আক্বীদার জিরক্স কপি নয়, মূলকপি চায়-২

তাওহীদে বিশ্বাসী সালাফী মুমিন সদা আল্লাহরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁরই নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করেন। তাঁরই ‘তাক্বদীরের’ ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস রেখে যথাসাধ্য ‘তদবীর’ করে চলেন। পরকালীন মুক্তির জন্য তারা শিরক ও বিদ‘আতমুক্ত এবং শরী‘আত অনুমোদিত নেক আমলকেই একমাত্র ‘অসীলা’ হিসাবে মনে করেন। যে সকল কথায় ও কর্মে শিরক ও বিদ‘আতের সামান্যতম ছিটে-ফোঁটা থাকে, তা হ’তে তারা দূরে থাকেন। কোন মানুষকে ‘ইলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে তারা বিশ্বাস করেন না। নবী ব্যতীত অন্য কাউকে তারা মা‘ছূম বা নিষ্পাপ বলে মনে করেন না। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তারা নূরের সৃষ্টি বা ‘নূরনবী’ নয় বরং মাটির সৃষ্টি বা ‘মানুষ নবী’ বলে বিশ্বাস করেন। আল্লাহ আরশে সমুন্নীত আছেন এবং তিনি অবশ্যই অবতরণ করেন,যেভাবে অবতরণ করা তাঁর মর্যাদার উপযোগী হয় ইত্যাদি।

(এক) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা :

আল্লাহ নিরাকার সত্তা নন। বরং তাঁর নিজস্ব আকার রয়েছে। এটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা। এতে কোন কল্পিত ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ নেই। কেননা কুরআনের অসংখ্য আয়াত ও হাদীছে আল্লাহর হাত, পা, চেহারা তথা আকার-আকৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে তা সৃষ্টিজগতের কোন কিছুর সাথে তুলনীয় নয়। অর্থাৎ- সৃষ্টির সাথে স্রষ্টা তুলনীয় নহে। আর তুলনা করা শয়তানের কর্ম ও হারাম। এমন চিন্তার কল্পনা মনে আসলে বিতাড়িত শয়তান থেকে বেশী বেশী পানাহ চায়তে হবে।

ছাহাবীগণের আক্বীদা :

আল্লাহ তাআলার নিজস্ব আকার আছে বরং তিনি নিরাকার নন। যেমনটি তাঁর উপযুক্ত। তিনি সাত আসমানের উপরে আরশে সমুন্নীত, প্রত্যেক ছাহাবীর এই আক্বীদা ছিল। মু‘আবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার একজন দাসী ছিল। ওহোদ ও জাওয়ানিইয়াহ নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি, নেকড়ে আমাদের একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান (সাধারণ মানুষ), তারা যেভাবে ক্রুদ্ধ হয় আমিও সেভাবে ক্রুদ্ধ হই। আমি তাকে একটা থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলে তিনি এটাকে গর্হিত কাজ বলে অভিহিত করলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কি তাকে আযাদ করে দেব না? তিনি বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে এস। আমি তাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার নারী’।[মুসলিম হা/৫৩৭ ‘মসজিদ সমূহ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ।]

উল্লিখিত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আসমানে আছেন এমনই ছিল ছাহাবীদের আক্বীদা। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, মুক্বাল্লিদ ভাইদের আক্বীদা হ’ল আল্লাহ নিরাকার এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান। অথচ তাদের অনুসরণীয় ইমাম আবু হানীফা (রাঃ)-এর আক্বীদা ছিল আল্লাহ নিরাকার নন এবং সর্বত্র বিরাজমান নন, তিনি আসমানের উপরে আরশে অবস্থান করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,من قال لا أعرف ربي في السماء أم في الأرض فقد كفر لأن الله تعالى يقول الرحمن على العرش استوى وعرشه فوق سبع سموات. ‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমীনে তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে। কেননা আল্লাহ বলেন, রহমান আরশে সমুন্নীত। আর তার আরশ সপ্ত আকাশের উপর।[ইজতিমাউল জুয়ূশিল ইসলামিয়াহ, পৃঃ ৯৯।] তিনি আরো বলেন,من قال لا أعرف ربي في السماء أو في الأرض فقد كفر وكذا من قال إنه على العرش ولا أدري العرش أفي السماء أو في الأرض والله تعالى يدعى من أعلى لا من أسفل ليس من وصف الربوبية والألوهية في شيء. ‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমীনে আছেন তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে। অনুরূপভাবে যে বলবে যে, তিনি আরশে আছেন। কিন্তু আরশ আকাশে না যমীনে, আমি তা জানি না, সেও কুফরী করবে। কেননা উপরে থাকার জন্যই আল্লাহকে ডাকা হয়; নীচে থাকার জন্য নয়। আর নীচে থাকাটা আল্লাহর রুবূবিয়াত এবং উলূহিয়াতের গুণের কিছুই নয়’।[ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিক্বহুল আবসাত, পৃঃ ৫১।]

