যথা সময়ে বিবাহের গুরুত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ ও পরিবার সম্পূর্ণ একটি চুক্তিনামা জীবন ও দায়িত্ববোধ। বিয়ের উপযুক্ত সকল নারীকে বিবাহের জন্য শরীয়াহ্ মোতাবেক উপস্থাপিত করা এবং সকল পুরুষের তা সাদরে গ্রহণ করা এই ‘ঈজাব’ ও ‘কবুল’ কর্তৃক বিবাহ সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের সঙ্গে মিলে-মিশে দাম্পত্য জীবন যাপন করার সুযোগ লাভ করে। তাছাড়া বিবাহিত জীবন যাপনে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যও রয়েছে। পৃথিবীর যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোন উদ্দেশ্য ছাড়া সম্পাদিত হয়নি বা হয়ও না। কুরআন, হাদীছ ও বিজ্ঞানের আলোকে বিবাহের উদ্দেশ্য বহুবিধ। তন্মধ্যে, দ্বীনের আদেশ পালন, স্বীয় নৈতিক চরিত্র কলুষমুক্ত পবিত্র রাখতে পারা, জৈবিক চাহিদা পূরণ, মনের গভীর প্রশান্তি ও স্থিতি লাভ এবং ভবিষ্যত বংশধর বৃদ্ধির লক্ষ্যে সন্তানের জন্মদান ও লালন-পালন এবং সমাজে সুস্থ মস্তিষ্ক দ্বীনী মানব গড়ে তোলা।

দ্বীন ইসলামে কিছু নারীকে বিবাহ করা হারাম করা হয়েছে, কিন্তু যাদের হালাল করা হয়েছে তাদেরকে উপযুক্ত মোহরানা বা অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে গ্রহণ করার অনুমতি রয়েছে। তাছাড়া হালাল নারীদের মোহরানা আদায় ব্যতিরিকে সম্পর্ক স্থাপন করা অবৈধ যৌনাচারের শামিল। এ সম্পর্র্কে মহান আল্লাহ বলেন, “আর নারীদের মধ্যে তাদের ছাড়া সকল সধবা স্ত্রীলোক তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ; তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়ে যায় এটা তোমাদের জন্য আল্লাহর হুকুম। এদের ছাড়া তোমাদের জন্য সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য ব্যভিচারের জন্যে নয়” (নিসা-৪/২৪)।

যাদের বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত হতে চলেছে তাদের বিয়ে করানো ফরয। যদি সামর্থ্য না থাকে তবে ততক্ষণ পযর্ন্ত সংযমী হতে হবে যতক্ষণ পযর্ন্ত না মহান আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে স্বচ্ছল, দারিদ্রমুক্ত করে দেন। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন, (وَ اَنۡکِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡکُمۡ وَ الصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِکُمۡ وَ اِمَآئِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِهِمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ) তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করেনি, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে স্বচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। আর যাদের বিবাহে সামর্থ্য নেই, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পযর্ন্ত না আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন (নূর ২৪/৩২-৩৩)। আবার যারা অভাবের কারণে বিবাহ করে না তাদের সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ বলেন, তোমরা যদি ধনী হতে চাও, তবে বিবাহ কর। কেননা, মহান আল্লাহ্ বলেন, তবে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন (নূর ২৪/৩২) (তাফসীর মা’রেফুল কুরআন-পৃঃ-৯৩১)।

শুধু দারিদ্র্য ও অর্থের অভাব বিবাহে বাধার কারণ হওয়া উচিত নয়। হতে পারে বিবাহের পর আল্লাহ তাআলা নিজ কৃপায় তার দরিদ্রতাকে ধনবত্তায় পরিবর্তন করে দেবেন। তাছাড়া কোন ব্যক্তি নিজের চারিত্রিক নিষ্কলুষতা বজায় রাখার জন্য বিবাহ করার নিয়ত করলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ ) বলেন, ثَلَاثَةٌ حَقٌّ عَلَى اللَّهِ عَوْنُهُمْ: الْمُكَاتَبُ الَّذِي يُرِيدُ الْأَدَاءَ وَالنَّاكِحُ الَّذِي يُرِيدُ الْعَفَافَ وَالْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ . ‘আল্লাহ তা‘আলা তিন প্রকারের মানুষকে সাহায্য করা নিজের কর্তব্য হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। (১) চুক্তিবদ্ধ গোলাম, যে চুক্তির অর্থ পরিশোধের ইচ্ছা করে; (২) বিবাহে আগ্রহী লোক, যে বিয়ের মাধ্যমে পবিত্র জীবন যাপন করতে চায় এবং (৩) আল্লাহর পথে জিহাদকারী’। (নাসাঈ হা/৩১৬৬; তিরমিযী হা/১৬৫৫; মিশকাত হা/৩০৮৯, সনদ হাসান)।

‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, উল্লেখিত বিষয়গুলোতে সাহায্যের ঘোষণার কারণ হলো, উল্লেখিত কাজগুলো খুব কঠিন, যা মানুষকে জটিলতায় ফেলে দেয়, যদি আল্লাহ তা‘আলা এ কাজগুলোর জন্য সাহায্যের ঘোষণা না দিতেন তবে মানুষ এ কাজগুলোর জন্য দাঁড়াত না। আর এগুলোর মধ্যে সব চাইতে কঠিন হলো, যিনা থেকে দূরে থাকা। কেননা এটা বহুগামিতা থেকে মানুষকে স্থিতিশীল চারিত্রিক চাহিদায় প্রবেশ করায়। অর্থাৎ- মানুষকে একাধিক নারীর কাছে গমন করা থেকে বিরত রাখে। আর বহুগামিতা হলো, নিম্নশ্রেণীর চতুস্পদ প্রাণীর চাহিদা। সুতরাং যখন কেউ নিজেকে যিনা থেকে বেঁচে রাখবে সে আল্লাহর সাহায্য পাবে। আর আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য তাকে ফেরেশতাদের অবস্থানে (নিষ্পাপ করে) উঠাবে এবং উঁচু আসনে সমাসীন করে’ (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হা/১৬৫৫; মিরকাতুল মাফাতীহ)।

যারা বিয়ে করেনি এমন যুবক-যুবতীদের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, হে যুবক-যুবতীরা, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তাদের বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে নমিত রাখে, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যাদের সামর্থ্য নেই তাদের ছিয়াম পালন করা উচিৎ। আর ছিয়াম যৌন কামনা দমন করার মাধ্যম। (বুখারী-মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮০ ‘নিকাহ’ অধ্যায়)

আল্লামা নববী (রহঃ) বলেনঃ الْبَاءَةَ ‘‘বাআত’’ এর উদ্দেশ্য নিয়ে ‘উলামাগণের মাঝে দু’টি অগ্রগণ্য মত রয়েছে। তন্মধ্যে অধিক বিশুদ্ধ মত হলো, الْبَاءَةَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সহবাস। সুতরাং মূল কথা হলো যে, সহবাসে সক্ষম সে যেন বিবাহ করে। আর যে স্ত্রীর ভরণ-পোষণে অক্ষম ও সহবাসে অক্ষম, তার যৌন চাহিদা দমন করার জন্য সিয়াম পালন করতে হবে আর এটাই তার খারাপ মনোবৃত্তি দূর করবে।

দ্বিতীয় মত হলো, বিবাহের খরচাদি বহনের সক্ষমতা (অর্থাৎ- দেন-মোহর, ওয়ালীমা ইত্যাদি)। সুতরাং হাদীসটির উদ্দেশ্য হলো, যে ব্যক্তি বিবাহের সমস্ত খরচ পরবর্তী স্ত্রী খরচাদি বহনে সক্ষম সে যেন বিবাহ করে। আর যে এতে অক্ষম সে তার প্রবৃত্তি দমনে সিয়াম পালন করবে। তবে আমি (‘আসকালানী) বলবঃ হাদীসে উল্লেখিত বাক্যে (مَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ) এখানে الْبَاءَةَ এর মধ্যে সহবাসে সক্ষমতা ও স্ত্রীর যাবতীয় খরচাদিসহ সবই রয়েছে। কারণ তিরমিযীতে আস্ সাওরী (রহঃ)-এর সূত্রে আ‘মাশ হতে বর্ণিত রয়েছে, যে ব্যক্তি الْبَاءَةَ করতে সক্ষম নয় সে সিয়াম পালন করবে। তিরমিযীর বর্ণনায় আবূ ‘আওয়ানাহ্-এর সূত্রে বর্ণিত রয়েছে, যে ব্যক্তি বিবাহ করতে সক্ষম সে যেন বিবাহ করে। আবার নাসায়ীর বর্ণনায় রয়েছে, যার সামর্থ্য আছে সে বিবাহ করবে।

ইবন হাযম (রহঃ) বলেনঃ সহবাসে সক্ষম ব্যক্তি মাত্র সবার ওপর বিবাহ করা ফরয, যদি তার বিবাহ করার সামর্থ্য থাকে। এতে যদি সে অক্ষম হয় তবে বেশী বেশী সিয়াম পালন করবে। আর এটাই এক দল সালাফগণের বক্তব্য।

ইবনুল বাত্ত্বল (রহঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা দ্বারা বিবাহ ওয়াজিব প্রমাণিত হয় না। কারণ বিবাহের পরিবর্তে সিয়াম পালন ওয়াজিব না, সুতরাং বিবাহটা অনুরূপই হবে। সিয়াম পালনের নির্দেশ রয়েছে সহবাসে অক্ষমতার কারণে, সুতরাং তা আবশ্যকীয় নয়। ব্যাপারটা এ রকম যে, কেউ কাউকে বলল, এ কাজ তোমার জন্য করা ওয়াজিব, তবে তা যদি না পার তবে তোমার জন্য এটা করা ভালো।

