লিলবর আল-বারাদী
আমরা শিশুকালে এমন অসহায় মুখাপেক্ষী যে নিজে নিজে কোন কাজ করার শক্তি থাকেনা, আমাদের পিতামাতা আমাদের এই সময় আমাদের অতি যত্নে লালন পালন করেন, তারা কখনও বিরক্ত বোধ করেন না, যদি মনে রাগের ছায়া পড়ে পরক্ষণে বুকে আগলে আদর ও মমতার চাদরে আচ্ছাদিত করে সন্তানকে। আর কোমল পরশে শান্ত হয় সন্তান। পিতামাতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, নিজের প্রতি খেয়াল করে না সর্বদা তার সন্তানের চিন্তায় মগ্ন। কিভাবে আমার সন্তান ভূবনে মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে? পিতামাতা পৃথিবীর সকল কিছু ছাড় দেয় তার সন্তানের প্রতি লক্ষ্য রেখে।
অথচ আমরা কি করি? আমারা যখন নিজে নিজে চলতে শিখি তখন তাদেরকে ভুলে যায়। যেমনটি পশু পাখিরা করে থাকে। আমদের সংসারে পিতামাতা আমাদের জন্যে বোঝা হয়ে যায়। তাদের নিজেদের কাছে রাখতে চাইনা! তাদের উপর আমরা চরম অবহেলা করি, তাদেরকে আমরা আমাদের সমাজে চলার অযোগ্য মনে করি, আমাদের অফিসের বস/কলিগদের সাথে পরিচয় করে দিতেও লজ্জা বোধ করি। বিদেশী কুকুর আমাদের বাসায় স্থান পেলেও আমাদের পিতামাতার স্থান হয় না। কারণ খুঁজতে গেলে কলবর বেড়ে যাবে। তাই সংক্ষেপে পিতামাতা সেকেলের, তারা আয় করতে পারেনা, ভরন পোষন ও চিকিৎসা খরচ ব্যয় বহুল, তাদের চিন্তা চেতনা প্রগতিশীল নয়, তাদের সংস্পর্শে নতুন প্রজন্ম বড় হলে নিঁচু মনের হবে, সারাক্ষণ তারা এটা সেটার চাহিদা করে, সর্বদা বকবক করে, তারা সংসারের বোঝা, স্বামীর আয়ে একমাত্র স্ত্রীর কর্তৃত্ব, বাসায় রাখার মত যথেষ্ট ঘর নেই। এরকম সহস্র অযুহাতে অপদার্থ ছেলে মেয়েরা একটি নিরাপদ স্থানে ফেলে আসে। যে স্থানের নাম বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে রাখার পর তাদের কোনো খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজন বোধও করেন না। তাই এভাবে ধুকে ধুকে মাতাপিতা শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে তখন সন্তান তার অবহেলিত পিতা-মাতাকে বেশী বেশী মিস্ (Miss) করে, যার ফলে গড়ে উঠেছে মা দিবস, বাবা দিবস। ইসলামে কোন দিবস পালনের মাসয়ালা আছে বলে আমার জানা নেই।
১. সদ্য বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ঐ মা তার ছেলেকে চিঠি লিখেছেন- ‘খোকা তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোটো দাদুভাই সবাই ভালো আছে তো? জানি তোদের তিন জনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ও বুঝতে পেরেছি, এখনো আমার উপর থেকে তোদের অভিমান যায়নি। আমাকে যেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশি রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কী বা আমি করব বল। সময় মতো ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিলনা। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই জেদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা। আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিলো, তাদের তড়িঘড়িতে পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগলো। এতে তো বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে? আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি। আর কেনই-বা ভালো থাকবনা বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনো-কোনোদিন মনে পড়ে; তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো একশ বছর বেঁচে থাক’।
২. বৃদ্ধাশ্রম থেকে একজন মায়ের চিঠি আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ছবিটা দেখে দেখে মনে মনে ভাবি এটাই কি আমার সেই খোকা!’ কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। বাবা… এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে? রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না? তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন চায়। তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তোমার বোন…. তার খবরাখবর নিও। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো আমি ভালো আছি। আমি দোয়া করি, তোমাকে যেন আমার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। কোনো এক জ্যোস্না ভরা রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভেবে নিও। বিবেকের কাছে উত্তর পেয়ে যাবে। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও।
