স্বামী/স্ত্রীর একান্ত গোপনীয় কথা অন্যদের সামনে প্রকাশ করা ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ। কিয়ামতের মাঠে এসব মানুষ খিয়ানতকারী হিসাবে লাঞ্চিত হবে। কারণ প্রত্যেক খিয়ানতকারী ব্যক্তির জন্য এক একটি পাতাকা থাকবে। তাই লাঞ্চিত হওয়ার পূর্বে সংশোধিত হই। তবে সৎ ও মহৎ গুণের কথা অন্যদের নিকটে বলা যাবে। এতে স্বামীর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করার নামান্তরও বটে। চলুন হাদীছটি পাঠ করি………..
আসমা বিনতে ইয়াযিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কিছু পুরুষ আছে যারা নিজ স্ত্রীর সাথে কৃত আচরণের কথা বলে বেড়ায়, তদ্রুপ কিছু নারীও আছে যারা আপন স্বামীর গোপন ব্যাপারগুলো প্রচার করে বেড়ায়?! এ কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল, কেউ কোনো শব্দ করল না। আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহ্র রাসূল! নারী-পুরুষেরা এমন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এমন করো না। এটা তো শয়তানের মতো যে রাস্তার মাঝে নারী শয়তানের সাক্ষাৎ পেল, আর অমনি তাকে জড়িয়ে ধরল, এদিকে লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে’!
তবে স্ত্রীরা তার স্বামীর বৈষয়িক বিষয়ের কথা বলতে পারবে। কিন্তু একান্ত গোপনীয় কথা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বলা উচিৎ নয়। সোনালী যুগের নারীরা যেভাবে স্বামীর সম্পর্কে আলোচনা করতেন তা নিচে তুলে ধরলাম। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এগার জন মহিলা এক স্থানে একত্রিত বসল এবং সকলে মিলে এ কথার ওপর একমত হ’ল যে, তারা নিজেদের স্বামীর ব্যাপারে কোন কিছুই গোপন রাখবে না।
প্রথম মহিলা বলল, لَحْمُ جَمَلٍ ، غَثٌّ عَلَى رَأْسِ جَبَلٍ ، لاَ سَهْلٍ فَيُرْتَقَى ، وَلاَ سَمِينٍ فَيُنْتَقَلُ. ‘আমার স্বামী হচ্ছে অত্যন্ত হাল্কা-পাতলা দুর্বল উটের গোশতের মত যেন কোন পর্বতের চুড়ায় রাখা হয়েছে এবং সেখানে উঠা সহজ কাজ নয় এবং গোশতের মধ্যে এত চর্বিও নেই, যে কারণে সেখানে উঠার জন্য কেউ কষ্ট স্বীকার করবে’।
দ্বিতীয় জন বলল, لاَ أَبُثُّ خَبَرَهُ ، إِنِّى أَخَافُ أَنْ لاَ أَذَرَهُ ، إِنْ أَذْكُرْهُ أَذْكُرْ عُجَرَهُ وَبُجَرَهُ. ‘আমি আমার স্বামী সম্পর্কে কিছু বলব না, কারণ আমি ভয় করছি যে, তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেষ করা যাবে না। কেননা, যদি আমি তার সম্পর্কে বলতে যাই, তা হলে আমাকে তার সকল দুর্বলতা এবং মন্দ দিকগুলো সম্পর্কেও বলতে হবে’।
তৃতীয় মহিলা বলল, الْعَشَنَّقُ، إِنْ أَنْطِقْ أُطَلَّقْ وَإِنْ أَسْكُتْ أُعَلَّقْ . ‘আমার স্বামী একজন দীর্ঘদেহী ব্যক্তি। আমি যদি তার বর্ণনা দেই এবং তা শোনে, তাহলে সে আমাকে তালাক্ব দিবে। আর যদি আমি কিছু না বলি, তাহলে সে আমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখবে। অর্থাৎ তালাকও দেবে না, স্ত্রীর মত ব্যবহারও করবে না’।
