সালাফী দাওয়াতে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের পদ্ধতি

সালাফীগণ মাঠে ময়দানে দাওয়াত দেয় তাদের দায়িত্ববোধ থেকে। আর সালাফী আলেম সমাজ সঠিক হক্বটা প্রচার করেন এবং যা সহীহ নয়, তা প্রচার থেকে বিরত থাকেন। কেননা এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, «بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوا عَنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ» ‘আমার পক্ষ হতে (মানুষের কাছে) একটি বাক্য হলেও পৌঁছিয়ে দাও। বনী ইসরাঈল হতে শোনা কথা বলতে পারো, এতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে, সে যেন তার বাসস্থান জাহান্নামে প্রস্তুত করে নেয় বুখারী হা/৩৪৬১,  মিশকাত হা/১৯৮)

কুরআনের একটি ছোট আয়াতও যদি জানা থাকে তাহলে তা প্রচার করতে হবে। আর কুরআন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যা তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হয়েছে। যে কুরআন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তার ধারক-বাহক অধিক হওয়া এবং স্বয়ং আল্লাহ তার সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়া সত্ত্বেও তা আরো প্রচারের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অতএব কুরআন ও হাদীস প্রচারের দায়িত্ব সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا عَلَیۡكُمۡ اَنۡفُسَكُمۡ ۚ لَا یَضُرُّكُمۡ مَّنۡ ضَلَّ اِذَا اهۡتَدَیۡتُمۡ ؕ اِلَی اللّٰهِ مَرۡجِعُكُمۡ جَمِیۡعًا فَیُنَبِّئُكُمۡ بِمَا كُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

অনুবাদ : ‘হে মু’মিনগণ! তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর। যখন তোমরা সত্যপথ প্রাপ্ত হয়েছ তখন যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকে, অতঃপর তোমরা যা করছিলে সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে’ (মায়েদা ৫/১০৫)।

প্রথমে প্রতিটি মানুষের উচিৎ নিজেকে ও তার নিজ কর্মের সংশোধনের চিন্তা করা। অন্যরা যা ইচ্ছা করুক, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই, এহেন কল্পনা করাও অনুচিৎ।

অথচ এ বিষয়টি কুরআনের যে সব আয়াতে সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করাকে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য এবং মুসলিম জাতির একটি স্বাতন্ত্র্যমূলক বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার পরিপন্থি হয়ে যায়। এ কারণেই আয়াতটি নাযিল হলে কিছু লোকের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের সামনে প্রশ্ন রাখেন এবং তিনি উত্তরে বলেন যে, আয়াতটি ‘সৎকাজে আদেশ দান’-এর পরিপন্থী নয়। তোমরা যদি ‘সৎকাজে আদেশ দান’ পরিত্যাগ কর, তবে অপরাধীদের সাথে তোমাদেরকেও পাকড়াও করা হবে’ (ইবনে কাসীর)।

আল্লাহর বান্দাদের উচিৎ যথাসাধ্য স্বীয় কর্তব্য পালন করতে থাকা। আর সৎকাজে আদেশ দানও এ কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো করার পরও যদি কেউ পথভ্রষ্ট থেকে যায়, তবে তাতে তোমাদের কোন ক্ষতি নেই।

