ইসলামের প্রচারের প্রাথমিক কালে মক্কার পৌত্তলিকরা দিন দিন অস্থির হয়ে উঠলো। অস্থির হবে না কেন? তারা বুঝতে পেরেছিলযে, এখন যদি মুহাম্মদকে হত্যা করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা হলে তাঁকে রক্ষা করার জন্য যে রক্তপাত হবে এতে মক্কা পান্তর লালে রন্জিত হয় যাবে। তাদের নিজেদের গোষ্ঠির মধ্যে ধ্বংশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। এ কারনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে হত্যা করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে পৌত্তলিকরা অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতনের নতুন পথ আবিষ্কার করল। আর এই পরিকল্পনা ছিল ইতোপূর্বে গৃহিত সকর পদক্ষেপের চেয়ে আরও বেশী মারাত্মক।
সর্বাত্মক বয়কট দলিল রিখেছিল মনছুর ইবনে আমের ইবনে হাশেম। কারে কারে মতে নযর ইবনে আমের ইবনে হারেছ লিখেছেল। কিন্তু সঠিক মত হলো, এই দলিল বোগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম লিখেছিল।
বয়কট দলিল লিখিত হওয়ার পর কা’বা ঘরে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো। এই দলিলের ফলে আবু লাহাব ব্যতিত বনু হাশেম ও বনু মোতালেবের মুসলিম অমুসলিম নারী, পুরুষ, শিশু, সকলের শা’বে তালেব নামক স্তানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এ ঘটনা ছিলবুওয়াতের ৭ম বছরের ঘটনা।
এ বয়কটের ফলে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠল। খাদ্য সামগ্রীর আগমন বন্ধ হয়ে গেল। মক্কায় যে সমস্ত খাদ্য পাণীয় আমদানী হত তা পৌত্তলিকরা তড়িঘড়ি ক্রয় করে নিত। ক্ষুধার কষ্ট এত মারাক্তক ছিল যে, ক্ষুধার্ত নারী শিশুর কাতর কান্নায় আবু তালিবের ঘাঁটির বাইরে থেকে শোনা যেত। এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় গাছের বাকল ও লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারন করতেন।
হাকিম ইবনে হাজাম ছিলেন হযরত খাদিজা (রাঃ) ভ্রাতুপুত্র। মাঝে মধ্যে তিনি তাঁর ফুফুর জন্য গম পাঠাতেন। একবার গম পাঠানোর উদ্যোগ নিতেই আবু জেহেল বাঁধা দেয়। আবু বাখতারি এসে হাকিম ইবনে হাজামের পক্ষ নিয়ে গম পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। এই বয়কট পূর্ন দুদির্ন কেটে যায় একে একে তিন বছর। এরপর নবুওয়াতের দশম বছর মহরম মাসে দলিল ছিন্ন করার ঘটনা ঘটে। কোরায়েশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ধরনের অবরোধ ব্যাবস্থার বিরোধী থাকায় তারা অবরোধ বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলিল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হিশাম ইবনে আমের। হিশাম রাত্রীকালে অতিচুপিসারে খাদ্যদ্রব্য পাঠিযে আবু তালিব ঘাটির অসহায় লোকদের সাহায্য করতেন। প্রথমে হিশাম যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখযুমির কাছে যান। যুহাইর মা অ তেকা ছিলেন আব্দুল মোত্তালেবের কণ্যা, আবু তালেবের বোন। হিশাম তাকে বললেন, যুহাইর তুমি চাও যে, তোমরা মজা করে পেট পুরে পানাহার করবে অথচ তোমার মামা ও অন্যরা অনাহারে ধূকে ধূকে মারা যাবে? তারা কি আবস্থায় রয়েছে সেটা কি তুমি জানোনা? যুহাইর বললেন, আফসোস সেটা তুমি জানোনা। যুহাইর বললেন, আফসোস আমি একা কি করতে পারি? যদি আমার সাথে আরও কেউ এগিয়ে আসে তবে আমি সে দলিল বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। হিশাম বললেন, অন্য একজন রয়েছেন। যুহাইর জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কে? হিশাম বললেন আমি হিশাম ইবনে আমের। যুবাইর বললেন, আচ্ছা তবে তৃতীয় কাউকে খুঁজে বের করো। একথা শোনার পর হিশাম মোতরাম ইবনে আদীর কাছে