আইয়্যামে জাহিলিয়্যাত দ্বারা তাওহীদ ও নুবুওয়্যাত সম্পর্কে অজ্ঞতাকে উদ্দিষ্ট করা হয়েছে। আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের পর নবী (সা.) -এর আগমনের বরকতে আল্লাহ তা’আলা অশেষ কল্যাণ প্রদান করেছেন এবং কুফর ও ভ্রষ্টতার ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছেন। অতঃপর আবার অকল্যাণ সংঘটিত হবে এবং তারপর আবারো কল্যাণ আসবে, তবে তার সাথে আঁধারও থাকবে। এ সময় লোকজন দ্বীনের সাথে সুন্নতের পরিপন্থী বিষয়সমূহ দ্বীন হিসেবে পালন করবে এবং নবী (সা.)-এর তরীকা ছেড়ে ভিন্ন তরীকা গ্রহণ করবে। শেষ যামানায় এমন কিছু দা’ঈ বা ‘আলিমের আবির্ভাব হবে যারা মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে, সন্দেহ সংশয় দ্বারা মানুষকে হিদায়াত থেকে বিরত রাখবে। সুন্নত ব্যতিরেকে বিদআতের দিকে এবং সংযম ব্যতীত পার্থিব আকাক্ষার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। হাদীছে আরো এসেছে,
عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُوْنَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِىْ فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! إِنَّا كُنَّا فِىْ جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللهُ بِهَذَا الْخَيْرِ، فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ؟ قَالَ: نَعَمْ. قُلْتُ: وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ؟ قَالَ: نَعَمْ، وَفِيْهِ دَخَنٌ؟ قُلْتُ: وَمَا دَخَنُهُ؟ قَالَ: قَوْمٌ يَهْدُوْنَ بِغَيْرِ هَدْيِيْ، تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ. قُلْتُ: فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ؟ قَالَ: نَعَمْ، دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوْهُ فِيْهَا. قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! صِفْهُمْ لَنَا. قَالَ: هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا، وَيَتَكَلَّمُوْنَ بِأَلْسِنَتِنَا. قُلْتُ: فَمَا تَأْمُرُنِىْ إِنْ أَدْرَكَنِىْ ذَلِكَ؟ قَالَ: تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ : فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ: فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ، حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ، وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-
‘হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকজন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করত, আর আমি তাঁকে অকল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করতাম এ ভয়ে যে, যেন অকল্যাণ আমাকে না পেয়ে বসে। একদা আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা তো অজ্ঞতা ও অকল্যাণের মাঝে ছিলাম। এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ কল্যাণের মাঝে নিয়ে আসলেন। এ কল্যাণের পর আবারও কী অকল্যাণ আসবে?
তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, এ অকল্যাণের পর কী আবার কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এর মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল থাকবে। আমি বললাম, এর ধুম্রজাল কেমন?
তিনি বললেন, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা আমার হেদায়াত ব্যতীত অন্য পথে পরিচালিত হবে। তাদের পক্ষ থেকে সম্পাদিত ভাল কাজও দেখবে এবং মন্দ কাজও দেখবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে কল্যাণের পর কী আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা জাহান্নামের দিকে আহবান করবে। যে ব্যক্তি তাদের ডাকে সাড়া দিবে তারা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাদের কাছে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি বললাম, যদি এমন অবস্থা আমাকে পেয়ে বসে তাহ’লে আমাকে কী করার নির্দেশ দেন?
তিনি বললেন, তুমি মুসলমানদের জামা‘আত ও তাদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, তখন যদি মুসলমানদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে?
