হে মানুষ! আল্লাহকে লজ্জা কর


— মুহাম্মাদ
আসাদুল্লাহ আল-গালিব
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ
اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- اسْتَحْيُوا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ. قَالَ
قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا لَنَسْتَحْيِى وَالْحَمْدُ لِلَّهِ. قَالَ :
لَيْسَ ذَاكَ وَلَكِنَّ الاِسْتِحْيَاءَ مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ أَنْ
تَحْفَظَ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى وَتَحْفَظَ الْبَطْنَ وَمَا حَوَى وَتَتَذَكَّرَ
الْمَوْتَ وَالْبِلَى وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا فَمَنْ
فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدِ اسْتَحْيَا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)
বলেন
, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর সত্যিকারের লজ্জাআমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা অবশ্যই আল্লাহকে
লজ্জা
করি- আলহামদুলিল্লাহ তিনি বললেন,
কথা সেটা নয়বরং আল্লাহকে
যথার্থভাবে
লজ্জা করার অর্থ এই যে, (১) তুমি তোমার
মাথা ও যেগুলিকে সে জমা করে
, তার হেফাযত কর। (২) তুমি তোমার পেট ও
যেগুলিকে সে জমা করে
, তার হেফাযত কর। (৩) আর তোমার বারবার স্মরণ করা উচিৎ মৃত্যুকে ও তার পরে
পচে-গলে যাওয়াকে
। (৪) আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে, সে যেন পার্থিব বিলাসিতা পরিহার করেযে ব্যক্তি
উপরোক্ত
কাজগুলি করে, সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে লজ্জা করে[1]

ব্যাখ্যা :
তোমরা আল্লাহকে লজ্জা করঅর্থ আল্লাহকে
যথাযথভাবে ভয় কর
ও শ্রদ্ধা করঅর্থাৎ তার শাস্তির ভয়ে নয় কিংবা কিছু পাওয়ার
আশায় নয়
বরং তার বড়ত্ব ও সর্বোচ্চ মর্যাদাকে সম্মান করতিনি তোমার সব কথা শুনছেন অতএব এমন কথা বলো না, যাতে তিনি কষ্ট
পান ও তিনি অসম্মানিত
বোধ করেনতুমি তোমার গুরুজনের
সামনে অনেক কথা বলতে লজ্জা পাও
লোকজনের সামনে অনেক কথা বলতে ভয় পাওকেউ শুনে ফেলবে সেই ভয়ে অনেক কথা চেপে যাওতাহলে কি তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করবে না, যিনি তোমার গোপন কথা শোনেন ও মনের কথা
জানেন? লোকলজ্জার ভয়ে কিংবা ধরা পড়ার আশংকায় তুমি প্রকাশ্যে কোন মন্দকর্ম করো নাঅথচ গোপনে বা অন্ধকারে তুমি সেই কাজ করছকারণ মানুষ দেখছে না অথচ আল্লাহ সবই দেখছেনঅতএব তুমি যেমন মানুষ থেকে লজ্জা পাও, তেমনি আল্লাহকে লজ্জা করতাঁর চোখের আড়ালে তুমি কিছুই করতে পারবে নাতুমি সর্বদা তাঁর চোখের সামনে রয়েছঅতএব মনিবের সামনে
চাকর
যেভাবে কাজ করে, তুমি সেভাবে ভীত ও সতর্কভাবে কাজকর্ম কর
লজ্জা তিন প্রকার : নিজেকে লজ্জা,
মানুষকে লজ্জা ও
আল্লাহকে লজ্জা
প্রথম প্রকারের লজ্জা থেকে মানুষ বেপরওয়াসে গোপনে ও একাকী যা ইচ্ছা তাই করেঅথচ সে জানেনা যে,
অনেকগুলি অবিচ্ছেদ্য সাক্ষী সর্বদা তার সাথে রয়েছেযাদেরকে বাদ দিয়ে সে কিছুই করতে পারে না সাক্ষীগুলি হল তার দেহচর্ম ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদিআল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ
وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
আজ আমরা তাদের মুখে মোহর এঁটে দিবআর তাদের হাত আমাদের সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা
তাদের কৃতকর্মের
সাক্ষ্য দিবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৫)তিনি আরও বলেন,
حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ
وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَقَالُوا
لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي
أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-
وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُونَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلَا
أَبْصَارُكُمْ وَلَا جُلُودُكُمْ وَلَكِنْ ظَنَنْتُمْ أَنَّ اللَّهَ لَا يَعْلَمُ
كَثِيرًا مِمَّا تَعْمَلُونَ- وَذَلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِي ظَنَنْتُمْ
بِرَبِّكُمْ أَرْدَاكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ مِنَ الْخَاسِرِينَ-