কুরআনের (إِذَا اهْتَدَيْتُمْ) শব্দে চিন্তা করলে এ তাফসীরের যথার্থতা ফুটে উঠে। কেননা, এর অর্থ হ’ল, যখন তোমরা সঠিক পথে চলতে থাকবে, তখন অন্যের পথ ভ্রষ্টতা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর নয়। এখন একথা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি ‘সৎকাজে আদেশ দান’-এর কর্তব্যটি বর্জন করে, সে সঠিক পথে চলমান নয়। সা’য়ীদ ইবন মুসাইয়্যাব বলেন, এর অর্থ, যদি সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ কর, তাহলে কেউ পথভ্রষ্ট হলে, তাতে তোমার ক্ষতি নেই, যখন তুমি হিদায়াতপ্রাপ্ত হলে’ (ইবনে কাসীর)।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ভাষণে বলেন, তোমরা উক্ত আয়াতটি পাঠ করে একে অস্থানে প্রয়োগ করছ। জেনে রাখ, আমি নিজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে শুনেছি, ‘যারা কোন পাপকাজ হতে দেখেও তা দমন করতে চেষ্টা করে না, আল্লাহ তা’আলা সত্ত্বরই হয় তো তাদেরকেও অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত করে আযাবে নিক্ষেপ করবেন’ (আবু দাউদ হা/৪৩৪১, তিরমিযী হা/৩০৫৮, ইবনু মাজাহ হা/৪০১৪)। অন্যত্র এসেছে, ‘‘লোকেরা যখন কাউকে কোন পাপ কাজে লিপ্ত দেখে এবং পরিবর্তন করার পরিকল্পনা বা চেষ্টা না করে, সম্ভবতঃ আল্লাহ তাদেরকে অচিরেই আযাব দ্বারা গ্রেফতার করবেন।’’ (আহমাদ, তিরমিযী হা/২১৭৮, আবু দাউদ হা/৪৩৩৮)

মানুষদের বুঝানো সত্ত্বেও যদি তারা পাপ থেকে বিরত না থাকে এবং সৎপথ অবলম্বন না করে, তাহলে এই অবস্থায় তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না; বরং তোমরা সৎপথে আছ এবং পাপ করা হতে বিরত আছ। অবশ্য একটি অবস্থায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া থেকে বিরত থাকা বৈধ, যদি কেউ সে কাজে নিজের মধ্যে দুর্বলতা পায় এবং জীবননাশের আশঙ্কা থাকে, তাহলে এই অবস্থায় ‘‘তাতে যদি সক্ষম না হয়, তাহলে হৃদয় দ্বারা; আর এ হল সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক’’।

সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সীমারেখা :

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিষয়। যদি একজন মুসলিম এই ফরয ত্যাগ করে, তাহলে কেহ এই পথভ্রষ্টকে পথ দেখাতে পারবে না। আর অন্যায় বা যুলুম বা যালেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তিনটি স্তর রয়েছে।

(এক) যথাসাধ্য হাত দ্বারা প্রতিহত করা।

(দুই) সৎ উপদেশের মাধ্যমে যবান বা কথা অথবা লেখনির মাধ্যমে প্রতিবাদ করা। (উপরোক্ত পদ্ধতিতে অপারগ ব্যক্তি)

(তিন) মন থেকে ঘৃণা করা। (উপরোক্ত দুটিতে অপারগ ব্যক্তি)

সালাফদের মতামত হ’ল-
প্রথম আদেশ : আমীর বা নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রযোজ্য।

দ্বিতীয় আদেশ : আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রযোজ্য।

তৃতীয় আদেশ : সাধারণ সকল মুমিন মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)। তবে প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিই কোন না কোন ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল বা নেতা ও আলেম হয়ে থাকেন।

হাদীসে এসেছে, আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন শারী’আত বিরোধী কার্যকলাপ হতে দেখে, সেটাকে যেন নিজ হাতে পরিবর্তন করে দেয়। যদি নিজ হাতে সেগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখে নিষেধ করবে। আর যদি মুখে নিষেধ করারও সাধ্য না থাকে, তাহলে অন্তরে সেটা ঘৃণা করবে। এটা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। (মুসলিম হা/৭৮-(৪৯), আবূ দাঊদ হা/১১৪০, তিরমিযী হা/২১৭২, মিশকাত হা/৫১৩৭)

ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) শারহু মুসলিমে বলেনঃ ভালো কাজের আদেশ করা আর মন্দ কাজের নিষেধ করার হুকুম হলো ফরযে কিফায়াহ্। কেউ করলে বাকীদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। আর কেউ না করলে সবাই গুনাহগার হয়। পক্ষান্তরে ‘উলামাগণ বলেছেন, ঐ ব্যক্তির ওপর থেকে সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের দায়িত্ব রহিত হবে না যার ওপর শারী‘আতের বিধান অর্পিত হয়েছে। এটা তার জন্য অত্যাবশ্যক। অন্যথায় সে গুনাহগার হবে। (‘আওনূল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪৩৩২; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২১৭২)

