আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন নবী (সা.) ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর উক্তি সংবলিত এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন, (অর্থাৎ) “হে প্রভু! এ সকল মূর্তিগুলো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত ও গোমরাহ করেছে, অতএব যে আমার অনুকরণ করবে সে-ই আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু”- (সূরাহ ইব্রাহীম ১৪: ৩৬)।
আর ’ঈসা আলায়হিস সালাম-এর উক্তিও পাঠ করলেন, অর্থাৎ “যদি তুমি তাদেরকে শাস্তি দাও, তারা তো তোমারই বান্দা”- (সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫:১১৮)। অতঃপর নবী (সা.) নিজের হস্তদ্বয় উঠিয়ে এ ফরিয়াদ করতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত। (তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর) এই বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা জিবরীল (আঃ)-কে বললেন, তুমি মুহাম্মাদ (সা.) -এর কাছে যাও এবং তাঁকে প্রশ্ন কর তিনি (সা.) কেন কাঁদছেন? অবশ্য আল্লাহ তা’আলা ভালোভাবেই জানেন, তাঁর কান্নার কারণ কী? তখন জিবরীল (আঃ) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁকে তাই অবগত করলেন যা তিনি বলেছিলেন, অতঃপর আল্লাহ
তা’আলা জিবরীল (আঃ)-কে পুনরায় বললেন, মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর কাছে যাও এবং তাঁকে বল, আমি আপনাকে আপনার উম্মতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট করে দেব এবং আপনাকে কষ্ট দেব না। (মুসলিম হা/৩৪৬, মিশকাত হা/৫৫৭৭)
অপর হাদীছে এসেছে, আবূ উমামাহ্ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, «وَعَدَنِي رَبِّي أَنْ يُدْخِلَ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعِينَ أَلْفًا لَا حِسَابَ عَلَيْهِمْ وَلَا عَذَابَ مَعَ كُلِّ أَلْفٍ سَبْعُونَ أَلْفًا وَثَلَاثُ حَثَيَاتٍ مِنْ حَثَيَاتِ رَبِّي» ‘আমার প্রভু আমার সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি আমার উম্মতের মধ্য থেকে সত্তর হাজার লোককে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাদের ওপর ’আযাবও হবে না। আবার উক্ত প্রত্যেক হাজারের সাথে সত্তর হাজার এবং আমার প্রভুর তিন অঞ্জলি ভর্তি লোকও জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’। (আহমাদ হা/২২৩৫৭, তিরমিযী হা/২৪৬৭, ছহীহুল জামি‘ হা/৭০৬২, মিশকাত হা/৫৫৫৬)। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছা.)-কে এ উম্মতের তিন অঞ্জলি ভর্তি লোক জান্নাতে দিয়ে সন্তুষ্ট করেদিবেন ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্তি সম্বলিত আয়াতটি ঘটনা বর্ণনা হেতু অথবা সূরা তিলাওয়াতকালে পাঠ করছিলেন। ইবরাহীম (আঃ) মূর্তিগুলোর প্রতি ইশারা করে দু’আ করছিলেন, “হে আমার প্রতিপালক! এ সমস্ত প্রতিমা বহু সংখ্যক মানুষকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে, অতএব যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।”
ইবরাহীম (আঃ)-এর কথা, “এ সমস্ত প্রতিমাগুলো বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ করে ফেলেছে।” এর অর্থ হলো এ সকল প্রতিমা পথভ্রষ্ট ও গোমরাহের কারণে হয়েছে।
“যে আমার অনুসরণ করবে” এর অর্থ হলো যে তাওহীদের ক্ষেত্রে, ইখলাসের ক্ষেত্রে এবং তাওয়াক্কুলের ক্ষেত্রে আমার অনুসরণ করবে। সে সকল বিষয়ে আমার অনুসারী দলভুক্ত বা সম্প্রদায়ভুক্ত হবে।
“আর কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু”, এর অর্থ হলো- “হে আল্লাহ! তুমি তো শিরক ছাড়া যাকে চাও তার সব গুনাহ ক্ষমা করে থাক, আর যাকে চাও তার প্রতি স্বীয় অনুগ্রহে রহম কর। এমনকি শিরককারীর প্রতিও তুমি অনুগ্রহ হলে তাকে ঈমান গ্রহণের তাওফীক দান করে থাক এবং সকর্মপরায়ণশীল করে দিয়ে থাক।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ঈসা (আঃ)-এর দু’আ সম্বলিত উক্তিটিও তিলাওয়াত করলেন। ‘ঈসা (আঃ) দু’আ করেছেন, “(হে আল্লাহ!) তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও তবে তুমি তো পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।”