চতুর্থ মহিলা বলল,كَلَيْلِ تِهَامَةَ، لاَ حَرٌّ، وَلاَ قُرٌّ، وَلاَ مَخَافَةَ، وَلاَ سَآمَةَ. ‘আমার স্বামী হচ্ছে তিহামার রাতের মত মাঝামাঝি; অতি গরমও না, অতি ঠান্ডাও না। আর আমি তাকে ভয়ও করি না, আবার তার প্রতি অসন্তুষ্টও নই’।
পঞ্চম মহিলা বলল, إِنْ دَخَلَ فَهِدَ، وَإِنْ خَرَجَ أَسِدَ، وَلاَ يَسْأَلُ عَمَّا عَهِدَ. ‘যখন আমার স্বামী ঘরে ঢুকে তখন চিতা বাঘের মত থাকে। যখন বাইরে যায় তখন সিংহের মত তার স্বভাব থাকে এবং ঘরের কোন কাজের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলে না’।
ষষ্ঠ মহিলা বলল, إِنْ أَكَلَ لَفَّ، وَإِنْ شَرِبَ اشْتَفَّ، وَإِنِ اضْطَجَعَ الْتَفَّ، وَلاَ يُولِجُ الْكَفَّ لِيَعْلَمَ الْبَثَّ. ‘আমার স্বামী যখন খেতে বসে, তখন সব খেয়ে ফেলে। যখন পান করে, তখন সব শেষ করে। যখন নিদ্রা যায়, তখন একাই চাদর বা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। এমনকি হাত বের করেও আমার খবর নেয় না’।
সপ্তম মহিলা বলল, غَيَايَاءُ أَوْ عَيَايَاءُ طَبَاقَاءُ، كُلُّ دَاءٍ لَهُ دَاءٌ، شَجَّكِ أَوْ فَلَّكِ أَوْ جَمَعَ كُلاًّ لَكِ. ‘আমার স্বামী হচ্ছে পথভ্রষ্ট অথবা দুর্বল মানসিকতা সম্পন্ন এবং চরম বোকা, সব রকমের দোষ তার আছে। সে তোমার মাথায় বা শরীরে অথবা উভয় স্থানে আঘাত করতে পারে’।
অষ্টম মহিলা বলল, الْمَسُّ مَسُّ أَرْنَبٍ، وَالرِّيحُ رِيحُ زَرْنَبٍ. ‘আমার স্বামীর স্পর্শ হচ্ছে খরগোশের মত এবং তার দেহের সুগন্ধ হচ্ছে যারনাব ফুলের মত’।
নবম মহিলা বলল, رَفِيعُ الْعِمَادِ، طَوِيلُ النِّجَادِ، عَظِيمُ الرَّمَادِ، قَرِيبُ الْبَيْتِ مِنَ النَّادِ. ‘আমার স্বামী হচ্ছে অতি উচ্চ অট্টালিকার মত এবং তার তরবারি ঝুলিয়ে রাখার জন্য সে চামড়ার লম্বা ফালি পরিধান করে অর্থাৎ দানশীল ও সাহসী। তার ছাইভষ্ম প্রচুর পরিমাণে, অর্থাৎ প্রচুর মেহমান ও মেহমানদারীও হয় এবং মানুষের জন্য তার গৃহ অবারিত। এলাকার জনগণ তার সঙ্গে সহজেই পরামর্শ করতে পারে’।
দশম মহিলা বলল, مَالِكٌ وَمَا مَالِكٌ، مَالِكٌ خَيْرٌ مِنْ ذَلِكِ، لَهُ إِبِلٌ كَثِيرَاتُ الْمَبَارِكِ قَلِيلاَتُ الْمَسَارِحِ، وَإِذَا سَمِعْنَ صَوْتَ الْمِزْهَرِ أَيْقَنَّ أَنَّهُنَّ هَوَالِكُ. ‘আমার স্বামীর নাম হল মালিক। মালিকের কী প্রশংসা আমি করব। যা প্রশংসা করব সে তার চেয়ে ঊর্ধ্বে। তার অনেক মঙ্গলময় উট আছে, তার অধিকাংশ উটকে মেহমানদের যবাই করে খাওয়ানোর জন্য ঘরে রাখা হয় এবং অল্প সংখ্যক মাঠে চরার জন্য রাখা হয়। বাঁশির শব্দ শুনলেই উটগুলো বুঝতে পারে যে, তাদেরকে মেহমানদের জন্য যবাই করা হবে’।
