আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেন, একদিন নবী (ছাঃ) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, (হে ’আবদুল্লাহ!) তখন তোমার কিরূপ হবে? যখন তুমি নিকৃষ্ট ও ইতর লোকদের মধ্যে যাবে, তাদের (দ্বীনের ব্যাপারে) অস্বীকার ও আমানতের মাঝে ভেজাল এসে যাবে এবং পরস্পরে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। তাদের অবস্থা হবে এরূপ এবং (এ কথা বলে) উভয় হাতের অঙ্গুলিসমূহকে পরস্পরের মধ্যে ঢুকালেন।
’আবদুল্লাহ বললেন, ফেৎনার সময় আমার কর্তব্য কি হবে? আপনিই আমাকে নির্দেশ করুন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عَلَيْكَ بِمَا تَعْرِفُ وَدَعْ مَا تُنْكِرُ وَعَلَيْكَ بِخَاصَّةِ نَفْسِكَ وَإِيَّاكَ وَعَوَامِّهِمْ ‘যে কাজটি তুমি সত্য ও ভালো বলে জানো, কেবলমাত্র তাই করবে এবং যা অসত্য ও খারাপ বলে জানো তা দূরে সরিয়ে রাখবে।
অপর বর্ণনায় আছে, الْزَمْ بَيْتَكَ وَأَمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ وَخُذْ مَا تَعْرِفُ وَدَعْ مَا تُنْكِرُ وَعَلَيْكَ بِأَمْرِ خَاصَّةِ نَفْسِكَ ودع أَمر الْعَامَّة ‘নিজ ঘরে বসে থাকো, নিজের মুখ ও জবানকে নিজ আয়ত্তে রাখো আর যা ভালো মনে কর, শুধু তাই কর এবং খারাপকে বর্জন কর। শুধুমাত্র নিজের ব্যাপারে সচেতন থাকো এবং সর্বসাধারণ মানুষ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা পরিহার কর’ (আবূ দাউদ হা/৪৩৪২, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৫৭, মিশকাত হা/৫৩৯৮)।
আলোচ্য হাদীছে ব্যাখ্যা-০১ :
ফিতনার যুগে মানুষকে চেনা কঠিন হয়ে যাবে। কেননা, প্রতিনিয়ত মানুষের চিন্তা-চেতনা, ‘আমাল-আখলাক, কাজকর্ম ও চলাফেরা পরিবর্তিত হবে। সে কারণেই মু’মিনদেরকে সতর্কতার সাথে জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। ষড়রিপুর সমন্বয়ে গঠিত মানব দেহ। যার প্রথম পাপের সূচনা হয় লোভ থেকে। আর লোভে পড়ে অধিকাংশ মানুষ সর্বদা অন্যকে ধোঁকা দিতে থাকে। ধোঁকা কঠিনতম গুণাহের কাজ। কঠিন এই জন্য বলা হয় যে, লোভে পড়ে ধোঁকার মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, হারামকে হালাল, হালালকে হারামের মত নানা প্রকার দ্বীনের বিধানে পরিবর্তন আনে। বলা যায়, ধোঁকা ব্যঞ্জকতা প্রদানের মানুষ প্রতিযোগীতা করে চলেছে। কেহ কেহ মনে করছেন, ধোঁকা ব্যঞ্জকের যুগের সূচনা হয়ে গেছে। ইন্টারনেট সেবার যুগে মানুষ সারা পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানকে এখন হাতের মুঠোতে নিয়ে এসেছে। যার ফলে মানুষ এখন রিয়া বা লৌকিকতা প্রদর্শনে প্রতিযোগীতা করছে। অতএব এটা ধোঁকা ব্যঞ্জকের যুগের সূচনা তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাসূল (ছাঃ)আগামবার্তা হিসেবে মনে করি বর্তমানে আমরা ফেৎনার যুগে অবস্থান করছি। মানুষ মানুষকে নানা উপায়ে ঠকাতে চায়, চায় ধোকা দিতে। মানুষ নিরূপায় হয়ে খেয়ানতকারীকে আমানতদার এবং সাধারণ তুচ্ছ ব্যক্তিরা জন সমাগমে ভাষণ দিবে। অনুরূপ হাদীছে এসছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের নিকট এমন ধোকাব্যঞ্জক যুগ আসবে, যাতে মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদীরূপে এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত করা হবে। যখন খেয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে এবং আমানতদার আমানতে খেয়ানত করবে। যখন জনসাধারণের ব্যাপারে তুচ্ছ লোক মুখ চালাবে’। (আহমাদ হা/৭৯১২, ইবনে মাজাহ হা/৪০৩৬, হাকেম হা/৮৪৩৯, ছহীহুল জামে হা/৩৬৫০)
অন্যত্র এসেছে, হুযায়ফাহ্ (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে দু’টি হাদীস বর্ণনা করেন। যার একটি আমি সংঘটিত হতে দেখেছি। আর অপরটির প্রতীক্ষায় আছি।
১. রাসূল (সা.) আমাদেরকে বলেছেন যে, আমানত মানুষের অন্তরসমূহের অন্তস্থলে (আল্লাহর নিকট হতে) অবতীর্ণ হয়। অতঃপর তারা কুরআন হতে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তারপর সুন্নাহ হতে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