আবূ সা’লাবাহ্ (রাঃ) হতে বলেন, আল্লাহর কসম! আমি উক্ত আয়াত সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেছি, অর্থাৎ- এ আয়াত অনুযায়ী সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করা থেকে বিরত থাকব কি-না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ’’না’’; বরং ঐ পর্যন্ত চালু রাখো, যখন তোমরা দেখবে, কৃপণের অনুসরণ করা হয়, প্রবৃত্তির পূজা করা হয়, ইহকালকে পরকালের উপর প্রাধান্য দেয়া হয় এবং প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের মতকে পছন্দনীয় বলে মনে করে। তুমি এমন কাজ দেখবে, যা থেকে তুমি এড়িয়ে চলতে পারবে না। তখন তুমি নিজেকেই নিজে রক্ষা করো এবং জনগণকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। কারণ তোমাদের ভবিষ্যৎযুগ এমন হবে, তোমাকে শুধু ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করবে, তার অবস্থা এরূপ হবে, যেন সে নিজের হাতে নিজে অঙ্গার উঠিয়ে নিয়েছে। সে সময় যে ব্যক্তি ধর্মের কাজে ’আমল করবে, সে পঞ্চাশজন লোকের ’আমল করার সাওয়াব পাবে। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! সে যামানারই পঞ্চাশজন লোকের ’আমলে সাওয়াবের সমান হবে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ না, তোমাদের যামানার পঞ্চাশজনের ’আমলের সাওয়াবের সমান হবে। (আবূ দাঊদ হা/৪৩৪১, তিরমিযী হা/১৪, ইবনু মাজাহ হা/৪০১৪, মিশকাত হা/৫১৪৪, হাসান হাদীস)।

উত্তম পদ্ধতিতে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে :

ইমাম ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তোমরা এ দু’টো বিষয়কে ‘১. সৎকাজের আদেশ ও ২. মন্দ কাজের নিষেধ’ পরিপূর্ণরূপে উত্তম পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন কর (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।

তবে নিরাশ না হয়ে বারংবার দাওয়াত দিতে থাকতে হবে। কজন ব্যক্তির জন্য অতিব আবশ্যক হলো তার উর্দ্ধতন, সমপর্যায় ও নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সৎ কাজের আদেশ দেওয়া, যখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে কল্যাণকামিতা; কাউকে নিন্দা করা নয়।  উত্তম আচরণের মাধ্যমে হক্ব জানিয়ে দেয়া বা উপদেশ প্রদান করা হ’ল কল্যাণকামিতা। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ভাল আর মন্দ সমান নয়। উৎকৃষ্ট দিয়ে মন্দকে দূর কর। তখন দেখবে, তোমার আর যার মধ্যে শত্রুতা আছে সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু’ (হা-মিম-সাজদা ৪১/৩৪)

এখানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক চারিত্রিক শিক্ষা যে, মন্দকে দূরীভূত কর ভাল দ্বারা। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে নিকৃষ্ট প্রতিহত কর। অর্থাৎ,অন্যায়ের বদলা নাও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে,যুলুমের বদলা নাও ক্ষমা করে,ক্রোধের বদলা নাও ধৈর্যধারণ করে, বেআদবীর বদলা নাও দৃষ্টিচ্যুত করে এবং মূর্খতা বা অশ্লীল কথার উত্তর দাও সহ্য করে নীরব থেকে। এর ফল এই হবে যে, তোমার শত্রু দেখবে তোমার বন্ধু হয়ে গেছে। তোমার থেকে দূরে দূরে থাকত এমন ব্যক্তি তোমার নিকটে হয়ে যাবে এবং তোমার রক্ত-পিপাসু ব্যক্তি তোমার বশীভূত ও প্রেম-পিপাসু হয়ে যাবে।

