নিয়ত হ’ল আরবী শব্দ। যার বাংলা অর্থ- ইচ্ছা করা, মনস্ত করা, এরাদা করা, সংকল্প করা। [মুনজিদ, ৮৪৯/ফতহুল বারী, ১/১৭]
ইবনুল কাইয়ুম (রহিঃ) বলেনঃ “নিয়ত হচ্ছে, কোন কিছু করার ইচ্ছা পোষণ ও সংকল্প করা। নিয়ত নির্ধারণের স্থান হচ্ছে অন্তরে, মুখে উচ্চারণের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণে না তো রাসূল (ছাঃ) হতে আর না কোন ছাহাবী হতে নিয়তের শব্দ বর্ণিত হয়েছে”। [ইগাসাতুল্ লাহ্ফান, ১/২১৪]
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, «إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوٰى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهٗ إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِه فَهِجْرَتُهٗ إِلَى اللهِ وَرَسُولِه وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهٗ اِلٰى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهٗ إِلٰى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ». ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পায়’। মানুষ তার নিয়্ত অনুযায়ী ফল পাবে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থপ্রাপ্তির জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহের জন্য হিজরত করবে সে হিজরত তার নিয়্যাত অনুসারেই হবে যে নিয়্ত সে হিজরত করেছে’। [বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১]
ইয়াহইয়া ইবনু আবু কাছীর বলেছেন, তোমরা কিভাবে নিয়ত করতে হয় তা শেখ। কেননা তা আমলের থেকেও বেশী গুরুত্ব বহন করে।[হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৭০; জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩]
নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا يُبْعَثُ النَّاسُ عَلَى نِيَّاتِهِمْ ‘মানুষ কেবলই তাদের নিয়ত অনুসারে উত্থিত হবে’।[ইবনু মাজাহ হা/৪২২৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩]
যুবাইদ আল-ইয়ামী (রহঃ) বলেছেন, প্রতিটি কথায় ও কাজে আমার আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত থাকা আমি খুব পসন্দ করি, এমনকি খাদ্য-পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রেও।[আল-ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাত, পৃঃ ৬২]
রিয়া প্রদর্শন করা শিরকে আছগার বা ছোট শিরক বলা হয়। আর আল্লাহ বিচার দিবসে এমন ব্যক্তিদেরকে তাড়িয়ে দিবেন। মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً. ‘আমি তোমাদের জন্য যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হ’ল শিরকে আছগর (ছোট শিরক)। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেসা করলেন ‘হে আল্লাহ্র রাসূল ছোট শিরক কি?’ তিনি জওয়াবে বললেন ‘রিয়া’ লোক দেখানো বা জাহির করা। কারণ নিশ্চয়ই শেষ বিচারের দিনে মানুষ তার পুরস্কার গ্রহণের সময় আল্লাহ বলবেন, ‘বস্তুজগতে যাদের কাছে তুমি নিজেকে জাহির করেছিলে তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের নিকট হ’তে কোন পুরস্কার পাও কি না’। [আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫৩৩৪]
আর এই রিয়া প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শিরকও বলা হয়। এই শিরক দাজ্জালের ফেৎনার চেয়েও ভয়াবহ। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা দিলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ؟ قَالَ قُلْنَا بَلَى، فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর একটি বিষয় সম্পর্কে বলব না? আমরা বললাম, জি বলুন। তিনি উত্তর দিলেন, সেটা হ’ল গুপ্ত শিরক। (অর্থাৎ) যখন কেউ ছালাত আদায় করতে উঠে ছালাত সুন্দর করার জন্য চেষ্টা করে এই ভেবে যে লোকেরা তার প্রতি চেয়ে আছে, সেটাই গুপ্ত শিরক’। [ইবনে মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩] ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই বাস্তবতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘চন্দ্রবিহীন রাত্রে একটা কালো পাথর বেয়ে উঠা একটা কালো পিঁপড়ার চেয়েও গোপন হ’ল শিরক’। [ছহীহুল জামি‘ হা/৩৭৩০]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللَّهُ بِهِ . ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমাল করে আল্লাহ তা’আলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকেদেরকে জানিয়ে ও শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কোন নেক কাজ করে, আল্লাহ তা’আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকেদের মাঝে ফাঁস করে দিবেন। [বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬; আহমাদ হা/২০৪৭০]
ইবনু রজব হাম্বালী (৭৩৬-৭৯৫হি.) (রহিঃ) বলেন, وَرَائِحَةُ الْرِيَاءِ كَدُخَانِ الْحِطَبِ، يَعِلُوْ إِلَى الْجَو ثُمَّ يَضْمِحَل وَتَبْقِى رَائحته الكَرِيْهَة ‘রিয়া বা লৌকিকতার ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল কয়লার ধুঁয়োর ন্যায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার দূর্গন্ধ কেবল অবশিষ্ট থাকে’। [মাজমূঊর রাসায়িল, পৃষ্ঠা-৭৫৮]
রিয়া প্রদর্শনকারী ব্যক্তি সকল জাহান্নামী হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা লোক দেখানে কোন ইবাদত কবূল করেন না। যেমন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম ব্যক্তি কিয়ামতের দিন যার ওপর ফয়সালা করা হবে, সে ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে, অতঃপর তাকে আল্লাহ্র নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ. আপনার জন্য জিহাদ করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لأَنْ يُقَالَ جَرِىءٌ. فَقَدْ قِيلَ. ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি এ জন্য জিহাদ করেছ যেন তোমাকে বীর বলা হয়, অতএব তা বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আবারও আলিম ব্যক্তিকে আনা হবে, যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছে। অতঃপর তাকে তার নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ. আমি ইলম শিখেছি ও শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ. وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ. فَقَدْ قِيلَ. ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি ইলম শিক্ষা করেছ যেন তোমাকে আলিম বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন তোমাকে ক্বারী বলা হয়। অতএব তা-ই বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
পুনরায় আরও এক ব্যক্তিকে আনা হবে, যাকে আল্লাহ সচ্ছলতান সাথে সকল প্রকার ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার নি‘আমতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا ‘তুমি এতে কী আমল করেছ?’ সে বলবে, مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا আপনি পছন্দ করেন এমন কোন খাত নেই, যেখানে আমি আপনার জন্য দান করিনি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ. فَقَدْ قِيلَ ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি দান করেছ যেন তোমাকে দানশীল বলা হয়। অতএব বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’। [মুসলিম হা/১৯০৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৫১৮; ছহীহুল জামি হা/২০১৪]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রিয়ামুক্তেএবং নিয়াত পরিশুদ্ধ করে মুখলেছ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন, আমীন।