আহমাদ-এর প্রসিদ্ধ বক্তব্য রয়েছে যে, পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে বিবাহ করা ওয়াজিব নয়। ‘আল্লামা কুরতুরী (রহঃ) বলেনঃ সামর্থ্যবান ব্যক্তির যদি বিবাহ ছাড়া নিজের ওপর কিংবা দীনের ব্যাপারে ক্ষতির (যিনায় লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা) আশঙ্কা থাকে এবং বিবাহ ছাড়া যদি এ অবস্থা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা না থাকে তবে তার জন্য বিবাহ করা ওয়াজিব। এতে কারো দ্বিমত নেই। (ফাতহুল বারী ৯ম খন্ড, হাঃ ৫০৬৫)

“যদি বিয়ের সামর্থ্য না থাকে তবে ছিয়াম পালন কর” এ চিরন্তন বাণী রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) এ জন্য দিয়েছেন যে, ছিয়াম পালন করলে পানাহার কমে গিয়ে যৌন প্রবৃত্তি দমিত হয়। (মাও:মুহাম্মাদ আব্দুর রহিম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন-পৃঃ ৯৪)। তাছাড়া অস্বাভাবিক যৌন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নারী-পুরুষের যৌন প্রেষণা নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ রক্ত স্রোতে বেশী বেশী যৌন হরমনের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখে। (মনোবিজ্ঞান- প্রেষণা অধ্যায়, পৃঃ ৬৮)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেন, “তোমাদের কাছে যদি কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, তবে তার চরিত্র পছন্দনীয় হলে অবশ্যই বিয়ে সম্পাদন করে দাও। এরূপ না করলে দেশে বিপুল পরিমাণে অনর্থ দেখা দেবে।’ [তিরমিযী হা/১০৮৪, ১০৮৫]

শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বিয়ে না করার অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে বলেনঃاعلم ان المنى اذا اكثر تولده فى البدن صعد بخاره الى الدماغ- (حجة الله البالغة) “জেনে রেখ, শুক্রের প্রজনন ক্ষমতা যখন দেহে খুব বেশী প্রবল হয়, তখন তা বের হতে না পারলে মগজে তার বাষ্পাকারে আঘাত হানে” (হুজ্জাতুল্লাহ বালেগাহ -)। প্রখ্যাত চিকিৎসাবীদ আল্লামা নফীসী বলেছেনঃو قد يستحيل المنى الى طبعية سمية ويرسل الى القلب و الدماغ بخارارديا سميا يوجب الغشى و الصرع نحوهما-(نافيسى) “শুক্র প্রবল হয়ে পড়লে অনেক সময় তা ভয়ানক বিষাক্ত হয়ে যায়। আত্মা ও মগজে এক প্রকার বিষাক্ত বাষ্প উত্থিত হয়, যার ফলে মৃগী রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়” (নাফিসী-পৃঃ-৪১৪ , পরিবার ও পারিবারিক জীবন পৃ.৮৫)

প্রাপ্ত যৌবন কালে দেহে নিয়মিত শুক্রসৃষ্টি হয় এবং তা এপিডিডিমিস্, শুক্রবাহীনালী ও শুক্রস্থলিতে জমা হয়। আর এই শুক্র নিদির্ষ্ট সময় অন্তর অন্তর সে’টি বের হবার পথ খুঁজে (ডাঃ এস. এন. পান্ডে- গাইনিকলজি শিক্ষা- আদিত্য প্রকাশনালয়-২য় সংস্করন-১৯৭৭, ৭৩)

সেই কারণেই দেহে বিভিন্ন প্রকার রোগের প্রদুর্ভাব ঘটে। দীর্ঘ দিন যাবৎ অবিবাহিত জীবন-যাপন মানসিক হীনমন্যতার জন্য পুরুষ-নারীদের প্রাপ্ত যৌবনে কৃত্রিম মৈথুন দ্বারা অনেক বেশী বীর্য ক্ষয় যৌন উত্তেজনা ও যৌনতার স্থায়ীত্ব কমে যায় এবং দেহের বিভিন্ন হরমোনের ক্রিয়া কমে আসে। যার ফলে ধ্বজভঙ্গসহ নানা প্রকার জটিল যৌন ব্যাধি পরিলক্ষিত হয় (গাইনিকলজি শিক্ষা- ৬০)।

যারা বিয়ে করেনা কিন্তু যৌন কামনা খুব বেশী অথচ অতৃপ্ত যৌন বাসনা তাদের হিষ্টিরিয়া বা মৃগী রোগ হবার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ (গাইনিকলজি শিক্ষা- ৯৪)

বিবাহিত যৌনতায় শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূর্ণ হয়। তাছাড়া বিবাহ বহির্ভূত অস্বাভাবিক যৌনাচারের স্বাভাবিক পরিণতি হ’ল বিভন্ন ধরনের জটিল যৌনরোগ। যৌন ক্ষমতা বিনষ্ট, হিষ্টিরিয়া বা মৃগী, সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস প্রভৃতি যৌন রোগে আক্রান্ত হয় (মাসিক পৃথিবীঃ প্রাশ্চাত্যে যৌন বিকৃতি- জুলাই ২০০১ইং)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top