লেখক : ড. নূরুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
কর্মজীবন :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর কর্মজীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তিনি যেসব শহরে-নগরে অবস্থান করেছিলেন, সে সকল স্থানে দরস প্রদানের কোন তথ্যও ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায় না। আসলেই কি তার দরসের কোন হালাকা ছিল না? এর সঠিক উত্তর দেওয়া বেশ মুশকিল। কারণ তাঁর যুগের ইলমী পরিবেশ দরস ও সংলাপে গুঞ্জরিত থাকত। তাছাড়া শেষ জীবনে তিনি মিসরের ‘মুনয়াতু বানী খাছীব’ নামক যে স্থানে বসবাস করতেন তা ইলমে দ্বীন চর্চার কেন্দ্রস্থল ও আলেম-ওলামার মিলনস্থল ছিল। নীলনদের উপকূলে অবস্থিত এর জামে মসজিদে মানুষজন দ্বীনী ইলম হাছিলের জন্য সমবেত হত। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে এ মসজিদে দ্বীনী ইলম শিক্ষার জন্য আসত। তাদের মধ্যে আবু মারওয়ান আল-বাজী নামক একজন ব্যক্তির কথা ইতিহাসে সুবিদিত হয়ে আছে।[1]
ছাত্রবৃন্দ :
বহু ছাত্র ইমাম কুরতুবীর ইলমী ঝর্ণাধারার স্বচ্ছ সলিলে অবগাহন করেছে। তারা তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করে তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে এবং তাঁর ইলমী প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হয়েছে।[2] কিন্তু তাদের সকলের নাম জানা যায় না। জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী[3] ও হাফেয শামসুদ্দীন দাঊদী[4] তাঁর মাত্র একজন ছাত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি হলেন তদীয় পুত্র শিহাবুদ্দীন আহমাদ। তিনি আলেম ও বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। সুয়ূত্বী বলেন,وروى عنه بالإجازة ولده شهاب الدين أحمد ‘কুরতুবীর নিকট থেকে তাঁর ছেলে শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইজাযা সূত্রে বর্ণনা করেছেন’।[5] হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) আহমাদ বিন মুহাম্মাদ কূছীর (মৃঃ ৭৩১ হিঃ) জীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ইমাম কুরতুবীর ছেলে আহমাদের কাছ থেকে হাদীছ শ্রবণ করেছেন।[6]
২. আবু জা‘ফর আহমাদ বিন ইবরাহীম বিন যুবায়ের গারনাতী (৬২৮-৭০৮ হিঃ) : তিনি আন্দালুসের ক্বারী ও মুহাদ্দিছগণের শায়খ ছিলেন। ইবনু বাশকূওয়ালের ‘আছ-ছিলাহ’ গ্রন্থের তিনি পরিশিষ্ট রচনা করেন। ঐতিহাসিক মার্রাকুশী ইমাম কুরতুবীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন, حدثنا عنه أبو جعفر بن الزبير، كتب إليه من مصر، ‘আবু জা‘ফর বিন যুবায়ের কুরতুবীর নিকট থেকে আমাদের কাছে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি মিসর থেকে তাঁর নিকট ইজাযাহ লিখে পাঠিয়েছিলেন’।[7]
৩. ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল করীম বিন আব্দুছ ছামাদ খুরাসতানী (৬৩৯-৭০৯ হিঃ) : ইনি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। ইবনু হাজার আসক্বালানী ইমাম কুরতুবী থেকে তাঁর হাদীছ শোনার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।[8]
৪. আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইমাম কামালুদ্দীন আবুল আববাস আহমাদ বিন আমীনুদ্দীন কাসতাল্লানী (৬১৪-৬৮৬ হিঃ) : আবুল মা‘আলী ফুরাবীর ‘আল-আরবাঊন’ গ্রন্থটি তিনি ইমাম কুরতুবীর নিকট থেকে শ্রবণ করেছেন।[9]
