পালকপুত্র সম্পর্কিত বিধান

ইসলামে দত্তক জায়েজ নেই। তবে মানুষকে (কোন সন্তানকে) আপনি দয়া করে তাঁকে লালন-পালন করতে পারেন শরীয়ার ভিত্তিতে।কিন্তু সন্তান দত্তক নেওয়া জায়েজ নেই, এটা বিধর্মীদের মধ্যে আছে। এটা কখনো ইসলামে নেই। ইসলামে দত্তক নিলে সে সন্তান কোনো ওয়ারিশ হবে না, সে কোনো সম্পত্তির ভাগ পাবে না।

পালক সন্তান পালনের শরীয়াগত শর্তাবলী :

১.পালক সন্তানের আসল বাপের পরিচয় গোপন করা যাবে না,করলে তা হারাম।

২. পালক সন্তানকে নিজের সন্তান বা নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেয়া যাবে না, দিলে তা হারাম।৩.একইভাবে পালক সন্তান সেই পিতাকে আসল পিতা বলে পরিচয় দিতে পারবে না, দিলে তা হারাম।

৪. সন্তান কেনা বেচা করা যাবে না। এটি হারাম।

৫.পালক সন্তান বড় হবার (বয়প্রাপ্ত) হবার সাথে সাথেই পালক সন্তানের প্রতি মাতা পিতার পর্দা করা ফরজ হবে।

৬. পালক সন্তানের আসল মা বাবাকে তার সন্তানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করার শর্ত দেয়া যাবে না।দেখা সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

৭.পালক সন্তানের সার্টিফিকেটে বা জন্ম নিবন্ধনে তার আসল পিতার নাম লিখতে হবে। নকল পিতার নাম লেখা যাবে না, লিখলে তা হারাম।

৮.পালক সন্তান স ম্পত্তির ভাগ পাবে না/উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকারী হবে না।

৯.যে ব্যক্তি অন্যকে পিতা বলে দাবী করবে অথচ সে জানে যে, এ ব্যক্তি তার পিতা নয় তার জন্য জান্নাত হারাম। (সহীহ বুখারী হা: ৬৭৬৬, সহীহ মুসলিম হা: ৬৩)

পালক সন্তানের প্রতি পর্দার বিধান :

লালন-পালনকারীর সঙ্গে পালিত সন্তান পর্দার ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ইসলামের বিধান রক্ষা করে চলতে হবে। নিজ হাতে লালন-পালন করেছি বলে পর্দার বিধান লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই। অর্থাত্ পালক নেওয়া শিশুটি ছেলে হলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাকে পালক নেওয়া মায়ের সঙ্গে পর্দা করতে হবে। অন্যদিকে পালক নেওয়া শিশুটি মেয়ে হলে তাকে পালক নেওয়া বাবার সঙ্গে পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে। কেননা ইসলামী শরিয়ত মতে, দত্তকসংক্রান্ত সম্পর্ক কখনো বংশীয় সম্পর্কে পরিণত হয় না। এমনকি তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও অন্য সাধারণ মানুষের ন্যায়ই বৈধ। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। (তুহফাতুল ফুকাহা : ২/১২৩)

তবে পর্দার ক্ষেত্রে একটি সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়, তা হলো পালক শিশুটি দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় তাকে লালন-পালনকারীর এমন কোনো মহিলা আত্মীয় থেকে দুধ পান করিয়ে নেবে, যাতে শিশুটির সঙ্গে তাদের দুধসম্পর্কের আত্মীয়তা হয়ে যায়। তখন তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ বৈধ হবে। এ ক্ষেত্রে পর্দাও জরুরি হবে না এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। (বুখারি : ২৬৪৫)

মহান আল্লাহ ও রাসূল (সা.) দুধ পান করানো দ্বারা একজন অন্য জনকে বিবাহ করা হারামের যে বিধান আরোপ করেছেন, তা শুধু মাত্র শিশুবেলার সাথে সম্পর্ক। দেখুন এসম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ مِنَ الرَّضَاعَةِ – النساء : ٢٣ অর্থ : তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে যারা তোমারেদকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ বোন……… (সূরা নিসা-২৩)

সহীহ বুখারীর বর্ণনার মাঝে এসেছে- ٢٦٤٥ -حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا هَمَّامٌ، حَدَّثَنَا قَتَادَةُ، عَنْ جَابِرِ بْنِ زَيْدٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بِنْتِ حَمْزَةَ: «لاَ تَحِلُّ لِي، يَحْرُمُ مِنَ الرَّضَاعِ مَا يَحْرُمُ مِنَ النَّسَبِ، هِيَ بِنْتُ أَخِي مِنَ الرَّضَاعَةِ –

