নবী সহধর্মিণী আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার মাতা পিতাকে কখনো ইসলাম ব্যাতীত অন্য কোন দ্বীন পালন করতে দেখিনি এবং এমন কোন দিন অতিবাহিত হয়নি যেদিন সকালে কিংবা সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়ীতে আসেন নি। যখন মুসলিমগণ (মুশ্রিকদের নির্যাতনে) অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন, তখন আবূ বকর (রাঃ) হিজরত করে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন। অবশেষে বারকুল গিমাদ (নামক স্থানে) পোঁছালে ইবনু দাগিনার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। সে ছিল তার গোত্রের নেতা। সে বলল, হে আবূ বকর, কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমার স্ব-জাতি আমাকে বের করে দিয়েছে। তাই আমি মনে করছি পৃথিবী ঘুরে বেড়াব এবং আমার প্রতিপালকের ইবাদত করব।
ইবনু দাগিনা বলল, হে আবূ বকর! আপনার মত ব্যাক্তি (দেশ থেকে) বের হতে পারে না। আপনি তো নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করে দেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানদের মেহমানদারী করে থাকেন, এবং সত্য পথের পথিকদের বিপদ আপদে সাহায্য করেন। সুতরাং আমি আপনাকে আশ্রয় দিচ্ছি, আপনাকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতার অঙ্গীকার করছি। আপনি ফিরে যান এবং নিজ শহরে আপনার রবের ইবাদত করুন।
আবূ বকর (রাঃ) ফিরে এলেন। তাঁর সঙ্গে ইবনু দাগিনাও এল। ইবনু দাগিনা বিকেল বেলা কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গের নিকট গেল এবং তাদের বলল, আবূ বকরের মত লোক দেশ থেকে বের হতে পারে না এবং তাকে বের করে দেওয়া যায় না। আপনারা কি এমন ব্যাক্তিকে বের করবেন, যে নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানের মেহমানদারী করন এবং ন্যায়ের উপর থাকার দরুন বিপদ এলে সাহায্য করেন। ইবনু দাগিনার আশ্রয়দান কুরাইশগণ মেনে নিল, এবং তারা ইবনু দাগিনাকে বলল, তুমি আবূ বকরকে বলে দাও, তিনি যেন তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করেন। সালাত (নামায/নামাজ) তথায়ই আদায় করেন, ইচ্ছা মাফিক কুরাআন তিলাওয়াত করেন। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের যেন কষ্ট না দেন। আর এসব যেন প্রকাশ্যে না করেন। কেননা, আমরা আমাদের মেয়েদের ও ছেলেদের ফিত্নায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করি।
ইবনু দাগিনাকে আবূ বকর (রাঃ) কে এসব কথা বলে দিলেন। সে মতে কিছুকাল আবূ বকর (রাঃ) নিজের ঘরে তাঁর রবের ইবাদত করতে লাগলেন। সালাত (নামায/নামাজ) প্রকাশ্যে আদায় করতেন না এবং ঘরেই কোরআন তিলওয়াত করতেন। এরপর আবূ বকরের মনে (একটি মসজিদ নির্মাণের কথা) উদিত হল। তাই তিনি তাঁর ঘরের পাশেই একটি মসজিদ তৈরী করে নিলেন। এতে তিনি সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতে এবং কোরআন তিলওয়াত করতেন। এতে তার কাছে মুশরিক মহিলা ও যুবকগণ ভীড় জমাতে লাগল। তারা আবূ বকর (রাঃ) এর এ কাজে বিস্মিত হত এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আবূ বকর (রাঃ) ছিলেন একজন ক্রন্দনশীল ব্যাক্তি, তিনি যখন কুরআন পড়তেন তখন তাঁর চোখের অশ্রু সামলিয়ে রাখতে পারতেন না। এ ব্যাপারটি মুশরিকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের আতঙ্কিত করে তুলল এবং তারা ইবনু দাগিনাকে ডেকে পাঠাল। সে এল।
