৫৮১] আর তার মাটি হবে মিশকের সুগন্ধে ভরপুর। তার পথে বিছানো কাঁকরগুলো হলো লাল-জহরত, পান্না-চুন্নি সদৃশ। [ইবনে কাসীর]
২. জান্নাতবাসীদেরকে একই আকৃতি বিশিষ্ট বিভিন্ন ফলমূল পরিবেশনের উদ্দেশ্য হবে পরিতৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চার। কোন কোন তাফসীরকারের মতে ফলমূল পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ জান্নাতের ফলাদি আকৃতিগতভাবে ইহজগতে প্রাপ্ত ফলের অনুরূপই হবে। সেগুলো যখন জান্নাতবাসীদের মধ্যে পরিবেশন করা হবে, তখন তারা বলে উঠবে, অনুরূপ ফল তো আমরা দুনিয়াতেও পেতাম। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। অপর কোন কোন তাফসীরকারকের মতে, ফলমূল পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ, জান্নাতে পরিবেশিত ফল-মূলাদি দেখে জান্নাতিগণ বলবে যে, এটা তো গতকালও আমাদের দেয়া হয়েছে, তখন জান্নাতের খাদেমগণ তাদের বলবে যে, দেখতে একই রকম হলেও এর স্বাদ ভিন্ন। ইবনে আব্বাস বলেন, দুনিয়ার ফলের সংগে আখেরাতের ফল-মূলের কোন তুলনাই চলবে না, শুধু নামের মিল থাকবে। [ইবনে কাসীর]
৩. মূল আরবী বাক্যে ازواج ‘আযওয়াজ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বহুবচন। এর এক বচন হচ্ছে زوج ‘যওজ’, অর্থ হচ্ছে জোড়া। এ শব্দটি স্বামী বা স্ত্রী অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী হচ্ছে ‘যওজ’! আবার স্ত্রীর জন্য স্বামী হচ্ছে ‘যওজ’। তবে আখেরাতে আযওয়াজ অর্থাৎ জোড়া হবে পবিত্রতার গুণাবলী সহকারে। জান্নাতে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্ত্রী লাভের অর্থ, তারা হবে পার্থিব যাবতীয় বাহ্যিক ও গঠনগত ক্রটি-বিচূতি ও চরিত্রগত কলুষতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং প্রস্ৰাব-পায়খানা, রজঃস্রাব, প্রসবোত্তর স্রাব প্রভৃতি যাবতীয় ঘৃণ্য বিষয়ের উর্ধ্বে। অনুরূপভাবে নীতিভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, অবাধ্যতা প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ ক্রটি ও কদৰ্যতার লেশমাত্রও তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। তাদের গুণাগুণ সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াতে এসেছে যে, “তাদের সংগে থাকবে আয়তনয়না, ডাগর চোখ বিশিষ্টাগণ” [সূরা আস-সাফফাত: ৪৮]
আরও বলা হয়েছে, “তারা যেন পদ্মরাগ ও প্রবাল” [সূরা আর-রহমান: ৫৮] আরও এসেছে, “আর তাদের জন্য থাকবে ডাগর চক্ষুবিশিষ্টা হুর, যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা [সূরা আল-ওয়াকি’আ: ২২-২৩) অনুরূপভাবে এসেছে, “আর সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী” [সূরা আন-নাবা ৩৩] যদি দুনিয়ার কোন সৎকর্মশীল পুরুষের স্ত্রী সৎকর্মশীলা না হয় তাহলে আখেরাতে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ঐ সৎকর্মশীল পুরুষটিকে অন্য কোন সৎকর্মশীলা স্ত্রী দান করা হবে। আর যদি দুনিয়ায় কোন স্ত্রী হয় সৎকর্মশীলা এবং তার স্বামী হয় অসৎ, তাহলে আখেরাতে ঐ অসৎ স্বামী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোন সৎ পুরুষকে তার স্বামী হিসেবে দেয়া হবে। তবে যদি দুনিয়ায় কোন স্বামী-স্ত্রী দুজনই সৎকর্মশীল হয়, তাহলে আখেরাতে তাদের এই সম্পর্কটি চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হবে।