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত হামজা (রা.) এর কন্যাকে বিবাহের বিষয়ে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তাকে বিবাহ করা তোমার জন্য বৈধ না। কেননা দুধ পান করার দ্বারা যেমন বিবাহ হারাম হয়, তেমনি বংশের কারণেও হারাম হয়, আর হামজা (রা.) এর কন্যা তোমার দুধ বোন। বুখারী-৩/১৭০, হাদীস-২৬৪৫।

শিশু বয়সে দুধ পান করানো দ্বারা শুধু মাত্র বিবাহ বন্ধন হারাম হয়, এর সময় সিমা বর্ণনা দিতে গিয়ে, মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন-

وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ -البقرة : ٢٣٣

অর্থ: আর সন্তানবর্তী নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ খাওয়াবে, যদি দুধ খাওয়াবার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়। সূরা বাকারা-২৩৩।

শিশুদের দুগ্ধপান করার সময়সীমা তথা দুই বা আড়াই বছরের মাঝে কোন সন্তান যদি কোন মহিলার স্তনের দুধ এক ফোটাও গলধকরণঃ করে থাকে, তাহলেই হুরমতে রিজাআত তথা দুগ্ধ সম্পর্কিত হুরমত প্রমাণিত হবে।

মাহরাম হিসাবে গণ্য হবে না। পালকপুত্রকে রক্তসম্পর্কীয় পুত্র হিসাবে গণ্য করা শরী‘আতে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا کَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنۡ رِّجَالِکُمۡ মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; (আহযাব ৪০)

লোকের ধারণা অপনোদন করা হয়েছে যারা বর্বর যুগের প্রথা অনুযায়ী যায়েদ বিন হারেসাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তান বলে মনে করতো এবং তিনি যায়নবকে তালাক দেয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে তার বিয়ে সংঘটিত হওয়ায় তার প্রতি পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন বলে কটাক্ষ করত। এ ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট ছিল যে, যায়েদের পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নন। বরং তার পিতা হারেসা। কিন্তু এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ তাকীদ দেয়াচ্ছলে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যকার কোন পুরুষের পিতা নন’। যে ব্যক্তি সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে কোন পুরুষ নেই, তার প্রতি এরূপ কটাক্ষ করা কিভাবে যুক্তিসংগত হতে পারে যে, তার পুত্র রয়েছে এবং তার পরিত্যক্ত স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পুত্রবধূ বলে তার জন্য হারাম হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রী খাদিজার গর্ভস্থ তিন পুত্র-সন্তান কাসেম, তাইয়্যেব ও তাহের এবং মারিয়ার গর্ভস্থ এক সন্তান ইবরাহীম—মোট চার পুত্র-সন্তান ছিলেন। কিন্তু এরা সবাই শৈশবাবস্থায় মারা যান। [দেখুন: কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর; বাগভী]

পালকপুত্র রক্তসম্পর্কীয় নয় :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  وَ اِذۡ تَقُوۡلُ لِلَّذِیۡۤ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِ وَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡهِ اَمۡسِکۡ عَلَیۡکَ زَوۡجَکَ وَ اتَّقِ اللّٰهَ وَ تُخۡفِیۡ فِیۡ نَفۡسِکَ مَا اللّٰهُ مُبۡدِیۡهِ وَ تَخۡشَی النَّاسَ ۚ وَ اللّٰهُ اَحَقُّ اَنۡ تَخۡشٰهُ ؕ فَلَمَّا قَضٰی زَیۡدٌ مِّنۡهَا وَطَرًا زَوَّجۡنٰکَهَا لِکَیۡ لَا یَکُوۡنَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ حَرَجٌ فِیۡۤ اَزۡوَاجِ اَدۡعِیَآئِهِمۡ اِذَا قَضَوۡا مِنۡهُنَّ وَطَرًا ؕ وَ کَانَ اَمۡرُ اللّٰهِ مَفۡعُوۡلًا  আর স্মরণ কর, আল্লাহ যার উপর নিআমত দিয়েছিলেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে, তুমি যখন তাকে বলেছিলে ‘তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর’। আর তুমি অন্তরে যা গোপন রাখছ আল্লাহ তা প্রকাশকারী এবং তুমি মানুষকে ভয় করছ অথচ আল্লাহই অধিকতর হকদার যে, তুমি তাকে ভয় করবে; অতঃপর যায়েদ যখন তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে; যখন তারা তাদের স্ত্রীদের সাথে বিবাহসম্পর্ক ছিন্ন করে।* আর আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর হয়ে থাকে। (আহযাব ৩৭)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পালকপুত্র যায়েদ বিন হারেছার তালাক দেওয়া স্ত্রী যয়নাব বিনতে জাহশকে বিবাহ করেছিলেন… আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছা.) যায়নাব বিনতু জাহশ (রাঃ)-এর বিয়েতে যত বড় আয়োজনে ওয়ালীমাহ্ করেন, আর অন্য কোনো স্ত্রীর বিয়েতে তা করেননি। এতে তিনি এক বকরী দ্বারা ওয়ালীমাহ্ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩২১১-১২ ওয়ালীমা অনুচ্ছেদ)। এর মাধ্যমে তিনি পালক ছেলে-মেয়ে যে মাহরাম নয়, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বালেগ হওয়ার সাথে সাথে তাদের ক্ষেত্রে হুরমতের বিধান প্রযোজ্য হবে তথা পর্দা ফরয হয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (ছা.) তার স্ত্রী যায়নাব-এর সাথে বিবাহোত্তর ওয়ালীমাহ্ যত বেশী সুন্দর এবং পরিসরে করেছিলেন এমনটি অন্য কোনো স্ত্রীর বেলায় করেননি। তিনি বকরী যবেহ করে তার ওয়ালীমাহ্ করেছিলেন।

