নাবীয পানীয়

নাবীয (نَبِيْذٌ) হ’ল খেজুর, আঙ্গুর, কিসমিস, মধু, গম ও যব ইত্যাদি ফল আলাদা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে ভিজিয়ে যে মিঠা শরবত পানীয় প্রস্তুত করা হয় তাকে নাবীয বলে। এটা সিডার জাতীয় পানীয়। ইহা পানে অনেক উপকার রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল শক্তিবর্ধক ও পাকস্থলীকে উর্বর করে। নাবীয পান করা বৈধ। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُنْتَبَذُ لَهُ أَوَّلَ اللَّيْلِ فَيَشْرَبُهُ إِذَا أَصْبَحَ يَوْمَهُ ذَلِكَ وَاللَّيْلَةَ الَّتِى تَجِىءُ وَالْغَدَ وَاللَّيْلَةَ الأُخْرَى وَالْغَدَ إِلَى الْعَصْرِ فَإِنْ بَقِىَ شَىْءٌ سَقَاهُ الْخَادِمَ أَوْ أَمَرَ بِهِ فَصُبَّ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য রাতের প্রথম ভাগে নাবীয প্রস্তুত করা হতো। তিনি তা পান করতেন, সেদিন সকালে, আগামী রাতে, পরবর্তী দিনে, এর পরের রাতে এবং পরদিন আসর পর্যন্ত। তবে যদি কিছু পরিশিষ্ট থেকে যেত, তা তিনি তার সেবাদানকারীকে পান করাতেন, কিংবা ফেলে দিতে নির্দেশ দিতেন’। (মুসলিম হা/২০০৪; মিশকাত হা/৪২৮৮)। কেননা তখন তা নেশাদ্রব্যে পরিণত হতো।

নাবীয হ’ল কাঁচা ও পাকা ফল আলাদা আলাদা ভাবে ভিজিয়ে রেখে যে শরবত তৈরী হয়, সেই শরবতকে নাবীয বলে। নাবীয পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী এবং শক্তিবর্ধক ও পাকস্থলী উর্বর কারক।

নাবীয পানীয় প্রস্তুত প্রণালী :

নাবীয পানীয় বানাতে হ’লে, খেজুর, আঙ্গুর, কিসমিস, মধু, গম ও যব ইত্যাদি ফল আলাদা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। অতঃপর যে মিঠা শরবত পানীয় প্রস্তুত হবে তা নাবীয শরবত হিসাবে পান করতে হবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে তা যেন ১২ ঘণ্টার বেশী সময় অতিক্রান্ত না হয়। কেননা, অধিক সময় ভিজিয়ে রেখে দিলে তা নেশাদ্রব্যে পরিণত হবে। আয়িশা (রাঃ) বলেন, كَانَ يُنْبَذُ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِى سِقَاءٍ يُوكَأُ أَعْلاَهُ وَلَهُ عَزْلاَءُ يُنْبَذُ غُدْوَةً فَيَشْرَبُهُ عِشَاءً وَيُنْبَذُ عِشَاءً فَيَشْرَبُهُ غُدْوَةً. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য যে পাত্রে নাবীয বানানো হতো, তার উপরের মুখ বন্ধ করে দেয়া হতো ও নীচের দিকেও মুখ ছিল। তাঁর জন্য সকালে যে নাবীয বানানো হতো, রাতের তা পান করতেন। আবার রাতে যে নাবীয বানানো হতো, সকালে তা পান করতেন’। আবূদাউদ হা/৩৭১১; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯৮; ছহীহ হাদীছ। অন্যত্র বলেন, ‘আমি সকাল সন্ধ্যায় নাবীয তৈরীর পাত্র ধুয়ে নিতাম’। আবূদাউদ হা/৩৭১২।

কিসমিস থেকেও নাবীয বানানো যায় এবং তা নিংড়াতে দেরী করলে নেশা জাতীয় দ্রব্যে পরিণত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু দায়লামী (রহঃ) তার পিতার সূত্রে বলেন, একদা আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলি, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি জানেন যে, আমরা কারা, কোথাকার অধিবাসী এবং কার নিকট এসেছি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট এসেছ’। আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমাদের এখানে আঙ্গুর উৎপাদিত হয়। আমরা এগুলো কি করবো? তিনি বললেন, ‘এগুলো শুকিয়ে কিসমিস বানাও’। আমরা বললাম, কিসমিস দিয়ে কি করবো? তিনি বললেন, انْبِذُوهُ عَلَى غَدَائِكُمْ وَاشْرَبُوهُ عَلَى عَشَائِكُمْ وَانْبِذُوهُ عَلَى عَشَائِكُمْ وَاشْرَبُوهُ عَلَى غَدَائِكُمْ وَانْبِذُوهُ فِى الشِّنَانِ وَلاَ تَنْبِذُوهُ فِى الْقِلاَلِ فَإِنَّهُ إِنْ تَأَخَّرَ صَارَ خَلاًّ. ‘নাবীয শরবত তৈরীর জন্য তা সকালে ভিজাবে এবং রাতে পান করবে অথবা রাতে ভিজাবে এবং সকালে পান করবে’। তা চামড়ার মশকে ভিজাবে। মাটির কলসীতে অথবা বড় পাত্রে নাবীয বানাবে না। কেননা নিংড়াতে দেরী হ’লে তা নেশা জাতীয় দ্রব্যে পরিণত হবে’। আবূদাউদ হা/৩৭১০; নাসাঈ হা/৫৭৩৬; সনদ হাসান ছহীহ।


