আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یَوۡمَ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا انۡظُرُوۡنَا نَقۡتَبِسۡ مِنۡ نُّوۡرِكُمۡ ۚ قِیۡلَ ارۡجِعُوۡا وَرَآءَكُمۡ فَالۡتَمِسُوۡا نُوۡرًا ؕ فَضُرِبَ بَیۡنَهُمۡ بِسُوۡرٍ لَّهٗ بَابٌ ؕ بَاطِنُهٗ فِیۡهِ الرَّحۡمَۃُ وَ ظَاهِرُهٗ مِنۡ قِبَلِهِ الۡعَذَابُ সেদিন মুনাফিক্ব পুরুষ ও মুনাফিক্ব নারীরা তাদেরকে বলবে যারা ঈমান এনেছে, ‘তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি। বলা হবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও নূরের সন্ধান কর। তারপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, যার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি। (হাদীদ ৫৭/১৩)।
রূহ জগতে সর্বপ্রথম নূর বণ্টন হয় :
এখানে নূর বলতে ঈমান, হেদায়েত এবং আমলে সলেহ বুঝানো হয়েছে। যা সর্বপ্রথম রূহ জগতে বণ্টন করা হয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ خَلَقَ خَلْقَهُ فِي ظُلْمَةٍ، فَأَلْقَى عَلَيْهِمْ مِنْ نُورِهِ، فَمَنْ أَصَابَهُ مِنْ ذَلِكَ النُّورِ اهْتَدَى، وَمَنْ أَخْطَأَهُ ضَلَّ، فَلِذَلِكَ أَقُولُ: جَفَّ القَلَمُ عَلَى عِلْمِ اللَّهِ “
‘আল্লাহ তা’আলা অন্ধকারে তার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি এদের উপর তার নূরের আলোকপ্রভা ঢেলে দিয়েছেন। সুতরাং সেই নূরের আলোকপ্রভা যে ব্যক্তির উপর পড়েছে সে সৎপথ পেয়েছে এবং যে ব্যক্তির উপর তা পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্যেই আমি বলি, আল্লাহ তা’আলার ইলম অনুযায়ী কলম (তাকদীরের লিখন) শুকিয়ে গেছে’ (তিরমিযী হা/২৬৪২; মিশকাত হা/১০১)।
সুতরাং সেই কিয়ামতের দিন চির স্মরণীয় হবে। যখন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের চারপাশে তাদের নূর তাদের অগ্রে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে। আর এই নূর দেয়ার ব্যাপারটি পুলসিরাতে চলার কিছু পূর্বে ঘটবে।
তারা নূর থেকে বঞ্চিত হবে :
মুনাফিক্বরা কিছু দূর পর্যন্ত ঈমানদারদের সাথে তাদের আলোতে চলবে। অতঃপর মহান আল্লাহ মুনাফিকদের জন্য তাদের পথ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেবেন। তখন তারা মু’মিনদেরকে এ কথা বলবে যে, তোমরা দুনিয়াতে গিয়ে এই ধরনের ঈমান ও সৎকর্মের পুঁজি নিয়ে এসো, যেমন আমরা নিয়ে এসেছি। অথবা বিদ্রূপের ছলে ঈমানদাররা বলবে যে, পিছনে যেখান থেকে আমরা এই জ্যোতি নিয়ে এসেছি, সেখানে গিয়ে তোমরাও তার খোঁজ কর। অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, اَوۡ كَظُلُمٰتٍ فِیۡ بَحۡرٍ لُّجِّیٍّ یَّغۡشٰهُ مَوۡجٌ مِّنۡ فَوۡقِهٖ مَوۡجٌ مِّنۡ فَوۡقِهٖ سَحَابٌ ؕ ظُلُمٰتٌۢ بَعۡضُهَا فَوۡقَ بَعۡضٍ ؕ اِذَاۤ اَخۡرَجَ یَدَهٗ لَمۡ یَكَدۡ یَرٰىهَا ؕ وَ مَنۡ لَّمۡ یَجۡعَلِ اللّٰهُ لَهٗ نُوۡرًا فَمَا لَهٗ مِنۡ نُّوۡرٍ ‘অথবা তাদের কাজ গভীর সাগরের তলের অন্ধকারের মত, যাকে আচ্ছন্ন করে তরংগের উপর তরঙ্গ, যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের উপর স্তর, এমনকি সে হাত বের করলে তা আদৌ দেখতে পাবে না। আর আল্লাহ্ যার জন্য নূর রাখেননি তার জন্য কোন নূরই নেই’ (নূর ২৪/৪০)।