৫. যিয়াউদ্দীন আহমাদ বিন আবিস সঊদ বিন আবুল মা‘আলী বাগদাদী : তিনি ৬৫৬ হিজরীতে কুরতুবীর ‘আত-তাযকিরাহ’ গ্রন্থটি তাঁর নিকট থেকে পান এবং অন্যের কাছে বর্ণনার অনুমতি লাভ করেন।[10]
৬. আবু মুহাম্মাদ আব্দুল গাফফার বিন মুহাম্মাদ আব্দুল কাফী আশ-শামমূনী : তিনি ইমাম কুরতুবীর নিকট তাঁর ‘আত-তাযকিরাহ’ গ্রন্থের কয়েকটি পাতা পড়েন এবং তাঁর গ্রন্থসমূহ বর্ণনার অনুমতি লাভ করেন। ইমাম কুরতুবী স্বহস্তে লিখিত ‘ইজাযা’ বা সনদও তাঁকে প্রদান করেন।[11]
শেষ জীবন ও মৃত্যু :
ইমাম কুরতুবী তাঁর জীবনের দীর্ঘ প্রায় ৩৮ বছর মিসরে অতিবাহিত করেন।[12] শেষ জীবনে তিনি মিসরের ‘মুনয়াতু বানী খাছীব’ নামক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।[13] সম্ভবত মিসরে সে সময় এ স্থানটি সবচেয়ে নিরাপদ ছিল বিধায় তিনি এখানে স্থায়ী নিবাস গড়েন। কারণ আলেকজান্দ্রিয়া ও এর আশেপাশে মাঝে-মধ্যে ক্রসেডাররা আক্রমণ করত এবং রাজধানী কায়রোতে সর্বদা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগে থাকত।[14] কুরতুবীর প্রিয় শিক্ষক ইবনুল জুম্মাইযীর (মৃঃ ৬৪৯) সাহচর্য লাভ এবং তাঁর প্রতি প্রচন্ড ভালবাসাও এখানে তাঁর থিতু হওয়ার একটি কারণ হতে পারে বলে অনুমিত হয়। কারণ এ স্থানে তিনি তাঁর নিকট থেকে হাদীছ শ্রবণ করেছেন এবং অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[15]
তিনি ৬৭১ হিজরীর ৯ই শাওয়াল (১২৭৪ খ্রিঃ) সোমবার রাতে ‘মুনয়াতু বানী খাছীব’ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।[16]
উল্লেখ্য যে, ‘মুনয়াতু বানী খাছীব’ স্থানটি মিসরের আসইঊত প্রদেশের উত্তরে নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত। বর্তমানে এটি নীলনদের পূর্বে ‘আল-মিনয়া’ যেলার অন্তর্ভুক্ত। এ যেলার ‘আরযু সুলতান’ নামক স্থানে বর্তমানে তাঁর কবরটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালে তাঁর নামে এখানে একটি বড় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।[17]
অনুপম চরিত্র মাধুর্য ও বৈশিষ্ট্য :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) একজন খ্যাতিমান ‘আলেমে রববানী’ ছিলেন। দুনিয়ার প্রতি তাঁর সামান্যতম মোহ ছিল না। তিনি সারাজীবন ইলমে দ্বীন চর্চায় ব্যয় করেন। পৃথিবীর মানুষকে তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু দুনিয়াতে তিনি কিছুই পাননি। যারা তাঁর জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের প্রত্যেকেই তাঁর উন্নত চরিত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি নানাবিধ মানবীয় গুণে গুণান্বিত ছিলেন। যেমন-
১. পরহেযগারিতা ও দুনিয়াবিমুখতা :
ঐতিহাসিক ইবনে ফারহূন বলেছেন, كَانَ من عباد الله الصَّالِحين وَالْعُلَمَاء العارفين الورعين الزاهدين فِي الدُّنْيَا المشغولين بِمَا يعنيهم من أُمُور الْآخِرَة- ‘তিনি আল্লাহর সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি মুত্তাক্বী ও দুনিয়াবিমুখ একজন বিদগ্ধ আলেম ছিলেন। পরকালে কল্যাণ বয়ে আনবে এমন কর্মে নিয়োজিতদের মধ্যে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[18] আব্দুল গাফফার আশ-শামমূনী বলেছেন,اجتمعتُ به بمنية بني خصيب، فرأيت آثار الصلاح لائحة عليه- ‘মুনয়াতু বানী খাছীবে আমি তাঁর সাথে মিলিত হয়েছি। আমি তাঁর মধ্যে তাক্বওয়ার চিহ্ন দীপ্তিমান দেখেছি’।[19]