(১) আল্লাহ আরশে সমুন্নীত :

আল্লাহ আরশে সমুন্নীত আছেন এবং তিনি অবশ্যই অবতরণ করেন,যেভাবে অবতরণ করা তাঁর মর্যাদার উপযোগী হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, কে আছ আমাকে আহবানকারী, আমি তার আহবানে সাড়া দেব। কে আছ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব। কে আছ আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব’। এভাবে বলতে থাকেন যতক্ষণ না ফজরের আলো স্পষ্ট হয়’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১২২৩; মুসলিম হা/৭৫৮)। হাদীছটি মুতাশাবিহ। যার অর্থ স্পষ্ট। কিন্তু ধরণ অস্পষ্ট। অতএব আয়াতের প্রকাশ্য অর্থের উপর ঈমান রাখা আবশ্যক। অস্পষ্ট বিষয়ের পিছনে ছুটতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন (আলে ইমরান ৭, ইসরা ৩৬)।

আল্লাহর কুরসী আকাশ ও পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করে আছে (বাক্বারাহ ২৫৫)। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ১১)। তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সবকিছু প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে কোনরূপ পরিবর্তন, প্রকৃতি নির্ধারণ, শূন্যকরণ, তুলনাকরণ বা ন্যস্তকরণ ছাড়াই (আলোচনা দ্রঃ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ থিসিস, পৃঃ ১১৭)।

(২) আল্লাহর চেহারা আছে :

আল্লাহ বলেন, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَّيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার চেহারা ব্যতীত’ (আর-রহমান ২৬-২৭)

এখানে চেহারাকে আল্লাহর সত্তাগত গুণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর সে কারণেই ‘যুল জালালে’ বলা হয়েছে। নইলে ‘যিল জালালে’ বলা হ’ত। তিনি বলেন, كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلاَّ وَجْهَهُ، ‘সবকিছুই ধ্বংস হবে তাঁর চেহারা ব্যতীত’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৮)। তিনি আরো বলেন, وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ، ‘সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ২২, ২৩)

চেহারা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَعُوذُ بِاللهِ الْعَظِيمِ، وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ، ‘আমি বিতাড়িত শয়তান হ’তে আশ্রয় প্রার্থনা করছি মহান আল্লাহর নিকটে এবং তাঁর সম্মানিত চেহারার মাধ্যমে’ (আবুদাঊদ হা/৪৬৬; মিশকাত হা/৭৪৯)

ক্বিয়ামতের দিন মুমিনগণ আল্লাহকে তাঁর নিজস্ব চেহারায় দেখতে পাবেন (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৫৫)। কিন্তু অবিশ্বাসীগণ ও কপটবিশ্বাসীগণ তাঁর দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৫)।

(৩) আল্লাহর চোখ আছে :

আল্লাহ তাআলা বলেন, تَجْرِيْ بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَنْ كَانَ كُفِرَ ‘যা আমার চোখের সামনে চালিত, এটা পুরস্কার তার জন্য, যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল’ (ক্বামার ১৪)। (২) তিনি আরো বলেন, وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِيْ ‘যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্ব-হা ৩৯)। অন্যত্র আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা বলেন “দৃষ্টি শক্তি তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না বরং তিনিই দৃষ্টি শক্তিকে প্রত্যক্ষ করেন এবং তিনিই দৃষ্টি শক্তিকে প্রত্যক্ষ করেন এবং তিনি সুক্ষদরশি,সম্যকপরিজ্ঞাত ।”[আনআম, ১০৩]

নবী মূসা (আঃ)-কে লক্ষ্য করে আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, “আমি আমার নিকট থেকে তোমার উপর ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।” [ত্বহা,৩৯]

এমনিভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.-কে স্বান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, “আপনি আপনার রবের নির্দেশের অপেক্ষায় ধৈর্যধারন করুন আপনি আমার চোখের সামনেই রয়েছেন।” [আত-তূর, ৪৮]