নাবীয তৈরীর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। কেননা দু’ধরনের ফল বা একই জাতীয় কাঁচা ও পাকা ফলের সংমিশ্রণে যে পানীয় প্রস্তুত হয়, তা হবে উত্তেজক নেশাদ্রব্য। আবূ কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিশমিশ ও শুকনো খেজুর একত্রে মিশিয়ে এবং কাঁচা ও পাকা খেজুর একত্রে মিশিয়ে এবং পাকা রং ধারণকৃত ও শুকনো খেজুর একত্রে মিশিয়ে নাবীয পানীয় বানাতে নিষেধ করেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, انْتَبِذُوا كُلَّ وَاحِدَةٍ عَلَى حِدَةٍ ‘প্রতিটি ফল দিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে তোমরা নাবীয বানাও’। আবূদাউদ হা/৩৭০৪, ৩৭০৫।

নাবীয ১২ ঘণ্টার বেশী রেখে দিলে তলানী বা গাদ পড়ে মিঠা শরবতের পরিবর্তে নেশাদ্রব্যে পরিণত হবে। তবে নাবীয পানীয় দু’ তিন দিন ধরে পান করা যায়। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য আঙ্গুরের নাবীয বানানো হলে তা তিনি সারা দিন পান করতেন, দ্বিতীয় দিন এবং তৃতীয় দিনও বিকাল পর্যন্ত পান করতেন। অতঃপর তিনি আদেশ দিলে অবশিষ্ট শরবত খাদেমদেরকে পান করানো হতো কিংবা ফেলে দেয়া হতো’। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, খাদেমদের পান করানোর অর্থ হ’ল, তাতে নেশা প্রকাশ পাওয়ার আগে তারা তা পান করতো’। আবূদাঊদ হা/৩৭১৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯৯; সদন ছহীহ।
অতএব এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। ইবন উমর (রাঃ) বলেন, ‘নাবীয পান শেষে মশক ধুয়ে ফেলতেন এবং তা তীব্র করার জন্য তাতে কোন প্রকার তলানী বা অন্য বস্তু মিশাতেন না’। নাফে (রহঃ) বলেন, فَكُنَّا نَشْرَبُهُ مِثْلَ الْعَسَلِ. ‘আমরা তা মধুর মত পান করেছি’। নাসাঈ হা/৫৭৪০; ছহীহ, সদন মওক্বুফ। আবূ মা’শার ইবরাহীম (রহঃ) বলেন, لاَ بَأْسَ بِنَبِيذِ الْبُخْتُجِ. ‘পাকানো নাবীযে কোন ক্ষতি নেই’। নাসাঈ হা/৫৭৪৮।

নাবীয পানীয় পানের উপকারিতা :

নাবীয স্বাস্থ্যের জন্য ভিষণ উপকারী। এটাকে এনার্জি ড্রিংকস বা বল বৃদ্ধিকারক পানীয় বলা হয়। গ্লুকোজ, পটাশিয়াম থাকায় এ পানীয় খুব সহজেই ক্লান্তি দূর করে। এর মেটাবলিক বা বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন যৌগ তৈরী করে। যেমন- নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগ,
কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ফসফেটস, সালফেটস, পানি প্রভৃতি দেহ ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু তা দেহের জন্য ভিষণ ক্ষতিকারক। আর নাবীয পানীয় পানের মাধ্যমে তা বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থগুলো রেচনতন্ত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়।

১. শক্তিবর্ধক নাবীয পানীয় পানে রক্তে শর্করার মাত্রা কমায় ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।

২. শরীরকে বিষ (টক্সিন) মুক্ত করে ও ক্লান্তি দূর করে।

৩. রক্তের কলেস্টরাল কমায় ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখে।

৪. ডিওডরেন্ট বা শরীরের দুর্গগন্ধ দূর করে।

৫. পটাশিয়াম থাকায় নার্ভ ও দুর্বল হার্ট সবল করে রাখে।

৬. মুখের দুর্গন্ধ দূর করে ও দাঁতের সৌন্দর্য ফিরে পায়।

৭. স্কিন টোনার হিসেবেও কাজে করে, ব্রণের প্রকোপ কমায় ও ট্যান বা রৌদ্রে থেকে ত্বকের প্রদাহ নিমেষে কমিয়ে দেয়।

৮. চুলের আদ্রতা ফিরে আনে এবং অকাল পক্কতা ও টাক পড়া দূর করে।

৯. পাকস্থলী উর্বর করে ও অম্লতা বা এসিডিটিসহ কষ্টকাঠিন্য দূর করে।

১০. স্মৃতিশক্তি বর্ধন, প্লীহা, লিভার, প্রোস্টেট ও ফুসফুসের কার্যক্ষমা বৃদ্ধি করে।

১১. প্রসূতি মায়েদের বুকের দুধ বৃদ্ধি করে ও জরায়ুর বিভিন্ন সমস্যা দূর করে।

১২. আয়রণের ভালো উৎস হওয়ায় রক্তের প্রোটিন মেটাবলিজম, হিমোগ্লোবিন ও লোহিত কণিকা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া :

এক. কাঁচা ও পাকা খেজুর একত্রে অথবা খেজুর ও অন্যান্য ফল মিশ্রণে নাবীয প্রস্তুত করা রাসূল (ছাঃ)-এর নিষেধ।আবূদাউদ হা/৩৭০৪, ৩৭০৫।
দুই. নাবীয পানীয় নিংড়াতে দেরী হ’লে কিংবা নিংড়ানো নাবীয তিনদিনের বেশী রেখে দিলে তা নেশা জাতীয় দ্রব্য বা এ্যালকাহোলে পরিণত হবে। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শারঈ বিধানে তা পান করা হারাম।

(‘রামাযান ও ছিয়াম’ বই থেকে নেয়া)

বইয়ের লিংক : https://anniyat.com/knkg

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top