তাফসীরে কুরতুবী ছাড়াও ‘কামউল হিরছ বিয-যুহদ ওয়াল কানা‘আহ’ এবং ‘আত-তাযকিরাহ বি-আহওয়ালিল মাওতা ওয়া উমূরিল আখেরাহ’ গ্রন্থ দু’টি তাঁর দুনিয়াবিমুখতা ও পরহেযগারিতার অন্যতম প্রমাণ।
তাঁর এই চরিত্র মাধুর্যের উৎস হল আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস, তাঁর ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্টি এবং পার্থিব জীবনের মূল্যহীনতা সম্পর্কে সম্যক অবগতি। যেমন তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাঁর প্রভুর আনুগত্য করবে, নিজের নফস ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করবে এবং শয়তান ও দুনিয়ার বিরোধিতা করবে, জান্নাত তাঁর ঠিকানা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর ভ্রষ্টতা ও অবাধ্যতায় সীমালংঘন করবে, দুনিয়াতে তাঁর পাপাচারের লাগামকে ঢিল দিবে, নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য স্বীয় নফস ও প্রবৃত্তির অনুগামী হবে এবং তার যাবতীয় প্রবৃত্তিপরায়ণতায় শয়তানের অনুসরণ করবে, জাহান্নাম তাঁর উপযুক্ত ঠিকানা হবে’।[20]
২. কারামত :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হল, ‘অলীগণের কারামত সত্য’।[21] তাঁদের মতে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কোন নেক বান্দার প্রতি কারামত বা বিশেষ সম্মান প্রদর্শন।[22] ইমাম কুরতুবী (রহঃ)ও নিঃসন্দেহে আল্লাহর একজন অলী ছিলেন। তাঁর থেকে প্রকাশিত দু’টি কারামত নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল:-
ক. সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘আমার মাতৃভূমি আন্দালুস বা স্পেনের কর্ডোভা অঞ্চলের একটি ভগ্নপ্রায় দুর্গে আমার ক্ষেত্রে এরূপ ঘটেছিল। ঘটনাটি হল, আমি শত্রুর সম্মুখ দিয়ে পলায়ন করে তার থেকে দূরে একটি জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম। ইত্যবসরে আমার সন্ধানে দু’জন অশ্বারোহী বেরিয়ে পড়ল। আমি তখন উন্মুক্ত ময়দানে বসাছিলাম। শত্রুসেনা থেকে আমাকে আড়াল করার মতো কিছু ছিল না। আমি তখন সূরা ইয়াসীনের প্রথম কয়েকটি আয়াত ও কুরআন মাজীদের অন্যান্য আয়াত পাঠ করছিলাম। সৈন্য দু’জন আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। অতঃপর ফিরে যাওয়ার সময় তারা একজন আরেকজনকে বলছিল, এতো সাক্ষাৎ শয়তান। আল্লাহ তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাই তারা আমাকে দেখতে পায়নি। এজন্য আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি’।[23]
খ. জ্বিনের আস্তানায় ছাগের চিৎকার :
