জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মৃত্যুর তিনদিন আগে এ কথা বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, «لَا يَمُوتَنَّ أَحَدُكُمْ إِلَّا وَهُوَ يُحْسِنُ الظَّنَّ بِاللَّه» ‘আল্লাহর ওপর ভাল ধারণা পোষণ করা ছাড়া তোমাদের কেউ যেন মৃত্যুবরণ না করে। (মুসলিম হা/২৮৭৭, মিশকাত হা/১৬০৫)
ব্যাখ্যা: মুল্লা ‘আলী ক্বারী বলেন, অবশ্যই আবশ্যই তোমাদের কেউ যেন এ চেতনা ও বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করে যে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করবেন। আর হাদীসটিতে অনুপ্রেরণা রয়েছে যে সৎ ‘আমলের চাহিদা হল সুধারণা।
খাত্ত্বাবী বলেন, কারও আল্লাহ সম্পর্কে ভালো ধারণা হল তা তার ভাল ‘আমল। তিনি আরও বলেন, তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে ভাল ধারণার মাধ্যমে তোমাদের ‘আমলকে সুন্দর কর। কারও আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ ধারণা হলে তার ‘আমলও খারাপ হয়ে যায়।
আর কখনও কখনও আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা হল তার ক্ষমা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
ত্বীবী বলেন, এখন তোমরা তোমাদের ‘আমলসমূহকে সুন্দর কর শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর সময় আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা হবে। আর যদি মৃত্যুর পূর্বে ‘আমল খারাপ হয় তাহলে মৃত্যুর সময় আল্লাহ সম্পর্কে কুধারণা হবে।
আমি মনে করি, সুধারনা অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলির প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং তাাঁর সাথে কোন কিছুর শরীক না করা। যথা- আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের পালনকর্তা, দয়ালু, মেহেরবান, বিচার দিবসের মালিক, তিনি একমাত্র ক্ষমাকারী, সকল বিষয়ে ক্ষমতাধর, রাজাধিরাজ, সকল বিষয়ের হিসাব গ্রহণকারী, তিনি সব দেখেন ও শুনেন, তিনিই একমাত্র অভিভাবক দুনিয়া ও আখেরাতে সকল কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর ইত্যাদি।
পথিকের মত জীবন-যাপন করো :
পথিব পথ শেষ করে গন্তব্যের যথাস্থানে পৌছার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে, নাওয়া খাওয়ার তোয়াক্কা করে না, শরীরের যত্ন নেয় না শুধু পথ চলাতে ব্যস্ত থাকে। ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা হাত দিয়ে আমার দু’কাঁধ ধরলেন। তারপর বললেন, «كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ» দুনিয়ায় তুমি এমনভাবে থাকো, যেমন- তুমি একজন গরীব অথবা পথের পথিক। (এরপর থেকে) ইবনু ’উমার (রাঃ) (মানুষদেরকে) বলতেন, إِذَا أَمْسَيْتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الْمَسَاءَ وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ وَمِنْ حياتك لموتك ’’সন্ধ্যা হলে আর সকালের অপেক্ষা করবে না। আর যখন সকাল হবে, সন্ধ্যার অপেক্ষা করবে না। নিজের সুস্থতার সুযোগ গ্রহণ করবে অসুস্থতার আগে ও জীবনের সুযোগ গ্রহণ করবে মৃত্যুর আগে। (বুখারী হা/ ৬৪১৬, মিশকাত হা/১৬০৪)।
ব্যাখ্যা: নাবাবী বলেন, হাদীসের অর্থ তুমি দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকবে না এবং তাকেই দেশ হিসেবে গ্রহণ করবে না আর নিজেকে সেখানে চিরস্থায়ীর জন্য ভাববে না এবং তার সাথে সম্পর্ক রাখবে না যেমন, দরিদ্র বা মুসাফির ব্যক্তি অন্যের দেশের সাথে সম্পর্ক রাখে না।
কারও মতে উদ্দেশ্য হলঃ মু’মিন ব্যক্তি দুনিয়াতে অবস্থান করবে বিদেশীর অবস্থানের মতো। সুতরাং তার অন্তরকে সম্পর্ক রাখবে না দূরবর্তী দেশের কোন কিছুর সাথে বরং সম্পর্ক রাখবে এমন এক দেশের সাথে সেখানে সে ফিরে যাবে। আর দুনিয়াকে প্রয়োজন মিটানোর অবস্থান হিসেবে গ্রহণ করবে আর প্রস্ত্ততি গ্রহণ করবে তার আসল দেশের প্রত্যাবর্তনের জন্য। এটাই হল গরীব বা বিদেশীর অবস্থা অথবা মুসাফিরের যে সে নির্ধারিত একটি স্থানে অবস্থান করে না বরং সর্বদাই স্থায়ী শহরের দিকে সফর করে যার অবস্থা দুনিয়াতে এরূপ তার চিন্তাই সফরে পাথেয় সংগ্রহকরণ আর দুনিয়া ভোগ বিলাস সামগ্রী গ্রহণ তার নিকট গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিরমিযীতে অতিরিক্ত বর্ণনা হিসেবে এসেছে,
فَإِنَّكَ لَا تَدْرِيْ يَا عَبْدَ اللهِ مَا اسْمُكَ غَدًا يَعْنِيْ لَعَلَّكَ غَدًا مِنَ الْأَمْوَاتِ دُوْنَ الْأَحْيَاءِ أَيْ لَا يَدْرِيْ هَلْ يُقَالُ لَكَ حَيٌّ أَوْ مَيِّتٌ؟