মাওয়াহিব নামক গ্রন্থে আছে, উম্মুল মু’মিনীন যায়নাব বিনতু জাহ্শ (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর ফুপী আমীমাহ্ বিনতু ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর কন্যা। রাসূলুল্লাহ (ছা.) তাকে তার পালক পুত্র যায়দ ইবনু হারিসাহ্-এর সাথে বিবাহ দিয়ে দেন। দীর্ঘদিন অবস্থানের পর যায়দ ইবনু হারিসাহ্ তাকে তালাক প্রদান করেন। অতঃপর যখন তার ‘ইদ্দত শেষ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (ছা.) যায়দ ইবনু হারিসাকে বলেন, তুমি যায়নাব-এর কাছে গিয়ে আমার কথা উল্লেখ কর, অর্থাৎ আমার পক্ষ থেকে তাকে বিয়ের প্রস্তাব পেশ কর। যায়দ ইবনু হারিসাহ্ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর আদেশ পালনে যায়নাব (রাঃ)-এর বাড়ী গেলাম এবং দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে কললাম, হে যায়নাব! আল্লাহর রসূল তোমাকে স্মরণ করিয়ে অর্থাৎ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছেন। এ কথা শুনে যায়নাব বললেন, আমি কোনো কাজই করতে যাই না যতক্ষণ না আমার রবের নির্দেশ জারী হয়। অতঃপর যায়নাব তার একটি মসজিদ ছিল সেদিকে রওনা হলেন, এরপর এ আয়াত নাযিল হলো:

فَلَمَّا قَضٰى زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا অর্থাৎ- ‘‘অতঃপর যায়দ যখন যায়নাবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দিলাম।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ৩৭)

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছা.) সোজা যায়নাব-এর বাড়ী চলে আসলেন এবং অনুমতি ছাড়াই তার ঘরে প্রবেশ করলেন। (সহীহ মুসলিম)

এ ঘটনার পর মুনাফিকরা বলতে লাগল মুহাম্মাদ পুত্রবধূকে হারাম বলে অর্থাৎ ছেলের বউকে বিবাহ করা হারাম বলে ঘোষণা করে থাকে অথচ নিজেই পুত্রবধূকে বিয়ে করে বসেছে। তখনই এ আয়াত নাযিল হলো:

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ

অর্থাৎ ‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যেকার কোনো পুরুষের পিতা নয়।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ৪০)

যায়নাব (রাঃ) নবী (ছা.)-এর অন্যান্য স্ত্রীদের ওপর গর্ব করে বলতেন: তোমাদের পিতাগণ ‘‘তোমাদের অভিভাবক হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর সাথে তোমাদেরকে’’ বিয়ে দিয়েছেন আর আমাকে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজে সপ্তম আসমানের উপর আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। (তিরমিযী)

