মুসলিম ভাইয়ের গলা কেটে দিয়ো না

মানুষ নিজের নামে প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। কিন্তু মন্দ শুনতে অপছন্দ করে। পক্ষান্তরে নিজের প্রশংসা শুনা উচিৎ নয়, বরং মন্দ বিষয়গুলো জানা আবশ্যক। কেননা মন্দ বিষয় জেনে নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারবে। আত্মশুদ্ধি ব্যতীত কোন মানুষ পরিপূর্ণ মুমিন বান্দা হতে পারে না। আত্ম সংশোধনের মাধ্যমে লোকমান (আঃ) নিজেকে একজন জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত করেছিলেন। যা কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে। কোন ব্যক্তি যখন তার অপর ভাইয়ের নামে প্রশংসায় পঞ্চমূখ হয়, তখন সে নিরবে তার ভাইয়ের গলা কেটে দেয়। তবে হ্যা, মানুষের প্রশংসা করা যাবে যা সত্য তাই বলে। আর কোন প্রকার বাড়াবাড়ী না করে তাকে আল্লাহর উপর সর্পদ করে। আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির খুব প্রশংসা করল। এটা শুনে তিনি বললেনঃ, «وَيْلَكَ قَطَعْتَ عُنُقَ أَخِيكَ» ’’হায় দুর্ভাগা! তুমি তোমার ভাইয়ের গলা কাটলে’’।

এ বাক্য তিনবার বললেন। অতঃপর বললেন, যদি তোমরা কারো প্রশংসা করা প্রয়োজন মনে করো, তবে এরূপ বলবে, أَحسب فلَانا وَالله حسيبه ’’আমি অমুক ব্যক্তি সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করি, প্রকৃত অবস্থার সঠিক হিসাব আল্লাহ তা’আলাই জানেন’’।

আর এটা ঐ সময় বলবে, যখন সে ব্যক্তি সম্পর্কে সত্যি সত্যিই তুমি এ ধারণা পোষণ করবে। কাউকে পূত-পবিত্র আখ্যায়িত করতে আল্লাহ তা’আলার ওপর বাড়াবাড়ি করবে না। (বুখারী হা/২৬৬২, ৬০৬১, ৬১৬২; মুসলিম হা/৩০০০; মিশকাত হা/৪৮২৭)।

ব্যাখ্যা : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে যে লোকটি অন্য আরেকজন লোকের প্রশংসা করছিল এই প্রশংসা ছিল মাত্রাতিরিক্ত এবং প্রশংসার ক্ষেত্রে অতি বাড়াবাড়ি, ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে বলেন (وَيْلَكَ) তোমার ধ্বংস হোক। (وَيْلَكَ) শব্দটি ‘আরবদের বর্ণনা বাগধারায় সতর্ক করণার্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। এর অর্থ (هَلَكْتَ هَلَاكًا) তুমি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছ অথবা ধ্বংস করে ফেলেছ। অর্থাৎ প্রশংসার ক্ষেত্রে তুমি অতিরঞ্জন করে নিজেকে মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে ফেলেছ, অথবা যার অতিরিক্ত প্রশংসা করছ তাকে ভীষণ ক্ষতির মধ্যে ফেলেছ। এ শব্দটি নিখাদ বদ্দু‘আ অর্থে নয় বরং ধমকী কিংবা আফসোস ও পরিতাপ প্রকাশার্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। সুতরাং (وَيْلَكَ) অর্থ তোমার জন্য আফসোস ও পরিতাপ। কোন কোন সংকলনে (وَيْحَكَ) শব্দ ব্যবহার হয়েছে। এটাও ধমকী অর্থে ব্যবহার হয়, তবে এতে থাকে মুহববাত ও দয়াশীলতা।

প্রশংসাকারীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা (قَطَعْتَ عُنُقَ أَخِيكَ) ‘‘তুমি তোমার ভাইয়ের গর্দান কেটে দিলে’’ এটা রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে ধ্বংস দ্বারা দীনের ক্ষতি বা ধ্বংস উদ্দেশ্য। কারো প্রশংসা করতে হলে, নিজের ধারণার কথাটুকু ব্যক্ত করবে মাত্র। সে এভাবে বলবে আমার ধারণা মতে অমুকে ভালো বা এমন। অথবা আমি তো তাকে ভালো বলেই মনে করি বা ধারণা করি। প্রকৃত ভালো কে সে তো আল্লাহ জানেন। অতএব আল্লাহর জ্ঞানের ও জানার উপর অতি প্রশংসাই আল্লাহর ওপর বাড়াবাড়ি করা, যা নিষিদ্ধ।

(মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৬১৬২; ‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৭৯৭; শারহুন নাবাবী ১৮শ খন্ড, হাঃ ৩০০০/৬৫)

অতিরিক্ত বাড়াবাড়ী করে প্রশংসা করলে তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরঞ্জিত প্রশংসা ইসলামে জায়েজ নেই।

মিকদাদ ইবনু আসওয়াদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,  ‘যখন তোমরা প্রশংসায় বাড়াবাড়িকারীদের দেখবে, তখন তাদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করবে’। মুসলিম হা/৩০০২; মিশকাত হা/৪৮২৬)।

ব্যাখ্যা :  কারো প্রশংসায় যখন অতিরঞ্জন হবে অথবা অহেতুক হবে অথবা প্রশংসা হবে নিজেকে চাটুকারিতামূলক কিংবা কিছু খাওয়া পাওয়ার জন্য তখন এ হুকুম।

এ হাদীসে রয়েছে তার চেহারায় মাটি নিক্ষেপ কর। কোন কোন সংকলনে রয়েছে তার মুখে মাটি পুরে দাও। মুখে মাটি পুরে দেয়া অথবা ধূলা নিক্ষেপ করা হলো হাদীসের প্রকাশ্য বা বাহ্যিক অর্থ। কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হলো তার চাহিদার মাল-সম্পদ তাকে দিয়ে দাও। কেননা দুনিয়ার মাল-সম্পদ ইযযত সম্মানের তুলনায় ধূলাবালির মতই তুচ্ছ বস্তু, সুতরাং সেই বস্তু তাকে দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে ফেলো।

আবার কেউ কেউ বলেছেন, তাকে সামান্য কিছু দিয়ে দাও, এই সামান্য কিছুকেই ধূলার সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন। (এছাড়াও আরো অনেকে অনেক ব্যাখ্যা করেছেন, বিস্তারিত মূল মিরক্বাতুল মাফাতীহ দ্রঃ)

মুল্লা ‘আলী কারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সামনে প্রশংসাকারীকে তিরস্কার করা এবং এ কাজ থেকে বিরত থাকার প্রতি উৎসাহিত করা। কেননা কারো সামনে তার প্রশংসা তাকে দাম্ভিক-অহংকারী বানিয়ে ফেলে।

‘আল্লামা খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ কিছু মানুষ আছে যারা স্বভাবগতভাবে মানুষের প্রশংসা করে তার নিকট থেকে কিছু খেতে বা পেতে চায়, নিশ্চয় এদের জন্য অত্র হাদীসের বিধান যথার্থ। কিন্তু যে ব্যক্তি সমাজের কল্যাণে প্রশংসনীয় কোন ভালো কাজ করল, অন্যদেরকেও এমন ভালো কাজে উৎসাহ দানের লক্ষ্যে এবং কল্যাণকর কাজে অনুপ্রাণিত করতে কারো প্রশংসা করল, সে ঐ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮৯৬)

পরিশেষে : প্রকৃত বন্ধ আপনার সামনে দোষ-ত্রুটি তুলে ধরলে তাকে বুকে টেনে তার কল্যাণ কামনা করা উচিৎ। পক্ষান্তরে যদি কেহ প্রশংসাতে পঞ্চমূখ হয়ে অতিরঞ্জিত প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করে তবে তাকে থামিয়ে দিন। কেননা আল্লাহর কোন বান্দা ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই কারু সম্পর্কে সত্য প্রশংসা করলে পরিশেষে বলুন, তার সম্পর্কে আল্লাহ অধিক অবগত। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top