যে দেহে ঈমান থাকে না

উপস্থাপনা : ঈমান হবে শিরক মুক্ত, ইবাদত হবে বিদ‘আত মুক্ত। আক্বীদা বিশ্বাসের মযবুতী না থাকায় মানুষ নানাভাবে ঈমানের স্বাদ থেকে বিমুখ হচ্ছে। ঈমান ব্যতীত কোন মানুষ মুমিন হিসেবে যেমন দাবী করতে পারে না। তেমনি মুমিন ব্যতীত ইবাদতের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না। মসজিদে মুছল্লীর সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বাড়লেও প্রকৃত মুমিন মুছল্লীর সংখ্যা সে হারে বাড়েনি। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, ‘মানুষের কাছে এমন এক যুগ আসবে। লোকেরা মসজিদে একত্রিত হয়ে ছালাত আদায় করবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও ঈমানদার থাকবে না’।[1] মূলতঃ পাপ- পঙ্কিলতার ফলে ঈমানের হ্রাস হয় এবং সৎআমলের ফলে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। মূলত ঈমান রাখা বিষম কঠিন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের উপর এমন একটি যুগের আগমন ঘটবে যখন তার পক্ষে ধর্মের উপর ধৈর্য ধারণ করে থাকাটা জ্বলন্ত অঙ্গার মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা ব্যক্তির মতো কঠিন হবে’।[2] সুতরাং একজন ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে ঈমানদার মনে হ’লেও, সে মূলতঃ ঈমানহীন হতে পারে, যদি তার মধ্যে ঈমানভঙ্গের কারণ ঘটে। আলোচ্য প্রবন্ধে উক্ত বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল।

ঈমানের সংজ্ঞা :

(ক) আভিধানিক অর্থ : ‘ঈমান’ অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, নিরাপত্তা দেওয়া, যা ভীতির বিপরীত’।[3] রাগেব আল-ইছফাহানী (রহঃ) বলেন, ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া’।[4] সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহর উপরে ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে’।[5]

(খ) পারিভাষিক অর্থ : আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে, ‘ঈমান’ হ’ল অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম, যা আনুগত্যে বৃদ্ধি হয় ও গুনাহে হ্রাস হয়। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না’।[6]

আর ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পঁাচটি। ১. আল্লাহ্ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া। ২. ছালাত আদায় করা। ৩. যাকাত প্রদান করা। ৪. হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫. রামাযানের ছিয়াম পালন করা’।[7] 

অন্তরে বিশ্বাস, ও করা মৌখিক স্বীকৃতির তদনুপাতে কাজ করার নাম ঈমান। অতএব কোন ব্যক্তি যদি আদিষ্ট কাজে ত্রুটি করে অথবা ব্যভিচার, মদপান ও চুরির মতো গুনাহের কাজে জড়িয়ে পড়লেও, তার ঈমানের পূর্ণতা হারায়। ফলে এমন ব্যক্তি পাপ-পঙ্কিলতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। সুতরাং ঈমান এমন একটি অদৃশ্য বিষয় যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, وَلَا يَقْتُلُ حِينَ يَقْتُلُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ- ‘হত্যাকারী যখন অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, সে সময়ও তার ঈমান থাকে না’। ইকরিমা (রহঃ) বলেন, আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কিরূপে ঈমান তার থেকে বের করে নেয়া হবে? তিনি বললেন, এভাবে বলে তিনি তার হাতের আঙ্গুলসমূহ পরস্পরের ফঁাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে, পরে তা পৃথক করে নিলেন। অতঃপর সে ব্যক্তি যদি তওবা করে, তাহ’লে পুনরায় ঈমান তার মধ্যে এভাবে ফিরে আসবে। এ কথা বলে পুনরায় তিনি দুই হাতের আঙ্গুলসমূহ পরস্পরের ফঁাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। আর আবু আব্দুল্লাহ ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, সে মু’মিন থাকে না অর্থাৎ সে প্রকৃত বা পূর্ণ মু’মিন থাকে না কিংবা তার ঈমানের নূর থাকে না’।[8] 