একদা ইমাম কুরতুবী ও কারাফী মিসরের ফাইয়ূম এলাকায় সফর করেন। শহরে প্রবেশ করার পর তারা তাদের বিশ্রামস্থল খুঁজছিলেন। তাদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্থান দেখিয়ে দেয়া হলে তারা সেখানে আসলেন। তখন একজন ব্যক্তি তাদেরকে বলল, জনাব, আল্লাহর কসম করে বলছি, আপনারা এখানে প্রবেশ করবেন না। কারণ এটি জ্বিনের আস্তানা। কারাফী একথা শুনে খাদেমদেরকে বললেন, তোমরা এখানে প্রবেশ করো এবং আমাদেরকে এ প্রলাপ থেকে মুক্তি দাও। একথা বলার পর তারা শহরের জামে মসজিদ অভিমুখে রওয়ানা হলেন। খাদেমরা স্থানটিকে থাকার উপযোগী করার পর তারা পুনরায় সেখানে ফিরে আসলেন। যখন তারা সেখানে স্থির হলেন, তখন একটি পরিত্যক্ত খাদ্য গুদামের ভিতর থেকে ছাগের চিৎকার শুনতে পেলেন। বারবার তার চিৎকার ধ্বনিত হচ্ছিল। এতে কারাফীর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল, তাঁর শক্তি উবে গেল এবং তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। অতঃপর গুদামের দরজা খোলা হল। সেখান থেকে ছাগের মাথা বেরিয়ে এল এবং সে চিৎকার শুরু করল। কারাফী তখন ভয়ে বিগলিত হয়ে যাওয়ার দশা। কিন্তু কুরতুবী ছাগের বেরিয়ে থাকা মাথাটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার দুই শিং ধরলেন এবং আঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠের পর নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করতে থাকলেন- آللهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى اللهِ تَفْتَرُونَ ‘এটা করার জন্য আল্লাহ কি তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করছ?’ (ইউনুস ১০/৫৯)।
অবশেষে খাদেম সেখানে প্রবেশ করল। তার হাতে রশি ও ছুরি ছিল। সে বলল, জনাব! আপনি এত্থেকে দূরে থাকুন। সে এগিয়ে এসে ছাগটিকে বের করে যবেহ করল। তারা তাকে বললেন, এটা কি? সে বলল, আপনারা মসজিদ অভিমুখে যাওয়ার সময় আমি জনৈক ব্যক্তির কাছে ছাগটি দেখে তা যবেহ করে খাওয়ার জন্য স্বল্প মূল্যে ক্রয় করি এবং এ গুদামে রেখে যাই। একথা শোনার পর কারাফী সম্বিৎ ফিরে পেলেন এবং বললেন, ভাই আমার! আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন! তুমি একথা না বললে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়তাম।[24]
৩. সত্য প্রকাশে নির্ভীক :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) অত্যন্ত সাহসী ও হক প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন। তিনি সত্য প্রকাশে নিন্দুকের নিন্দাকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করতেন না। তিনি তাঁর তাফসীরের অনেক জায়গায় সমকালীন শাসকদের কড়া সমালোচনা করতে পিছপা হননি। কারণ তারা মানুষের উপর অত্যাচার করত এবং ঘুষ খেত। তাছাড়া তারা আহলে কিতাবদেরকে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত করত।[25] যেমন সূরা বাক্বারাহ ১৮৮ আয়াতের তাফসীরে তিনি বলেন,فالحكام اليوم عين الرشا لَا مَظِنَّتُهُ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ ‘বর্তমানে শাসকেরা কেবল ঘুষের উৎসই নয়; নিজেরাই ঘুষখোর। ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’।[26]
‘আত-তাযকিরাহ’ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি বলেন, ‘এটা সেই যুগ যেখানে হকের উপর বাতিল প্রাধান্য লাভ করেছে এবং দাসরা স্বাধীন ব্যক্তিদের উপর বিজয় লাভ করেছে। ফলে তারা দ্বীনের বিধি-বিধানকে বিক্রি (বিনষ্ট) করেছে। এতে শাসকদের সায় ছিল। ফলে শাসন হয়ে পড়েছে ট্যাক্সনির্ভর আর সত্য ঠিক এর বিপরীত। হকের নিকট পৌঁছার যেন কোন ক্ষমতাই নেই। তারা আল্লাহর দ্বীনকে পরিবর্তন করে দিয়েছে এবং আল্লাহর বিধানকে করেছে বিকৃত। তারা মিথ্যা কথা শুনতে যেমন অভ্যস্ত, সুদ খেতেও তেমনি অভ্যস্ত…। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের নিম্নোক্ত কবিতাটি তিনি উল্লেখ করেছেন-