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَيْسَ بِأَعْوَرَ، أَلاَ إِنَّ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ أَعْوَرُ الْعَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অন্ধ নন। সাবধান! নিশ্চয়ই দাজ্জালের ডান চোখ কানা। তার চোখটা যে একটি ফুলে যাওয়া আঙ্গুরের মতো’ (বুখারী, হা/৩৪৩৯ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়)। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃতই চোখ আছে এটা প্রমাণিত। তবে তা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা যাবে না।

(৪) আল্লাহর শ্রবণ শক্তি আছে :

আল্লাহ তাআলা বান্দারসহ সকল সৃষ্টি ভাষা বুঝেন এবং তার হুকুমেই নিয়ন্ত্রিত হয়। আল্লাহ্‌ বলেন,“নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ শ্রবণ করেন ও দেখেন ।”[মুজাদালাহ, ১] অন্যত্র আল্লাহ্‌ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ  ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন’ (শূরা ৪২/১১)

(৫) আল্লাহর পা আছে :

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার চেহারা, চোখ, হাত ও পা আছে। এসম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَيَسْتَطِيْعُوْنَ- ‘সেদিন পায়ের নলা উন্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে (কাফিরদেরকে) আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য কিন্তু তারা তা করতে পারবে না’ (কলম ৪২)

আল্লাহ তা‘আলার পা মোবারক সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَيَزَالُ يُلْقَى فِيْهَا وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَّزِيْدٍ حَتَّى يَضَعَ فِيْهَا رَبُّ الْعَالَمِيْنَ قَدَمَهُ فَيَنْزَوِىْ بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ ثُمَّ تَقُوْلُ قَدْ قَدْ بِعِزَّتِكَ وَكَرَمِكَ- ‘জাহান্নামে (জাহান্নামীদের) নিক্ষেপ করা হ’তে থাকবে আর সে (জাহান্নাম) বলবে, আরো আছে কি? শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক তাতে পা রাখবেন। তাতে জাহান্নামের একাংশের সাথে আরেকাংশ মিশে যাবে। অতঃপর জাহান্নাম বলবে, তোমার প্রতিপত্তি ও মর্যাদার শপথ! যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে’(বুখারী হা/৭৩৮৪ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَكْشِفُ رَبُّنَا عَنْ سَاقٍ فَيَسْجُدُ لَهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ وَّمُؤْمِنَةٍ فَيَبْقَى كُلُّ مَنْ كَانَ يَسْجُدُ فِى الدُّنْيَا رِيَاءً وَّسُمْعَةً فَيَذْهَبُ لِيَسْجُدَ فَيَعُوْدُ ظَهْرُهُ طَبَقًا وَّاحِدًا-

‘(ক্বিয়ামতের দিন) আমাদের প্রভু পায়ের নলা উন্মুক্ত করে দিবেন। অতঃপর সকল মুমিন পুরুষ ও নারী তাকে সিজদা করবে। কিন্তু বাকী থাকবে ঐসব লোক, যারা দুনিয়ায় সিজদা করত লোক দেখানো ও প্রচারের জন্য। তারা সিজদা করার জন্য যাবে, কিন্তু তাদের পৃষ্ঠদেশ একখন্ড তক্তার মত শক্ত হয়ে যাবে’ (বুখারী হা/৪৯১৯ ‘তাফসীর’ অধ্যায়)।

(৬) আল্লাহর হাত আছে :

 আল্লাহ তা‘আলার হাত আছে এসম্পর্কে তিনি বলেন, يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর’ (ফাতহ ১০)।  আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, تَبَارَكَ الَّذِيْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (মুলক ১)। তিনি আরো বলেন, بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘আপনারই হাতে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আলে ইমরান ২৬)

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইহুদীদের একটি বক্তব্য এভাবে তুলে ধরেছেন, وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ يَدُ اللهِ مَغْلُوْلَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيْهِمْ وَلُعِنُوْا بِمَا قَالُوْا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوْطَتَانِ- ‘আর ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত রুদ্ধ; তাদের হাতই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এ উক্তির দরুণ তাদের প্রতি অভিশাপ করা হয়েছে; বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় হাত প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৬৪)

(আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। ক্বিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আকাশ সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে’ (যুমার ৬৭)