আল্লাহর শত্রুরা যখন
জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে
, তখন তাদের কান, চোখ ও দেহচর্ম তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেতখন তারা তাদের দেহচর্মকে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন,
তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন তোমাদের কান, চোখ ও তবক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না… এ ধারণা থেকেই তোমরা তাদের কাছে কোন কিছু গোপন
করতে না
আর তোমরা মনে করতে যে তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন
না
অথচ তোমাদের
প্রতিপালক
সম্পর্কে তোমাদের এই ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছেফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছ’ (হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২৩)
গোপনে মন্দকর্ম করার সময় দ্বিতীয়
সাক্ষী থাকেন
আল্লাহ যিনি তার গোপন ও প্রকাশ্য সব খবর রাখেন অতএব কোন কাজ করার সময় নিজের অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীগুলি থেকে যেমন সাবধান
থাকতে হবে
, তেমনি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ থেকে লজ্জিত হতে হবে
সাঈদ বিন ইয়াযীদ আল-আযদী (রাঃ)
বলেন
, তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, আপনি আমাকে উপদেশ দিনতিনি বললেন,
أُوْصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ، وَأَنْ تَسْتَحِيَ مِنَ
اللهِ كَمَا تَسْتَحِي رَجُلاً صَالِحًا مِنْ قَوْمِكَ
আমি তোমাকে উপদেশ
দিচ্ছি এই মর্মে যে
, তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং আল্লাহকে লজ্জা কর, যেমন তুমি তোমার
কওমের পুণ্যবান ব্যক্তিকে
লজ্জা করে থাক[2]
নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত মূল্যবান
উপদেশ
কেননা একজন দুষ্ট লোক সর্বদা পুণ্যবান ও সৎকর্মশীল জ্ঞানী-গুণী লোকদের সামনে প্রকাশ্য ভাবে কোন অন্যায় কর্ম করতে লজ্জা পায়তাহলে যিনি তার ভিতর-বাহির সব খবর রাখেন, যিনি সর্বদা তার সম্মুখে আছেন, তাকে কেন মানুষ লজ্জা করবে না? আর এটাই স্বাভাবিক যে
যিনি যত নিকটে থাকেন
, মানুষ তাকে তত বেশী লজ্জা পায় তাহলে আল্লাহর
চাইতে নিকটে আর কে আছে
? আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ
خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ
أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ-
আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মনের
মধ্যে যে কুচিন্তা
আসে সেটাও আমরা জানিআর তার গর্দানের মূল শিরা থেকেও আমরা তার
নিকটবর্তী
’ (ক্বাফ ৫০/১৬)
তবে যেসব কাজে আল্লাহ পর্দা করতে
বা লজ্জা করতে নিষেধ
করেননি, সেসব কাজে আল্লাহকে লজ্জা করার প্রয়োজন নেইযেমন মুআবিয়া বিন হায়দাহ আল-কুশায়রী (রাঃ) একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলেন, يَا نَبِىَّ اللهِ عَوْرَاتُنَا مَا نَأْتِى مِنْهَا وَمَا نَذَرُ
হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের এমন কিছু লজ্জার বিষয় রয়েছে যা আমরা করি এবং যা আমরা ছাড়ি নাজবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, احْفَظْ عَوْرَتَكَ
إِلاَّ مِنْ زَوْجَتِكَ أَوْ مَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ
তুমি তোমার লজ্জাস্থানের হেফাযত করতবে তোমার স্ত্রী অথবা দাসী ব্যতীত’ … হাদীছের শেষাংশে তিনি বলেন, فَاللهُ أَحَقُّ أَنْ يُسْتَحْيَا مِنْهُ مِنَ النَّاسِ
মানুষের চাইতে
আল্লাহ অধিকতর লজ্জার যোগ্য
[3] অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে
ও তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সর্বাবস্থায় তাঁকে লজ্জা কর এবং তাঁর
অবাধ্যতা থেকে বিরত হও
বিগত দিনে বৃষ্টি বিঘ্নিত
ঘনঘটাপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে
পাহাড়ের গুহায় আটকে যাওয়া তিন যুবকের যে
কাহিনী
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে একজন ছিল
সেই যুবক
, যে তার প্রেমিকার সঙ্গে কুকর্মে উদ্যত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে প্রেমিকার মুখ থেকে শুনেছিল, يَا
عَبْدَ اللهِ اتَّقِ اللهَ
হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর’!
