যাকাত ও সাদাকার মধ্যে পার্থক্য এবং ফযীলত

যাকাত একটি বাধ্যতামূলক দান যা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ নির্দিষ্ট সময় ধরে থাকলে প্রদান করতে হয়, যেখানে সাদাকা একটি ঐচ্ছিক দান যা যেকোনো ভালো কাজ বা সম্পদ দিয়ে করা যায়। যাকাত হলো ফরয বা আবশ্যিক, আর সাদাকা হলো নফল বা ঐচ্ছিক।

الزكاة (যাকাত)-এর শাব্দিক অর্থ: বৃদ্ধি, লাভ, বরকত ও পবিত্র করা। (লিসানুল আরাব ১৪/৩৫৮ ও ফাতহুল কাদীর ২/৩৯৯)।

আর الصدقة (সাদাকা) শব্দটি الصِّدق (আস্‌-সিদক বা সত্য) থেকে গৃহীত। যেহেতু সাদাকা করা সাদাকাকারীর ঈমানের সত্যতার দলীল (ফাতহুল কাদীর (২/৩৯৯)।

শারঈ পারিভাষিক সংজ্ঞা:

যাকাত হচ্ছে: বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পদে আল্লাহ যে যাকাত ফরয করেছেন শরীয়তের বর্ণনা অনুযায়ী সেগুলো এর হকদারদেরকে প্রদান করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত পালন।

আর সাদাকা হলো: সম্পদ ব্যয় করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা; যে ব্যয় শরিয়ত আবশ্যক করেনি। অনেক সময় ফরয যাকাতকেও সাদাকা বলা হয়।

যাকাত আর সাদাকার মাঝে পার্থক্য নিম্নরূপ:

১. ইসলাম নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের মধ্যে যাকাতকে আবশ্যক করেছে। যথা: স্বর্ণ, রৌপ্য, ফসল, ফল-ফলাদি, ব্যবসার পণ্য এবং গবাদিপশু তথা উট, গরু ও ছাগল-ভেড়া। পক্ষান্তরে সাদাকা কোনো নির্দিষ্ট বস্তুতে আবশ্যক নয়। বরং এটার ক্ষেত্রে মানুষ নির্দিষ্ট না করে যা খুশি দান করতে পারে।

২. যাকাতের জন্য কিছু শর্ত আছে; যেমন বর্ষপূর্তি ও নেসাব এবং প্রদেয় যাকাতের সম্পদের নির্ধারিত পরিমাণ আছে। পক্ষান্তরে সাদাকার জন্য কোনো শর্ত নেই। সাদাকা যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিমাণে দেওয়া যায়।

৩. যাকাত: আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট কিছু খাতে যাকাত বণ্টন করা আবশ্যক করেছেন। এদের বাহিরে অন্যদেরকে দেওয়া জায়েয নয়। আল্লাহর বাণীতে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে:“যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাতের কাজে নিয়োজিত কর্মী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের জন্য এবং ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে যারা আছে তারা ও মুসাফিরদের খাতে। এটি আল্লাহ কর্তৃক ফরযকৃত। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”[সূরা তাওবাহ ৯:৬০]। পক্ষান্তরে সাদাকা যাকাতের আয়াতভুক্ত ব্যক্তিদেরকে দেওয়া যাবে, আবার অন্যদেরকেও দেওয়া যাবে।

৪. কারো উপর যাকাত আবশ্যক থাকা অবস্থায় যদি সে মারা যায়, তাহলে তার সম্পদ থেকে যাকাত বের করা উত্তরাধিকারী ব্যক্তিদের উপর আবশ্যক। ওসীয়ত ও উত্তরাধিকারীদের অংশের উপর যাকাত অগ্রাধিকার পাবে। পক্ষান্তরে সাদাকাতে এর কোনোটি আবশ্যক নয়।

