মদীনার বাগান সমূহের মধ্যে এক ইয়াতীম বাচ্চার একটি বাগান ছিল। তার বাগানের সাথে অন্য এক লোকেরও একটি বাগান ছিল। যার নাম ছিল আবু লুবাবা। ইয়াতীম চিন্তা করল, আমি জমির সীমানা বরাবর প্রাচীর নির্মাণ করে বাগানটি আদালা করে নেব। যাতে প্রত্যেকের অংশ পৃথক হয়ে যায়। যখন প্রাচীর দিতে শুরু করল তখন দেখা গেল তার প্রতিবেশীর একটি খেজুর গাছ সীমানার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। যার কারণে প্রাচীরটি সোজা হচ্ছে না। তাই সে তার প্রতিবেশীর নিকট গিয়ে বলল, আপনার বাগানে অনেক খেজুর গাছ। আমি একটি প্রাচীর দিতে চাচ্ছি, কিন্তু আপনার একটি খেজুর গাছের কারণে প্রাচীরটি সোজা হচ্ছে না। ঐ গাছটি আমাকে দিয়ে দিন তাহ’লে আমার দেওয়ালটি সোজা হয়ে যাবে। এতে আপনার কোন ক্ষতি হবে না। লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি খেজুর গাছটি দান করব না। ইয়াতীম ছেলেটি বলল, ভাই আপনার তো কোন ক্ষতি হবে না। হয় আপনি গাছটি দান করুন আর না হয় আমার কাছ থেকে এর মূল্য নিয়ে নিন। সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি এর কোনটাই করব না। ইয়াতীম ছেলেটি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করল। প্রতিবেশীর অধিকারের কথা বলল। কিন্তু সে ছিল দুনিয়াপ্রেমিক। তাই না সে ইয়াতীমের অসহায়ত্বের প্রতি লক্ষ্য করল, আর না প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি। ইয়াতীম বলল, তাহ’লে কি আমি প্রাচীর দিব না এবং তা সোজা করব না? প্রতিবেশী লোকটি বলল, এটা তোমার ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। ইয়াতীম যখন তার কথায় নিরাশ হ’ল তখন সে চিন্তা করল যে, এমন একজন ব্যক্তি আছেন যদি তিনি সুপারিশ করেন, তাহ’লে হয়ত আমার কাজ হ’তে পারে। একথা মনে করে সে মসজিদে নববীর দিকে রওয়ানা হ’ল।
ঐ ইয়াতীম মসজিদে নববীতে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার বাগান অমুক ব্যক্তির বাগানের সাথে মিশে আছে। আমি এর মাঝে প্রাচীর দিতে চাচ্ছি। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত প্রাচীর সোজা হচ্ছে না যতক্ষণ না আমার প্রতিবেশীর একটি খেজুর গাছ আমার দখলে আসবে। আমি তার মালিককে বলেছি যে, এটি আমার নিকট বিক্রি করে দাও। আমি তাকে যথেষ্ট বুঝানোরও চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে তা অস্বীকার করছে। হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার জন্য তার নিকট একটু সুপারিশ করুন যাতে সে আমাকে ঐ খেজুর গাছটি দিয়ে দেয়। তিনি বললেন, যাও! তাকে ডেকে নিয়ে এসো।
ঐ ইয়াতীম তার নিকট গিয়ে বলল, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আপনাকে ডেকেছেন। সে মসজিদে নববীতে আসল। নবী করীম (ছাঃ) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, সে বেড়া দিয়ে তোমার বাগান থেকে তার বাগান পৃথক করতে চায়। তোমার একটি খেজুর গাছের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। তুমি তোমার ভাইকে ঐ খেজুর গাছটি দিতে নাকি অস্বীকার করেছ?
লোকটি বলল, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, গাছটি তোমার ভাইকে দিয়ে দাও।
সে বলল, আমি দিব না। তিনি তাকে কয়েকবার বলার পরেও যখন রাযী হ’ল না তখন তিনি তাকে বললেন, তোমার ভাইকে ঐ খেজুর গাছটি দিয়ে দাও। আমি তোমার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছের যিম্মাদার হব। ঐ লোকটি এ কথা শুনেও বলল, না আমি তা দিব না। তিনি তখন চুপ হয়ে গেলেন। এর চেয়ে বেশী তিনি তাকে আর কী বলতে পারেন!
ছাহাবীগণ নিশ্চুপ থেকে কথাবার্তা শুনছিলেন। উপস্থিত লোকদের মধ্যে আবু দাহদাহ (রাঃ)ও ছিলেন। মদীনায় তার খুব সুন্দর একটি বাগান ছিল। সেখানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিল। সুস্বাদু খেজুরের কারণে বাগানটি খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। এর খেজুর ছিল খুব উন্নতমানের এবং বাজারে তার যথেষ্ট চাহিদাও ছিল। মদীনার বড় বড় ব্যবসায়ী এ কামনা করত যদি এ বাগানটি আমার হ’ত। আবু দাহদাহ (রাঃ) ঐ বাগানের মধ্যে খুব সুন্দর করে স্বীয় ঘর নির্মাণ করেছিলেন। স্বপরিবারে তিনি সেখানে বসবাস করতেন। মিষ্টি পানির কূপ এ বাগানের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি করেছিল। আবু দাহদাহ (রাঃ) যখন রাসূল (ছাঃ)-এর কথা শুনছিলেন তখন মনে মনে ভাবছিলেন যে, এ দুনিয়া কি? আজ নয় তো কাল মৃত্যুবরণ করতেই হবে। এরপর শুরু হবে চিরস্থায়ী জীবন। যা স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে, না দুঃখে ভরপুর হবে তা কে জানে? যদি জান্নাতে একটি খেজুর গাছ পাওয়া যায়, তাহ’লে আর কি চাই? সামনে এসে আবু দাহদাহ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যে কথা আপনি বললেন, এটা কি শুধু তার জন্যই খাছ? আমি যদি ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে ঐ খেজুর গাছটি ক্রয় করে এ ইয়াতীমকে দিয়ে দেই তাহ’লে আমিও কি জান্নাতে খেজুর গাছের মালিক হব?
রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তোমার জন্যও জান্নাতে খেজুর গাছ থাকবে। আবু দাহদাহ (রাঃ) ভাবতে লাগলেন, এমন কি সম্পদ আছে যা আমি ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে খেজুর গাছটি ক্রয় করব। তিনি ভেবে দেখলেন, মদীনায় তার একটি বাগান আছে। যেখানে ছয়শ’ খেজুর গাছ, পানির কূপ ও একটি বাড়ি আছে। এগুলোর বিনিময়ে ঐ গাছটি কিনে ইয়াতীমকে দিয়ে দিব। তিনি ঐ ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বললেন, শোন! তুমি আমার বাগান সম্পর্কে অবগত আছ, যেখানে ৬০০ খেজুর গাছ আছে, সাথে ঘর ও কুয়াও আছে? সে বলল, মদীনাতে এমন কে আছে যে আপনার বাগান সম্পর্কে জানে না? তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি আমার ঐ সম্পূর্ণ বাগান গ্রহণ করে তোমার একটি খেজুর গাছ আমাকে দিয়ে দাও।
ঐ ব্যক্তি তা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে আবু দাহদাহ (রাঃ)-এর দিকে ফিরে তাকাল। অতঃপর লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা লক্ষ্য কর, আবু দাহদাহ কি বলছে? লোকজন যখন তার কথার ব্যাপারে সাক্ষী হ’ল, তখন সে বলল, হ্যাঁ আমি তোমার খেজুর গাছের বাগান গ্রহণ করলাম এবং ঐ খেজুর গাছটি তোমাকে দিয়ে দিলাম। যখন তিনি ঐ খেজুর গাছের মালিক হয়ে গেলেন তখন ঐ ইয়াতীমকে বললেন, এখন থেকে ঐ খেজুর গাছটি তোমার। আমি তা তোমাকে উপহার হিসাবে দিলাম। এখন তোমার দেয়াল সোজা করতে আর কোন বাঁধা নেই। এরপর আবু দাহদাহ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এখন আমি কি জান্নাতে খেজুর গাছের মালিক হ’লাম? তিনি বলেন, كَمْ مِنْ عِذْقِ رَدَاحٍ لِأَبِي الدَّحْدَاحِ فِي الْجَنَّةِ ‘আবু দাহদাহর জন্য জান্নাতে এখন কত বিশাল বিশাল খেজুরের বাগান অপেক্ষা করছে’!
বর্ণনাকারী আনাস (রাঃ) বলেন, এ শব্দটি তিনি এক, দুই বা তিনবার বলেননি; বরং খুশী হয়ে বারংবার বলেছেন।
শেষে আবু দাহদাহ (রাঃ) সেখান থেকে বের হ’লেন। জান্নাতে বাগানের সুসংবাদ পেয়ে নিজের বর্তমান বাগানের পথে রওয়ানা হ’লেন। মনে মনে বললেন, নিজের ব্যবহারিক কিছু কাপড় এবং কিছু যরূরী জিনিসপত্র তো ওখান থেকে নিতে হবে। তিনি বাগানের দরজায় এসে ভিতরে বাচ্চাদের কণ্ঠ শুনতে পেলেন। স্ত্রী তখন ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল আর বাচ্চারা খেলাধূলা করছিল। ভিতরে গিয়ে তিনি স্ত্রীকে সংবাদ দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন, হে উম্মে দাহদাহ!
উম্মে দাহদাহ অত্যন্ত অবাক হ’লেন যে, আজকে আবু দাহদাহ বাগানের বাইরে দরজায় কেন দাঁড়িয়ে আছেন? ভিতরে আসছেন না কেন? আবারও আওয়াজ আসল! উম্মে দাহদাহ! উত্তর আসল, আমি উপস্থিত হে আবু দাহদাহ! বাচ্চাদেরকে নিয়ে এ বাগান থেকে বের হয়ে আস। ঊম্মে দাহদাহ (রাঃ) বললেন, আমি বাগান হ’তে বের হয়ে আসব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি এ বাগান বিক্রি করে দিয়েছি। উম্মে দাহদাহ (রাঃ) বললেন, আপনি কার নিকট এটা বিক্রি করেছেন? কে কত দাম দিয়ে এটা ক্রয় করেছে? আবু দাহদাহ (রাঃ) বললেন, আমি জান্নাতে একটি খেজুর বাগানের বিনিময়ে তা বিক্রি করে দিয়েছি। উম্মে দাহদাহ (রাঃ) বললেন, আল্লাহু আকবার। হে আবু দাহদাহ (রাঃ)! আপনি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা করেছেন। জান্নাতের একটি বৃক্ষ, যার নিচে অশ্বারোহী একশত বছর পর্যন্ত চলার পরেও তার ছায়া শেষ হবে না (বুখারী হা/৩২৫১)। কী সৌভাগ্য আমাদের যে, আমরা জান্নাতে এমন একটি গাছ পাব। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৭৯১-৯৩; হাকেম হা/২১৯৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৬৪; মু‘জামুল কাবীর হা/৭৬৩; শু‘আবুল ঈমান হা/৩৪৫১)।