ঈমান নাজাতের অসীলা : ইবাদতের পূর্ব ও প্রধান শর্ত ঈমান থাকা বা মুমিন হওয়া। এই ঈমান কমে-বাড়ে, আবার মাঝে মাঝে তা হারিয়েও যায়। আমরা ঈমানের সাথে মুমিন মুসলমান হয়ে মৃত্যু কামনা করে থাকি। ঈমান নিয়ে অধিক গুনাহের কারণে কোন মুসলিম যদি জাহান্নামে চলে যায়, তবে সে ঈমান থাকার ফযীলতে আল্লাহর রহমতে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতে জাহান্নাম থেকে জান্নাতে প্রবেশ করবে। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ (مخَلِصًا) دَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘যে ব্যক্তি ইখলাছের সাথে বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[9] অন্যত্র আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ. ‘ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে ঐ ব্যক্তি, যে খালেছ অন্তরে বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[10] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এই কালিমা ঐ সময় মুক্তি দিবে, যখন তার উপর মুছীবত আসবে’।[11]

ঈমান ব্যতীত পরকালে নাজাতের কোন পথ বা অবলম্বন নেই। ঈমানের সাথে মুসলমান হিসেবে মৃত্যু হ’লে সেটাই উত্তম মৃত্যু। অতঃপর পাপের কারণে জাহান্নামে প্রবেশকারী যে ব্যক্তিদের অন্তরে সামান্য পরিমাণ ঈমানের বীজ রয়েছে, তারাও রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত পাবেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যখন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন মানুষ একে অপরে সমবেত অবস্থায় উদ্বেলিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে। …অবশেষে আমি বলব, ‘হে প্রভু! যারা শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, আমাকে তাদের জন্যও শাফা‘আত করার অনুমতি দিন। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘আমার ইযযত ও জালাল এবং আমার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের শপথ করে বলছি, যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, আমি নিজেই তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করব’।[12] সুতরাং ঈমানের সাথে মৃত্যু অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্নে যেসব কারণে ঈমান আনার পরও তা বিনষ্ট হয়ে যায়, সে বিষয়ে আলোচনা পেশ করা হ’ল।

১. শিরক : 

শিরক একটি কবীরা গুনাহ। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করাকে শিরক বলা হয়। সেটা একক স্রষ্টার মর্যাদার সাথে হোক, তঁার গুণাবলী ও তাঁর ইবাদত সমূহের সাথে হোক। শিরককারী ব্যক্তির উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সবচেয়ে কঠিনভাবে রাগান্বিত হন। ঈমান না থাকার কারণে শিরককারী ব্যক্তি নিজের প্রতি জঘন্যতম যুলুমকারী হিসেবে পথভ্রষ্ট হয়, জীবনের সৎআমল বরবাদ হয়ে যায় এবং নিজের জন্য জাহান্নামকে চিরস্থায়ী ঠিকানা করে নেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এটা ব্যতীত যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে ব্যক্তি দূরতম ভ্রষ্টতায় নিপতিত হ’ল’ (নিসা ৪/১১৬)। তিনি বলেন,إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ- ‘বস্ত্তত, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে, আল্লাহ অবশ্যই তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম’ (মায়েদাহ ৫/৭২)

তিনি আরো বলেন, وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘আর ‘যদি তুমি শিরক কর, তাহ’লে তোমার সকল আমল অবশ্যই বরবাদ হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)

রিয়া প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শিরকও বলা হয়। এই শিরক দাজ্জালের ফেৎনার চেয়েও ভয়াবহ। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা দিলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর একটি বিষয় সম্পর্কে বলব না? আমরা বললাম, জী বলুন। তিনি উত্তর দিলেন, সেটা হ’ল গুপ্ত শিরক। (অর্থাৎ) যখন কেউ ছালাত আদায় করতে উঠে ছালাত সুন্দর করার জন্য চেষ্টা করে এই ভেবে যে, লোকেরা তার প্রতি চেয়ে আছে, সেটাই গুপ্ত শিরক’।[13] ইবনু আববাস (রাঃ) এই বাস্তবতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘চন্দ্রবিহীন রাত্রে একটা কালো পাথর বেয়ে উঠা একটা কালো পিঁপড়ার চেয়েও গোপন হ’ল শিরক’।[14]

আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরের খবর রাখেন। যে ব্যক্তি যা নিয়ত করবে তার অভিপ্রায় আল্লাহ দুনিয়ার মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করে দিবেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللهُ بِهِ- ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমল করে আল্লাহ তা‘আলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকেদেরকে জানিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কোন নেক কাজ করে, আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকেদের মাঝে ফঁাস করে দিবেন’।[15]

রিয়া সম্পর্কে ইবনু রজব হাম্বালী (৭৩৬-৭৯৫ হি.) বলেন, وَرَائِحَةُ الْرِيَاءِ كَدُخَانِ الْحِطَبِ، يَعِلُوْ إِلَى الْجَو ثُمَّ يَضْمِحَل وَتَبْقِى رَائحته الكَرِيْهَة- ‘রিয়া বা লৌকিকতার ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল কয়লার ধোয়ার ন্যায়, যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার দুর্গন্ধ কেবল অবশিষ্ট থাকে’।[16] শিরক ও রিয়া হ’ল গর্হিত ও শয়তানী ক্রিয়াকর্ম। শিরক ও রিয়া মুক্ত থাকতে হ’লে অবশ্যই বেশী বেশী তওবা করতে হবে। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘জানা ও অজানা সকল গুনাহ থেকে নাজাত পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হ’ল আমভাবে তওবা করা। হ’তে পারে জানা অপেক্ষা তার অজানা গুনাহের পরিমাণ অধিক’।[17]

২. কুফরী : 

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী বান্দারা ‘মুমিন’ এবং অবিশ্বাসী বান্দারা ‘কাফের’। পরিণতির দিক দিয়ে মুমিন বান্দা জান্নাতী এবং কাফেররা জাহান্নামী। কাফের বান্দা আল্লাহ তা‘আলার বিধানকে জেনে-বুঝে, সজ্ঞানে, সরাসরি অস্বীকার করে থাকে। এরা আল্লাহর বিধানের সাথে মূর্খতাকে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কুফরী করে। এরা সর্বনিকৃষ্ট জাহেল। এরা আল্লাহ ও তঁার রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর সাথে নানাভাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস করে থাকে। এরা ঈমান রাখার পরেও মুমিন নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ- لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ- ‘আর যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, তাহ’লে তারা অবশ্যই বলবে, আমরা তো কেবল গল্প-গুজব ও খেল-তামাশা করছিলাম। বলে দাও, তবে কি তোমরা আল্লাহ, তঁার আয়াত সমূহ ও তঁার রাসূল সম্পর্কে হাসি-ঠাট্টা করছিলে?’ ‘তোমরা কোন ওযর পেশ করো না। ঈমান আনার পরে তোমরা অবশ্যই কুফরী করেছ’। অতএব যদি আমরা তোমাদের একটি দলকে ক্ষমা করি ও তথাপি একটি দলকে আমরা অবশ্যই শাস্তি দেই। কেননা (বিদ্রূপ করার কারণে) তারা পাপী’ (তওবা ৯/৬৫-৬৬)

যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে, রাসূল (ছাঃ) এ সকল কাফের ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন, তখন বলতেন, اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا- ‘তোমরা আল্লাহর নামে তঁার রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে’।[18]

ঈমানের ছয়টি বিশ্বাসের মধ্যে অন্যতম হ’ল নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস রাখা। কিন্তু হাদীছ অস্বীকারকারী ব্যক্তিরা সুকৌশলে আক্বীদাগতভাবে নবী-রাসূলকে অস্বীকার করে। অনুরূপ বর্তমানে বাংলাদেশে তথা কথিত আহলে কুরআন নামক একদল হাদীছ অস্বীকারকারী সুকৌশলে হাদীছ অস্বীকার করার মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে অস্বীকার ও অমান্য করে। আর এসকল মূর্খ-জাহেল ব্যক্তির দেহে ঈমান থাকে না। বিদ্বানগণ প্রকাশ্যে হাদীছ অস্বীকারকারীদের মুরতাদ ও কাফের বলেছেন। ইসহাক ইবনু রাহওয়াইহ (২৩৮ হি.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির নিকট রাসূল (ছাঃ)-এর কোন হাদীছ পেঁয়েছে যাকে সে সত্য বলে স্বীকার করেছে, অতঃপর প্রকাশ্যে তা পরিত্যাগ করেছে, সে কাফের’।[19] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (২৪১ হি.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে অস্বীকার করল, সে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিপতিত হ’ল’।[20]