ব্যস তাতেই সে
বিরত হয়
সেদিন সে আল্লাহকে লজ্জা করেছিলতার পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহর
হুকুমে গুহার মুখ
থেকে বিশাল পাথরটি সরে যায় এবং তারা সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়[4]
মানুষ সর্বদা তার চাইতে বড় ব্যক্তি
থেকে লজ্জা পায়
অথচ অন্যদেরকে লজ্জা পায় নাসে শিশুদেরকে লজ্জা
পায় নাকেননা অবুঝ শিশু
কিছু
বুঝে নাসে পাগলকে লজ্জা পায় নাকেননা সেও কিছু বুঝে না বা তার
সাক্ষ্য
কেউ বিশ্বাস করে নাসে পশুকেও লজ্জা পায় নাকেননা ওরা বাকশক্তিহীন এবং তারাও কিছু বুঝে না বা কিছু বুঝলেও তা গ্রহণযোগ্য হয় নামানুষ মূর্খ থেকে জ্ঞানীকে বেশী লজ্জা পায় এবং একজনের চাইতে অধিক জনকে বেশী লজ্জা পায় সে সাধারণ লোকদের চাইতে প্রশাসনের লোকদের বেশী ভয় পায়এমতাবস্থায় সকল
জ্ঞানীর
বড় জ্ঞানী, সকল শাসকের বড় শাসক আল্লাহকে সে কেন ভয়
পায় না
? কেন আল্লাহর চোখের সামনে পাপ কাজে সে লজ্জা পায় না? অথচ তিনিই লজ্জা
পাওয়ার অধিক
হকদার!
চারটি বিষয়ের ব্যাখ্যা :
হাদীছে বর্ণিত চারটি কাজকে
আল্লাহকে লজ্জা করার প্রধান বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে
তন্মধ্যে প্রথমটি ল মাথা ও তাতে সঞ্চিত বিষয়গুলির হেফাযত করাএর স্থুল ও আধ্যাত্মিক দুটি দিক রয়েছে স্থূল দিকটি হ, মাথার সাথে যুক্ত চুল, কান, চোখ, নাক-মুখ ইত্যাদিযেগুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন
রাখা ও যত্ন করার মাধ্যমে
হেফাযত করা আবশ্যকযেভাবে হাদীছে বর্ণিত হয়েছেদ্বিতীয় দিকটি হ, নৈতিক বা আধ্যাত্মিকএর অর্থ হল মাথাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট সিজদাবনত না করামাথা ও সংশ্লিষ্ট
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর
অবাধ্যতায় লিপ্ত না
করামাথার মধ্যে রিয়া,
অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ
ইত্যাদি রোগ-ব্যাধি
লালন না করাবরং যে কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, সে কাজে মাথা ও
তার সকল প্রত্যঙ্গ ও
চিন্তাশক্তিকে নিয়োজিত করা
মুখে কথা বলার সময় ভেবে দেখ এটা
মিথ্যা
, গীবত বা অপবাদ হচ্ছে কি-না, চোখে কিছু দেখার সময় ভেবে দেখ তাতে তোমার
কোন কল্যাণ আছে
কি-না, হাতে কাজ করার সময় দেখ  তাতে পরকালের পাথেয় সঞ্চয়
হচ্ছে কি-না
চিন্তা করার সময় ভাব সেটা কুচিন্তা হচ্ছে কি-নাকেননা আল্লাহ বলেন,وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ
وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولاً

যে বিষয়ে তুমি
জানো না
, সে বিষয়ের পিছে পড়ো না নিশ্চয়ই কান, চোখ, হৃদয় সবকিছুই জিজ্ঞাসিত হবে(ইসরা ১৭/৩৬)
(২) পেট ও তার মধ্যেকার সবকিছুকে
হেফাযত করা
এর অর্থ পেটে হারাম খাদ্য সঞ্চিত না করাপেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
হৃদয়
, হাত-পা, গুপ্তাঙ্গ সবগুলিকে অন্যায় কর্ম থেকে হেফাযত করা এবং আল্লাহর
আনুগত্যে
নিয়োজিত করারাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ
يَضْمَنْ لِى مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ
الْجَنَّةَ
যে ব্যক্তি তার দুটি অঙ্গের যামিন হবে, আমি তার জান্নাতের যামিন
হব
তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ, অর্থাৎ জিহবা এবং তার দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ, অর্থাৎ লজ্জাস্থান[5]
(৩) মৃত্যুকে ও তার পরবর্তী
পচে-গলে যাওয়া অবস্থাকে স্মরণ
করাবিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণকেননা শক্তি মদমত্ত মানুষ সাধারণতঃ শয়তানের সাথী হয় এবং সে আল্লাহকে লজ্জা
পায় না
সে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয় সেকারণেই
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন
, أَكْثِرُوا ذِكْرَ
هَاذِمِ اللَّذَّاتِ
তোমরা স্বাদ বিনষ্টকারী বস্ত্তকে (অর্থাৎ
মৃত্যুকে) বেশী বেশী স্মরণ কর
[6] একই কারণে মুসলমানকে জানাযায়
অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে
যাতে ঐ দৃশ্য দেখে নিজের মৃত্যুদৃশ্য স্মরণ হয়[7] এবং সে পাপ থেকে বিরত হয়এছাড়া রাসূল (ছাঃ) বিচক্ষণ মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন,
أَكْثَرُهُمْ لِلْمَوْتِ ذِكْرًا وَأَحْسَنُهُمْ لِمَا
بَعْدَهُ اسْتِعْدَادًا أُولَئِكَ الأَكْيَاسُ
যারা মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে এবং মৃত্যু
পরবর্তী জীবনের জন্য সবচেয়ে
সুন্দরভাবে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে[8]
(৪) যে ব্যক্তি আখেরাতকে কামনা
করে
, সে ব্যক্তি
দুনিয়ার
চাকচিক্য পরিহার করেঅর্থাৎ দুনিয়ার বিলাস-ব্যসন,
আরাম-আয়েশ,
অর্জন-বিয়োজন ভুলে
গিয়ে সবকিছুর উপর পরকালীন জীবনকে
অগ্রাধিকার দেওয়া সেকারণ অন্যত্র
রাসূল (ছাঃ) বলেন
,مَنْ طَلَبَ الدُّنْيَا أَضَرَّ
بِالْآخِرَةِ، وَمَنْ طَلَبَ الْآخِرَةَ أَضَرَّ بِالدُّنْيَا- فَأَضِرُّوْا
بِالْفَانِي لِلْبَاقِيْ-
যে ব্যক্তি দুনিয়ার (ভোগ-বিলাস) অন্বেষণে
লিপ্ত থাকে
, সে আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেআর যে ব্যক্তি আখেরাতের পাথেয় অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, সে দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করেঅতএব তোমরা চিরস্থায়ী বস্ত্তকে পাওয়ার জন্য ক্ষণস্থায়ী বস্ত্তকে ক্ষতিগ্রস্ত কর[9]
তবে এর অর্থ একেবারেই দুনিয়া
পরিত্যাগ করা নয়
বরং এর অর্থ হ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সৌন্দর্য ও বিলাসিতা পরিহার করাআল্লাহ বলেন,
لَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
তুমি তোমার
পার্থিব অংশ
ভোগ করতে ভুলো না’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৭)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)
বলেন
, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, كُنْ فِى الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ ، أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ
হে আব্দুল্লাহ!