৩। ২০০৬ সালে অবসর নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. এম আব্দুল আউয়ালের (৭০)। দীর্ঘ ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসরের পর কিছুদিন ভালোই চলছিলো তাঁর। অধ্যাপক আব্দুল আউয়ালের সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়ে সবার বড়, নাম রেজিনা ইয়াসিন, আমেরিকা প্রবাসী। এরপর বড় ছেলে উইং কমান্ডার (অব.) ইফতেখার হাসান। সবার ছোট ছেলে রাকিব ইফতেখার হাসান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। জীবনে এতো কিছু থাকার পরও আজ তার দু’চোখে অন্ধকার। থাকেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে।
৪। আমেরিকার এক নামকরা ব্যবসায়ী ছিলো। তার টাকা পয়সা, ধন-সম্পদে কোন কিছুরই অভাব ছিলো না। কিন্তু তার মডার্ণ সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারতো না শুধু তার মায়ের জন্য। কারণ তার মা ছিলো অন্ধ ও দেখতে কদাকার। মায়ের মুখে ছিলো আগুনে পোড়া বিশ্রী কালো দাগ। আর মাথার চামড়া পুড়ে চুল ছিলো না। সব মিলিয়ে তার মা একজন কুশ্রী কদাকার সেকেলের মানুষ। তাই মডার্ণ সোসাইটিতে নিজের মান-সম্মান ও আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য মা’কে বাসা থেকে বের করে দিলো। বেচারি একেতো অন্ধ মানুষ তারপরে বৃদ্ধা। কেঁদে কেঁদে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দিল, ছিটকে পড়ে বৃদ্ধা মা ঘটনাস্থলে ইন্তেকাল করেন। তার ছেলে জেনে-শুনে কষ্ট পেলো না, ভাবলো আপদ বিদায় হয়েছে । কিছুদিন পর ছেলে তার বিশেষ কিছু কাগজপত্র খুঁজতে খুঁজতে তার মা’র লেখা একটা ডাইরি পেলো । ডাইরিতে লেখা ছিলো; ০৫-১২-১৯৮০ আজ আমি সুন্দরী ‘মিস্ আমেরিকা’ এর খেতাব পেয়েছি। ০২-০৫-১৯৮৩ আজ আমার গর্ভপাত না ঘটানোর জন্য আমার প্রিয় স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছে। ০৭-০৩-১৯৮৫ আজ আমার বাড়িতে আগুন লেগেছিলো। আমি বাহিরে ছিলাম। আর আমার কলিজার টুকরা ছেলে বাড়ির ভিতরে ছিলো। নিজের জীবন বাজি রেখে শুধু ছেলের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আগুনে আমার চুল এবং মুখমন্ডলসহ আমার সমস্ত সৌন্দর্য ছাই হয়ে গেছে। তথাপী আমার কোন দুঃখ নেই। কিন্তু আমার কলিজার টুকরা ছেলের চোখদুটো আমি বাঁচাতে পারিনি। ০৭-৫-১৯৮৫ আজ আমার নিজের চোখ দুটো আমার ছেলে কে দিতে যাচ্ছি। আজকের পর থেকে আর কখনো ডাইরি লিখতে পারব না। ইতি
এই ডাইরিটি পড়ে ছেলে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে দেওয়ালে মাথা আছড়াতে লাগলো। হায় আজ আমি কি করেছি?
ইসলাম সার্বজনীন, চিরন্তন এবং শ্বাশত প্রগতিশীল এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদ প্রগতি, তা পরিত্যাজ্য। আর ধ্বজাধারী প্রগতিশীল কিছু মানুষ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে সন্তানকে তার পিতামাতার নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে সকল কিছু প্রাপ্তির মাঝেও যা পাওয়া যায় না তা হলো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারাজীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায় এর জন্যই মানুষ সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকে। যারা অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যান, তাদের স্মরণ রাখা দরকার, এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে পিতামাতা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই তার নিজের সন্তানও হয়ত একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। ঈদের দিনে যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, এমনকি সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে কামনা করেন, তার সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করল, ভবিষ্যতে তার সন্তানও যেন একই আচরণ করে। মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামীদিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে পিতামাতার যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। যদি কোন সন্তান তা পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে সে ইহকালিন শান্তি ও পরোকালিন মুক্তি হরাবে। কারণ ইলম অর্জন কিংবা ইসলামী অনুশাষন ব্যতীত এই ভয়াবহ পরিণতির সমাধান কখনও সম্ভবপর নয়। সন্তানের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজীবন বৃদ্ধ পিতামাতা গোপনে নিরবে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিবেন। মনে রেখ, হে আদম সন্তান! পিতামাতা যখন সন্তানের জন্য ভালো/মন্দ দো’আ করেন তখন মহান আল্লাহ ও তাদের মধ্যে কোন পর্দা থাকে না। আজকের এই ধ্বজাধারী আধুনিক প্রগতিশীল সকল সন্তান তথা গোটা জাতীর কাছে প্রশ্ন, মা দিবস, পিতা দিবস পালন কিংবা বৃদ্ধ পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ও তাদেরকে কাঁদানোটা কি প্রগতির নামে প্রহসন নয়?