এ আয়াতের তাফসীরে ছহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, ইহুদীদের একজন বড় আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, يَا مُحَمَّدُ إِنَّا نَجِدُ أَنَّ اللهَ يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْأَرَضِيْنَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلَائِقِ عَلَى إِصْبَعٍ فَيَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ، فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ تَصْدِيْقًا لِقَوْلِ الْحَبْرِ. ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) এটা লিখিত পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা সপ্ত আকাশ রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবংযমীনগুলো রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, বৃক্ষরাজিকে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবং পানি ও মাটি রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, আর সমস্ত মাখলূককে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর। অতঃপর তিনি বলবেন, আমিই সবকিছুর মালিক ও বাদশা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহুদী আলেমের কথার সত্যতায় হেসে ফেলেন, এমনকি তার মাড়ির দাঁত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন (বুখারী হা/৪৮১১, ‘তাফসীর’ অধ্যায়।)।

ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَقْبِضُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْأَرْضَ وَتَكُوْنُ السَّمَاوَاتُ بِيَمِيْنِهِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ. ‘আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবীকে তাঁর মুঠোতে ধারণ করবেন এবং সমস্ত আকাশকে স্বীয় ডান হাতে গুটিয়ে নিয়ে বলবেন, আমিই একমাত্র বাদশাহ’ (বুখারী হা/৭৪১২।)। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لَيِتُوْبَ مُسِئُ النَّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِئُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا- ‘আল্লাহ তা‘আলা পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) প্রতি রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যাতে করে দিনের গুনাহগার তওবা করে। আর তিনি দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যাতে করে রাতের গুনাহগার তওবা করে’(মুসলিম হা/২৭৫৯; ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫।)।

শাফা‘আত সংক্রান্ত হাদীছে আছে, হাশরবাসী আদম (আঃ)-এর কাছে এসে বলবে, يَا أَدَمُ أَنْتَ أَبُو الْبَشَرِ، خَلَقَكَ اللهُ بِيَدِهِ، ‘হে আদম! আপনি মানুষের পিতা। আল্লাহ আপনাকে তাঁর নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭২।)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا إِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ- ‘হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হ’তে তোমাকে কিসে বাধা দিল?’ (ছোয়াদ ৭৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَقُوْلُ اللهُ يَا آدَمُ فَيَقُوْلُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِيْ يَدَيْكَ قَالَ يَقُوْلُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ- ‘আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বলবেন, হে আদম! উত্তরে তিনি বলবেন, হাযির হে প্রতিপালক! আমি সৌভাগ্যবান এবং সমস্ত কল্যাণ আপনার হাতে। তিনি বলবেন, জাহান্নামীদেরকে বের করে দাও’(বুখারী, হা/৩৩৪৮ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।)।

(৭) আল্লাহর আঙ্গুল আছে :

আল্লাহ তাআলার আঙ্গুল সম্পর্কে  আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ قُلُوْبَ بَنِيْ آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ كَقَلْبٍ وَاحِدٍ يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ. ‘নিশ্চয়ই সকল আদম সন্তানের অন্তর সমূহ একটি অন্তরের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল সমূহের দু’টি আঙ্গুলের মাঝে অবস্থিত। তিনি যেমন ইচ্ছা তা পরিচালনা করেন’(মুসলিম হা/২৬৫৪ ‘ভাগ্য’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩।)।

আরো এসেছে,  আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,  مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِّنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلاَيَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِيْنِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيْهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّيْ أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُوْنَ مِثْلَ الْجَبَلِ-

‘যে তার হালাল রোযগার থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করবে (আল্লাহ তা কবুল করবেন) এবং আল্লাহ হালাল বস্ত্ত ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তার দানকারীর জন্য তা প্রতিপালন করতে থাকেন যেরূপ তোমাদের কেউ তার অশ্ব-শাবককে লালন-পালন করতে থাকে। অবশেষে একদিন তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়’(বুখারী, হা/১৪১০ ‘যাকাত’ অধ্যায়।)।

অন্যত্র এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, ইহুদীদের একজন বড় আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, يَا مُحَمَّدُ إِنَّا نَجِدُ أَنَّ اللهَ يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْأَرَضِيْنَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلَائِقِ عَلَى إِصْبَعٍ فَيَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ، فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ تَصْدِيْقًا لِقَوْلِ الْحَبْرِ. ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) এটা লিখিত পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা সপ্ত আকাশ রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবং যমীনগুলো রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, বৃক্ষরাজিকে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবং পানি ও মাটি রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, আর সমস্ত মাখলূককে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর। অতঃপর তিনি বলবেন, আমিই সবকিছুর মালিক ও বাদশা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহুদী আলেমের কথার সত্যতায় হেসে ফেলেন, এমনকি তার মাড়ির দাঁত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন (বুখারী হা/৪৮১১, ‘তাফসীর’ অধ্যায়।)।