তারা তাকে বলল, তোমার আশ্রয় প্রদানের কারণে আমরাও আবূ বকর কে আশ্রয় দিয়েছিলাম, এই শর্তে যে, তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করবেন কিন্তু সে শর্ত তিনি লংঘন করেছেন। আমাদের ভয় হচ্ছে, আমাদের মহিলা ও সন্তানরা ফিতনায় পড়ে যাবে। কাজেই তুমি তাঁকে নিষেধ করে দাও। তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর গৃহে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করলে, তিনি তা করতে পারেন। আর যদি তিনি তা অস্বীকার করে প্রকাশ্যে তা করতে চান তবে তাঁকে তোমার আশ্রয় প্রদান ও দায় দায়িত্বকে প্রত্যার্পণ করতে বল। আমরা তোমার আশ্রয় প্রদানের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করাকে অত্যন্ত অপছন্দ করি, আবার আবূ বকরকেও এভাবে প্রকাশ্যে ইবাদত করার জন্য ছেড়ে দিতে পারিনা।
আয়শা (রাঃ) বলেন, ইবনু দাগিনা এসে আবূ বকর (রাঃ)-কে বলল, আপনি অবশ্যই জানেন যে, কী শর্তে আমি আপনার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলাম। আপনি হয়ত তাতে সীমিত থাকবেন অন্যথায় আমার জিম্মাদারী আমাকে ফিরত দিবেন। আমি এ কথা আদৌ পছন্দ করিনা যে আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং আমার আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যাক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ আরববাসীর নিকট প্রকাশিত হউক। আবূ বকর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমার আশ্রয় তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার আল্লাহর আশ্রয়ের উপরই সন্তুষ্ট আছি। এসময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান (স্বপ্নে) দেখান হয়েছে। সে স্থানে খেজুর বাগান রয়েছে এবং তা দুইটি প্রস্তরময় প্রান্তরে অবস্থিত। এরপর যারা আবিশিনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, তাদেরও অধিকাংশ সেখান থেকে ফিরে মদিনায় চলে আসলেন। আবূ বকর (রাঃ)ও মদিনায় দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, তুমি অপেক্ষা কর। আশা করছি আমাকেও অনুমতি দেওয়া হবে। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান! আপনিও কি হিজরতের আশা করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আবূ বকর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহচর্য লাভের জন্য নিজেকে হিজরত থেকে বিরত রাখলেন এবং তাঁর নিকট যে দু’টি উট ছিল এ দুটি চার মাস পর্যন্ত (ঘরে রেখে) বাবলা গাছের পাতা (ইত্যাদি) খাওয়াতে থাকেন।
ইবনু শিহাব উরওয়া সূত্রে আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যে একদিন আমরা ঠিক দুপুর বেলায় আবূ বকর (রাঃ) এর ঘরে বসাছিলাম। এমন সময় এক ব্যাক্তি এসে আবূ বকরকে সংবাদ দিল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা ঢাকা অবস্থায় আসছেন। তা এমন সময় ছিল যে সময় তিনি পূর্বে কখনো আমাদের এখানে আসেননি। আবূ বকর (রাঃ) তাঁর আগমন বার্তা শুনে বললেন, আমার মাতাপিতা তাঁর প্রতি কুরবান। আল্লাহর কসম, তিনি এ সময় নিশ্চয় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কারনেই আসছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৌঁছে (প্রবেশের) অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেওয়া হল। প্রবেশ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বকরকে বললেন, এখানে অন্য যারা আছে তাদের বের করে দাও। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কুরবান! এখানেতো আপনারই পরিবার। তখন তিনি বললেন, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
আবূ বকর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান! আমি আপনার সফরসঙ্গী হতে ইচ্ছুক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঠিক আছে। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার পিতামাতা কুরবান! আমার এ দু’টি উট থেকে আপনি যে কোন একটি গ্রহণ করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ঠিক আছে) তবে মূল্যের বিনিময়ে। আয়িশা (রাঃ) বলেন, আমরা তাঁদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা দ্রুততার সহিত সম্পন্ন করলাম এবং একটি থলের মধ্যে, তাঁদের খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে দিলাম। আমার বোন আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) তার কোমর বন্ধের কিছু অংশ কেটে সে থলের মুখ বেঁধে দিলেন। এ কারনেই তাঁকে ’জাতুন নেতাক’ (কোমর বন্ধ বিশিষ্ট) বলা হত।
