বন্দুকের নলের সামনে হুকুমাত কায়েম করা সম্ভব হলেও অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করানো সম্ভব নয়

মূল গল্পটি পড়ুন—
হিংস্রতা নয়, চাই ভালোবাসা
মুরাদুল ইসলাম, ফিলিপাইন থেকে | আপডেট: ১৯:৫১, জুলাই ২১, ২০১৬

মসজিদের পাশে লেখকচাকরিসূত্রে ফিলিপাইনে আসার পর ২০০৮ সালে দেশটির
দক্ষিণের এক দ্বীপে গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। সেটাই ছিল আমাদের অফিসের কোনো
প্রকল্প এলাকায় আমার প্রথম পরিদর্শনে যাওয়া। এর কয়েক দিন পর ছিল কোরবানির
ঈদ। সেখানে যাওয়ার আগে শুনেছিলাম ওখানে বেশ কিছু মুসলমান আছেন। তাই মনে
মনে ভেবেছিলাম ঈদের নামাজের সমস্যা হবে না। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টো। গিয়ে
শুনি আমার অফিসের ধারে কাছে কোনো মসজিদ নেই। ওই এলাকায় খ্রিষ্টান
সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিভিন্নজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম অফিস থেকে অনেক
দূরে একটি মসজিদ আছে। গাড়িতে প্রায় দুই ঘণ্টার দূরত্ব।

ঈদের দিন খুব
ভোরে গাড়ির চালককে নিয়ে বের হলাম। ঠিকানা বলতে শুধু ওই এলাকার নাম।
নির্দিষ্ট করে গ্রামের নাম কেউ আমাকে বলতে পারেনি। তাই অনেক জায়গায় থেমে,
অনেকের কাছে জিজ্ঞাসা করে হাজির হলাম সেই মসজিদে। সাগরের তীর ঘেঁষে ছোট্ট
একটি মসজিদ। দেখে মনে হলো নতুন নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েকজন মাত্র মুসল্লি
নামাজের জন্য এসেছেন। মসজিদের অর্ধেক অংশ দোতলা করে সামনে রেলিং দিয়ে পাতলা
পর্দায় ঘেরা। সেখানে নারীরা নামাজ আদায় পড়েন।
নামাজ শেষ হলো।
নারী-পুরুষ মিলে ১০-১২ জন হবে। অনেকের দৃষ্টি আমার দিকে। তারা কেউ আমার
পূর্ব পরিচিত নন। দু-একজন কথা বলতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে এলেন ইমাম সাহেব।
খুব সাধারণ একজন মানুষ। পোশাকআশাকে আর পাঁচটা ইমামের মতো নন। আলাপ, পরিচয় ও
কোলাকুলি শেষে ইমাম সাহেব জানালেন, তিনি একটি ছাগল কোরবানি দেবেন এবং
দুপুরে তাঁর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে চান। আমি একটু আমতা-আমতা করেও
এড়াতে পারলাম না। রাজি হলাম।
কিন্তু ভাবতে লাগলাম দুপুরের আগ পর্যন্ত
কীভাবে সময় কাটানো যায়। চালক সমাধান বের করলেন। পাশের শহরে আমাদের অফিসের
একটি শাখা আছে। সেখানে আমার যাওয়া হয়নি। তাই সেখানেই গেলাম। ঠিক দুপুরের
দিকে ফিরে এলাম ইমাম সাহেবের বাড়িতে। মসজিদের পাশেই ছোটখাট ও কিছুটা দৈন্যর
স্পর্শে ঘেরা এক বাড়িতে তাঁর বসবাস। বাড়ির পাশেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে তখন
তিনি ছাগলের মাংস কাটায় ব্যস্ত। আমাকে দেখে বেশ খুশি হলেন। বাড়ির ভেতরে
তাঁর স্ত্রী রান্না শুরু করেছেন।
ইমাম (সর্ব ডানে ) মাংস কাটছেনইমাম
সাহেব মাংস কাটা শেষ করে আমার সঙ্গে বসে বাংলাদেশের মুসলমানদের বিভিন্ন
খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। লক্ষ্য করলাম একটু
আগে মসজিদে পরিচয় হওয়া মানুষজন ছাড়াও আরও অনেক নতুন মুখ। ইমাম সাহেব
তাঁদের সঙ্গে আমাকে ভেতর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। খাবার প্রস্তুত। তিনি আমার
চালকের খোঁজ করলেন। বললাম সে তো খ্রিষ্টান। তাই এখানে ডাকিনি। যদি আপনারা
কিছু মনে করেন। ইমাম সাহেব আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, খ্রিষ্টান হয়েছে তো
কি হয়েছে, এখানে যে অতিথিদের দেখছেন তাদের অনেকেই খ্রিষ্টান। তিনি নিজেই
গিয়ে চালককে ডেকে আনলেন।
খাবার শেষে অতিথিদের বিদায় দিয়ে বাড়ির বাইরে
এক গাছের নিচে এসে আমার সঙ্গে বসলেন। তাঁর ব্যক্তিগত অনেক কথা বললেন।
বললেন, প্রায় এক যুগ আগে তিনি এই এলাকায় এসেছিলেন পৌরসভার ছোট এক চাকরি
নিয়ে। তখন এখানে কোনো মুসলমান ছিল না। প্রায় বছর খানিক পরে তিনি এক
খ্রিষ্টান মেয়েকে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে
সেখানে বাস করার মনস্থির করেন। আশপাশ এলাকায় কোনো মসজিদ ছিল না। বাড়িতেই
স্বামী-স্ত্রী মিলে নামাজ পড়তেন। এর মধ্যে তার মাধ্যমে আরও কয়েকজন মুসলমান
হন। সাগরের কোল ঘেঁষে তারা ছোট্ট একটি মসজিদ বানালেন। কিন্তু পাকা করার
সামর্থ্য ছিল না। সারা দিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরে প্রতিবেশীদের খোঁজ খবর
নিতেন। যে কারও বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন সাধ্যমতো। তাঁর এই
ভালোবাসায় মুগ্ধ হলেন অনেকে। মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে
প্রায় ছয়-সাতটি পরিবার মুসলমান হয়েছে। কাউকে জোর করতে হয়নি। জোর করার মতো
ক্ষমতাও ছিল না। ইমাম সাহেব ছিলেন একা মানুষ। শুধু তাঁর ভালোবাসায় মানুষ
তাঁর বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে। এখন একটি পাকা মসজিদ হয়েছে।
সেখানে সবাই মিলে নামাজ পড়েন।
আজ যখন ধর্মের নামে হামলার কথা শুনি তখন
মনে পড়ে ইমাম সাহেবের কথা। বন্দুকের নলের সামনে কাউকে কলেমা পড়ানো সম্ভব,
কিন্তু তাঁর অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন সম্ভব নয়।
http://www.prothom-alo.com/…/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top