২. আমানত কিরূপে উঠে যাবে- এ কথাটিও রাসূল (সা.) আমাদেরকে বলেছেন। এমন সময় মানুষ নিদ্রা যাবে, এমতাবস্থায় তার অন্তর হতে আমানত তুলে নেয়া হবে। তখন শুধুমাত্র কালো দাগের মতো একটি সাধারণ চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। অতঃপর মানুষ আবার নিদ্রা যাবে, তখন আমানত উঠিয়ে নেয়া হবে। এতে এমন ফোসকা সদৃশ চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে, যেমন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, তাকে তুমি নিজের পায়ের উপর রেখে রোমন্থন করলে তথায় ফুলে উঠে। তুমি অবশ্য স্ফীতি দেখতে পাবে, কিন্তু তার ভিতরে কিছুই নেই। আর লোকজন ভোরে উঠে স্বভাবত ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত হবে, কিন্তু কাউকেও আমানত রক্ষাকারী পাবে না।
তখন বলা হবে, অমুক সম্প্রদায়ে একজন বিশ্বস্ত ও আমানতদার লোক রয়েছে। আবার কোন ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হবে যে, সে কতই জ্ঞানী! সে কতই চালাক ও চতুর! এবং সে কতই সচেতন ও দৃঢ় প্রত্যয়ী! অথচ তার অন্তরে রাই পরিমাণও ঈমান নেই।(বুখারী হা/৬৪৯৭; তিরমিযী হা/২১৭৯ ; মিশকাত হা/৫৩৮১)
উপরোক্ত হাদীস থেকে এটা জানা যায়, মুসনাদে আহমাদ ও সহীহ ইবনু হিব্বানে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত সংকলিত হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : “যার আমানতদারিতা নেই তার দীন নেই।” ইমাম আলবানী (রহিমাহুল্লাহ) তদীয় সহীহ আল জামি’ গ্রন্থে হাদীসটি সহীহ বলেছেন। উক্ত হাদীসে এসেছে- “যার আমানতদারিতা নেই তার ঈমান নেই এবং যার প্রতিশ্রুতি নেই তার দীন নেই।” হাসান বসরী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন : দীন পুরোটাই হচ্ছে আমানত। আবূল আলিয়া (রহিমাহুল্লাহ)এর মতে আল্লাহ তা’আলার আদেশকৃত ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়সমূহ আমানত। (তুহফাতুল আহওয়াযী)
মানুষের রূপ পরিবর্তন হবে শেষ জামানাতে। সকালে সত্যবাদী রাতে মিথ্যেবাদী, আবার সকালে মিথ্যেবাদী সে রাতে সত্যবাদী এভাবে পরিবর্তন হবে মানুষের চরিত্র। ফজরের সালাত জামাআতে আদায় করে মুমিন হয় এবং অফিসে গিয়ে সূদের ঘুসের হিসেব কষে, ওজনে কম দেয়, মানুষকে ঠকায়, এভাবে রাতে সে কাফেরে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,بَادِرُوْا بِالْاَعْمَالِ فَسَتَكُوْنُ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَّ يُمْسِىْ كَافِرًا وَّ يُمْسِىْ مُؤْمِنًا وَّ يُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيْعُ دِيْنَهُ بِعَرَضٍ مِّنَ الدُّنْيَا- ‘তোমরা অনতিবিলম্বে সৎকাজের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যাও। কেননা শীঘ্রই অন্ধকার রাতের অংশের মত বিপদ-বিশৃংখলার বিস্তার ঘটবে। তখন মানুষ সকাল বেলা মুমিন থাকবে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যাবে, আবার সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে সকালে কাফের হয়ে যাবে। সে তার দ্বীনকে পার্থিব স্বার্থের বদলে বিক্রয় করবে’ (ছহীহুল জামি‘ হা/২৮১৪)
আলোচ্য হাদীসে ফিতনার ব্যাপকতা প্রকাশের পূর্বে সৎ কাজের প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফিতনাহ্ বলতে মুসলিমদের মাঝে দীন ও দুনিয়াবী বিষয়কে কেন্দ্র করে হত্যা, লুটতরাজ সংঘর্ষ ও পারস্পরিক মতবিরোধ চরম পর্যায়ে পৌছবে। এতে সাধারণ মুসলিমগণ সঠিকভাবে নিরাপদে ‘ইবাদত-বন্দেগী পালন করতে সক্ষম হবে না। ফিতনার ভয়াবহতা এতটাই ব্যাপক হবে যে, একদিনের মাঝেই মানুষ সকাল-সন্ধ্যায় ঈমানহারা হয়ে যাবে। সেই সময়ের ফিতনাকে আঁধার রাতের সাথে তুলনা করে এর রহস্যময় অস্পষ্টতাকে বুঝানো হয়েছে। এর কারণ উদঘাটন ও পরিত্রাণের উপায় বের করাও কঠিন হয়ে যাবে।