দ্বীনের মধ্যে পরস্পর মতভেদ করে না :

সালাফীগণ দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও মতভেদ করে না। আর সালাফদের মধ্যে মতভেদ করা বা উপদলে বিভক্ত হওয়া গর্হিত কাজ।এটা মুমিন মুসলমানদের নিকট কাম্য নয়, করা উচিৎও নয়। কেননা ইহুদী-নাছারাদের মত বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ততা থেকে সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ، يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوْهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوْهٌ ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে ও পরস্পর মতভেদে লিপ্ত রয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। সেদিন কতগুলি মুখমন্ডল হবে শ্বেতবর্ণ এবং কতক মুখমন্ডল হবে কৃষ্ণবর্ণ’ (আলে ইমরান ৩/১০৫-১০৬)

ইবনু জারীর (রহঃ) তার সনদে আল্লাহ তা‘আলার নিম্নের বাণী সম্পর্কে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে ও পরস্পরে মতভেদে লিপ্ত রয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১০৫) তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে জামা‘আত আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত ও পরস্পর মতভেদে লিপ্ত হ’তে নিষেধ করেছেন। তিনি তাদেরকে এ সংবাদও দিয়েছেন যে, তাদের পূর্ববর্তীরা দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।[9]  ইবনু কাছীর (রহঃ) আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর ব্যাপারে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوْهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوْهٌ ‘সেদিন কতগুলি মুখমন্ডল হবে শ্বেতবর্ণ এবং কতক মুখমন্ডল হবে কৃষ্ণবর্ণ’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)। তিনি বলেন, অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মুখমন্ডল হবে উজ্জ্বল এবং বিদ‘আতী ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত ব্যক্তিদের মুখমন্ডল হবে কালো।[তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৭৬।]

যারা বিভেদ করেছে তাদের জন্যে কঠোর হুশিয়ারী দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (আনআম ৬/১৫৯)

ফেৎনা ও অকল্যাণ থেকে  নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে :  

ফেৎনা ও অকল্যাণ কোন মানুষের কাম্য নয়। কিন্তু আমরা নিজেরাই অকল্যাণ ও মন্দ কামনা করি। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। আর আল্লাহ যখন কোন জাতির প্রতি মন্দ কিছু ইচ্ছা করেন, তখন তাকে রদ করার কেউ নেই। আর আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নেই’ (রাদ ১৩/১১)

জামা‘আতবদ্ধভাবে জীবন যাপন করলে ফেৎনা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। আর বর্তমানে আমরা ফেৎনার যুগে অবস্থান করছি। মানুষ মানুষকে নানা উপায়ে ঠকাতে চায়, চায় ধোঁকা দিতে। এককভাবে সৎ ও আমানতদার মানুষ চেনা তাই খুব কঠিন। জামাআতবদ্ধ জীবন তাই সঠিক ব্যক্তি ও পথ চেনাতে সহায়তা করে, যা তাকে নিজের অজান্তে ফেৎনায় পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। 

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سَيَأْتِى عَلَى النَّاسِ سَنَوَاتٌ خَدَّاعَاتٌ يُصَدَّقُ فِيهَا الْكَاذِبُ وَيُكَذَّبُ فِيهَا الصَّادِقُ وَيُؤْتَمَنُ فِيهَا الْخَائِنُ وَيُخَوَّنُ فِيهَا الأَمِينُ وَيَنْطِقُ فِيهَا الرُّوَيْبِضَةُ قِيلَ وَمَا الرُّوَيْبِضَةُ قَالَ الرَّجُلُ التَّافِهُ فِى أَمْرِ الْعَامَّةِ. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘অচিরেই লোকদের উপর প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির যুগ আসবে। তখন মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী হিসাবে গণ্য করা হবে। আমানতের খিয়ানতকারীকে আমানতদার, আমানতদারকে খিয়ানতকারী হিসাবে গণ্য করা করা হবে এবং রুওয়াইবিযা হবে বক্তা। জিজ্ঞাসা করা হলো রুওয়াইবিযা কি? তিনি বলেন, নীচ প্রকৃতির লোক জনগণের হর্তাকর্তা হবে’।[আহমাদ হা/৭৯১২; ইবনে মাজাহ হা/৪০৩৬; হাকেম হা/৮৪৩৯; ছহীহুল জামেহা/৩৬৫০]