(৮) আল্লাহর হাসি ও আনন্দ :

আল্লাহ তা‘আলার আনন্দ প্রকাশ ও হাসি সম্পর্কিত বর্ণনা হাদীছে এসেছে। আল্লাহর আনন্দ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحاً بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِيْنَ يَتُوْبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتهِ بِأَرْضٍ فَلاَةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِيْ ظِلِّهَا وَقَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ : اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِيْ وَأَنَا رَبُّكَ! أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ-

‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবার কারণে ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক আনন্দিত হন, যে মরুভূমিতে রয়েছে, তার বাহনের উপরে তার খাদ্য-পানীয় রয়েছে, এসবসহ তার বাহনটি পালিয়ে গেল। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় এসে শুয়ে পড়ল। এভাবে সময় কাটতে লাগল। এমন সময় সে তার পাশেই তাকে দন্ডায়মান দেখে তার লাগাম ধরে ফেলল। অতঃপর অত্যধিক আনন্দে বলে ফেলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব। সে আনন্দের আতিশয্যে ভুল করে ফেলে’ (মুসলিম, হা/২৭৪৭ ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১)।

আল্লাহ তা‘আলার হাসি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَضْحَكُ اللهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى إِلَى رَجُلَيْنِ يَقْتُلُ أَحَدُهُمَا الْآخَرَ يَدْخُلاَنِ الْجَنَّةَ، يُقَاتِلُ هَذَا فِيْ سَبيْلِ اللهِ فَيُقْتَلُ، ثُمَّ يَتُوْبُ اللهُ عَلَى القَاتِلِ فَيُسْتَشْهَدُ- ‘আল্লাহ তা‘আলা দু’ব্যক্তির কর্ম দেখে হাসেন। এদের একজন অপর জনকে হত্যা করে। অবশেষে তারা উভয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। একজন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে নিহত হয়। অতঃপর হত্যাকারী আল্লাহর নিকট তওবা করে। এরপর সে শাহাদতবরণ করে’ (বুখারী, হা/২৮২৬ ‘জিহাদ ও সিয়ার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৮)।

(দুই) রাসূলুল্লাহ (ছা.) সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা :

পৃথিবীতে নানা মতের ভিন্ন ভিন্ন আক্বীদার মানুষ রয়েছে।যারা তাদের আক্বীদা বিশ্বাসের কারণে দ্বীন থেকে ভ্রষ্টাতার দিকে হারিয়ে গেছে। মুর্জিয়া, মুতাজিলা, শিয়া, রাফেজিয়া ইত্যাদি নানা উপদলে বিভক্ত হয়েগেছে। এমন বিভক্তির মধ্য থেকেই কেহ কেহ মনে করেন রাসূল (সা.)সৃষ্টিকুলের প্রথম সৃষ্টি এবং সদা হাজির নাজির। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ

(১) রাসূল (ছাঃ) প্রথম সৃষ্টি নয় এবং হাযির-নাযিরও নয় :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন ‘কলম’। অতঃপর তাকে বলেন, লিখ। সে বলল, কি লিখব? আল্লাহ বললেন, তাক্বদীর লিখ। অতঃপর সে লিখল, যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটবে ভবিষ্যতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত (আবুদাউদ হা/৪৭০০; তিরমিযী হা/২১৫৫; ছহীহাহ হা/১৩৩)। আলবানী বলেন, أَولُ مَا خلقَ اللهُ نُوْرِ نَبِيِّكَ يَا جابرُ ‘আল্লাহ প্রথম তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেন হে জাবের!’ মর্মে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীছটির কোন সনদ আমি জানতে পারিনি (তাহকীক মিশকাত হা/৯৪-এর টীকা ১; ১/৩৪ পৃঃ)। আর لَولاَكَ لماَ خَلقتُ الأَفْلاَك ‘তুমি না হলে আমি আসমান-যমীন কিছুই সৃষ্টি করতাম না’ মর্মে বর্ণিত হাদীছটি মওযূ বা জাল (সিলসিলা যঈফাহ হা/২৮০, ২৮২)।

রাসূল (ছাঃ) মানুষ ছিলেন (কাহফ ১৮/১১০) এবং তিনি সহ পূর্বেকার সকল নবী মৃত্যুবরণ করেছেন (যুমার ৩৯/৩০)। জীবিত বা মৃত কোন মানুষ কখনো হাযির-নাযির হতে পারে না। এটি সম্পূর্ণরূপে শিরকী আক্বীদা। আর আল্লাহ আরশে সমুন্নীত। অতএব তাঁর সত্তা সর্বত্র হাযির-নাযির নয়। বরং তাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজমান। যেমন তিনি মূসা ও হারূণকে বলেন, ‘আমি তোমাদের সাথে আছি। শুনছি এবং দেখছি (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)। অতএব প্রথম সৃষ্টি হ’ল কলম। যা দিয়ে তাক্বদীর লেখা হয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) সর্বত্র হাযির-নাযির নন।