গেলেন এবং বনু হাশেম ও বনু মোত্তালেবের দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করে তার সহায্য চাইলেন। তারা যে তার নিকট আত্মীয় সে কথাও বললেন। মোতায়েম বললেন আমি একা কি করতে পারি? হিশাম বললেন, আরও একজন আছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কে সে? হিসাম বললেন, আমি। মোতায়াম বললেন, আচ্ছা তৃতীয় একজন খুঁজে নাও। তিনি বললেন সেটাও করেছি। মোতায়াম বললেন, তিনি কে হিশাম বললেন, তিনি হচ্ছেন জুবাইর ইবনে উমাইয়া। এভাবে হিসাম আবুল বাখতারি, জামায়া ইবনে আছোয়াদ ইবনে মোতালেব ইবনে আছাদের কাছে গেলেন এবং তাদের মতামত একত্রিত করলেন। উল্লেখিত সকলে হাজুন নামক স্থানে একত্রিত হয়ে দলিল বিনষ্ট করার অঙ্ঘীকারাবদ্ধ হলেন। যুবাইর বললেন, প্রথমে আমি কথা তুলবো। সকাল বেলা নিয়মানুযায়ী সকলে মজলিসে একত্রিত হল। যুবাইর দামী পোশাক পরিধান করে সেজে গুজে উপস্থিত হল। প্রথমে কা’বা ঘর সাতবার তওয়াফ করে সবাইকে সম্বোধন করে বলল, মক্কাবাসীরা শোন আমরা পানাহার করব, পোশাক পরিধান করব আর বনু হাশেম ধ্বংশ হয়ে যাবে। তাদের কাশে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না তাদের নিকটে থেকে কেনাও হচ্ছে না। আল্লাহর কসম এ ধরনের অমানবিক দলিল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি নিরব থাকতে পারি না। আমি চাই এ দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হোক।
আবু জেহেল বলল, তুমি ভূল বকছো। আল্লাহর শপথ এ দলিল ছিন্ন করা যাবে না।
হামজা ইবনে আছোয়াদ বললেন, আল্লাহর শপথ তুমিই ভূর বকছো। এ দলিল যখন লেখা হয়েছিল তখনও আমি রাজি ছিলাম না। আমি এটা মেনে নিতে প্রস্তুত নই।এরপর মোতায়েম ইবনে আদি বললেন, তোমরা দুজনে ঠিকই বলেছ। আমরা এ দলিলে যা কিছু লেখা রয়েছে তা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। হিসাম ইবনে আমরও এধরনের কথা বললেন।
এ অবস্থা দেখে আবু জেহেল বলল হুঁহ রাত্রি কালেই এধরনের ঐক্যমত হয়েছে। এ পরামর্শ এখানে নয় বরং অন্য কোথাও করা হয়েছে।
সে সময় আবু তালেবও অদুরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোরায়েশদের বললেন, আমার ভাতিজা আমাকে আপনাদের কাছে এ কথা বলে পাঠিয়েছেন যে, আপনাদের অঙ্গিকার পত্রটি মহান আল্লাহ একরকম পোকা পাঠিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। শুধুমাত্র আল্লাহ নামটি সেখানে অবশিষ্ট আছে। যদি এ কথা মিথ্যা হয় তাহলে আমি তাঁর ও আপনাদের মাঝে থেকে সরে দাঁড়াব এবং আপনার যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আর যদি সত্য বলে প্রমানিত হয় তাহলে বয়কটের মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অন্যায় করেছেন তা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবে কুরায়েশরা সর্বসম্মত হল। এ বিষয়ে আবু জেহেল ও অন্যদের মাঝে তর্কবিতর্ক শেষ হলে মুতয়েম ইবনে আদী অঙ্গিকারপত্র ছিড়তে গিয়ে দেকলেন যে, সত্যি সত্যি আল্লাহর নাম লেখা অংশ ছাড়া বাঁকি অংশ পোকায় খেয়ে ফেলেছে। এরপর অঙ্গিকার পত্রটি ছিঁড়ে ফেলা হলে বয়কটের অবসান হল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও অন্য সকলে শোয়াবে আবু তালিব থেকে বেরিয়ে এলেন।
উল্লেখ্য বয়কট দলিল লেখকের জন্য নবী (ছাঃ) বদদো‘আ করেছিলেন এবং তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল।
আরবের পৌত্তলিকরা নবুওতের বিষ্ময়কর এ নিদর্শন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিল এবং নিজেদের কুফুরীর পথে আরো কয়েক কদম অগ্রসর হল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, আর তারা কোন মোজেযা দেখে, তখন টাল বাহানা করে এবং বলে এ তো যাদু।