৫. যে ব্যক্তি যাকাত দিবে না সে শাস্তি পাবে; যেমনটা সহীহ মুসলিমে (৯৮৭) বর্ণিত হাদীসে আছে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “সোনা-রূপা সঞ্চয়কারী ব্যক্তি যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে জাহান্নামের আগুনে সেগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। তারপর এগুলোকে পাতের ন্যায় বানিয়ে এর দ্বারা তার পার্শ্ব এবং কপালে দাগ দেয়া হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা শেষ করা পর্যন্ত এমন এক দিনে যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এরপর তাকে তার পথ দেখানো হবে; জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে। কোন উটের মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে তাকে এক প্রশস্ত সমতল প্রান্তরে অধোমুখী করে শায়িত করা হবে। এরপর সে উট পূর্বের চাইতেও অধিক মোটাতাজা অবস্থায় মালিকের নিকট উপস্থিত হবে এবং তাকে পদদলিত করতে থাকবে। এদের শেষটি চলে গেলে আবার প্রথমটি ফিরে আসবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করা পর্যন্ত এমন এক দিনে যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। এরপর তাকে তার পথ দেখানো হবে; জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে। বকরীর কোন মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে তাকে প্রশস্ত সমতল প্রান্তরে শায়িত করা হবে। এরপর সে বকরী পূর্বের চেয়েও অধিক মোটাতাজা অবস্থায় মালিকের নিকট উপস্থিত হবে এবং স্বীয় খুর দ্বারা তাকে দলিত করবে ও শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে। এদের মধ্যে সেদিন কোনটাই শিংবিহীন এবং উল্টো শিং বিশিষ্ট থাকবে না। যখন এদের শেষটি চলে যাবে তখন আবার প্রথমটি ফিরে আসবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা শেষ করা পর্যন্ত এমন এক দিনে যে দিনের পরিমাণ হবে তোমাদের হিসাব অনুসারে পঞ্চাশ হাজার বছর। এরপর তাকে তার রাস্তা দেখানো হবে, জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে। … ” পক্ষান্তরে সাদাকা ত্যাগকারী ব্যক্তির শাস্তি হবে না।

৬. যাকাত: চার মাযহাবের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যাকাত মূল ও শাখা আত্মীয়দের কাউকে দেওয়া জায়েয নয়। মূল হল মা-বাবা, দাদা-নানাগণ এবং দাদী-নানীগণ। আর শাখা হল সন্তান-সন্ততি। পক্ষান্তরে সাদাকা: মূল ও শাখা উভয় শ্রেণীর আত্মীয়কে দেওয়া জায়েয।

৭. যাকাত: ধনী ও উপার্জনে সক্ষম সবল ব্যক্তিকে দেওয়া জায়েয নয়। উবাইদুল্লাহ ইবনে আদী বর্ণনা করেন, আমাকে দুই ব্যক্তি এই খবর দিয়েছেন যে, তারা বিদায় হজ্জের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছিলেন। তখন তিনি যাকাতের মাল বণ্টন করছিলেন। সেই ব্যক্তিদ্বয় তাঁর কাছে কিছু যাকাতের মাল চাইলেন। তখন তিনি তাদের দিকে উপরে ও নীচে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। তিনি দেখলেন যে, আমরা শক্তিশালী। তখন তিনি বললেন: “তোমরা যদি চাও তবে আমি তোমাদের দু’জনকে দিব। (কিন্তু জেনে রাখো!) এই সম্পদে ধনী উপার্জনে সক্ষম সবল ব্যক্তির কোনো প্রাপ্য নেই।”[আবু দাউদ হ/১৬৩৩ ও নাসাঈ হ/২৫৯৮]। ইমাম আহমদ ও অন্যান্যরা এটাকে সহীহ বলেছেন ( তালখীসুল হাবীর (৩/১০৮। আর এইজন্য বলা হয় ধনীদের সম্পদে অভাবী ও বঞ্চিতদের হক বা অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার” (যারিয়াত, ১৯)। এর অর্থ হলো, সম্পদশালীদের তাদের সম্পদের একটি অংশ গরিবদের দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা যাকাত প্রদানের মাধ্যমে পূরণ হয়।  পক্ষান্তরে সাদাকা: ধনী ও উপার্জনে সক্ষম সবল ব্যক্তিকে দেওয়া জায়েয আছে। বরং তা অভাবী দুস্থ ব্যক্তিদের দেয়া জায়েজ। অনেক প্রেক্ষাপটে ধনীরাও সাদাকা গ্রহণ করতে পারবেন।

সাদাকা ব্যয়ের খাত সমূহ :

পবিত্র কুরআনে সূরায়ে তওবা ৬০নং আয়াতে ফরয ছাদাক্বা সমূহ ব্যয়ের আটটি খাত বর্ণিত হয়েছে। যথা-

ক. ফক্বীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী, 

খ. মিসকীন : যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়,

‘আমেলীন : যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ, 

ঘ. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তিগণ : অমুসলিমদেরকে ইসলামে দাখিল করাবার জন্য এই খাতটি নির্দিষ্ট, 