(২) রাসূল (ছাঃ) মাটির তৈরী :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন; নূরের তৈরী ননআল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) তুমি বলে দাও, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মত একজন মানুষ মাত্র। (পার্থক্য হল) আমার নিকট অহিকরা হয় …’ (কাহ্ফ ১৮/১১০)এটা কেবল আমাদের নবীই নন, বরং বিগত সকল নবীই স্ব স্ব কওমের উদ্দেশ্যে একথা বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের মত মানুষ মাত্র’ (ইবরাহীম ১৪/১১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। আমিও তোমাদের মত ভুলে যাই। সুতরাং আমি (ছালাতে কিছু) ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ো’ (বুখারী হা/৪০১; মুসলিম হা/৫৭২; মিশকাত হা/১০১৬ ‘সিজদায়ে সহো’ অনুচ্ছেদ)। তিনি বলেন, আমি একজন মানুষ। আমি তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কোন কিছু আদেশ করলে তা গ্রহণ করবে। আর নিজস্ব রায় থেকে কিছু বললে আমি একজন মানুষ মাত্র। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে আমার ভুলও হ’তে পারে (মুসলিম হা/২৩৬৫, মিশকাত হা/১৪৭)।

প্রকৃতপক্ষে, ফেরেশতারা হ’ল নূরের তৈরী, জিনেরা আগুনের তৈরী এবং মানুষ হ’ল মাটির তৈরী মুসলিম হা/২৯৯৬; মিশকাত হা/৫৭০১; মুমিনূন ২৩/১২, আন‘আম ৬/২)।

উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) নূরের তৈরী ছিলেন মর্মে সমাজে কিছু হাদীছ প্রচলিত রয়েছে। যেমন ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেন’। এ মর্মে বর্ণিত সব বর্ণনাই জাল (‘আজলূনী, কাশফুল খাফা হা/৮২৭; ছহীহাহ হা/৪৫৮-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

সূরা মায়েদাহ ১৫ আয়াতে বলা হয়েছে, قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللهِ نُوْرٌ وَكِتَابٌ مُبِيْنٌ ‘তোমাদের কাছে এসেছে একটি জ্যোতি এবং একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ’। উক্ত আয়াতে ‘নূর’ বা জ্যোতি দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কুরআন শিরকের অন্ধকার হ’তে মানুষকে তাওহীদের আলোর পথে বের করে আনে। এখানে ‘ওয়া কিতাবুম মুবীন’ (وَكتابٌ مبيْنٌ)তার পূর্ববর্তী ‘নূর’ (نُوْرٌ)-এর উপর عطف بيان হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে একটি জ্যোতি ও সমুজ্জ্বল গ্রন্থ’। যেমন ইতিপূর্বে সূরা নিসা ১৭৪-৭৫ আয়াতে بُرْهَانٌ ও نُوْرًا مُبِيْنًا বলে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। অমনিভাবে সূরা আ‘রাফ ১৫৭ আয়াতের কুরআনকে ‘নূর’ বলা হয়েছে।

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ‘নূর’-এর ব্যাখ্যায় যাজ্জাজ বলেন, এখানে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে (কুরতূবী)। যদি সেটাই ধরে নেওয়া হয়, তাহ’লেও এর অর্থ এই নয় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) নূরের তৈরী ছিলেন। কারণ কুরআনেই বলা হয়েছে যে, তিনি তোমাদের মত মানুষ ছিলেন’(কাহফ ১৮/১১০)। আর মানুষ বলেই তো তিনি পিতা-মাতার সন্তান ছিলেন এবং সন্তানের পিতা ছিলেন। তিনি খানা-পিনা ও বাজার-ঘাট করতেন। অতএব রাসূল (ছাঃ) যে মাটির তৈরী মানুষ ছিলেন, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

(তিন) অন্যান্য অন্যতম আক্বীদা :

(১) সালাফীগণ ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী : 

