মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তবে মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার চরিত্র, আমল এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের উপর। যারা আল্লাহর জন্য নিজেদের জীবন পরিচালনা করে, খাঁটি নিয়তে ইবাদত করে এবং স্বার্থপরতা, অহংকার ও কপটতা থেকে দূরে থাকে—তাদেরকে বলা হয় মুখলেস বান্দা। এরা আল্লাহর নেক বান্দা, যাদের অন্তর পরিশুদ্ধ এবং আমল শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে, দুনিয়ার স্বার্থ থেকে মুক্ত থাকে, তাদেরকে বলা হয় মুখলেস বান্দা। এরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা ওলী। তাই তাদের সাথে বেয়াদবি করা আসলে আল্লাহর সাথে বেয়াদবি করার শামিল। আল্লাহ বলেন—
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
জেনে রাখ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলীদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”
— (সূরা ইউনুস-৬২)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন— وَمَن يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ
আর আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন, তার সম্মান দানকারী কেউ নেই।”
(সূরা হাজ্জ-18)
এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অবমাননা করা মানে নিজেকে আল্লাহর অপমানের মুখে ঠেলে দেওয়া। এসম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—
إِنَّ اللَّهَ قَالَ: مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ
আল্লাহ বলেন: যে আমার কোনো ওলীর সাথে শত্রুতা করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।” (সহিহ বুখারি, হা/6502)
এছাড়া রাসূল ﷺ আরও বলেছেন—
اتَّقُوا دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ
“মাজলুমের দোয়া থেকে বাঁচো, কারণ তার দোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।” (বুখারি, হা/2448; মুসলিম, হা/19)
এখান থেকে স্পষ্ট হয়, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কষ্ট দিলে তাদের দোয়া কবুল হয়ে যায়, আর সেই দোয়ার কবল থেকে কেউ রক্ষা পায় না।
মুখলেস বান্দাদের সাথে বেয়াদবীর বিস্তারিত পরিণাম :
১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি :
মুখলেস বান্দারা আল্লাহর বন্ধু (ওলী)। তাদেরকে কষ্ট দেওয়া মানে আল্লাহকেই কষ্ট দেওয়া। কুরআনে আল্লাহ বলেন—
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে লানত করেছেন এবং তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি প্রস্তুত করেছেন।”
— (সূরা আহযাব, আয়াত 57)
২. দুনিয়াতে শাস্তি :
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যে জাতি আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের উপহাস বা কষ্ট দিয়েছে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।
- আদ জাতি নবী হুদ (আ.)-এর কথা মানেনি → প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝায় ধ্বংস হয়।
- সমূদ জাতি নবী সালেহ (আ.)-এর সাথে বেয়াদবি করে উটীকে হত্যা করেছিল → ভয়াবহ ভূমিকম্প ও বজ্রাঘাতে ধ্বংস হয়।
- বনী ইসরাইলের কিছু অংশ নবীদের হত্যা করেছিল → আল্লাহ তাদের উপর অভিশাপ দিয়েছেন।
- ফিরআউন মূসা (আ.)-এর সাথে অবজ্ঞা করে শেষ পর্যন্ত পানিতে ডুবে মারা যায়।
- নিমরূদ ইবরাহীম (আ.)-কে অপমান করে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ক্ষুদ্র মশার দ্বারা ধ্বংস হয়।
আল্লাহ বলেন— وَمَن يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ
“আল্লাহ যাকে অপমান করেন, তার সম্মানদাতা কেউ নেই।”(হাজ্জ -18)
৩. বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া :
আল্লাহর মুখলেস বান্দারা দোয়ার মানুষ। তাদের দোয়া জীবনে বরকত নিয়ে আসে। কিন্তু তাদের সাথে বেয়াদবি করলে সেই দোয়া পাওয়া যায় না। বরং জীবনে অশান্তি, অকল্যাণ ও অবারকতি নেমে আসে।
রাসূল ﷺ বলেছেন—
رُبَّ أَشْعَثَ مَدْفُوعٍ بِالْأَبْوَابِ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لَأَبَرَّهُ
“কতই না আছে এলোমেলো চুলওয়ালা, দরজায় ধাক্কা খাওয়া মানুষ, যদি সে আল্লাহর নামে শপথ করে কিছু চাইত, আল্লাহ তা পূর্ণ করতেন।”
— (সহিহ মুসলিম, হাদীস 2622)
অর্থাৎ, নিঃস্ব ও বিনয়ী মুখলেস বান্দাদের দোয়া খুবই শক্তিশালী। তাদের কষ্ট দিলে সেই কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
৪. মাজলুমের দোয়া কবুল হয়ে যায় :
কোনো মুখলেস বান্দাকে কষ্ট দিলে তার অন্তর থেকে যে দোয়া বের হয়, তা প্রত্যাখ্যাত হয় না।
রাসূল ﷺ বলেছেন—
اتَّقُوا دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ، فَإِنَّهَا تَصْعَدُ إِلَى السَّمَاءِ كَأَنَّهَا شَرَارٌ
“মাজলুমের দোয়া থেকে বাঁচো। তা আসমানের দিকে আগুনের শিখার ন্যায় উঠে যায়।”
— (মুসনাদ আহমদ, হাদীস 12549)
অতএব, মুখলেস বান্দার কষ্ট থেকে তার দোয়া কবুল হয়ে যায়, যা অন্যের ধ্বংস ডেকে আনে।
৫. আখেরাতে কঠিন শাস্তি :
দুনিয়াতে হয়তো কেউ বেঁচে গেলেও আখেরাতে আল্লাহর কাছে তার কোনো আশ্রয় থাকবে না। বরং সে হবে সবচেয়ে অপমানিতদের একজন।
কুরআনে আল্লাহ বলেন—
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ
“তুমি কখনোই মনে করো না যে, আল্লাহ জালিমদের কাজকর্ম থেকে গাফেল।”
— (সূরা ইবরাহীম, আয়াত 42)
এভাবে আখেরাতে তাদের জবাবদিহি কঠিন হবে এবং জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
মুখলেস বান্দাদের সাথে বেয়াদবি করা কোনো সাধারণ অপরাধ নয়; বরং এটি আল্লাহর সাথে বিরোধিতা করার নামান্তর। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা, তাদের কাছ থেকে দোয়া নেওয়া এবং সর্বদা তাদের সাথে নম্র আচরণ করা। এতে দুনিয়া-আখেরাতে কল্যাণ লাভ হবে।
মুখলেস বান্দাদের সাথে বেয়াদবীর পরিণাম শুধু দুনিয়াতে নয়, বরং আখেরাতেও ভয়াবহ। এটি আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য। তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও নম্র আচরণ করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি, দুনিয়ার বরকত ও আখেরাতের মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন আমীন।