আয়শা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর (রাঃ) (রওনা হয়ে) সাওর পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। তাঁরা সেখানে তিনটি রাত অবস্থান করলেন। আবদুল্লাহ ইবনু আবূ বকর (রাঃ) তাঁদের পাশেই রাত্রি যাপন করতেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ। তিনি শেষ রাত্রে ওখান খেকে বেরিয়ে মক্কায় রাত্রি যাপনকারী কুরাইশদের সহিত ভোর বেলায় মিলিত হতেন এবং তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হত তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, ও স্মরণ রাখতেন। যখন আঁধার ঘনিয়ে আসত তখন তিনি সংবাদ নিয়ে তাঁদের উভয়ের কাছে যেতেন। আবূ বকর (রাঃ)-এর গোলাম আমির ইবনু যুহাইরা তাঁদের কাছেই দুধালো বকরীর পাল চড়িয়ে বেড়াত। রাত্রের কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে বকরীর পাল নিয়ে তাঁদের নিকটে যেত এবং তাঁরা দু’জন দুধ পান করে আরামে রাত্রিযাপন করতেন। তাঁরা বকরীর দুধ দোহন করে সাথে সাথেই পান করতেন।
তারপর শেষ রাতে আমির ইবনু ফুহাইরা বকরীগুলি হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। এ তিনটি রাতের প্রত্যেক রাতে সে এরুপই করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বকর (রাঃ) বনী আবদ ইবনু গোত্রের এক ব্যাক্তিকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ’খির্রীত’ পথ প্রদর্শক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। পারদর্শী পথ প্রদর্শককে ’খির্রীত’ বলা হয়। আদী গোত্রের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সে ছিল কাফির কুরাইশের ধর্মাবলম্বী। তাঁরা উভয়ে তাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাঁদের উট দু’টি তার হাতে দিয়ে দিলেন এবং তৃতীয় রাত্রের পরে সকালে উট দু’টি সাওর গুহার নিকট নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন। আর সে যথা সময়ে তা পৌঁছিয়ে দিল। আর আমির ইবনু ফুহাইরা ও পথ প্রদর্শক তাঁদের উভয়ের সঙ্গে চলল। প্রদর্শক তাঁদের নিয়ে উপকূল পথ ধরে চলতে লাগল।
ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, আবদুর রাহমান ইবনু মালিক মুদলেজী আমাকে বলেছেন, তিনি সুরাকা ইবনু মালিকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তার পিতা তাকে বলেছেন, তিনি সুরাকা ইবনু জু’শুমকে বলতে শুনেছেন যে, আমাদের নিকট কুরাইশ কাফিরদের দূত আসল এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর (রাঃ) এ দুই জনের যে কোন একজনকে যে হত্যা অথবা বন্দী করতে পারবে তাকে (একশ উট) পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিল। আমি আমার কওম বনী মুদলীজের এক মজলিসে বসা ছিলাম। তখন তাদের নিকট থেকে এক ব্যাক্তি এসে আমাদের নিকটে দাঁড়াল। আমরা বসাই ছিলাম। সে বলল, হে সুরাকা, আমি এই মাত্র উপকুলের পথে কয়েকজন মানুষকে যেতে দেখলাম। আমার ধারণা এরা মুহাম্মদ ও তাঁর সহগামীগণ হবেন। সুরাকা বললেন, আমি বুঝতে পারলাম যে এরা তাঁরাই হবেন। কিন্তু তাকে বললাম, এরা তারা নয়, বরং তুমি অমুক অমুককে দেখেছ। এরা এই মাত্র আমাদের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল।
