আযানের ইতিহাস সার-সংক্ষেপ

আযান (আরবি: أَذَان আযান্‌) হচ্ছে মসজিদে জামাতে সালাত আদায়ের জন্য ইসলামি আহ্বান বা ডাকধ্বনি। দিনের নির্ধারিত সময়ে একজন মুয়াজ্জিন আযান পাঠ করেন।
ʾআযান শব্দের মূল অর্থ দাড়ায় أَذِنَ ডাকা, আহবান করা। যার মূল উদ্দেশ্য হলো অবগত করানো। এই শব্দের আরেকটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ʾআজুন। (أُذُن), যার অর্থ হলো “শোনা”। কুরআনে মোট পাঁচ স্থানে আজুন শব্দটি এসেছে। পারিভাষিক অর্থে, শরিয়ত নির্ধারিত আরবি বাক্যসমূহের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে উচ্চকণ্ঠে সালাতের আহবান করাকে আযান বলা হয়।
মক্কায় অবস্থানকালে মহানবী (ﷺ) তথা মুসলিমগণ বিনা আযানে নামায পড়েছেন। অতঃপর মদ্বীনায় হিজরত করলে হিজরী ১ম (মতান্তরে ২য়) সনে আযান ফরয হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৭৮)
সকল মুসলমানকে একত্রে সমবেত করে জামাআতবদ্ধভাবে নামায পড়ার জন্য এমন এক জিনিসের প্রয়োজন ছিল, যা শুনে বা দেখে তাঁরা জমা হতে পারতেন। এ জন্যে তাঁরা পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাযের অপেক্ষা করতেন। এ মর্মে তাঁরা একদিন পরামর্শ করলেন; কেউ বললেন, ‘নাসারাদের ঘন্টার মত আমরাও ঘন্টা ব্যবহার করব।’ কেউ কেউ বললেন, ‘বরং ইয়াহুদীদের শৃঙ্গের মত শৃঙ্গ ব্যবহার করব।’ হযরত উমার (রাঃ) বললেন, ‘বরং নামাযের প্রতি আহ্বান করার জন্য একটি লোককে (গলি-গলি) পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়?’ কিন্তু মহানবী (ﷺ) বললেন, “হে বিলাল! ওঠ, নামাযের জন্য আহ্বান কর।”(বুখারী ৬০৪ , মুসলিম, সহীহ)

(’আবদুল্লাহ) ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুসলিমরা মদীনায় হিজরত করে আসার পর সালাতের জন্য অনুমান করে একটা সময় ঠিক করে নিতেন। সে সময় সকলে একত্রিত হতেন। কারণ তখনও সালাতের জন্য কেউ আহবান করতো না। একদিন এ বিষয় নিয়ে তারা আলোচনায় বসতেন। কেউ বললেন, নাসারাদের মতো ঘণ্টা বাজানো হোক। আবার কেউ বললেন, ইয়াহূদীদের মতো শিঙ্গার ব্যবস্থা করা হোক। তখন ’উমার (রাঃ) বলেন, তোমরা কি একজন লোক পাঠিয়ে দিয়ে মানুষকে সালাতের জন্য আহবান করতে পারবে? তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বিলাল! উঠো, সালাতের জন্য আহবান করো (আযান দাও)। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৬৪৯)।
ব্যাখ্যা: হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, সালাতের মানুষকে ডাকার জন্য একজন ব্যক্তিকে পাঠানোর ব্যাপারে ‘উমার (রাঃ)-এর ইশারা, এ ব্যাপারে সাহাবীগণের মধ্যকার পরামর্শের পূর্বের ঘটনা। ‘আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ)-এর স্বপ্ন দেখার ঘটনাও এরপরের। ক্বাযী ‘ইয়ায বলেন, এ হাদীসে বিলাল (রাঃ) কর্তৃক সালাতের জন্য মানুষকে ডাকার যে কথা এসেছে তা হচ্ছে মানুষকে সালাতের সময় ঘোষণা জানাবার, বিধিসম্মত আযানের কথা নয়।