৩. আমানতের খেয়ানত : 

আমানত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। দ্বীনের বিধি-বিধান তথা আদেশ-নিষেধকে বুঝায়। বিধায় আমানত দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার আমানত নেই, তার দ্বীন নেই; যার দ্বীন নেই, তার ঈমানও নেই। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকট খুব কমই ভাষণ দিতেন যেখানে তিনি বলতেন না যে, ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারিতা নেই। আর ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই, যার অঙ্গীকার ঠিক নেই’।[21]

মুমিন কখনো খেয়ানতকারী ও মিথ্যাবাদী হ’তে পারে না। যারা এটা করে, তারা আসলে মুমিন নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى الْخِلاَلِ كُلِّهَا إِلاَّ الْخِيَانةَ وَالْكَذِبَ ‘মুমিন সকল স্বভাবের উপর সৃষ্টি হ’তে পারে, খেয়ানত ও মিথ্যা ব্যতীত’।[22]

ক্বিয়ামতের মাঠে খেয়ানতকারীর জন্য একটি পতাকা রাখা হবে, যা তার পিঠের পেছনে পঁুতে দেওয়া হবে। আর জনগণের খেয়ানতকারী সবচেয়ে বড় খেয়ানতকারী। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক খেয়ানতকারীর জন্য ক্বিয়ামতের দিন একটি ঝান্ডা থাকবে, যা তার পিঠের পিছনে পুঁতে দেওয়া হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তার খেয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী সেটি উঁচু হবে। সাবধান! জনগণের নেতার খেয়ানতের চাইতে বড় খেয়ানত আর হবে না’।[23]

সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা খেয়ানত করতে নিষেধ করে বলেন, يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَخُونُوا اللهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوآ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তঁার রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খেয়ানত করো না’ (আনফাল ৮/২৭)। অন্যত্র বলেন, وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ ‘আর যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে’ (মুমিনূন ২৩/৮; মা‘আরেজ ৭০/৩২)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا- ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথাযথ হকদারগণের নিকট পেঁŠছে দাও’…(নিসা ৪/৫৮)। [ক্রমশ]

——————————————————————–

[1]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৩৭৫৮৬; হাকেম হা/ ৮৩৬৫।

[2]. তিরমিযী হা/২২৬০; মিশকাত হা/৫৩৬৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০০২।

[3]. জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/২০৭১;, আল-ক্বামূসুল মুহীত ১১৭৬ পৃ.।

[4]. আল-মুফরাদাত ৩৫ পৃ.।

[5]. আছ-ছারিম আল-মাসলূল ৫১৯ পৃ.।

[6]. ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান ১/৩৩১; আহলেহাদীছ আন্দোলন মনোন্নয়ন সিলেবাস, পৃ. ১১।

[7]. বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৪।

[8]. বুখারী হা/৬৮০৯; মিশকাত হা/৫৪।

[9]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৩৫৫।

[10]. বুখারী হা/৯৯; আহমাদ হা/৮৮৪৫; মিশকাত হা/৫৫৭৪।

[11]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৩২; সনদ ছহীহ।

[12]. বুখারী হা/৭৫১০; মিশকাত হা/৫৫৭৩।

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩।

[14]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭৩০।

[15]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬।

[16]. মাজমূঊর রাসায়েল, পৃষ্ঠা-৭৫৮।

[17]. মাদারিজুস সালেকীন ১/২৮৩।

[18]. মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮।

[19]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ১/৯৯।

[20]. ইবনুল জাওযী, মানাক্বিবুল ইমাম আহমাদ, পৃ. ২৪৯।

[21]. শো‘আব হা/৪০৪৫; মিশকাত হা/৩৫; ছহীহুত তারগীব হা/৩০০৪।

[22]. মুসনাদ বাযযার হা/১১৩৯; আহমাদ, মিশকাত হা/৪৮৬০।

[23]. মুসলিম হা/১৭৩৮; মিশকাত হা/৩৭২৭।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top