৪. বলা হয়েছে যে, জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ-বিলাসের উপকরণসমূহকে যেন দুনিয়ার পতনশীল ও ক্ষীয়মান উপকরণসমূহের ন্যায় মনে না করা হয় যাতে যেকোন মূহুর্তে ধ্বংস ও বিলুপ্তির আশংকা থাকে। বরং জান্নাতবাসীগণ অনন্তকাল সুখস্বাচ্ছন্দ্যের এই অফুরন্ত উপকরণসমূহ ভোগ করে বিমল আনন্দ-স্ফূর্তি ও চরম তৃপ্তি লাভ করতে থাকবেন। [ইবনে কাসীর]
জান্নাতের বর্ণনা :
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জান্নাতীরা জান্নাতের কামরাগুলোকে এমনভাবে দেখবে যেমন তোমরা আকাশে তারকা দেখতে পাও”। [বুখারী: ৬৫৫৫l অন্য হাদীসে এসেছে, ‘জান্নাতে এমন কিছু কক্ষ আছে যে কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের অংশ দেখা যায় আর বাইরে থেকে ভেতরের অংশ দেখা যায়। আল্লাহ তা’আলা এগুলো তো তাদের জন্য তৈরী করেছেন, যারা অপরকে খাদ্য খাওয়ায়, নম্রভাবে কথা বলে, নিয়মিত সাওম পালন করে এবং যখন মানুষ ঘুমন্ত, তখন সালাত আদায় করে। [মুসনাদ আহমাদ: ৫/৩৪৩] অন্য হাদীসে এসেছে, “জান্নাতের প্রাসাদের এক ইট হবে রৌপ্যের, আরেক ইট হবে স্বর্ণের। …”। [মুসনাদ আহমাদ: ২/৩০৪]
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মুমিন ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি তাবু থাকবে, যা হবে মাত্র একটি ফাঁপা মুক্তা, আর যার উচ্চতা হবে ষাট মাইল। মুমিন ব্যক্তির জন্য তাতে পরিবার-পরিজন থাকবে, সে তাদের কাছে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু তাদের একজন আরেকজনকে দেখতে পাবে না।” [বুখারী: ৪৮৭৯, মুসলিম: ২৮৩৪]
আর আরশের অধিক নিকটবর্তী, জান্নাতের সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন স্থানের নাম ওয়াসীলা। এটাই জান্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাসস্থান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যদি তোমরা মুয়াযযিনের আযান শোন, তবে সে আযানের জবাব দাও। অতঃপর আমার উপর সালাত পাঠ কর। কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করে, আল্লাহ্ তা’আলা এর বিনিময়ে তার উপর দশবার সালাত পাঠ করেন। তারপর আমার জন্য তোমরা ‘ওয়াসীলা’র প্রার্থনা কর। আর ওয়াসীলা হল জান্নাতের এমন এক মর্যাদাসম্পন্ন স্থান, যা কেবলমাত্র একজন বান্দা ছাড়া আর কারও উপযুক্ত নয়। আর আমি আশা করি, আমি-ই সে বান্দা। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য ওয়াসীলার প্রার্থনা করবে, সে কেয়ামতের দিন আমার শাফা’আত পাবে। [মুসলিম: ১৩৮৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতবাসীদেরকে বলবে, হে জান্নাতবাসীরা! তখন তারা বলবে, হে রব! আমরা হাজির, আমরা হাজির, আর সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। তখন তিনি বলবেন, ‘তোমরা কি সন্তুষ্ট? তখন তারা বলবে, আমরা কেন সন্তুষ্ট হব না, অথচ আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন, যা আপনার কোন সৃষ্টিকেই দেন নি? তখন তিনি বলবেন, আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দেব না? তারা বলবে, এর চেয়েও উত্তম কী হতে পারে? তখন তিনি বলবেন, আমি আমার সন্তুষ্টি তোমাদের উপর অবতরণ করাব; এরপর আর কখনো তোমাদের উপর অসন্তুষ্ট হব না।” [বুখারী: ৬৫৪৯, মুসলিম: ২৮২৯]