দরসে হাদীস : অন্তরের ধনীই হ’ল প্রকৃত ধনবান

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ، وَلَكِنَّ الْغِنَىْ غِنَى النَّفْسِ ‘ধনের আধিক্য হ’লেই ধনী হয় না, বরং অন্তরের ধনীই হ’ল প্রকৃত ধনী’। [মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১৭০। ]

ব্যাখ্যা  : মনের সুখই তো প্রকৃত সুখ। আর অন্তরের ধনাঢ্যতাই প্রকৃত সম্পদশালী।  : (لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفس) উল্লেখিত হাদীসে (الْعَرَضُ) শব্দটি যদি ‘হরকত’ যোগে পড়া হয় তবে অর্থ হবে টাকা-পয়সা যাবতীয় সম্পদ। আর ‘সাকীন’ যোগে পড়া হলে অর্থ হবে টাকা-পয়সা ব্যতীত অন্যান্য সকল সম্পদ। 

আবূ ‘উবায়দ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,(الْعَرَضُ) হলো সব ধরনের ভোগ্য সামগ্রী। তবে জীবজন্তু জমি জমা আর ঐ সমস্ত বস্তু যেগুলো ওযন বা পরিমাপ করা যায় না এগুলো(الْعَرَضُ) -এর অন্তর্ভুক্ত নয়।

ইবনু বাত্বল (রহিমাহুল্লাহ) বলেন : (إِنَّمَا الْغِنَى غِنَى النَّفس)  প্রকৃত ধনী অধিক সম্পদ থাকলেই হওয়া যায় না। কারণ অধিকাংশ সম্পদশালী লোক তাদের সম্পদে আত্মতৃপ্ত হতে পারে না। সম্পদের প্রতি চরম মোহ থাকায় আরো বেশি সম্পদশালী হবার জন্য চেষ্টা চালায়। এজন্য সে সম্পদশালী হয়েও ফকীর থেকে যায়। তার স্বভাব ফকীরদের মতো ভিক্ষুক। 

পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তির বাহ্যিক অবস্থা যাই হোক সে যদি প্রশস্ত মনের অধিকারী হয় এবং অল্পেই তার মন থেকে অভাব দূর হয় তবে সেই হবে প্রকৃত ধনী। কারণ সে ভিক্ষুকের মতো মনের মধ্যে আরো বেশি পাওয়ার স্বপ্ন দেখে না। 

ইমাম কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন : মনের প্রাচুর্যতাই হলো প্রশংসনীয় মহান এবং উপকারী ধনী। 

ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, মনের ধনাঢ্যতা অর্জন হয় অন্তর তথা কলবের ধনাঢ্যতা থেকে। অর্থাৎ সে সকল বিষয়ে তার রবের মুখাপেক্ষী হবে। আর সে নিশ্চিতভাবে জানবে যে তার রবই তাকে দান করে থাকেন। আর না দিলেও তিনি দেন না। বিধায় তার রবের ফায়সালার উপর সে রাজি খুশি থাকে। তাই নিআমাত পেয়ে সে তার রবের শুকরিয়া আদায় করে। আর বিপদে পতিত হয়ে সে তার রবেরই অভিমুখী হয়। অতএব রবের মুখাপেক্ষিতাই তাকে অন্যের দ্বারস্থ হওয়া থেকে যথেষ্ট করে দেয়।  (মিক্বাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১শ খণ্ড, হা, ৬৪৪৬)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,  বাহ্যিক ঐশ্বর্যে যে ধনী মূলতঃ সে ধনী নয়। কেবল মনের ধনীই বড় ধনী।  আল্লাহ যখন তাঁর কোন বান্দার কল্যাণ চান, তখন তিনি তার অন্তর অভাবমুক্ত করে দেন এবং তার হৃদয়ে আল্লাহভীতি দান করেন।

আর যখন আল্লাহ কোন বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তিনি তার দু’চোখের মাঝে দারিদ্রতা স্থাপন করেন’। (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬২১৭, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৫০)।

দুনিয়াতে রেখে যাওয়া সম্পদ মানুষের :

হে আদম সন্তান! তোমার মাল তো তাই যা তুমি ভক্ষণ করেছ। অর্থাৎ মাল অর্জন করে যা তুমি জমা করে রাখবে তা অন্যে ভোগ করবে। তুমি ভোগ করতে পারবে না। আর যা তুমি ভক্ষণ করেছ তাই ভোগ করেছ। অতএব যা তুমি ভোগ করতে পেরেছ তা তোমার। অনুরূপ যা তুমি পরিধান করেছ এটাও তোমারই। আর যা তুমি দান করেছ তা তুমি আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছো তোমার জন্য তা জমা থাকবে। পরকালে তুমি তা ভোগ করবে, অতএব এতটুকুই তোমার মাল।

মুত্বাররিফ তাঁর পিতা (’আবদুল্লাহ ইবনু শিখখীর (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : একদিন আমি নাবী (সা.) -এর দরবারে আসলাম, এ সময় তিনি সূরাহ্ (اَلۡهٰکُمُ التَّکَاثُرُ) “ধনের প্রাচুর্য তোমাদেরকে গাফিল করে রেখেছেন”- (সূরাহ্ আত্ তাকা-সুর ১০২ : ১) পাঠ করছিলেন। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন: আদম সন্তান বলে- “আমার মাল, আমার মাল”। তিনি (সা.) বলেন : হে আদম সন্তান! তুমি যা খেয়ে শেষ করে দিয়েছ অথবা পরিধান করে ছিড়ে ফেলেছ অথবা দান করে সঞ্চয় করেছ এছাড়া কি তোমার কোন সম্পদ আছে? (মুসলিম হা/ ২৯৫৮, ছহীহুল জামি‘ হা/ ৮১৩২, মিশকাত হা/৫১৬৯)