আবূ দাঊদ-এ সহীহ সানাদে বর্ণিত ‘আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ)-এর হাদীস যে, ‘‘তিনি এক রাত্রে আযান-এর পদ্ধতি স্বপ্নে দেখলেন। অতঃপর তিনি এ খবর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানাতে গেলেন। এমতাবস্থায় ‘উমার (রাঃ)-ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলেন। ঘটনা শুনে ‘উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ সে অর্থাৎ- ‘আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) যা স্বপ্নে দেখেছে আমিও স্বপ্নে তা দেখেছি’’। এ হাদীস প্রমাণ করে যে, এটা ছিল ভিন্ন বৈঠকের ঘটনা। মূলকথা হলো প্রথম ঘটনা ছিল মানুষকে সালাতের সময়ের খবর জানানো। অতঃপর ‘আবদুল্লাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) স্বপ্নে দেখা পদ্ধতিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শারী‘আহসম্মত বলে ঘোঘণা দেন। বিষয়টিতে ওয়াহীর নির্দেশও রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, আযানের পদ্ধতি শুধু স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই প্রবর্তিত হয়নি।

ফজরের আযানের অতিরিক্ত বাক্য সম্পর্কে মতামত :
মিশকাত হা/ ৬৪৫ : আবূ মাহযূরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে আযানের নিয়ম শিখিয়ে দিন। তিনি [আবূ মাহযূরাহ্ (রাঃ)] বলেন, (আমার কথা শুনে) তিনি আমার অথবা এবং বললেন, বলোঃ আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার। এ বাক্যগুলো তুমি খুব উচ্চস্বরে বলবে। এরপর তুমি নিম্নস্বরে বলবে, আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ, আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ এবং আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্ল-হ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্ল-হ। তুমি পুনরায় উচ্চস্বরে শাহাদাত বাক্য বলবেঃ আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ, আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্ল-হ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্ল-হ, হাইয়্যা ’আলাস্ সলা-হ্, হাইয়্যা ’আলাস্ সলা-হ্; হাইয়া ’আলাল ফালা-হ, হাইয়্যা ’আলাল ফালা-হ। এ আযান ফজরের (ফজরের) সালাতের জন্য হলে বলবে, আস্‌সলা-তু খয়রুম মিনান্ নাওম, আস্‌সলা-তু খয়রুম মিনান্ নাওম। আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার। লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ। (আবূ দাঊদ)[1] [1] সহীহ : আবূ দাঊদ ৫০০।
………
ব্যাখ্যা: ফাজরের (ফজরের) আযানের মধ্যে ‘‘আস্ সলা-তু খয়রুম্ মিনান্ নাওম’’ বাক্য প্রবেশ করানো হয়েছে ‘উমার (রাঃ)-এর আদেশে। অথচ এ বাক্যটি ফাজরের (ফজরের) আযানের মধ্যে বলার জন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল (রাঃ)-কে আদেশ দিয়েছিলেন, এ কথা প্রমাণিত। তাহলে ‘উমার (রাঃ)-এর এ আদেশে এ বাক্যটি ফাজরের (ফজরের) আযানে ঢুকানো হয়েছে বলে যে কথা এ হাদীসে রয়েছে তার উত্তর কী হবে? এর অনেক উত্তর হতে পারে। যেমন- ‘উমার (রাঃ)-এর এ আদেশ দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, এ বাক্যটি অন্য কোন সালাতের আযানে না বলে শুধু ফাজরের (ফজরের) আযানে বলতে হবে। তার উদ্দেশ্য ছিল বিধিসম্মান আযান ব্যতীত ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করার জন্য আমীরের বাড়ির দরজায় এসে এ বাক্য বলে ডাকা ঠিক না, এ কথা বুঝানো। অর্থাৎ- এ বাক্যটি ফাজরের (ফজরের) আযানে বলা অব্যাহত রাখতে হবে এবং ফাজরের (ফজরের) আযান ছাড়া অন্য কোথাও কাউকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে না (মুয়াত্তা মালিক হা/১৫৪ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় বর্ণিত)। তবে প্রকাশ থাকে যে, ফজরের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম–’ বলতে ভুলে গেলে আযানের কোন ক্ষতি হয় না। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৯)। আবার টেপ-রেকর্ডারের মাধমে আযান শুদ্ধ নয়। কারণ, আযান এক ইবাদত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৬১-৬২)।

অতএব, এটা কোন বিদ‘আত নয়। এটা সুন্নাতের অন্যতম। কুরআন-হাদীছ পেলে আমরা নিজেদের মতকে গুটিয়ে রাখি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top