وَهَلْ أَفْسَدَ الدِّيْنَ إِلاَّ الْمُلُوْكُ + وَأَحْبَارُ سُوْءٍ وَرُهْبَانُهَا؟
‘দ্বীনকে ধ্বংস করে মাত্র তিনজন : অত্যাচারী শাসকবর্গ, দুষ্টমতি আলেমরা ও ছূফী পীর-মাশায়েখরা’।[27]
ইমাম কুরতুবীর সময়ে আহলে কিতাবদের কর্তৃত্ব সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘এই যুগে আহলে কিতাবদেরকে লেখক ও সচিবরূপে গ্রহণ করার মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এর মাধ্যমে তারা গন্ডমূর্খ শাসক ও আমীরদের নিকট কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছে’।[28]
৪. সাধাসিধা জীবন যাপন :
কুরতুবী পার্থিব জাঁকজমক ও আড়ম্বতার ঊর্ধ্বে সহজ-সরল জীবনাচরণকে বেছে নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ এদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, وَكَانَ قد أطرح التَّكَلُّف يمشي بِثَوْب وَاحِد وعَلى رَأسه طاقية ‘তিনি কৃত্রিমতাকে পরিহার করে একটি কাপড় পরিধান করে রাস্তায় হাঁটতেন। তখন তার মাথায় থাকত একটি টুপি’।[29]
এ উক্তি দ্বারা বুঝা যায় যে, দুনিয়ার প্রতি তিনি নিরাসক্ত ছিলেন। পার্থিব ভোগ-বিলাস ছিল তাঁর কাছে অতীব তুচ্ছ বিষয়। পরকালীন অনন্ত সুখকেই তিনি ক্ষণস্থায়ী আড়ম্বতার উপরে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তবে এটা সুদূরপরাহত যে, তিনি ছূফীদের মতো তালি দেয়া বা খসখসে পোষাক পরিধান করতেন। না ছেঁড়া পর্যন্ত শরীর থেকে যারা সেটি খুলে না। কারণ ছূফীদের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘যারা বলেছেন যে, খসখসে কাপড় পরিধান করা তাক্বওয়ার পোষাক। কারণ সেটা বিনয়-নম্রতার অধিক নিকটবর্তী। এটা স্রেফ তাদের দাবী। কারণ খ্যাতিমান আলেমগণ তাক্বওয়ার গুণে বিভূষিত হওয়া সত্ত্বেও উন্নত পোষাক পরিধান করতেন’।[30]
অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘যাঁরা সুন্দর পোষাক পরিহার করে কাতান ও পশমের খসখসে পোষাক পরিধান করাকে প্রাধান্য দেয় এবং বলে যে, ‘আল্লাহভীতির পোষাকই সর্বোত্তম’ (আ‘রাফ ৭/২৬), তারা এ আদর্শ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। যাদের কথা আমি উল্লেখ করেছি[31] তারা কি তাক্বওয়ার পোষাক পরিত্যাগ করেছিলেন। আল্লাহর কসম, তারা তা করেননি। বরং তারা তাক্বওয়াশীল ও জ্ঞানী-গুণী। আর অন্যরা তাক্বওয়ার দাবীদার মাত্র। বস্ত্তত তাদের অন্তর তাক্বওয়াশূন্য’।[32]
৫. মিষ্টভাষী :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) মিষ্টভাষী ছিলেন। তিনি মানুষের সাথে সদাচরণ করতেন এবং কারো জন্য কর্কশ ভাষা ব্যবহার করতেন না। বিভিন্ন মাসআলায় বিরোধীদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রেও তার ভাষা হত সংযত, কোমল ও নরম।[33]
তিনি স্বদেশী মুফাস্সির ইবনুল আরাবী কর্তৃক বিরোধীদের ক্ষেত্রে কঠোর ভাষা প্রয়োগের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।[34]
৬. সময়ের প্রতি যত্নবান :