অর্থাৎ কোন কিছুই তোমাকে পরাভূত করতে পারে না, তুমি মহাশক্তিমান কুদরতওয়ালা; তুমি যা ইচ্ছা তাই কর। তুমি এমন ফায়সালাকারী যে ফায়সালা কেউ খণ্ডন করতে পারে না।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দরবারে তার হাত দু’খানি উত্তোলন করে বললেন, “আল্ল-হুম্মা উম্মাতী উম্মাতী, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে ক্ষমা কর, আমার উম্মতের প্রতি রহম কর। এ বাক্যটি একাধিকবার উল্লেখের উদ্দেশ্য হলো সম্ভবত আবেদনটি গুরুত্বের সাথে পেশ করা অথবা পূর্বাপর সকল উম্মতকে শামিল করা। (وبكى) এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) কাঁদলেন, কেননা নবী (সা.) যে আয়াত পাঠ করলেন তাতে তার স্মরণ হলো ইবরাহীম খলীল আলায়হিস সালাম-এর কথা এবং ঈসা আলায়হিস সালাম-এর কথা, তারা উভয়ই তাদের উম্মতদের জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট সুপারিশ করেছেন। এতে আল্লাহর নবীর হৃদয় তার উম্মতের জন্য বিগলিত হয়ে গেল, ফলে তিনি কাঁদলেন।
আল্লাহ তা’আলা নবী মুহাম্মাদ-এর কান্নার কারণ জানা সত্ত্বেও জিবরীলকে পাঠিয়ে দিয়ে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, জিবরীল আলায়হিস সালাম এসে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তা বললেন, অর্থাৎ তিনি তার উম্মতের জন্য কাঁদছিলেন। জিবরীল আল্লাহ তা’আলার কাছে এসে কান্নার কারণ জানালে আল্লাহ তা’আলা জিবরীলকে বললেন, তুমি মুহাম্মাদের কাছে ফিরে গিয়ে বল, আমি (আল্লাহ) তার সকল উম্মাতের ব্যপারে তাকে সন্তুষ্ট করব, অসন্তুষ্ট করব না বা তাকে চিন্তিত ও দুঃখিত করে রাখব না। আপনার সন্তুষ্টির জন্য আপনার উম্মতকেও ক্ষমা করব এবং তাদের প্রতি রহম করব।
মহান আল্লাহর বাণী: (وَ لَسَوۡفَ یُعۡطِیۡکَ رَبُّکَ فَتَرۡضٰی) “আর সত্বর আল্লাহ আপনাকে (এরূপ বস্তু) দান করবেন যা পেয়ে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।” (সূরাহ্ আহ্ যুহা- ৯৩:৫)
‘আল্লামাহ্ নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটি বিভিন্ন ফায়দা সম্বলিত হাদীস। সেগুলোর কতিপয় হলো-
(এক) উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) চূড়ান্ত ভালোবাসার পরিচয় বর্ণনা করা এবং তাদের বিপদ ও মুসীবতকালে তাতে দেখাশুনা ও যত্নশীল থাকার দৃষ্টান্ত পেশ করা।
(দুই) এ উম্মতের মহাসুসংবাদ পেশ করা, যেমন মহান আল্লাহর ওয়াদা: (سَنُرْ ضِيكَ فِىْ أمَّتك وَلَانَسُوْؤُكَ) আমি আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব, আপনাকে অসন্তুষ্ট রাখব না। এ উম্মাতের জন্য এ হাদীস সর্বোচ্চ খুশির ও সন্তুষ্টির হাদীস।
(তিন) আল্লাহ তা’আলার নিকট আমাদের নবীর মহান মর্যাদা বর্ণনা করা।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, ৭০ পৃ, হা. ৩৪৬)
(চার) মূলত রাসূলুল্লাহ (ছা.) কোন উম্মাতকে অর্থাৎ- তাঁর তথা সুন্নাতের অনুসারী নিজের দলভুক্ত মনে করেন তাই তিনি তাদেরকে জাহান্নামে রাখবেন না। রাসূল (ছা.) বলেন, فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي যে আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। (বুখারী হা/৫০৬৩, মুসলিম হা/৩৪৬৯) —– কথাটি ব্যাখ্যার্থে নিলাম…. যারা ঈমান রেখে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তারা জাহান্নামে থাকবে না। আর যারা অনুসরণ করে কেবল তারাই রাসূল (ছা.)-এর উম্মাত। আবার যারা ঈমান রাখবে কিন্তু পাপের কারণে জাহান্নামে যাবে তারাও মুক্তি পাবেন রাসূল (ছা.)-এর শাফায়াতের মাধ্যমে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।