ইমাম ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, শেষ যামানার ফিতনাগুলো হবে কঠিন, বিভৎস, জটিল ও অস্পষ্ট। অল্প সময়ের ব্যবধানে মানুষের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ মানুষের কথা, কাজ ও অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। যেমন অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, আমানতের খিয়ানত করা, সৎ-অসৎ কাজ, সুন্নাত-বিদ্আত এবং ঈমান ও কুফর। অতএব, এসব ফিতনাহ্ হতে দূরে অবস্থান করা ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংশ্রব বর্জন করাই সর্বোত্তম। এসব ফিতনাহ্ হতে দূরে থাকার জন্য নবী (সা.) কিছু পদ্ধতি জানিয়ে দিয়েছেন। তন্মধ্যে প্রধান হলো, ধারালো অস্ত্র ভোঁতা করে দেয়া। এসব ফিতনায় কেউ যদি কোনভাবে আক্রান্ত হয়, তবে সেক্ষেত্রে আদম (আঃ)-এর পুত্রদ্বয়ের মাঝে শ্রেষ্ঠ হাবিলের ভূমিকা পালন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে কারণেই “ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদনে প্রতিযোগিতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে’’। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
ইমাম ইবনু মাজাহ ও ইমাম তবারানী (রহিমাহুল্লাহ) আবূ উমামাহ হতে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ’’শীঘ্রই এমন ফিতনাহ্ আপতিত হবে যে, সকালে মানুষ মু’মিন থাকবে সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে জ্ঞানের মাধ্যমে পরিত্রাণ দিবেন সে ব্যতীত’’। (শারহু ইবনে মাজাহ ২/১৩০৫)
ইমাম তিরমিযী ও ইমাম হাকিম (রহিমাহুল্লাহ) তদীয় গ্রন্থদ্বয়ে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তোমরা সাতটি বিষয়ের অপেক্ষার পূর্বে সৎকাজে প্রতিযোগিতা কর, সেগুলো হলো : বিস্মৃতকারী দারিদ্রতা, সীমালঘনকারী সচ্ছলতা, ধ্বংসাত্মক ব্যাধি, হঠাৎ মৃত্যু অথবা দাজ্জালের আগমন।
হাদীছের সবশেষ যা বুঝানো হয়েছে, দ্বীন ও দুনিয়া আলাদা কোন বিষয়বস্তু নয়। দ্বীন দ্বারা দুনিয়া একই রেখাতে পরিচালিত হবে। আর যারা আলাদা করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সুতরাং দুনিয়া নয়, দ্বীনকে আঁকড়ে ধরুন। দুনিয়ার জীবন যাত্রা একটি সফরের তুল্য মাত্র। যারা সফরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হবে দ্বীন পালনের উপর, কেবল তারাই সফল হবেন। অথচ মানুষ সুখে থাকতে পছন্দ করে, কষ্ট নয়। বিধায় দুনিয়ার মানুষ দ্বীনকে দুনিয়ার সামান্যতম হারাম সম্পদের বিনিময়ে বিক্রি করে ফেলছে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ’’মানুষ দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দিবে’’(ছহীহুল জামি‘ হা/৫১২৫)। অথচ আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া বিক্রয় করা উচিৎ (নিসা ৪/৭৪)। আর মুনাফিক্ব ও কাফের দুনিয়ার সামান্য মালের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে থাকে (ইবনে কাছীর)।
আলোচ্য হাদীছে ব্যাখ্যা-০২ :
মানুষের দোশ-ত্রুটি তালাশ করা গর্হিত কাজ। সর্বদা অন্যের নয়, নিজের দোষ-ত্রুটি তালাশ করা উচিৎ। রাসূল (ছাঃ) মানুষের দোষ ও ছিদ্রান্বেষণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি মানুষকে স্ব-স্ব দোষত্রুটি সংশোধনে আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ্র কাছে যেসব কথাবার্তা-ধ্যানধারণার মূল্য নেই তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সর্বোপরি মুসলিম ভাইয়ের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন ও তাদের ছিদ্রান্বেষণকারীর অন্তরে ঈমান থাকে না। আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلاَ تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِى بَيْتِهِ ‘ওহে যারা মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে ঈমান এনেছ, অথচ এখনো অন্তঃকরণে ঈমান পৌঁছেনি! তোমরা মুসলিমদের নিন্দা কর না, তাদের ছিদ্রান্বেষণ করো না। কেননা যে ব্যক্তি অপরের দোষ খোঁজে আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আর আল্লাহ যার দোষ তালাশ করেন, তাকে তার নিজস্ব বাসগৃহেই অপদস্থ করেন’ (আবুদাউদ হা/৪৮৮০; আহমাদ হা/১৯৮১৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৩৪০; হাসান ছহীহ)।