একাদশতম মহিলা বলল, ‘আমার স্বামী আবূ যার‘আ। তার কথা আমি কী বলব। সে আমাকে এত অধিক গহনা দিয়েছে যে, আমার কান ভারী হয়ে গেছে, আমার বাজুতে মেদ জমেছে এবং আমি এত সন্তুষ্ট হয়েছি যে, আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। সে আমাকে এনেছে অত্যন্ত গরীব পরিবার থেকে, যে পরিবার ছিল মাত্র কয়েকটি বকরীর মালিক। সে আমাকে অত্যন্ত ধনী পরিবারে নিয়ে আসে, যেখানে ঘোড়ার হরেষাধ্বনি এবং উটের হাওদার আওয়াজ এবং শস্য মাড়াইয়ের খসখসানি শব্দ শোনা যায়। সে আমাকে ধন-সম্পদের মধ্যে রেখেছে। আমি যা কিছু বলতাম, সে বিদ্রূপ করত না এবং আমি নিদ্রা যেতাম এবং সকালে দেরী করে উঠতাম এবং যখন আমি পান করতাম, অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে পান করতাম। আর আবূ যার‘আর আম্মার কথা কী বলব! তার পাত্র ছিল সর্বদা পরিপূর্ণ এবং তার ঘর ছিল প্রশস্ত। আবূ জার‘আর পুত্রের কথা কী বলব! সেও খুব ভাল ছিল। তার শয্যা এত সংকীর্ণ ছিল যে, মনে হত যেন কোষবদ্ধ তরবারি অর্থাৎ সে অত্যন্ত হালকা-পাতলা দেহের অধিকারী। তার খাদ্য হচ্ছে ছাগলের একখানা পা। আর আবূ যার‘আর কন্যা সম্পর্কে বলতে হয় যে, সে কতই না ভাল। সে বাপ-মায়ের সম্পূর্ণ বাধ্য সন্তান। সে অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী, যে কারণে সতীনরা তাকে হিংসা করে। আবূ যার‘আর ক্রীতদাসীরও অনেক গুণ। সে আমাদের গোপন কথা কখনো প্রকাশ করত না, সে আমাদের সম্পদকে কমাত না এবং আমাদের বাসস্থানকে আবর্জনা দিয়ে ভরে রাখত না।
সে মহিলা আরও বলল, ‘একদিন দুধ দোহন করার সময় আবূ যার‘আ বাইরে বেরিয়ে এমন একজন মহিলাকে দেখতে পেল, যার দু’টি পুত্র-সন্তান রয়েছে। ওরা মায়ের স্তন নিয়ে চিতা বাঘের মত খেলছিল (দুধ পান করছিল)। সে ঐ মহিলাকে দেখে আকৃষ্ট হ’ল এবং আমাকে তালাক্ব দিয়ে তাকে বিয়ে করল। এরপর আমি এক সম্মানিত ব্যক্তিকে বিয়ে করলাম। সে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ত এবং হাতে বর্শা রাখত। সে আমাকে অনেক সম্পদ দিয়েছে এবং প্রত্যেক প্রকারের গৃহপালিত জন্তু থেকে এক এক জোড়া আমাকে দিয়েছে এবং বলেছে, হে উম্মু যার‘আ! তুমি এ সম্পদ থেকে খাও, পরিধান করো এবং উপহার দাও। মহিলা আরও বলল, فَلَوْ جَمَعْتُ كُلَّ شَىْءٍ أَعْطَانِيهِ مَا بَلَغَ أَصْغَرَ آنِيَةِ أَبِى زَرْعٍ. ‘সে আমাকে যা কিছু দিয়েছে, তা আবূ যার‘আর একটি ক্ষুদ্র পাত্রও পূর্ণ করতে পারবে না’।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, كُنْتُ لَكِ كَأَبِى زَرْعٍ لأُمِّ زَرْعٍ. ‘আবূ যার‘আ তার স্ত্রী উম্মু যার‘আর জন্য যেমন আমিও তোমার প্রতি তেমন। তবে আমি কখনও তোমাকে তালাক দেব না’।
(বুখারী হা/৫১৮৯; মুসলিম হা/২৪৪৮; ইবনে হিব্বান হা/৭১০৪; ছহীহুল জামি‘ হা/১৪১; সনদ ছহীহ)।