ফেৎনা থেকে সাধ্যমত বেঁচে থাকার জন্য রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ خَالِدِ بْنِ عُرْفُطَةَ قَالَ قَالَ لِى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَا خَالِدُ إِنَّهَا سَتَكُونُ بَعْدِى أَحْدَاثٌ وَفِتَنٌ وَاخْتِلاَفٌ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُونَ عَبْدَ اللَّهِ الْمَقْتُولَ لاَ الْقَاتِلَ فَافْعَلْ খালেদ বিন উরফুত্বাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হে খালেদ! আমার পরে বহু অঘটন, ফেৎনা ও মতানৈক্য সৃষ্টি হবে। সুতরাং তুমি পারলে সে সময় আল্লাহর নিহত বান্দা হও এবং হত্যাকারী হয়ো না’।[আহমাদ হা/২২৫৫২, ২২৪৯৯; হাকেম হা/৮৫৭৮; ত্বাবরানী হা/১৭০৩]  

আর ফেৎনা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দিলে ফেৎনা থেকে আত্মরক্ষার জন্য রাসূল (ছাঃ) কাঠের তরবারী বানিয়ে নিতে বলেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, سَتَكُونُ فِتَنٌ وَفُرْقَةٌ فَإِذَا كَانَ ذَلِكَ فَاكْسِرْ سَيْفَكَ وَاتَّخِذْ سَيْفاً مِنْ خَشَبٍ- ‘ভবিষ্যতে ফেৎনা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেবে। সুতরাং সে সময় এলে তুমি তোমার তরবারি ভেঙ্গে ফেলো এবং কাষ্ঠের তরবারি বানিয়ে নিয়ো’।[আহমাদ হা/২০৬৭১,২০৬৯০]  ফেৎনা দেখা দিলে সর্বোত্তম কাজ হলো নিজ গৃহে অবস্থান করা। হাদীছে এসেছে, আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ফেৎনার সময় মানুষের নিরাপত্তার উপায় তার স্বগৃহে অবস্থান।[দাইলামী, ছহীহুল জামে হা/৩৬৪৯]

অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَبِى بُرْدَةَ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى مُحَمَّدِ بْنِ مَسْلَمَةَ فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتْنَةٌ وَفُرْقَةٌ وَاخْتِلاَفٌ فَإِذَا كَانَ كَذَلِكَ فَأْتِ بِسَيْفِكَ أُحُدًا فَاضْرِبْهُ حَتَّى يَنْقَطِعَ ثُمَّ اجْلِسْ فِى بَيْتِكَ حَتَّى تَأْتِيَكَ يَدٌ خَاطِئَةٌ أَوْ مَنِيَّةٌ قَاضِيَةٌ. আবু বুরদাহ বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অচিরেই কলহ, অনৈক্য, বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধ ছড়িয়ে পড়বে। এ অবস্থা চলাকালে তুমি তোমার তরবারিসহ উহুদ পাহাড়ে আসো, তাতে আঘাত করো, যাতে তা ভেঙ্গে যায়। অতঃপর তুমি তোমার ঘরে বসে থাকো, যতক্ষণ না কোন বিদ্রোহী বা অনিষ্টকারী তোমাকে হত্যা করে বা তোমার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়’।[ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬২; আহমাদ হা/১৭৫২১; সিলসিলা ছহীহাহ  হা/১৩৮০]