তারপর আমি কিছুক্ষন মজলিসে অবস্থান করে (বাড়ী) চলে এলাম এবং আমার দাসীকে আদেশ করলাম, তুমি আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে যাও এবং অমুক টিলার আড়ালে ঘোড়াটি ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি বর্শা হাতে নিলাম এবং বাড়ির পিছন দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বর্শাটির এক প্রান্ত হাতে ধরে অন্য প্রান্ত মাটি সংলগ্ন অবস্থায় আমি টেনে নিয়ে চলছিলাম ঐ অবস্থায় মাটি সংলগ্ন অংশ দ্বারা মাটির উপর রেখাপাত করতে করতে আমার ঘোড়ার নিকট নিয়ে পৌঁছলাম এবং ঘোড়ায় আরোহণ করে তাঁকে খুব দ্রুত ছুটালাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। আমি প্রায় তাঁদের নিকট পৌঁছে গেলাম, এমন সময় আমার ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে গেল। আমিও তাঁর পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম। তারপর আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তুণের দিকে হাত বাড়ালাম এবং তা থেকে তীরগুলো বের করলাম ও তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করে নিলাম যে আমি তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারব কিনা।
তখন তীরগুলি দুর্ভাগ্যবশতঃ এমনভাবে বেরিয়ে এল যে, ভাগ্য নির্ধারণের বেলায় এমনটি হওয়া পছন্দ করিনা। আমি পুনরায় ভাগ্য পরীক্ষার ফলাফল অমান্য করে অশ্বারোহণ করে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এত নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যে তাঁর তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি (আমার দিকে) ফিরে তাকাচ্ছিলেন কিন্তু আবূ বকর (রাঃ) বার বার তাকিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় আমার ঘোড়ার সামনের পা দু’টি হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে গেল এবং আমি তার উপর থেকে পড়ে গেলাম। তখন আমি ঘোড়াকে ধমক দিলাম, সে দাঁড়াতে ইচ্ছা করল, কিন্তু পা দু’টি বের করতে পারছিল না। অবশেষে যখন ঘোড়াটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, তখন হঠাৎ তার সামনের পা দু’টি যেস্থানে গেড়ে ছিল সেস্থান থেকে থেকে ধুঁয়ার ন্যায় ধূলি আকাশের দিকে উঠতে লাগল। তখন আমি তীর দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। এবারও যা আমার অপছন্দনীয় তা-ই প্রকাশ পেল। তখন উচ্চস্বরে তাঁদের নিরাপত্তা চাইলাম। এতে তাঁরা থেমে গেল এবং আমি আমার ঘোড়ায় আরোহণ করে এলাম।
আমি যখন ইত্যাকার অবস্থায় বার বার বাধাপ্রাপ্ত ও বিপদে পতিত হচ্ছিলাম তখনই আমার অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ মিশনটি অচিরেই প্রভাব বিস্তার করবে। তখন আমি তাঁকে বললাম আপনার কওম আপনাকে ধরে দিতে পারলে একশ উট পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। মক্কায় কাফিরগণ তাঁর সম্পর্কে যে ইচ্ছা করেছে তা তাঁকে জানালাম। এবং আমি তাঁদের জন্য কিছু খাবার ও অন্যানা সামগ্রী পেশ করলাম। তাঁরা তা থেকে কিছুই নিলেন না। আর আমার কাছে এ কথা ছাড়া কিছুই চাইলেন না, আমাদের সংবাদটি গোপন রেখ। এরপর আমি আমাকে একটি নিরাপত্তা লিপি লিখে দেওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। তখন তিনি আমের ইবনু ফুহাইরাকে আদেশ করলেন। তিনি একখণ্ড চামড়ায় তা লিখে দিলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা দিলেন।
ইবনুুে শিহাব (রহঃ) বলেন, উরওয়া ইবনু যুবায়র (রাঃ) আমাকে বলেছেন, পথিমধ্যে যুবায়েরর সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাত হয়। তিনি মুসলিমদের একটি বানিজ্যিক কাফেলার সাথে সিরিয়া থেকে ফিরছিলেন। তখন জুবায়ের (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর (রাঃ) কে সাদা রঙের পোশাক দান করলেন। এদিকে মদিনায় মুসলিমগণ শুনলেন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনার পথে রওয়ানা হয়েছেন। তাই তাঁরা প্রত্যহ সকালে মদিনার (বাইরে) হার্রা পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করে থাকতেন, দুপুরে রোদ প্রখর হলে তাঁরা ঘরে ফিরে আসেতেন। একদিন তাঁরা পূর্বাপেক্ষা অধিক সময় অপেক্ষা করার পর নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। এমন সময় একজন ইয়াহুদী তার নিজ প্রয়োজনে একটি টিলায় আরোহন করে এদিক ওদিক কি যেন দেখছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথী সঙ্গীদেরকে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় মরীচিকাময় মরুভুমির উপর দিয়ে আগমন করতে দেখতে পেল।