যায়নাব-এর আসল নাম ছিল বারীরাহ্, রাসূলুল্লাহ (ছা.) তার নাম রাখলেন যায়নাব।

আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (ছা.) যখন যায়নাবকে বিয়ে করলেন তখন ওয়ালীমার জন্য কওমের লোকজনকে দা‘ওয়াত করলেন। লোকজন খানা খাওয়া শেষ হলে বসে বসে গল্প শুরু করল, এটা হলো রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর জন্য ভীষণ কষ্টের, কারণ তিনি তাদের উঠে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত করলেন কিন্তু তারা উঠলেন না। অনেকেই রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর এ বিব্রত ও অস্বস্তি অবস্থা দেখে একে একে উঠে চলে গেলেন কিন্তু তিনজন লোক অবশিষ্ট বসেই রইলেন। রাসূলুল্লাহ (ছা.) ঘরে প্রবেশের জন্য এসে দেখেন লোকজন বসেই আছেন। এরপর তারা যখন চলে গেলেন তখন আমি (আনাস) গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খবর জানালাম যে, তারা চলে গেছেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করলেন। এ সময় আমি ঘরে ঢোকার জন্য গেলাম কিন্তু তিনি আমার ও তার মাঝে পর্দা টেনে দিলেন, তখনই আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করলেন:

يٰاَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ

অর্থাৎ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নাবীর ঘরে প্রবেশ করো না।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ৫৩)

বিস্তারিত ঘটনা তাফসীরে ইবনু কাসীর ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থ দেখুন। (ফাতহুল বারী ৯ম খন্ড, হাঃ ৫১৬৮; শারহে মুসলিম ৯/১০ম খন্ড, হাঃ ১৪২৮; মিরকাতুল মাফাতীহ)

পালকপুত্র ওয়ারিশ নয় :

সা’দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের বৎসর আমি এমন এক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলাম, যা আমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলাম। এমনি সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখতে আসলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমার প্রচুর ধন-সম্পদ আছে, আর আমার একমাত্র কন্যা ছাড়া (ঔরসজাত) কোনো ওয়ারিস নেই। আমি কি আমার সমস্ত ধন-সম্পদ (অপর কারো জন্য) ওয়াসিয়্যাত করে যেতে পারব? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে কি দুই-তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তবে কি অর্ধেক? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তবে কি এক-তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এক-তৃতীয়াংশ; আর এক-তৃতীয়াংশও অতিরিক্ত।

তুমি তোমার ওয়ারিসদেরকে দরিদ্র রেখে যাওয়া অপেক্ষা সচ্ছল রেখে যাওয়া তোমার জন্য উত্তম, যাতে তারা অন্যের নিকট যাচ্ঞা না করে (হাত না পাতে)। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে তোমার পরিবারের প্রতি যে খরচ করবে, নিশ্চয় এতেও তোমাকে সাওয়াব দেয়া হবে- এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে (খাদ্য) লোকমা উঠিয়ে দাও তাতেও। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৭১)

উল্লেখিত হাদীসে কী পরিমাণ সম্পদ ওয়াসিয়্যাত করা বৈধ তা বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে যান। তখন সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই। আমার এই প্রচুর ধন-সম্পদ সবটুকু কি আমি ওয়াসিয়্যাত করে দিব আল্লাহর রাস্তায় দান করার জন্য? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দেননি, এভাবে সে দুই-তৃতীয়াংশ এবং পরে অর্ধাংশ ওয়াসিয়্যাত করতে চাইলেও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দেননি। সর্বশেষ সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) তার সমুদয় সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ ওয়াসিয়্যাত করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, এটাও বেশি হয়ে যায়। এ থেকে বুঝা যায় এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ ওয়াসিয়্যাত বৈধ, তবে এর কম হওয়াটাই উত্তম। কেননা সন্তান-সন্ততিকে অভাবগ্রস্ত রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদেরকে স্বচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া উত্তম। অন্যথায় তারা মানুষের নিকট হাত পেতে ভিক্ষা করবে। যে ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাত করার মাধ্যমে প্রতিদান পেতে চায়, সে ব্যক্তির স্মরণ রাখা উচিত যে, পরিবার-পরিজনের জন্য যা কিছু ব্যয় করা হয় তার প্রতিদান তাকে দেয়া হবে। এমনকি ঐ লোকমাটির প্রতিদানও দেয়া হবে যা তার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে। সুবহানাল্লাহ! কেননা প্রতিটি ভালো কাজের সাওয়াব আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাকে নিয়্যাত অনুসারে দিয়ে থাকেন। যদি কাজটি দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। (ফাতহুল বারী ৩য় খন্ড, হাঃ ১২৯৫; শারহে মুসলিম ১১/১২ খন্ড, হাঃ ১৬২৮; মিরকাতুল মাফাতীহ)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top