’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্উদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যার কাছে নিজ সম্পদ অপেক্ষা উত্তরাধীকারীদের সম্পদ অধিক প্রিয়? তারা বলল : হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই; বরং ওয়ারিসের সম্পদ অপেক্ষা নিজের সম্পদই অধিক প্রিয়। তিনি (সা.) বললেন : যে (আল্লাহর পথে খরচ করে) যা অগ্রিম পাঠায় তাই তার সম্পদ। আর যা সে পিছনে রেখে যায় তা তার ওয়ারিসের সম্পদ। (বুখারী হা/ ৬৪৪২, মিশকাত হা/৫১৬৮)।

এ হাদীস সম্পর্কে ইবনু বাত্ত্বলসহ আরো অনেকে বলেন, আখিরাতে উপকৃত হওয়ার জন্য সৎ ও উত্তম পন্থায় সম্পদ দান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কেননা মৃত ব্যক্তি যে সম্পদ রেখে মারা যায় তার মালিক তার উত্তরাধিকারীগণ। অতএব মৃতের পূর্বে মালের মালিক নিজে যদি ঐ মাল দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজ সম্পাদন করে তাহলে এর সাওয়াব সে নিজে পাবে। আর এই মাল উপার্জন ও তা জমা করার জন্য যে কষ্ট সে নিজে করেছে তা দ্বারা উপকৃত হতে পারবে। আর ঐ মাল দ্বারা যদি সে আল্লাহর অবাধ্যমূলক কাজ করে তাহলে তো সে উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। (ফাতহুল বারী ১১শ খণ্ড, হা. ৬৪৪২)

নিচের পাঁচটি বিষয়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিৎ :

আবু হুরায়রাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : কে এ বাক্যগুলো আমার নিকট হতে গ্রহণ করবে? অতঃপর নিজে সে মতো ’আমল করবে অথবা এমন ব্যক্তিকে শিখিয়ে দেবে যে সে অনুযায়ী আমল করে। আমি বললাম : আমি হে আল্লাহর রাসূল! এরপর তিনি (সা.) আমার হাত ধরে পাঁচটি গণনা করলেন। তিনি (সা.) বললেন,

১. আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হতে বেঁচে থাকো, এতে তুমি হবে মানুষের মাঝে উত্তম ইবাদাতকারী,1

২. আল্লাহ তোমার তাকদিরে যা বন্টন করেছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে, এতে তুমি হবে মানুষের মাঝে সর্বাপেক্ষা ধনবান,

৩. তোমার প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করবে, এতে তুমি হবে পূর্ণ ঈমানদার,

৪. নিজের জন্য যা পছন্দ করো মানুষের জন্যও তা পছন্দ করবে, তখন তুমি হবে পূর্ণ মুসলিম এবং

৫. বেশি হাসবে না; কেননা বেশি হাসি অন্তরকে মেরে ফেলে।

(তিরমিযী হা/২৩০৫, মুসনাদে আহমাদ হা/৮০৮১, ছহীহুল জামি হা/১০০, মিশকাত হা/৫১৭১)

ব্যাখ্যা : (اتَّقِ الْمَحَارِمَ) অর্থাৎ তোমার ওপর আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাতে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাক। 

(وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللَّهُ لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ) আল্লাহ তোমাকে যে অংশ দিয়েছে তাতে রাজি থাক, তাহলেই তুমি সবার চাইতে ধনী হতে পারবে। অর্থাৎ আল্লাহ তোমার ভাগ্যে যা রেখেছেন তাতো আল্লাহ তোমাকে দিয়েছেনই, তাই তুমি এতেই সন্তুষ্ট থাকো তবেই তুমি সর্বাধিক ধনী বলে বিবেচিত হবে। কেননা যে ব্যক্তি তার জন্য নির্ধারিত অংশ পেয়েই সন্তুষ্ট হতে পারে যদিও তা পরিমাণে কম হয় তাহলেই সে অন্যের হাতে যা আছে তার প্রতি লোভ করে না। এতে সে অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়াই ধনী হওয়ার প্রমাণ।

(وَلَا تُكْثِرِ الضَّحِكَ فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكَ تُمِيتُ الْقَلْبَ) এখানে হাসির সাথে অন্তরের মৃত্যুর সম্পর্ক হলো এই, মৃতের ব্যক্তির অন্তরে যে রকম আল্লাহর যিক্র-আযকার, ভয় বা ইবাদাত-বন্দেগীর কথা স্মরণ থাকে না বা অনুভূতি জন্মায় না, অনুরূপ অধিক হাসির কারণে সীমাহীন আনন্দে মত্ত থাকায় আল্লাহর যিক্র-আযকার, ভয় বা ‘ইবাদতের কথা স্মরণ থাকে না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খণ্ড, হা. ২৩০৫, মিরকাতুল মাফাতীহ)

  1. ↩︎

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top