ইমাম কুরতুবী সময়ের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তিনি নিজের জীবনকে ইলম অন্বেষণ, অধ্যয়ন ও গ্রন্থ রচনায় উৎসর্গ করেছিলেন। এক্ষেত্রে কোন ক্লান্তি, বিরক্তি বা অবসাদ তাঁকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। এজন্য ঐতিহাসিকগণেন দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তি হল, أوقاته معمورة مَا بَين توجه وَعبادَة وتصنيف ‘আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ, ইবাদত-বন্দেগী ও গ্রন্থ রচনায় তাঁর সময় কাটত’।[35]
৭. ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর কাজে-কর্মে ইখলাছের প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি আল্লাহর একজন মুখলিছ বা একনিষ্ঠ বান্দা ছিলেন। তিনি ইলম অন্বেষণে তাঁর যুগের কিছু আলেমের ইখলাছহীনতার অভিযোগ করেছেন। ইমাম মালেক (রহঃ)-এর উক্তি ‘আমাদের যুগে ইনছাফের চেয়ে কম আর কিছুই নেই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্য হল, ইমাম মালেকের যুগের অবস্থা যদি এরূপ হয়, তাহলে বর্তমানে আমাদের যুগের অবস্থা কেমন হতে পারে? যে যুগে দুর্নীতি
ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং আহাম্মকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন গভীর জ্ঞান অন্বেষণের জন্য নয়; নেতৃত্ব লাভের জন্য ইলমে দ্বীন হাছিল করা হয়। বরং বলা চলে দুনিয়ায় খ্যাতি লাভ এবং তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে সমসাময়িকদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য জ্ঞানার্জন করা হয়। অথচ বিতর্ক অন্তরকে কঠোর করে দেয় এবং শত্রুতার সৃষ্টি করে। আর এটি তাক্বওয়াহীনতা ও আল্লাহভীতি পরিত্যাগে প্রলুব্ধ করে’।[36]
৮. ইলমী আমানত রক্ষা :
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর গ্রন্থসমূহ রচনায় যেসব বিগত মনীষীর লেখনী দ্বারা উপকৃত হয়েছেন তাদের অবদান অকপটে স্বীকার করেছেন এবং বিভিন্ন মনীষীর অভিমত সমূহকে তার প্রবক্তাদের প্রতি নিসবত করেছেন। কেননা এতে ইলমের বরকত বৃদ্ধি হয়।[37]
৯. দ্বীনী আবেগ :
ইমাম কুরতুবী তাঁর যুগের শাসকদের যুলুম-নির্যাতন ও ঘুষ গ্রহণের যেমন সমালোচনা করেছেন, তেমনি সাধারণ মানুষকেও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেছেন। মানুষের মধ্যে দ্বীনী প্রভাব হ্রাস পাওয়া এবং বিদ‘আত ও অন্যায়-অপকর্ম বৃদ্ধি পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।[38] বিশেষত তিনি মিসরীয়দের বিভিন্ন আচার-অভ্যাসের কড়া সমালোচনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, وأما ظهور الزنا، فذلك مشهور في كثير من الديار المصرية. ‘অনেক মিসরীয় ভূখন্ডে যেনা-ব্যভিচার ব্যাপকতা লাভ করেছে’।[39] এসব তাঁর তীব্র দ্বীনী আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এর মাধ্যমে মানুষের সমালোচনা করা উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য স্রেফ সমাজ সংস্কার। একজন সমাজ সংস্কারক হিসাবে তাঁর দায়িত্বশীলতা থেকে তিনি মানুষের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরেছেন।
(ক্রমশঃ)
[1]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৯৪-৯৫।
[2]. দ্রঃ নাফহুত তীব ২/২১১-১২।
[3]. তাবাকাতুল মুফাস্সিরীন, পৃঃ ৯২।
[4]. দাঊদী, তাবাকাতুল মুফাস্সিরীন ২/৭০।
[5]. তাবাকাত, পৃঃ ৯২।