মুমিন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি তালাশ করা অন্যায় অপবাদ ও পাপ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡذُوۡنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ بِغَیۡرِ مَا اکۡتَسَبُوۡا فَقَدِ احۡتَمَلُوۡا بُهۡتَانًا وَّ اِثۡمًا مُّبِیۡنًا ‘আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে তাদের কৃত কোন অন্যায় ছাড়াই কষ্ট দেয়, নিশ্চয় তারা বহন করবে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপ’ (আহযাব ৩৩/৫৮)।
অন্যের নয়, নিজের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে তা অতি সত্তর সংশোধন করা উচিৎ। এতে নিজের আমল আখলাকে পূর্ণতা পায় এবং আত্মতৃপ্তি থাকে সদাসর্বদা। আবু হাত্বেব ইবনে হিব্বান আল বাসাতী (রহঃ) বলেন, ‘জ্ঞানীদের উপর আবশ্যক হ’ল অপর মানুষের মন্দচারী থেকে নিজেকে পূর্ণভাবে মুক্ত রাখা, নিজের দোষ-ত্রুটি সংশোধনার্থে সর্বদা নিমগ্ন থাকা। যে ব্যক্তি অপরেরটা ত্যাগ করে নিজের ভুলত্রুটি সংশোধনে সদা ব্যস্ত থাকে, তার দেহ-মন শান্তিতে থাকে। আর যে অন্য মানুষ সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে, তার অন্তর মরে যায়, আত্মিক অশান্তি বেড়ে যায় এবং তার অন্যায় কর্মও বৃদ্ধি পায়’ (রওয়াতুল উক্বালা পৃঃ ১৩১)।
জিহ্বা থেকে যে নিরাপদ সেই প্রকৃত মুমিন মুসলমান। আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তারা (সাহাবাগণ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইসলামে কোন্ জিনিসটি উত্তম? তিনি বললেনঃ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ. ‘যার জিহবা ও হাত হতে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে’ (বুখারী হা/১১)।
জিহ্বার পরিস্কার রাখতে পারলে জান্নাত আপনারই হবে। আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তার দুই চোয়ালের মধ্যস্থিত অঙ্গ (জিহ্বা) ও দু’পায়ের মাঝখানের অঙ্গ (লজ্জা-স্থান)-এর ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখবেন, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে” (তিরমিযী হা/১৫২৭)
মানুষ বুঝে না বুঝে অন্যকে জিহ্বার মাধ্যমে কষ্ট দেয়। কিন্তু সেই কষ্ট দেয়া যদি অহংকার বশতঃ হয় তবে দুনিয়ার সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যাবে। কাউকে তুচ্ছ জ্ঞান করার পরিণাম জাহান্নাম। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, বনী ইসরাঈলের মধ্যে দু’জন ব্যক্তি ছিলো। তাদের একজন পাপ কাজ করতো এবং অন্যজন সর্বদা ইবাদাতে লিপ্ত থাকতো। যখনই ইবাদাতরত ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে দেখত তখনই তাকে খারাপ কাজ পরিহার করার জন্য বলত।
একদিন সে তাকে পাপ কাজে লিপ্ত দেখে বলল, তুমি এমন কাজ থেকে বিরত থাকো। লোকটি বলল, আমাকে আমার রবের উপর ছেড়ে দাও। তোমাকে কি আমার উপর পাহারাদার করে পাঠানো হয়েছে? সে বলল, আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না অথবা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না।
অতঃপর দুই জনকেই মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ্র নিকট উপস্থিত করা হলে তিনি (আল্লাহ) ইবাদতকারী ব্যক্তিকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আমার সম্পর্কে জানতে? অথবা তুমি কি আমার হাতে যা আছে তার উপর ক্ষমতাবানী ছিলে? এবং পাপীকে বললেন, তুমি চলে যাও এবং আমার রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করো।
আর অপর ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি বললেন, তোমরা একে জাহান্নামে নিয়ে যাও। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَوْبَقَتْ دُنْيَاهُ وَآخِرَتَهُ ‘সেই মহান সত্ত্বার কসম! যার হাতে আমার জীবন! সে এমন উক্তি করেছে যার ফলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েই বরবাদ হয়ে গেছে’(আবূ দাউদ হা/৪৯১০; ছহীহ হাদীছ)।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের ইলম ও সঠিক বুঝ দান করুন আমীন।