দরসে হাদীস : অনুতপ্ত ব্যক্তির ক্ষমা অনিবার্য

আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষ হত্যা করেছিল। তারপর সে শার’ঈ বিধান জানার জন্য একজন আল্লাহভীরুর কাছে জিজ্ঞেস করল, এ ধরনের মানুষের জন্য তাওবার কোন অবকাশ আছে কিনা? তিনি বললেন, নেই। তারপর সে তাকেও (’আলিমকেও) হত্যা করল। এভাবে সে লোকদেরকে অনবরত জিজ্ঞেস করতে থাকল। এক ব্যক্তি শুনে বলল, অমুক গ্রামে গিয়ে অমুককে জিজ্ঞেস করো। এমন সময়েই সে মৃত্যুমুখে পতিত হলো এবং মৃত্যুর সময় সে ওই গ্রামের দিকে নিজের সিনাকে বাড়িয়ে দিলো। তারপর রহমতের মালাক (ফেরেশতা) ও ’আযাবের মালাক পরস্পর ঝগড়া করতে লাগল, কারা তার রূহ নিয়ে যাবে। এমন সময় আল্লাহ তা’আলা ওই গ্রামকে বললেন, তুমি মৃত ব্যক্তির কাছে আসো। আর নিজ গ্রামকে বললেন, তুমি দূরে সরে যাও। অতঃপর আল্লাহ মালায়িকাহকে (ফেরেশতাদের) বললেন, তোমরা উভয় দিকের পথের দূরত্ব পরিমাপ করে দেখো। মাপের পর মৃতকে এ গ্রামের দিকে এক বিঘত নিকটে পাওয়া গেল। সুতরাং তাকে ক্ষমা করে দেয়া হলো। (বুখারী হা/৩৪৭০, মুসলিম হা/২৭৬৬, মিশকাত হা/২৩২৭)।

ব্যাখ্যা: (كَانَ فِىْ بَنِىْ إِسْرَائِيلَ رَجُلٌ) হাফেয বলেন, আমি লোকটির নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি এবং ঘটনাতে উল্লেখ করা কোন লোকের নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি।

(قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ إِنْسَانًا) আবূ মু‘আবিয়াহ্ বিন আবূ সুফ্ইয়ান-এর হাদীসে ত্ববারানী একটু বেশি উল্লেখ করেছেন আর তা হল হাদীসে হত্যাকারী নিহতদের প্রত্যেককে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন।

(ثُمَّ خَرَجَ يَسْأَلُ) ‘‘অতঃপর সে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকলো’’। অর্থাৎ- তাওবাহ্ ও ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ আছে কিনা। আর মুসলিমে কাতাদাহ্ থেকে হিশাম-এর এক বর্ণনাতে আছে, লোকটি পৃথিবীবাসীদের মাঝে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর তাকে এক পাদ্রী সম্পর্কে বলে দেয়া হল।

(فَأَتٰى رَاهِبًا) বলতে আল্লাহ ভীতিসম্পন্ন, ‘ইবাদাতকারী ও সৃষ্টি থেকে যিনি আলাদা থাকেন, খিষ্টানদের ধর্মযাজক। আর হাদীসে ইঙ্গিত আছে, উল্লেখিত ঘটনাটি ঈসা (আঃ)-কে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়ার পর ঘটেছিল। কেননা সন্ন্যাসী পন্থার আবিষ্কার তার পরে হয়েছিল যেমন কুরআনে এ ব্যাপারে ভাষ্য এসেছে।

(فَسَأَلَه فَقَالَ: أَلَهَ تَوْبَةٌ) অর্থাৎ- এ ধরনের অপরাধের পর এ ধরনের কর্মের জন্য কি কোন তাওবাহ্ আছে? (أَلَهَ تَوْبَةٌ) কারী বলেন, মিশকাতের এক কপিতে আছে (ألى توبة) ‘‘আমরা কি তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ আছে’’। ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, বূলাক-এর (জায়গা) ১২৯৪ সনের ছাপা অনুযায়ী আমাদের কাছে বিদ্যমান মাসাবীহের এক কপিতে আছে (فقال له هل لى توبة) অর্থাৎ- অতঃপর লোকটি পাদ্রীকে বলল, আমার কি কোন তাওবার সুযোগ আছে? ‘আয়নী এবং কুসতুলানী-এর মূলকপিতে আছে, (ففال له هل من توبة) ‘আয়নী বলেন, অতঃপর লোকটি পাদ্রীকে বলল, আমার কি তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ আছে? মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে, নিশ্চয়ই লোকটি নিরানব্বই লোককে হত্যা করেছে, এখন তার কি কোন তাওবাহ্ করার সুযোগ আছে?