আল্লাহ পাক এরশাদ করেন যে, ‘মুমিন কেবল তারাই যাদের নিকটে
আল্লাহর কথা বলা হ’লে ভয়ে তাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে এবং যখন তাদের নিকটে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তাদের প্রভুর উপরে তারা একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়’ (আনফাল ৮/২-৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। যার মধ্যে সর্বোত্তম (فأفضلها) হ’ল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সর্বনিম্ন (أدناها) হ’ল রাস্তা হ’তে কষ্ট (বাধা) দূর করা’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর (أعلاها) হ’ল…..(বুখারী, মুসলিম)। ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, ‘পৃথিবীর সকল মুমিনের ঈমান আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানের সাথে ওযন করা হ’লে আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানের ওযন বেশী হবে’ (ইবনু আহমাদ, কিতাবুস সুন্নাহ)।

(২) কবীরা গোণাহগার মুমিন থাকে, ঈমান হতে খারিজ নয় :

খারেজী ও মু‘তাযিলীগণ আমলকে ঈমানের অংশ মনে করলেও তারা ঈমানের
হ্রাস-বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী নন। খারেজীদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি ‘কাফির’ এবং মু‘তাযিলীদের নিকটে সে ‘মুমিনও নয় কাফিরও নয় বরং দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে’ (منزلة بين المنزلتين) । মুরজিয়াদের নিকটে আমল ঈমানের অংশ নয় এবং ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের মতে আবুবকরের ঈমান ও অন্যদের ঈমান সমান। এরা ‘শৈথিল্যবাদী’ হিসাবে অভিহিত।

সালাফী আক্বীদা মতে কবীরা গোনাহগার মুমিন ঈমান হ’তে খারিজ নয়। সে তওবা না করে মারা গেলেও স্থায়ীভাবে জাহান্নামী নয়। আল্লাহ পাক শিরক ব্যতীত বান্দার যে কোন গোনাহ মাফ করে থাকেন। গোনাহের কারণে তাকে ‘গোনাহগার’ (عاصي) , ‘দোষযুক্ত’ (ناقص) , ‘ফাসিক্ব’ (فاسق)ইত্যাদি বলা যাবে। কিন্তু ‘খাঁটি মুমিন’ (مؤمن حق) কিংবা ‘কাফির’ (كافر) বলা যাবে না। 

একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি মৃতের ন্যায় হ’লেও তাকে যেমন প্রাণহীন মৃত বলা যায় না, তেমনি গোনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে ঈমানের দীপ্তি সাময়িকভাবে স্তিমিত হ’য়ে গেলেও কোন মুমিনকে ঈমান শূন্য কাফির বলা যায় না। তাছাড়া ক্বিয়ামতের দিন শেষ নবীর শাফা‘আত তো মূলতঃ কবীরা গোনাহগার মুমিনদের জন্যই হবে। কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি খারেজীদের নিকটে কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। মু‘তাযিলাদের নিকটে ফাসিক এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তবে কাফিরদের তুলনায় তাদের আযাব  কিছুটা হালকা হবে এহেন ধারনা পোষণ করে। 

(৩) আল্লাহ বান্দার সকল ভাল-মন্দ কর্মের স্রষ্টা :

এ বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমরা যা কর সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৬)। বান্দা হ’ল আল্লাহ সৃষ্ট কর্মশক্তি প্রয়োগে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা রাস্তা বাৎলে দিয়েছি। এক্ষণে তোমরা তা অনুসরণ করে কৃতজ্ঞ হও অথবা অকৃতজ্ঞ হও’ (দাহর ৭৬/৩)। এই কর্মশক্তির ভাল-মন্দ প্রয়োগের উপরে নির্ভর করছে বান্দার
পুরস্কার লাভ অথবা শাস্তি ভোগ। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘স্ব স্ব আমলের বাইরে আজকের দিন কাউকে কোন বদলা দেওয়া হবে না বা সামান্যতম যুলুম করা হবে না’ (ইয়াসীন ৩৬/৫৪)। মোটকথা আল্লাহ হ’লেন কর্মের স্রষ্টা (خالق الأفعال) এবং বান্দা হ’ল কর্মের বাস্তবায়নকারী (فاعل الأفعال)। কিন্তু অদৃষ্টবাদী জাবরিয়াগণ বান্দাকে ‘ইচ্ছা ও কর্মশক্তিহীন বাধ্যগত জীব’ (مجبور فى أفعاله لا قدرة له ولا إرداة ولااختيار) বলে মনে করেন।

(৪) গায়েবে বিশ্বাস : 