তুমি জান না হে ‘আবদুল্লাহ! আগামীকাল তোমার নাম কী হবে অর্থাৎ সম্ভবত জীবিত হতে বিদায় নিয়ে মৃতদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার তথা জানা থাকবে না তোমাকে কি মৃত্যু বা জীবিত বলা হবে।
আর হাকিমে ইবনে ‘আব্বাস-এর হাদীস মারফূ’ সূত্রে
أَنَّ النَّبِيَّ – ﷺ – قَالَ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُه اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابُكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتُكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغُكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتُكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেনঃ পাঁচটি বিষয়কে গনীমাত মনে করবে পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে-
তোমার যৌবনকে বার্ধক্য আসার পূর্বে
তোমার সুস্থতাকে অসুস্থ আসার পূর্বে
তোমার স্বচ্ছলতাকে দরিদ্র আসার পূর্বে
তোমার অবসরতাকে ব্যস্ততা আসার পূর্বে
তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার পূর্বে।
মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করো :
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ «أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ الْمَوْتِ» তোমরা দুনিয়ার ভোগবিলাস বিনষ্টকারী জিনিস, মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করো। (তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬০৭)
ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন, আল্লাহর সাথে লজ্জা করার মতো লজ্জা করো। সাহাবীগণ বললেন, আমরা আল্লাহর সাথে লজ্জা করছি, হে আল্লাহর রসূল! সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ লজ্জার মতো লজ্জা এটা নয় যা তোমরা বলছ। বরং প্রকৃত লজ্জা এমন যে, যখন ব্যক্তি লজ্জার হক আদায় করে সে যেন মাথা ও মাথার সাথে যা কিছু আছে তার হিফাযাত করে। পেট ও পেটের সাথে যা কিছু আছে তারও হিফাযাত করে। তার উচিত মৃত্যু ও তার হাড়গুলো পঁচে গলে যাবার কথা স্মরণ করে। যে ব্যক্তি পরকালের কল্যাণ চায়, সে যেন দুনিয়ার চাকচিক্য ও জৌলুশ ছেড়ে দেয়। অতএব, যে ব্যক্তি এসব কাজ করল, সে ব্যক্তিই আল্লাহর সাথে লজ্জার হক আদায় করল। (আহমাদ, তিরমিযী হা/ ২৪৫৮, মিশকাত হা/ ১৬০৮)।
ব্যাখ্যা: (فليحفظ رأسه) সে যেন আপন মাথাকে হিফাযাত করে আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া অন্য কোন কর্মে ব্যবহার হতে তথা তিনি ব্যতীত অন্য কারও উদ্দেশে সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) না করে এবং লোক দেখানোর উদ্দেশে সালাত আদায় না করে আর মাথাকে আল্লাহ ছাড়া কারও জন্য বিনয়ী না করে আর মাথাকে আল্লাহর বান্দার জন্য অহংকার উদ্দেশে না উঠায়।
(وَمَا وَعى) আর মাথা তার যাকে সংরক্ষণ করছে তথা যে সমস্তকে মাথা একত্রিত করেছে যেমন জিহবা চক্ষু কান এগুলোকে সংরক্ষণ করেছে যা হালাল না তা হতে।
(وَلْيَحْفَظِ الْبَطْنَ وَمَا حَوى) আপন পেটকে হারাম ভক্ষণ হতে রক্ষা করেছে এবং পেটের সাথে সংশ্লিষ্ট বস্ত্তকেও যেমন লজ্জাস্থান দু’পা, দু’হাত এবং হৃদয় আর এদের সংরক্ষণ বা হিফাযাতের বিষয় হল এগুলোকে গুনাহের কাজে ব্যবহার করবে না বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির কাজে ব্যবহার করবে। ত্বীবী বলেন, তোমরা যা মনে করছ তা প্রকৃত লজ্জা নয় আল্লাহর হতে বরং প্রকৃত লজ্জা হল যে নিজেকে সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা হিফাযাত করা।
মুমিনের মৃত্যু :
বুরায়দাহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মু’মিন কপালের ঘামের সাথে মৃত্যুবরণ করে। (তিরমিযী হা/৯৪২, মিশকাত হা/১৬১০)।
ব্যাখ্যা: মু’মিন মৃত্যুবরণ করে ঘামের সাথে কথাটির তাৎপর্য হলঃ
* মৃত্যুর কষ্টের মুখোমুখি হওয়ায় কপালের ঘাম ঝড়ে আর এর মাধ্যমে গুনাহ হতে মৃত ব্যক্তি মুক্ত হয়ে উঠে।
* মৃত্যুর সময় মু’মিন ব্যক্তির এ কাঠিন্যতার কারণে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
* মু’মিন ব্যক্তির এমনটি হয় তার লজ্জার কারণে যখন সুসংবাদ আসে তার নিকট অথচ সে পাপকাজ করেছে এর জন্য সে লজ্জিত হয় আর এই লজ্জার কারণে তার কপালে ঘাম ঝড়ে।
* আর এটা মু’মিনের মৃত্যুর আলামত বা চিহ্ন যদিও সে না বুঝে তা।
* কারও মতে এটা কিনায়া তথা রূপক আর হালাল রুযী উপার্জনে কষ্টের কারণে।