আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, «ابْغُونِي فِي ضُعَفَائِكُمْ فَإِنَّمَا تُرْزَقُونَ – أَوْ تُنْصَرُونَ – بِضُعَفَائِكُمْ» “তোমাদের দুর্বলদের মধ্যে আমাকে খোঁজ করো। কেননা তোমাদের দুর্বলদের ওয়াসীলায় তোমাদেরকে রিযিক দান করা হয়, বা সাহায্য করা হয়’’। (আবু দাউদ হা/২৩৩৫, মিশকাত হা/৫২৪৬, ছহীহুল জামি‘ হা/৪১)।
ব্যাখ্যা : ‘তোমরা দুর্বলদের মাঝে আমাকে সন্ধান কর’-এর অর্থ হ’ল- তাদের ভালোবাসার মাধ্যমে আমার সন্তুষ্টি সন্ধান কর। এখানে (ضُعَفَاء) দ্বারা উদ্দেশ্য দুস্থ, অসহায়, ফকীর, মিসকীন, ইয়াতিম; তাদের মাঝে’ মানে, তাদের প্রতি ইহসানের মাধ্যমে।
‘তোমরা দুর্বলদের কারণে সাহায্যপ্রাপ্ত হও’, এর অর্থ হ’ল- শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ সাহায্য পেয়ে থাক। কেননা তাদের মধ্যে থাকে আল্লাহ তা‘আলার অতীব প্রিয় বান্দা ও অলী, যারা আল্লাহর অতীব নিকটের।
হাদীসে কুদসীতে রয়েছে- “যে আমার বন্ধুকে কষ্ট দেয় আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি”। (মিরক্বাতুল মাফাতীহঃ তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খণ্ড, হা. ১৭০২)
মুল্লা আলী ক্বারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাদের প্রতি এ তাগিদ এজন্য যে, তারা ছিলেন একাধারে ফকীর, গরীব, মাযলুম, মুজাহিদ, মুজতাহিদ। অতএব তাদের দু’আর প্রভাব সর্বসাধারণের দু’আর উপর বেশি আশা করা যায়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; আল কাশিফ লিত্ ত্বীবী ১০ম খণ্ড, হা. ৩৩১৪, ১৫ পৃ.; মাত্বালিউল আনোয়ার লি ইবরাহীম ইবনু ইউসুফ ৫ম খণ্ড, ১৮৮ পৃ.)
আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, فَقَالَ الۡمَلَاُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ قَوۡمِه مَا نَرٰىکَ اِلَّا بَشَرًا مِّثۡلَنَا وَ مَا نَرٰىکَ اتَّبَعَکَ اِلَّا الَّذِیۡنَ هُمۡ اَرَاذِلُنَا بَادِیَ الرَّاۡیِ ۚ وَ مَا نَرٰی لَکُمۡ عَلَیۡنَا مِنۡ فَضۡلٍۭ بَلۡ نَظُنُّکُمۡ کٰذِبِیۡنَ ‘অতঃপর তার কওমের নেতৃস্থানীয়রা, যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, ‘আমরা তো তোমাকে আমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখছি না এবং আমরা দেখছি যে, কেবল আমাদের নীচু শ্রেণীর লোকেরাই বিবেচনাহীনভাবে তোমার অনুসরণ করেছে। আর আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব আমরা দেখছি না; বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করছি’। (হুদ ১১/২৭)
কওমের জাহেল লোকেরা সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেনীকে, ইতর ও ছোটলোক সাব্যস্ত করেছিল- যাদের কাছে পার্থিব ধন-সম্পদ ও বিষয় বৈভব ছিল না। মূলত তা ছিল তাদের জাহেলী চিন্তাধারার ফল। প্রকৃতপক্ষে ইজ্জত কিংবা অসম্মান ধন দৌলত বিদ্যা বুদ্ধির অধীন নয়। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সম্পদ এবং সম্মানের মোহ একটি নেশার মত, যা অনেক সময় সত্য ন্যায়কে গ্রহন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, সত্য ও ন্যায় হতে বিচ্যুত করে। দরিদ্র ও দুর্বলদের সম্মুখে যেহেতু এরূপ কোন অন্তরায় থাকে না কাজেই তারাই সর্বাগ্রে সত্য ন্যায়কে বরণ করতে এগিয়ে আসে। প্রাচীনকাল হতে যুগে যুগে দরিদ্র দুর্বলরাই সমসাময়িক নবীগণের উপর সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিল। [কুরতুবী]
অনুরূপভাবে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন ঈমানের আহ্বান সম্বলিত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র চিঠি লাভ করল, তখন গুরুত্ব সহকারে নিজেই সেটার তদন্ত তাহকীক করতে মনস্থ করে। কেননা, সে তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাব পাঠ করে সত্য নবীগণের আলামত ও লক্ষণাদি সম্পর্কে পুঙ্খানুপঙ্খরূপে পারদর্শী ছিল। কাজেই তৎকালে আরব দেশের যেসব ব্যবসায়ী সিরিয়ায় উপস্থিত ছিল, তাদের একত্রিত করে উক্ত আলামত ও লক্ষণাদি সম্পর্কে কতিপয় প্রশ্ন করে। তন্মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল যে, তার অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণী ঈমান এনেছে নাকি ধনী শ্রেণী? তখন আবু সুফিয়ান উত্তরে বলেছিল, বরং দরিদ্র ও দূর্বল শ্রেণী। তখন হিরাক্লিয়াস মন্তব্য করল, এটা তো সত্য রাসূল হওয়ার লক্ষণ। কেননা, যুগে যুগে দরিদ্র দুর্বল শ্রেণীই প্রথমে নবীগণের আনুগত্য স্বীকার করেছে। [দেখুন, বুখারীঃ ৭, ৫১, মুসলিমঃ ১৭৭৩]
আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, لَیۡسَ عَلَی الضُّعَفَآءِ وَ لَا عَلَی الۡمَرۡضٰی وَ لَا عَلَی الَّذِیۡنَ لَا یَجِدُوۡنَ مَا یُنۡفِقُوۡنَ حَرَجٌ اِذَا نَصَحُوۡا لِلّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ ؕ مَا عَلَی الۡمُحۡسِنِیۡنَ مِنۡ سَبِیۡلٍ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ‘কোন দোষ নেই দুর্বলদের উপর, অসুস্থদের উপর ও যারা দান করার মত কিছু পায় না তাদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়। সৎকর্মশীলদের উপর (অভিযোগের) কোন পথ নেই, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (তওবাহ ৯/৯১)। অন্যত্র বলেন, ‘সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিরাই সর্বপ্রথম পয়গম্বরদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করতে থেকেছে। (যুখরুফ : ৪৩/২৩)
তবে আয়াতে একটি শর্ত দেয়া হয়েছে যে তাদের আল্লাহ ও তার রাসূলের হিতাকাঙ্খী হতে হবে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হিতাকাঙ্খাকেই দ্বীন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, দ্বীন হচ্ছে, নসীহত বা হিতাকাঙ্খা, দ্বীন হচ্ছে, হিতাকাঙ্খা, দ্বীন হচ্ছে, হিতাকাঙ্খা, আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তার কিতাবের জন্য, তার রাসূলের জন্য, মুসলিম ইমামদের জন্য এবং সর্বসাধারণের জন্য। [মুসলিম: ৫৫]
তবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে প্রকৃত পক্ষে ভালোবাসবে তারা অবশ্যই দারিদ্রতার শিকার হবে। আবূ সাঈদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, একদা তিনি নিজের প্রয়োজনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অভিযোগ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবূ সাঈদ! ধৈর্য ধর। কারণ, আমাকে যে ভালোবাসে তার কাছে অভাব-অনটন ঐরূপ দ্রুত গতিতে আসবে, যেরূপ পানির স্রোত উঁচু উপত্যকা থেকে এবং পাহাড়ের উঁচু জায়গা থেকে নীচের দিকে দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হয়। (আহমাদ হা/১১৩৭৯, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮২৮)
অতএব, দারিদ্রতায় কল্যাণ ও অকল্যাণ দুটোই নিহিত রয়েছে। কিন্তু মানুষ দারিদ্রতাকে পছন্দ করে না। এসম্পর্কে হাদীসে এসেছে, মাহমূদ ইবনু লাবীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নাবী (সা.) বলেছেন: আদম সন্তান দুটি জিনিসকে অপছন্দ করে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে অথচ মু’মিনের পক্ষে ফিতনায় পতিত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু অনেক উত্তম। আর সে মাল-সম্পদের স্বল্পতাকে অপছন্দ করে অথচ মালের স্বল্পতায় (পরকালে) হিসাবনিকাশ কম হয়। (আহমাদ হা/২৩৬৭৪, মিশকাত হা/৫২৫১)
আল্লামাহ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, মু’মিনের দীনী ফিতনাহ্ হলো মুরতাদ বা ধর্মচ্যুত হওয়া এবং অন্যকে গুনাহের জন্য বাধ্য করা। আবূ নু’আয়ম হিলয়াহ গ্রন্থে আবু আবদুল্লাহ আস সানাবিহী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, দুনিয়া ফিতনার দিকে আহ্বান করছে, আর শয়তান আহ্বান করছে পাপের দিকে অথচ আল্লাহর সাক্ষাৎ এ দুয়ের সাথে অবস্থানের চেয়ে অধিক কল্যাণকর। মানুষের দ্বিতীয় অপছন্দনীয় বস্তুটি হলো স্বল্প সম্পদ। অথচ এটা তার পরকালের হিসাবের ক্ষেত্রে অতীব সহজতর ব্যবস্থা এবং আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার একান্ত পন্থা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১৬ পৃ.)।