যার প্রকৃত অবস্থা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। মি‘রাজের সময়ে আল্লাহর নবী (ছাঃ) স্বচক্ষে এগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন। কবরবাসীগণ জান্নাতের সুগন্ধি বা জাহান্নামের উত্তাপ কবরেই প্রাপ্ত হবে। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় তাদেরকে স্ব স্ব ঠিকানা দেখানো হবে। ক্বিয়ামতের দিন সকল মাখলূক্বাত ধ্বংস হবে। কিন্তু জান্নাত, জাহান্নাম ও তার ভিতরকার বস্ত্তসমূহ অক্ষত থাকবে। এছাড়াও ঐসব গায়েবী ব্যাপারে দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করেন, যে সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে খবর দিয়েছেন। যেমন মি‘রাজের ঘটনাবলী, কবরের সওয়াল-জওয়াব, আযাব ও শান্তি, ক্বিয়ামতপূর্ব কালে ইমাম  মাহ্দী-র আগমন ও সমগ্র পৃথিবীতে সাত বছর যাবত ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের সঙ্গে নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চাবুকের অগ্রভাগ, জুতার ফিতা এবং জীবজন্তুর কথোপকথন প্রভৃতি ছাড়াও ক্বিয়ামত প্রাক্কালের দশটি নিদর্শন, যেমন (১) পশ্চিম দিকে হ’তে সূর্যের উদয় (২) ‘দাববাতুল আরয’–এর আগমন (৩) দাজ্জালের আবির্ভাব (৪) ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ (৫) ইয়াজূজ-মাজূজ-এর আগমন (৬) প্রাচ্যে (৭) পাশ্চাত্যে ও (৮) আরব উপদ্বীপে মাটিতে ধ্বস নামা (৯) ধোঁয়া উদগীরণ ও সবশেষে (১০) ইয়ামন অথবা অন্য বর্ণনা মতে এডেন-এর গর্তসমূহ (قعر عدن) হ’তে প্রচন্ডবেগে অগ্নি নির্গত হওয়া, যা লোকদেরকে হাশরের ময়দানের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে। অন্য বর্ণনা মতে ‘প্রচন্ড ঝড়’ যা লোকদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। অতঃপর সিংগায় ফুঁক দান, ক্বিয়ামত অনুষ্ঠান, মৃতদের পুনর্জীবন লাভ, হাশরের ময়দানে জমায়েত হওয়া, বিচারের সম্মুখীন হওয়া, দাঁড়িপাল্লায় আমলের ওযন হওয়া, শাফায়াত, হাউয কাওছার, পুলছিরাত সবকিছুকেই নির্দ্বিধায় সত্য বলে বিশ্বাস করা।

এছাড়াও সালাফীগণ কোন মৃত ব্যক্তিকে কোনরূপ মঙ্গলামঙ্গলের অধিকারী মনে করেন না। এমনকি কোন জীবিত ব্যক্তিও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত অপরের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। কবরে সিজদা করা, সেখানে মানত করা, ফুল দেওয়া, বাতি দেওয়া, গেলাফ চড়ানো, গোসল করানো, নযর-নেয়ায পাঠানো, মোরগ বা খাসি যবেহ করে ‘হাজত’ দেওয়া, কবরবাসীর অসীলায় মুক্তি কামনা করা, তার নিকটে ফরিয়াদ পেশ করা ইত্যাদিকে তারা প্রকাশ্য শিরক মনে করেন। এমনিভাবে একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মীলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হওয়ার অলীক ধারণা ও তাঁর সম্মানে সকলে দাঁড়িয়ে (ক্বিয়াম করে) সালাম জানানোকে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণ কল্পনার মতই ঘৃণ্যতম পাপ বলে মনে করেন। তাঁর নামে ‘জশনে জুলূস’ ও র‌্যালী করাকে স্রেফ ‘রিয়া’ ও ভক্তির নামে ভান করা বলে মনে করেন। যা নিকৃষ্টতম বিদ‘আত সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে কোন মৃত মানুষের সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, নিজেদের বানানো স্মৃতিসৌধে বা কথিত শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, বিভিন্ন মানুষের তৈলচিত্র, ছবি-মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নির্মাণ ও সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন ইত্যাদি সবকিছু জাহেলী যুগের ফেলে আসা অগ্নিপূজা ও মূর্তিপূজার আধুনিক রূপ বলে মনে করেন।

পরিশেষে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকটে পানাহ চাই দ্বীনের নামে ভ্রষ্টতা, অকল্যাণ ও মূর্খতা থেকে এবং আমাদের সঠিক আক্বীদা বিশ্বাসের উপর অবিচল রাখুন ও দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top