[6]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আদ-দুরারুল কামিনাহ ফী আ‘য়ানিল মিআতিছ ছামিনাহ ১/৩৬১, জীবনী ক্রমিক ৭৭৪।
[7]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৫।
[8]. আদ-দুরারুল কামিনাহ ১/৪৫১, জীবনী ক্রমিক ৯৫৬।
[9]. ইবনু রশীদ আল-ফিহরী, মিলউল আয়বাহ ৩/৪২৫।
[10]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৯৪।
[11]. হাফেয ইয্যুদ্দীন হুসায়নী, ছিলাতুত তাকমিলাহ লিঅফায়াতিন নাকালাহ, তাহকীক ও তা‘লীক : ড. বাশার আওয়াদ মা‘রূফ (বৈরূত : দারুল গারব আল-ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৪২৮ হিঃ/২০০৭ খ্রিঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৩৯, পাদটীকা-১ দ্রঃ।
[12]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৪৫।
[13]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৪।
[14]. মানহাজুল কুরতুবী ফিল কিরাআ-ত, পৃঃ ২৬।
[15]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৪০।
[16]. নাফহুত তীব ২/২১১; আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৯; দাঊদী, তাবাকাত ২/৭০।
[17]. ড. আল-কাছাবী মাহমূদ যালাত, আল-কুরতুবী ওয়া মানহাজুহু ফিত-তাফসীর (বৈরূত : আল-মারকাযুল আরাবী লিছ-ছাকাফাহ ওয়াল উলূম, তাবি), পৃঃ ৩০।
[18]. আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৮।
[19]. ছিলাতুত তাকমিলাহ ১/৬৩৯, টীকা-১; আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৫, টীকা-২।
[20]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/৮৮০।
[21]. আক্বীদা ত্বহাবিয়াহ প্রভৃতি দ্রঃ।
[22]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ১১০।
[23]. তাফসীরে কুরতুবী, বণী ইসরাঈল ৪৫ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[24]. আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২/৮৭, জীবনী ক্রমিক ৪৭২।
[25]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৫০।
[26]. তাফসীরে কুরতুবী, বাক্বারাহ ১৮৮ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[27]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/১২২৮।
[28]. তাফসীরে কুরতুবী, আলে ইমরান ১১৮ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[29]. আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৯; নাফহুত তীব ২/২১১; দাঊদী, তাবাকাত ২/৭০।
[30]. তাফসীরে কুরতুবী, আ‘রাফ ২৬ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[31]. হুসাইন তনয় আলী, তামীম আদ-দারী, মালেক বিন দীনার প্রমুখ।
[32]. তাফসীরে কুরতুবী, আ‘রাফ ৩২ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[33]. ‘তারজামাতুল ইমাম আল-কুরতুবী’ www.alukah.net.
[34]. তাফসীরে কুরতুবী, নাহল ৬৭ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[35]. আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৮; নাফহুত তীব ২/২১০; দাঊদী, তাবাকাত, ২/৬৯।
[36]. তাফসীরে কুরতুবী, বাক্বারাহ ৩২ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[37]. তাফসীরে কুরতুবী, ভূমিকা দ্রঃ।
[38]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৫৩।
[39]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/১২৪০।