তিনি বললেন, ‘তখন সকল দলমত ত্যাগ করে সম্ভব হ’লে কোন গাছের শিকড় কামড়িয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে অবস্থায় তোমার মৃত্যু উপস্থিত হয়’ (বুখারী হা/৩৬০৬,৭০৮৪; মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২)।
অন্যত্র এসেছে, قُلْتُ فَهَلْ مِنْ وَرَاءِ ذَلِكَ الْخَيْرِ شَرٌّ قَالَ: نَعَمْ. قُلْتُ: كَيْفَ؟ قَالَ: يَكُوْنُ بَعْدِىْ أَئِمَّةٌ لاَ يَهْتَدُوْنَ بِهُدَاىَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِىْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالٌ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِىْ جُثْمَانِ إِنْسٍ. قَالَ: قُلْتُ: كَيْفَ أَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنْ أَدْرَكْتُ ذَلِكَ، قَالَ: تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلأَمِيْرِ وَإِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَأُخِذَ مَالُكَ فَاسْمَعْ وَأَطِعْ ‘আমি বললাম, এ কল্যাণের পর কী আর কোন অকল্যাণ থাকবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, অবস্থা কেমন হবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন একদল শাসক হবে, যারা আমার হেদায়াত ও সুন্নাত অনুযায়ী চলবে না। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের মানব দেহে শয়তানের হৃদয় বিরাজ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আমি সেই অবস্থার সম্মুখীন হই তাহ’লে কী করব? তিনি বললেন, ‘তুমি আমীরের কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে। যদিও তোমার পিঠে চাবুকের আঘাত পড়ে এবং তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়। তবুও তার কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে’ (মুসলিম হা/১৮৪৭; ছহীহাহ হা/২৭৩৯; মিশকাত হা/৫৩৮২)।
ইমাম ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, আলোচ্য হাদীসে অকল্যাণ/অনিষ্ট দ্বারা ফিতনাহ্ উদ্দেশ্য। তাছাড়া এ দ্বারা গোমরাহী ও বিদ’আতের প্রসার বুঝানো হয়েছে। এ কারণেই নবী (সা.) এ সকল দা’ঈ বা আহ্বায়কের ডাকে সাড়া দেয়াকে গোমরাহীতে প্রবেশ ও জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
কারো মতে, আলোচ্য হাদীসে প্রথম ফিতনাহ্ দ্বারা উসমান (রাঃ)-এর হত্যা ও তৎপরবর্তী ফিতনাকে বুঝানো হয়েছে। এরপরের কল্যাণ দ্বারা খলীফাহ্ ‘উমার ইবনু আবদুল আযীয-এর খিলাফতকাল উদ্দেশ্য। অতঃপর এমন কিছু রাজা বাদশা আসবে যারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ভালো-মন্দ উভয় প্রকার কাজ করবে। কারো মতে, উসমান (রাঃ) হত্যার পরবর্তী ফিতনার পর হাসান (রাঃ) ও মু’আবিয়াহ্ (রাঃ) -এর মধ্যকার সন্ধি চুক্তিকে কল্যাণ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
কোন কোন বিদ্বান, এ সকল ভ্রষ্ট দা’ঈ দ্বারা খারিজী ও রাফিজী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেতৃপর্যায়ের লোকেদেরকে বুঝিয়েছেন, যারা আখিরী যামানায় মানুষের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, নেতৃত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা করবে যদিও তাদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিদ্যমান থাকবে না। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
অনুরূপ হাদীছে এসছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের নিকট এমন ধোকাব্যঞ্জক যুগ আসবে, যাতে মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদীরূপে এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত করা হবে। যখন খেয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে এবং আমানতদার আমানতে খেয়ানত করবে। যখন জনসাধারণের ব্যাপারে তুচ্ছ লোক মুখ চালাবে’। (আহমাদ হা/৭৯১২, ইবনে মাজাহ হা/৪০৩৬, হাকেম হা/৮৪৩৯, ছহীহুল জামে হা/৩৬৫০)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,بَادِرُوْا بِالْاَعْمَالِ فَسَتَكُوْنُ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَّ يُمْسِىْ كَافِرًا وَّ يُمْسِىْ مُؤْمِنًا وَّ يُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيْعُ دِيْنَهُ بِعَرَضٍ مِّنَ الدُّنْيَا- ‘তোমরা অনতিবিলম্বে সৎকাজের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যাও। কেননা শীঘ্রই অন্ধকার রাতের অংশের মত বিপদ-বিশৃংখলার বিস্তার ঘটবে। তখন মানুষ সকাল বেলা মুমিন থাকবে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যাবে, আবার সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে সকালে কাফের হয়ে যাবে। সে তার দ্বীনকে পার্থিব স্বার্থের বদলে বিক্রয় করবে’ (ছহীহুল জামি‘ হা/২৮১৪)
দীছের সবশেষ যা বুঝানো হয়েছে, দ্বীন ও দুনিয়া আলাদা কোন বিষয়বস্তু নয়। দ্বীন দ্বারা দুনিয়া একই রেখাতে পরিচালিত হবে। আর যারা আলাদা করেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সুতরাং দুনিয়া নয়, দ্বীনকে আঁকড়ে ধরুন। দুনিয়ার জীবন যাত্রা একটি সফরের তুল্য মাত্র। যারা সফরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হবে দ্বীন পালনের উপর, কেবল তারাই সফল হবেন। অথচ মানুষ সুখে থাকতে পছন্দ করে, কষ্ট নয়। বিধায় দুনিয়ার মানুষ দ্বীনকে দুনিয়ার সামান্যতম হারাম সম্পদের বিনিময়ে বিক্রি করে ফেলছে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ’’মানুষ দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দিবে’’(ছহীহুল জামি‘ হা/৫১২৫)। অথচ আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া বিক্রয় করা উচিৎ (নিসা ৪/৭৪)। আর মুনাফিক্ব ও কাফের দুনিয়ার সামান্য মালের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে থাকে (ইবনে কাছীর)।
পরিশেষে, দ্বীন কায়েমের জন্য তথাকতিথ গণতন্ত্র পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতায় আসীন হওয়া মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। দ্বীন হলো তাওক্বওয়া। এটা তৈরী হয় দ্বীনের বুঝ থেকে এবং দ্বীনের বুঝ আসে অধিক হারে ইলমের পথ অবলম্বন করলে। ঈমানের নূর তথা হেদায়াত নসীবে জুটে দ্বীনের ইলম অর্জন ও আমলের ফলে। সুতরাং ইবাদতের পূর্বে জ্ঞানার্জন ফরয। একটি সুন্দর হাদীস জেনে নেয়।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, বনী ইসরাঈলের মধ্যে দু’জন ব্যক্তি ছিলো। তাদের একজন পাপ কাজ করতো এবং অন্যজন সর্বদা ইবাদাতে লিপ্ত থাকতো। যখনই ইবাদাতরত ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে দেখত তখনই তাকে খারাপ কাজ পরিহার করার জন্য বলত।
একদিন সে তাকে পাপ কাজে লিপ্ত দেখে বলল, তুমি এমন কাজ থেকে বিরত থাকো। লোকটি বলল, আমাকে আমার রবের উপর ছেড়ে দাও। তোমাকে কি আমার উপর পাহারাদার করে পাঠানো হয়েছে? সে বলল, আল্লাহ্র কসম! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না অথবা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না।
অতঃপর দুই জনকেই মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ্র নিকট উপস্থিত করা হলে তিনি (আল্লাহ) ইবাদতকারী ব্যক্তিকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আমার সম্পর্কে জানতে? অথবা তুমি কি আমার হাতে যা আছে তার উপর ক্ষমতাবানী ছিলে? এবং পাপীকে বললেন, তুমি চলে যাও এবং আমার রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করো।
আর অপর ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি বললেন, তোমরা একে জাহান্নামে নিয়ে যাও। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَوْبَقَتْ دُنْيَاهُ وَآخِرَتَهُ ‘সেই মহান সত্ত্বার কসম! যার হাতে আমার জীবন! সে এমন উক্তি করেছে যার ফলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েই বরবাদ হয়ে গেছে’(আবূ দাউদ হা/৪৯১০; ছহীহ হাদীছ)। অতএব কথা জেনে বুঝে বলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের ইলম ও সঠিক বুঝ দান করুন আমীন।