ইয়াহুদী তখন নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে উচ্চস্বরে চীৎকার করে বলে উঠল, হে আরব সম্প্রদায়! এইতো সে ভাগ্যবান ব্যাক্তি- যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। মুসলিমগণ তাড়াতাড়ি হাতিয়ার তুলে নিয়ে এবং মদিনার হাররার উপকন্ঠে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে মিলিত হলেন। তিনি সকলকে নিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে বনী আমর ইবনু আউফ গোত্রে অবতরন করলেন। এদিনটি ছিল রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার। আবূ বকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরব রইলেন। আনসারদের মধ্য থেকে যাঁরা এ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেননি তাঁরা আবূ বকর (রাঃ) এর কাছে সমবেত হতে লাগলেন, তারপর যখন রৌদ্রত্তাপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর পড়তে লাগল এবং আবূ বকর (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তাঁর চাঁদর দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপর ছায়া করে দিলেন। তখন লোকেরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে চিনতে পারল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনু আউফ গোত্রে দশদিনের চেয়ে কিছু বেশী সময় অতিবাহিত করলেন, এবং সে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা (কুরআনের ভাষায়) তাক্ওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উঠে আরোহণ করে রওয়ানা হলেন। লোকেরাও তাঁর সঙ্গে চলতে লাগলেন। মদিনায় (বর্তমান) মসজিদে নব্বীর স্থানে পৌঁছে উটটি বসে পড়ল। সে সময় ঐ স্থানে কপিতয় মুসলিম সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতেন। এ জায়গাটি ছিল আসআদ ইবনু যুরারার আশ্রয়ে পালিত সাহল ও সুহায়েল নামক দু’জন ইয়াতীম বালকের খেজুর শুকাবার স্থান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে উটটি যখন এ স্থানে বসে পড়ল, তখন তিনি বললেন, ইনশাল্লাহ, এ স্থান্তটই হবে মানযিল। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বালক দু’টিকে ডেকে পাঠালেন এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য তাদের নিকট জায়গাটির মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয়ের আলোচনা করলেন।
তাঁরা বলল ইয়া রাসুলাল্লাহ! বরং এটি আমরা আপনার জন্য বিনামুল্যে দিচ্ছি। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছ থেকে বিনামুল্যে গ্রহণে অসম্মতি জানালেন এবং অবশেষে স্থানটি তাদের থেকে খরিদ করে নিলেন। তারপর সেই স্থানে তিনি মসজিদ নির্মাণ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ নির্মাণ কালে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে ইট বহন করছিলেন এবং ইট বহনের সময় তিনি আবৃত্তি করছিলেন এ বোঝা খায়বারের (খাদ্যদ্রব্য) বোঝা নয়। ইয়া রব, এর বোঝা অত্যন্ত পুন্যময় ও পবিত্র। তিনি আরো বলছিলেন, ইয়া আল্লাহ! পরকালের প্রতিদানই প্রকৃত প্রতিদান। সুতরাং আনসার ও মুজাহিরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মুসলিম কবির কবিতা আবৃত্তি করেন, যার নাম আমাকে বলা হয়নি। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কবিতাটি ছাড়া অপর কোন পূর্ণাঙ্গ কবিতা পাঠ করেছেন বলে, কোন বর্ণনা আমার কাছে পৌঁছেনি। (বুখারী হা/৩৯০৫-৬)