আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ صَدُوْقِ اللِّسَانِ ‘প্রত্যেক শুদ্ধহৃদয় ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে আমরা চিনতে পারি। কিন্তু শুদ্ধহৃদয় ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব? জবাবে তিনি বললেন, هُوَ التَّقِىُّ النَّقِىُّ لاَ إِثْمَ فِيْهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ ‘সে হবে আল্লাহভীরু ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়; যাতে কোন পাপ নেই, সত্যবিমুখতা নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই’ (ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত হা/৫২২১)।
হাদীছের শিক্ষা :
১। এই হাদীসটির দ্বারা এই বিষয়টি প্রমাণিত হয় যে, বিশুদ্ধ অন্তর ও প্রশান্তচিত্তের কতকগুলি উপকরণ রয়েছে, সেই উপকরণগুলির অন্তর্ভুক্ত বিষয় হলা: ভক্তিসহকারে মহান আল্লাহর অনুগত ভক্ত হওয়া, সদাসর্বদা সততা অবলম্বন করা, পাপাচার পরিত্যাগ করা, অন্যায়, অত্যাচার, ঘৃণা এবং হিংসা পরিহার করা।
২। তাকওয়া বা আল্লাহকে ভক্তিসহকারে ভয় করে তাঁর সঠিক অনুগত ভক্ত হওয়ার ভাবার্থ হলো এই যে, মহান আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা এবং অতিশয় শ্রদ্ধাসহকারে তাঁর আনুগত্য করা, তাঁর জন্য সতর্ক থাকা এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।
৩। প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক মহান আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ঈমান মানুষকে সৎলোক করে দেয়; সুতরাং তার গুণাবলি হয় ভালো, তার কর্ম হয় কল্যাণদায়ক, তার কথা হয় মঙ্গলদায়ক অতঃপর সে নিজেও হয়ে যায় সর্বোত্তম মানুষ।
এছাড়াও যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে মুমিন হিসাবে দাবী করলে অবশ্যই হিংসা ও বিদ্বেষ পরিহার করতে হবে এবং সত্যের নিকটে মাথানত করতে হবে। অন্তরে বিষ রেখে মুখে মিষ্টিভাষী। মনে রাখবেন আল্লাহ তা‘আলা আমাদের অন্তরের খবর রাখেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও মাল-সম্পদ দেখেন না। বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল’ (মুসলিম হা/২৫৬৪, মিশকাত হা/৫৩১৪)।
হিংসা ও বিদ্বেষ হ’ল অন্তরের বিষয়। কিন্তু তার বিষফল হিসাবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও সম্পর্কচ্ছেদ ইত্যাদি হ’ল কর্মের বিষয়। তাই অন্তর বিদ্বেষমুক্ত না হ’লে কর্ম অন্যায়মুক্ত হয় না। যদি কোন মুমিন পাপকর্ম করে, তাহ’লে তার পাপকে ঘৃণা করবে। কিন্তু ঈমানের কারণে তাকে ভালবাসবে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ সকলে ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। মুমিন ভাইয়ের পাপকর্ম পরিলক্ষিত হলে তাকে সংশোধনের নিমিত্তে উপদেশ দিতে হবে।
মুমিন ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অপর ভাইকে নিকৃষ্ট ও মন্দ মনে করবে না। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ. التَّقْوَى هَا هُنَا. وَيُشِيْرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তাকে যুলুম করে না, লজ্জিত করে না, নিকৃষ্ট ভাবে না। তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে বলে তিনি নিজের বুকের দিকে তিনবার ইশারা করেন। অতঃপর বলেন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার অন্য মুসলিম ভাইকে নিকৃষ্ট ভাবে। মনে রেখ এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের জন্য হারাম হ’ল তার রক্ত, তার মাল ও তার ইযযত’(মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯)।
যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, তার ঈমান হয় ত্রুটিপূর্ণ। হিংসা তার সমস্ত নেকীকে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন ধীরে ধীরে কাঠকে খেয়ে ফেলে। মুমিন সর্বদা অন্যের শুভ কামনা করে। যেমন সে সর্বদা নিজের শুভ কামনা করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্তুত ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’(বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৯৬১)।
এই হাদীছের আলোকে দুনিয়ার সকল মানুষ পরিচালিত হলে হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে যেত। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।