ঙ. দাসমুক্তির জন্য: এই খাত বর্তমানে শূন্য। তবে অনেকে অসহায় কয়েদী মুক্তিকে এই খাতের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন (কুরতুবী)

চ. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : যার সম্পদের তুলনায় ঋণের অংক বেশী। কিন্তু যদি তার ঋণ থাকে ও সম্পদ না থাকে, এমতাবস্থায় সে ফক্বীর ও ঋণগ্রস্ত দু’টি খাতের হকদার হবে,

ছ. ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা : এটা

দুস্থ মুসাফির : পথিমধ্যে কোন কারণবশতঃ পাথেয় শূন্য হয়ে পড়লে পথিকগণ এই খাত হ’তে সাহায্য পাবেন। যদিও তিনি নিজ দেশে বা বাড়ীতে সম্পদশালী হন। 

৮. যাকাতের ক্ষেত্রে উত্তম হল স্থানীয় ধনীদের থেকে যাকাত আদায় করে স্থানীয় দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা। বরং অনেক আলেম মনে করেন বিশেষ কোন কল্যাণ ছাড়া অন্য শহরে যাকাত স্থানান্তর করা জায়েয নেই। পক্ষান্তরে সাদাকা: কাছের-দূরের সবার মাঝে বণ্টন করা যায়।

৯. যাকাত কাফের ও মুশরিকদেরকে দেওয়া জায়েয নেই। পক্ষান্তরে সাদাকা কাফের ও মুশরিকদেরকে দেওয়া জায়েয। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “আর খাদ্যের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীদেরকে খাবার দান করে।”[সূরা ইনসান: ৮] কুরতুবী বলেন: মুসলিম দেশে বন্দি হিসেবে থাকে কেবল মুশরিক।

১০. একজন মুসলিমের জন্য নিজের স্ত্রীকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। ইবনুল মুনযির এই বিষয়ে ফকীহদের ইজমা (ঐকমত্য) বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে সাদাকা স্ত্রীকে দেওয়া যেতে পারে।

সাদাকাহ সম্পর্কে আরো কিছু কথা। সকল পুণ্যের কাজকে সাদাকা বলা হয়। বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তার সহীহ বইয়ে বলেন: “অধ্যায়: প্রত্যেকটি সৎকাজই সাদাকা।” তারপর তিনি তাঁর সনদে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “প্রতিটি সৎকাজই সাদাকা।”

ইবনে বাত্তাল বলেন: “হাদীসটি প্রমাণ করে যে, মানুষ প্রত্যেক যে ভাল কাজ করে বা যে ভাল কথা বলে এর বদলে তার জন্য একটি সাদাকা লেখা হয়।”

নববী বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “প্রতিটি সৎকাজ-ই সাদাকা” অর্থাৎ নেকীর দিক সাদাকার অধিভুক্ত।

সূরায়ে তওবার ৬০নং আয়াতের শুরুতে إِنَّمَا শব্দ আনা হয়। যার অর্থঃ কেবলমাত্র, শুধুমাত্র। তাই শুরু থেকেই বুঝা যাচ্ছে যে, সদকার যে সকল খাতের বর্ণনা সামনে দেয়া হচ্ছে কেবল সে আটটি খাতেই সকল ওয়াজিব সদকা ব্যয় করা হবে, এছাড়া অন্য কোন ভাল খাতেও ওয়াজিব সদকা ব্যয় করা যাবে না। [কুরতুবী]
সদকা শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। নফল ও ফরয উভয় দানই এতে শামিল রয়েছে। নফলের জন্যে শব্দটির প্রচুর ব্যবহার, তেমনি ফরয সদকার ক্ষেত্রেও কুরআনের বহুস্থানে শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। বরং কোন কোন মুফাসসিরের তথ্য মতে কুরআনে যেখানে শুধু সদকা শব্দের ব্যবহার রয়েছে, সেখানে ফরয সদকা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। [কুরতুবী]

সাহাবা ও তাবেয়ীগনের ঐক্যমতে এ আয়াতে সেই ওয়াজিব সদকার খাতগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যা মুসলিমদের জন্যে সালাতের মতই ফরয। কারণ, এ আয়াতে নির্ধারিত খাতগুলো ফরয সদকারই খাত। হাদীস অনুযায়ী নফল সদকা আট খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর পরিসর আরও প্রশস্ত। আয়াতে আল্লাহ তা’আলা যাকাতের ব্যয় খাত ঠিক করে দিয়ে কারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত তা বাতলে দিয়েছেন। আর দেখিয়ে দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর হুকুম মতেই যাকাতের বিলি বন্টন করেছেন নিজের খেয়াল খুশীমত নয়। এক হাদীসে এ সত্যটি প্রমাণিত হয়। যিয়াদ ইবন হারিস আস-সুদায়ী বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে জানতে পারলাম যে, তিনি তার গোত্রের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে সৈন্যের একটি দল অচিরেই প্রেরণ করবেন।