তুমি দুনিয়াতে থাক একজন আগন্তুক বা একজন মুসাফিরের মত
এবংনিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর[10]
হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,
كَانَ أَكْثَرُ دَعْوَةٍ يَدْعُو بِهَا: اللَّهُمَّ
رَبَّنَا آتِنَا فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِى الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا
عَذَابَ النَّارِ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ সময় দোআ পড়তেন, হে আল্লাহ! হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে দুনিয়ায় মঙ্গল
দাও
ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে
জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও
[11]
অতএব আলোচ্য হাদীছে দুনিয়াকে
অস্বীকার করা হয়নি
বরং অধিক দুনিয়াবী চাকচিক্য ও বিলাসিতাকে পরিহার করতে বলা
হয়েছে এবং দুনিয়ার উপর
আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে
দুনিয়া ও আখেরাত দুটি সম্পূর্ণ পৃথক
আবাসস্থল
দুনিয়া ল লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বস্ত্তযে ব্যক্তি দুনিয়ার লোভে আটকে
যাবে
, সে ব্যক্তি আখেরাত হারাবেঅতএব জৈবিক ও মানবিক চাহিদা অনুযায়ী যতটুক প্রয়োজন, ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকতে হবেএর বাইরে সর্বদা আখেরাতের সঞ্চয় বৃদ্ধির কাজে লিপ্ত থাকতে হবেযিনি যত বেশী আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবেন,
তিনি তত বেশী
আল্লাহর নিকটবর্তী হবেন এবং তার প্রতি আল্লাহ তত বেশী খুশী
হবেন কিন্তু যে তার বিপরীত করবে, আল্লাহ তার উপর রুষ্ট হবেনঅতএব আল্লাহ থেকে সাবধান! সর্বদা তাকে লজ্জা কর!
মুরববীকে দেখে যেমন মানুষ জড়সড়
হয়
, গুরুজন দেখবেন
ভেবে
নিজেকে লুকায়, তেমনি আল্লাহ দেখছেন ভেবে কি মানুষ লজ্জিত
হবে না
? তাই আল্লাহর পথে বাধা দানকারীকে এবং আত্মভোলা মানুষকে ধমক দিয়ে আল্লাহ সতর্ক করে বলেন, أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَىসে কি জানে না যে আল্লাহ তাকে দেখছেন? (আলাক্ব ৯৬/১৪)
মানুষ যখন কোন পাপ করতে চায়,
তখন তা অন্যকে
লুকিয়ে করে বা
অন্ধকারে যেয়ে করেঅথচ আল্লাহর কাছে কোন কিছুই গোপন
থাকে না
তাই কবি বলেন,
وَإِذا خَلَوتَ بِرِيبَةٍ
في ظُلمَةٍ + وَالنَفسُ داعيَةٌ إِلى الطُّغيانِ
فاِستَحي مِن نَظَرِ الإِلَهِ وَقُل لَها + إِنَّ الَّذي
خَلَقَ الظَّلامَ يَرانِي
যখন তুমি অস্থির হয়ে
অন্ধকারে লুকাবে
, অথচ প্রবৃত্তি সর্বদা অবাধ্যতার দিকে আহবানকারীতখন তুমি আল্লাহর
দৃষ্টি থেকে লজ্জিত হও এবং
প্রবৃত্তিকে বল, নিশ্চয়ই যিনি অন্ধকারকে সৃষ্টি করেছেন,
তিনি আমাকে দেখছেন
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর
অবাধ্যতা করতে চায়
, সে যেন তার যমীনের উপর তা না করেতার দেওয়া খাদ্য ভক্ষণ না
করে
, তার দেওয়া আলো-বাতাস গ্রহণ না করেও তার সৃষ্ট আকাশের নীচে বসবাস না করেকেননা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁরঅতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করে, সে কোন লজ্জায় তার যমীনে বসবাস করে? তার দেওয়া খাদ্য ভক্ষণ করে? তার দেওয়া পানি
পান করে
? তার সৃষ্ট বায়ু সেবন করে? সে কিভাবে আল্লাহর দেওয়া অমূল্য নেমত তার চক্ষু দিয়ে দর্শন করে ও কান দিয়ে শ্রবণ করে? ঐ শোন আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-
وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللهِ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ
فَإِلَيْهِ تَجْأَرُونَ- ثُمَّ إِذَا كَشَفَ الضُّرَّ عَنْكُمْ إِذَا فَرِيقٌ
مِنْكُمْ بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ
তোমাদের কাছে যেসব নেমত রয়েছে, সবই আল্লাহর দেওয়াঅতঃপর যখন তোমরা
কষ্টে পতিত
হও, তখন তাঁরই কাছে কান্নাকাটি করআবার যখন আল্লাহ
কষ্ট দূর করে দেন
, তখন তোমাদের একদল তাদের পালনকর্তার সাথে অন্যকে শরীক করে
(নাহল ১৬/৫৩-৫৪)
আমরা আল্লাহর নিকট তাঁকে লজ্জা
করার তাওফীক কামনা করছি
এবং যে কাজ তিনি ভালবাসেন ও যে কাজে তিনি খুশী হন, তা করার শক্তি প্রার্থনা করছি
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)
বলেন
, ‘হায়া’ (الْحَيَاء ) অর্থ শরম, বৃষ্টি, তরতাযা ইত্যাদি, যা হায়াত’ (الْحَيَاة ) মাছদার হতে উৎপন্নযার অর্থ হজীবন এজন্য বৃষ্টি (الغَيْثُ)কে জীবন বলা হয়কেননা বৃষ্টিপাতের মাধ্যমেই মৃত যমীন জীবিত হয়
ও সেখানে ঘাস ও উদ্ভিদ সমূহের জন্ম হয়
আরহায়াত’ (الحَيَاة
) বললে দুনিয়া ও
আখেরাতের জীবন (
حَيَاة الدُنْيَا والآخِرَة
)-কে বুঝানো হয়অতএব যার হায়াঅর্থাৎ লজ্জা নেই,
সে দুনিয়াতে মৃত এবং আখেরাতে হতভাগ্য (مَيِّتٌ
فِي الدُّنْيَا وَشَقِىٌّ فِي الآخِرَةِ)
অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করার সময় তাকে
লজ্জা করে
, আখেরাতে সাক্ষাতকালে আল্লাহ তাকে শাস্তিদানে
লজ্জাবোধ করবেন
আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতায় লজ্জাবোধ করে না, আল্লাহ তাকে শাস্তিদানে
লজ্জাবোধ
করবেন না[12]
সারকথা : হাদীছটির সারকথা এই যে, মানুষের মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরা দেহ যন্ত্রটির ভিতর ও বাহির মন্দের খনি ও অপরাধপ্রবণচুম্বক খন্ডের মত সে দ্রুত অপরাধের প্রতি আকৃষ্ট হয়কিন্তু যখনই আল্লাহর কথা স্মরণ হয় বা তাকে স্মরণ করানো হয়, তখনই সে ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় এবং সরল পথে ফিরে আসেঅতএব সবাইকে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে লজ্জা করা উচিৎ
আল্লাহ বলেন, سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ
السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ
فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ

তোমরা প্রতিযোগিতা
করে এগিয়ে চলো তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের
দিকে, যার প্রশস্ততা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের ন্যায়এটা প্রস্ত্তত করা হয়েছে তাদের জন্য,
যারা আল্লাহ ও তার রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এটি আল্লাহর
অনুগ্রহ
তিনি যাকে খুশী তাকে সেটা দান করে থাকেনআর আল্লাহ মহান করুণার
অধিকারী
(হাদীদ ৫৭/২১)
অতএব আসুন! আমরা প্রকাশ্যে ও গোপনে
আল্লাহকে লজ্জা করি এবং তাঁর ক্ষমা ও জান্নাত লাভে প্রতিযোগিতা
করি- আমীন!


[1].
আহমাদ হা/৩৬৭১;
তিরমিযী হা/২৪৫৮,
মিশকাত হা/১৬০৮,
সনদ হাসান জানায়েযঅধ্যায় মৃত্যু কামনা
অনুচ্ছেদ
[2].
ত্বাবারাণী কাবীর,
বায়হাক্বী শুআব হা/৭৭৩৮;
ছহীহাহ হা/৭৪১
[3].
তিরমিযী হা/২৭৯৪;
আবু দাঊদ হা/৪০১৭
প্রভৃতি
[4].
বুখারী হা/২৩৩৩,
মুসলিম হা/২৭৪৩,
মিশকাত হা/৪৯৩৮
[5].
বুখারী হা/৬৪৭৪;
মিশকাত হা/৪৮১২
[6].
তিরমিযী হা২৩০৭,
মিশকাত হা/১৬০৭
[7].
বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৬৪৯
[8].
ইবনু মাজাহ
হা/৪২৫৯
; ছহীহাহ হা/১৩৮৪
[9].
আহমাদ, মিশকাত হা/৫১৭৯;
সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৮৭
[10].
বুখারী হা/৬৪১৬; ইবনু মাজাহ হা/৪১১৪; মিশকাত হা/৫২৭৪
[11].
বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৮৭
[12].
ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ শাফী, মরক্কো : দারূল মারেফাহ, ১ম প্রকাশ ১৯৯৭,
পৃঃ ৬৯

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top