(قالا) অর্থাৎ- নিরানব্বই জন ব্যক্তি হত্যা করার পর তার বা তোমার তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ নেই। পাদ্রীর মনে লোকটির ব্যাপারে ব্যাপক ভয়ের কারণে এবং এত অধিক পরিমাণ লোককে অন্যায়ভাবে হত্যা করার পর তার তাওবাহ্ যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে তা অসম্ভবপর ব্যাপার মনে করে লোকটিকে তিনি এমন ফাতাওয়া দিয়েছিলেন। (فقتله) অর্থাৎ- পাদ্রীকে হত্যা করে একশত হত্যা পূর্ণ করল। কারী বলেন, সম্ভবত লোকটি তার এ ধারণার কারণে এমন কাজ করেছিল যে, তার তাওবাহ্ কবূল করা হবে না যদিও তার কাছে প্রাপ্যদাবীদাররা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।

এক মতে বলা হয়েছে, পাদ্রীর ফাতাওয়া লোকটির নিকট এ ভাব প্রকাশ করেছে যে, তার কোন মুক্তি নেই। সুতরাং সে রহমাত থেকে নিরাশ হয়ে গেল, অতঃপর আল্লাহ তাকে অনুভূতি শক্তি দিলে সে কৃতকর্মের উপর লজ্জিত হয়ে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল।

(وَجَعَلَ يَسْأَلُ) অতঃপর লোকটি যার কাছে যেয়ে তার তাওবাহ্ কবূল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, এমন লোকের অন্বেষণে জিজ্ঞেস করতে থাকলো। অবশেষে লোকটি এক ‘আলিম ব্যক্তিকে বলল, ‘‘নিশ্চয়ই আমি একশত লোককে হত্যা করেছি এখন আমার কি কোন তাওবাহ্ আছে?’’ এ কথা বলার পর ‘আলিম ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, আপনার ও আপনার তাওবার মাঝে কে বাধা দিবে? হিশাম-এর বর্ণনাতে আছে, অতঃপর লোকটি পৃথিবীর সর্বাধিক জ্ঞানী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তাকে এক বিদ্বান ব্যক্তি সম্পর্কে বলে দেয়া হল, অতঃপর লোকটি বিদ্বান ব্যক্তির কাছে বলল, নিশ্চয়ই সে একশত জন লোককে হত্যা করেছে, এখন কি তার কোন তাওবার সুযোগ আছে? উত্তরে ‘আলিম ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, তার মাঝে ও তাওবার মাঝে কোন জিনিস বাধা দিবে?

(ائْتِ قَرْيَةَ كَذَا) অর্থাৎ- তুমি এমন গ্রামে যাও যার অধিবাসীগণ সৎ এবং আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ করে ও তাদের সাথে ‘ইবাদাত কর অতঃপর লোকটি ঐ গ্রামের দিকে যেতে থাকলো। হিশাম-এর বর্ণনাতে আছে, লোকটি এ রকম গ্রামের দিকে চলল, অর্থাৎ- ‘‘যে গ্রামের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছিল’’। কেননা সে গ্রামে কিছু মানুষ আছে তারা আল্লাহর ‘ইবাদাত করে। সুতরাং তাদের সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাত কর এবং তোমার গ্রামের দিকে প্রত্যাবর্তন করিও না, কেননা তা মন্দ গ্রাম। অতঃপর সে চলতে থাকলো এমনকি যখন সে অর্ধপথ অতিক্রম করল তখন তাকে মৃত্যু গ্রাস করল। আর এ গ্রামের নাম ছিল নুসরা, পক্ষান্তরে যে গ্রামের দিক থেকে এসেছিল সে তার নাম কুফরাহ্। যেমন ত্ববরানীতে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ)-এর হাদীস জাইয়িদ সানাদে আছে। নাবাবী বলেন, তার উক্তি (انطلق إلى أرض كذا الخ) অর্থাৎ- সে এ ধরনের গ্রামের দিকে চলল শেষ পর্যন্ত। এতে আছে তাওবাহকারীর ঐ সমস্ত স্থান থেকে আলাদা থাকা মুস্তাহাব যাতে গুনাহ সংঘটিত হয়েছে এবং ঐ বন্ধু থেকে আলাদা থাকা যারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা যোগায় এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যতক্ষণ তারা এ অবস্থার উপর থাকে। আর তাদের পরিবর্তে ভালো, সৎ, বিদ্বান, আল্লাহভীরু ‘ইবাদাতকারীদের বন্ধুত্ব গ্রহণ করা এবং এর মাধ্যমে তার তাওবাতে গুরুত্ব দেয়া।