আমি আরয করলাম ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনি বিরত হোন আমি দায়িত্ব নিচ্ছি যে, তারা সবাই আপনার বশ্যতা স্বীকার করে এখানে হাযির হবে। তারপর আমি স্বগোত্রের কাছে পত্র প্রেরণ করি। পত্র পেয়ে তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে। এর প্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, ‘তুমি তোমার গোত্রের একান্ত প্রিয় নেতা। আমি আরয করলাম এতে আমার কৃতিত্বের কিছুই নেই। আল্লাহর অনুগ্রহে তারা হেদায়েত লাভ করে মুসলিম হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন আমি এই বৈঠকে থাকাবস্থায়ই এক ব্যক্তি এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু সাহায্য চাইল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জবাব দিলেন, সদকার ভাগ বাটোয়ার দায়িত্ব আল্লাহ নবী বা অন্য কাউকে দেননি। বরং তিনি নিজেই সদকার আটটি খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এই আট শ্রেণীর কোন একটিতে তুমি শামিল থাকলে দিতে পারি। [আবু দাউদ হা/১৬৩০; দারাকুতনী: হা/২০৬৩]

সাদাকা প্রদানের ফযীলত :

সাদাকা মুমিনের জন্য অপরিহার্য বিষয়। যা পালনে নানা বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সাদাকা মুমিনের রিযিক বৃদ্ধির পাশাপাশি সদা কল্যাণ বয়ে আনে। সম্পদ ব্যয় মানেই সাদাকা নয়, এর বাহিরেও নানা প্রকার সাদাকা রয়েছে যথা- ভালো কথা, হেসে কথা বলা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো, মানুষকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া প্রভৃতি সাদাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যারা রাতে-দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে তাদের মাল-সম্পদ খরচ করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট বদলা রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।” [বাকারাহ ২/২৭৪]

১-সাদাকা ধন-সম্পদ ও রিজিক বৃদ্ধির কারণ: আল্লাহ তায়ালা বলেন: (আল্লাহ তায়ালা সুদকে বিলুপ্ত করেন এবং সাদাকাকে বৃদ্ধি করেন।) [বাকারাহ/২৭৬] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সাদাকা কোনও মালকে হ্রাস করে না”। [মুসলিম, হা/ ২৫৮৮]

২-সাদাকা রোগ থেকে আরোগ্যে পাওয়ার কারণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সাদাকার মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা করো”। [স্বাহীহ আল জামি, শাইখ আলবানী হাসান বলেছেন]

৩-সাদাকা সাদাকারীর সঠিক ঈমানের প্রমাণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সাদাকা হচ্ছে প্রমাণ”। [মুসলিম, স্বহীহ আল জামি হা/ ৩৯৫৭]

৪-সাদাকা পুণ্য ও তাকওয়া অর্জনের উপায়: আল্লাহ তায়ালা বলেন: (তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু খরচ না করা পর্যন্ত কক্ষনো পুণ্য লাভ করবে না) [আল্ ইমরান ৩/৯২]

৫-সাদাকা আত্মাকে পাক ও পরিশুদ্ধ করে: আল্লাহ তায়ালা বলেন: (তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ গ্রহণ করবে যাতে তা দিয়ে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে পার।) [তাওবা ৪/১০৩]

৬-সাদাকা কিয়ামত দিবসে সাদাকাকারীকে সূর্যের তাপ থেকে ছায়া করবে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক ব্যক্তি তার সাদাকার ছায়াতলে থাকবে যতক্ষণে লোকদের মাঝে ফয়সালা শেষ না হয়”। [আহমদ, শাইখ আলবানী স্বহীহ বলেছেন, স্বহীহ আল জামি হা/ ৪৫১০] অন্য হাদীসে সাত প্রকারের লোক আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে বলে উল্লেখ হয়েছে, তন্মধ্যে এক ব্যক্তি সে যে, “গোপনে এমন ভাবে সাদাকা করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে তার বাম হাত জানতে পারে না”। [বুখারী,হা/১৪২৩) মুসলিমহা/১০৩১)]