হাদীছে আরো এসেছে, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকজন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করত, আর আমি তাঁকে অকল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করতাম এ ভয়ে যে, যেন অকল্যাণ আমাকে না পেয়ে বসে। একদা আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা তো অজ্ঞতা ও অকল্যাণের মাঝে ছিলাম। এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ কল্যাণের মাঝে নিয়ে আসলেন। এ কল্যাণের পর আবারও কী অকল্যাণ আসবে? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, এ অকল্যাণের পর কী আবার কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এর মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল থাকবে। আমি বললাম, এর ধুম্রজাল কেমন? তিনি বললেন, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা আমার হেদায়াত ব্যতীত অন্য পথে পরিচালিত হবে। তাদের পক্ষ থেকে সম্পাদিত ভাল কাজও দেখবে এবং মন্দ কাজও দেখবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে কল্যাণের পর কী আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা জাহান্নামের দিকে আহবান করবে। যে ব্যক্তি তাদের ডাকে সাড়া দিবে তারা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাদের কাছে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি বললাম, যদি এমন অবস্থা আমাকে পেয়ে বসে তাহ’লে আমাকে কী করার নির্দেশ দেন? তিনি বললেন, তুমি মুসলমানদের জামা‘আত ও তাদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, তখন যদি মুসলমানদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, ‘তখন সকল দলমত ত্যাগ করে সম্ভব হ’লে কোন গাছের শিকড় কামড়িয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে অবস্থায় তোমার মৃত্যু উপস্থিত হয়’।[বুখারী হা/৩৬০৬,৭০৮৪; মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২]   

অন্যত্র এসেছে, قُلْتُ فَهَلْ مِنْ وَرَاءِ ذَلِكَ الْخَيْرِ شَرٌّ قَالَ: نَعَمْ. قُلْتُ: كَيْفَ؟ قَالَ: يَكُوْنُ بَعْدِىْ أَئِمَّةٌ لاَ يَهْتَدُوْنَ بِهُدَاىَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِىْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالٌ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِىْ جُثْمَانِ إِنْسٍ. قَالَ: قُلْتُ: كَيْفَ أَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنْ أَدْرَكْتُ ذَلِكَ، قَالَ: تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلأَمِيْرِ وَإِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَأُخِذَ مَالُكَ فَاسْمَعْ وَأَطِعْ ‘আমি বললাম, এ কল্যাণের পর কী আর কোন অকল্যাণ থাকবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, অবস্থা কেমন হবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন একদল শাসক হবে, যারা আমার হেদায়াত ও সুন্নাত অনুযায়ী চলবে না। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের মানব দেহে শয়তানের হৃদয় বিরাজ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আমি সেই অবস্থার সম্মুখীন হই তাহ’লে কী করব? তিনি বললেন, ‘তুমি আমীরের কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে। যদিও তোমার পিঠে চাবুকের আঘাত পড়ে এবং তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়। তবুও তার কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে’।[মুসলিম হা/১৮৪৭; ছহীহাহ হা/২৭৩৯; মিশকাত হা/৫৩৮২]

শেষ যামানায় এমন কিছু দা’ঈ বা ‘আলিমের আবির্ভাব হবে যারা মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে, সন্দেহ সংশয় দ্বারা মানুষকে হিদায়াত থেকে বিরত রাখবে। সুন্নত ব্যতিরেকে বিদআতের দিকে এবং সংযম ব্যতীত পার্থিব আকাক্ষার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। এ কারণেই নবী (সা.) এ সকল দা’ঈ বা আহ্বায়কের ডাকে সাড়া দেয়াকে গোমরাহীতে প্রবেশ ও জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
কোন কোন বিদ্বান, এ সকল ভ্রষ্ট দা’ঈ দ্বারা খারিজী ও রাফিজী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেতৃপর্যায়ের লোকেদেরকে বুঝিয়েছেন, যারা আখিরী যামানায় মানুষের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, নেতৃত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা করবে যদিও তাদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিদ্যমান থাকবে না। (মিরকাতুল মাফাতীহ)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top