(فَأَدْرَكَهُ الْمَوْتُ) অর্থাৎ- অতঃপর মরণের আলামাত বা মরণ যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করল, অর্থাৎ- লোকটি ঐ গ্রামের দিকে যেতে ইচ্ছা করে তার মাঝপথে পৌঁছল তখন মরণ তাকে পেয়ে গেল। (فَنَاءَ بِصَدْرِه) অর্থাৎ- অতঃপর সে তার বক্ষকে ঐ গ্রামের দিকে হেলিয়ে দিল তাওবার জন্য যে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল।

(فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ الْعَذَابِ) হিশাম-এর বর্ণনাতে একটু বেশি এসেছে, তাতে আছে, অতঃপর রহমাতের মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) বলল, লোকটি তাওবাহ্ করার উদ্দেশে তার অন্তরকে আল্লাহমুখী করে এসেছে। পক্ষান্তরে ‘আযাবের মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) বলল, নিশ্চয়ই সে কোন ভালো ‘আমল করেনি। অতঃপর তাদের কাছে মানুষের আকৃতিতে একজন মালাক (ফেরেশতা) এলো, অতঃপর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) তাকে তাদের মাঝে স্থাপন করল, অতঃপর মানুষরূপী মালাক দলকে বলল, তোমরা দু’ জমির মাঝে মেপে দেখ মৃত লোকটি যে জমির অধিক নিকটবর্তী হবে তাকে ঐ জমির লোক হিসেবেই গণ্য করা হবে। নাবাবী বলেন, দুই গ্রামের মাঝে মালায়িকাহর (ফেরেশতার) মাপা এবং মালাক দল যাকে তাদের মাঝে ফায়সালাকারী নিয়োগ করেছিল তার ফায়সালা ঐ ব্যাপারে সম্ভাবনা রাখছে যে, মালাক দলের কাছে মৃত লোকটির অবস্থা সংশয়পূর্ণ ছিল এবং তার ব্যাপারে মতানৈক্য হওয়ার সময় আল্লাহ মালাক দলকে নির্দেশ করেছিল তাদের পাশ দিয়ে যারা অতিক্রম করবে তাদের একজনকে বিচারক নিয়োগ করতে। অতঃপর একজন মালাক মানুষের আকৃতিতে অতিক্রম করলে মালাক দল তাকে ঐ ফায়সালার ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়।

(فَوُجِدَ إِلٰى هٰذِه) অর্থাৎ- ঐ গ্রামের দিকে যে দিকে লোকটি যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল আর তার নাম হল নুসরাহ্। (وَإِلٰى هٰذِه) অর্থাৎ- ঐ গ্রামের দিকে তাওবার উদ্দেশে যে গ্রাম থেকে বের হয়েছিল আর তার নাম কুফ্রাহ্ এবং বুখারীতে (وأوحى) এসেছে। (أَنْ تَبَاعَدِىْ) অর্থাৎ- মৃত ব্যক্তি থেকে দূর হও। (فَوُجِدَ إِلٰى هٰذِه أَقْرَبَ) হিশাম-এর বর্ণনাতে আছে, অতঃপর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) মেপে মৃত লোকটিকে ঐ জমির অধিক নিকটবর্তী পেল যে জমির দিকে সে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমি ঐ ব্যক্তিকে জানি যে, সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে ও সর্বশেষে জাহান্নাম হতে বের হবে। সে হবে ঐ ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে যার ছোট ছোট পাপগুলো তুলে ধরা হবে আর বড় বড় পাপগুলি একদিকে রেখে দেওয়া হবে। তাকে বলা হবে, ‘তুমি অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক পাপ করেছিলে?’ সে স্বীকৃতিবাচক জবাব দেবে এবং অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা তার থাকবে না। তাছাড়া সে এই ব্যাপারেও ভয় পাবে যে, এক্ষনি তার বড় বড় পাপগুলি তুলে ধরা হবে। এমতাবস্থায় বলা হবে, ‘যাও! তোমার প্রত্যেক পাপের বদলে এক একটি নেকী।’ আল্লাহর এই দয়া দেখে সে বলবে, ‘এখনও তো আমি আমার অনেক আমল দেখছি না।’’ এই কথা বলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হেসে ফেললেন, এমনকি তার দাঁত দেখা গেল। (মুসলিম)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top