৭-সাদাকা করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বৈশিষ্ট: ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন এবং তাঁর দানশীলতা আরও বৃদ্ধি পেত, যখন রামাযান মাসে ফেরেশতা জিবরীল তাঁর সাথে সাক্ষাত করত”। [বুখারী, হা/৬) মুসলিম]

৮-সাদাকা হচ্ছে আত্মীয়তা বজায় রাখা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “কোনও এক মিসকিনকে সাদাকা করা একটি সাদাকা আর তা আত্মীয়কে করা একটি সাদাকা ও একটি আত্মীয়তা”। [আহমাদ, নাসাঈ, তিরমিযী, নং (৬৫৮) ইবনে কাসীর হাদীসটির সূত্রকে স্বহীহ বলেছেন]

৯-সাদাকা বিপদ থেকে নিরাপদে রাখে এবং আল্লাহর ক্রোধ নিভিয়ে দেয়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “ সওয়াবের কাজ বিপদাপদ থেকে নিরাপদে রাখে, গোপন ভাবে সাদাকা করা প্রতিপালকের ক্রোধ নিভিয়ে দেয় এবং আত্মীয়তা বজায় রাখা বয়স বৃদ্ধি করে”। [স্বহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব]

১০-সাদাকা অন্তরের নিষ্ঠুরতার চিকিৎসা: একদা এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট তার অন্তরের কঠোরতার অভিযোগ করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন: “ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও এবং মিসকিনদের খাদ্য দান করো”। [আহমদ, হা/৭৫৬৬, হাসান স্বহীহ আল জামি হা/ ১৪১০]

১১-সাদাকা কিয়ামতের দিনে জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ: (আর তারা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসার কারণে মিসকিন, ইয়াতীম ও কয়েদীকে খাবার খাওয়ায়। …. যার ফলে আল্লাহ তাদের সে দিনের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন আর তাদের দিবেন সজীবতা ও আনন্দ।) [সূরা দাহর/৯ ও ১১] হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাক যদিও অর্ধেক খেজুরও সাদাকা করে হয়”। [মুত্তাফাক আলাইহি]

১২-সাদাকা পাপ মোচন করে এবং তা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “এবং সাদাকা পাপ মুছে দেয় যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়”। [তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী স্বহীহ বলেছেন, স্বহীহ আল জামি হা/ ২৯৫১]

১৩-সাদাকা আল্লাহর ভালবাসার কারণ: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় সৎ কাজ হচ্ছে, মুসলিম ব্যক্তিকে খুশী করা কিংবা তার কষ্ট দূর করা কিংবা তার ক্ষুধা নিবারণ করা কিংবা তার ঋণ পরিশোধ করা”। [স্বহীহুত তারগীব ওয়াত্ তারহীব]

১৪-সাদাকাকারীর জন্য প্রত্যেক দিন ফেরেশতা দুআ করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “প্রতিদিন মানুষ যখন সকাল করে, তখন দুই জন ফেরেশতা অবতরণ করে। তাদের একজন বলে: হে আল্লাহ! তুমি (সৎ কাজে) ব্যয়কারীকে তার প্রতিদান দাও। আর দ্বিতীয় জন বলে: হে আল্লাহ! (আল্লাহ যা জরুরি করেছেন তা) ব্যয় না কারীর (সম্পদকে) ধ্বংস করে দাও”। [বুখারী, যাকাত অধ্যায়/১৩৭৪]

১৫-সাদাকার সওয়াব মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আদম সন্তান মারা গেলে তার সৎ আমল সমাপ্ত হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত: ১-সাদাকায়ে জারিয়া ২-উপকারী ইলম ৩-সৎ সন্তান যে তার জন্য দুআ করে”। [মুসলিম, অসিয়ত অধ্যায়]

১৬-সাদাকা জান্নাতে প্রবেশের কারণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “হে লোকেরা! আপসে সালাম বিনিময় কর, অন্যকে খাবার খাওয়াও, আত্মীয়তা বজায় রাখ এবং রাত্রে নামায আদায় কর যখন লোকেরা নিদ্রায় থাকে, তাহলে অভিবাদনের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। [ তিরমিযী বর্ণনা করেছেন, হা/২৪৯০) এবং শাইখ আলবানী স্বহীহ বলেছেন]

প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা জমিনে নেমে আসেন এবং সাদাকা প্রদানকারীর পক্ষে এবং কৃপণের বিপক্ষে দোআ করেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে দান-সাদাকা তাওফীক দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top