উপরোক্ত উপমা, তাদের আমল হবে অন্ধকারের ন্যায়। অর্থাৎ, তাদের আমলগুলি মরীচিকার মত অথবা অন্ধকারের মত। অথবা আগের উপমা ছিল কাফেরদের আমলের। আর এটি তাদের কুফরের উপমা, যার মধ্যে একজন কাফের সারা জীবন নিমজ্জিত থাকে। কুফর, অবিশ্বাস, অস্বীকার, মিথ্যাজ্ঞান ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার, নিকৃষ্ট আমল ও শিরকী বিশ্বাসের অন্ধকার এবং প্রতিপালক ও তাঁর পরকালের আযাব সম্বন্ধে অজ্ঞানতার অন্ধকার। এই সমস্ত অন্ধকার তাকে হিদায়াতের কোন পথই দেখতে দেয় না; যেমন অন্ধকারে মানুষ তার নিজের হাতও দেখতে পায় না। পৃথিবীতে ঈমান ও ইসলামের নূর তাদের ভাগ্যে জোটে না।
অপর দিকে, আখেরাতে ঈমানদাররা ঈমান, হেদায়োত এবং আমলে সলেহের মাধ্যমে যে নূর (আলো) পাবে, তা থেকে তারা বঞ্চিত থাকবে । আর এই কারণে তারা ঈমানদারদের তাদের পাশে দাঁড়াতে বলবে।
তাদের মুখমণ্ডল হবে গাঢ় কৃষ্ণবৰ্ণ :
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘প্রত্যেক মুমিনকে তার আমল পরিমাণে নূর দেয়া হবে। ফলে কারও নূর পর্বতসম, কারও খর্জুর বৃক্ষসম এবং কারও মানবদেহসম হবে। সর্বাপেক্ষা কম নূর সেই ব্যক্তির হবে, যার কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নূর থাকবে; তাও আবার কখনও জ্বলে উঠবে এবং কখনও নিভে যাবে’। (ইবনে কাসীর)।
আবু উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “অতঃপর তোমরা কবর থেকে হাশরের ময়দানে স্থানান্তরিত হবে। হাশরের বিভিন্ন মনযিল ও স্থান অতিক্রম করতে হবে। এক মনযিলে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে কিছু মুখমণ্ডলকে সাদা ও উজ্জ্বল করে দেয়া হবে এবং কিছু মুখমণ্ডলকে গাঢ় কৃষ্ণবৰ্ণ করে দেয়া হবে। ইবনু কাছীর (রহঃ) আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর ব্যাপারে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوْهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوْهٌ ‘সেদিন কতগুলি মুখমন্ডল হবে শ্বেতবর্ণ এবং কতক মুখমন্ডল হবে কৃষ্ণবর্ণ’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)। তিনি বলেন, অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন হেদায়াতপ্রাপ্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মুখমন্ডল হবে উজ্জ্বল এবং বিদ‘আতী ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত ব্যক্তিদের মুখমন্ডল হবে কালো (তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৭৬)।
অপর এক মনযিলে সমবেত সব মুমিন ও কাফেরকে গভীর অন্ধকার আচ্ছন্ন করে ফেলবে। কিছুই দৃষ্টিগোচর হবে না। এরপর নূর বণ্টন করা হবে। প্রত্যেক মুমিনকে নূর দেয়া হবে। মুনাফিক ও কাফেরকে নূর ব্যতীত অন্ধকারেই রেখে দেয়া হবে।
অত:পর যেভাবে অন্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান ব্যক্তির চোখ দ্বারা দেখতে পায় না তেমনি কাফের ও মুনাফিক ঈমানদারের নুর দ্বারা আলোকিত হতে পারবে না। মুনাফিকরা ঈমানদারদের বলবে, “তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি।” এভাবে আল্লাহ্ মুনাফিকদেরকে ধোঁকাগ্ৰস্থ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “তারা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় আর আল্লাহ্ তাদেরকে ধোঁকা দিবেন।” ( আন নিসা ১৪২)। তারপর তারা যেখানে নূর বন্টন হয়েছিল সেখানে ফিরে যাবে, কিন্তু উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, ওটার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি। এভাবেই মুনাফিক ধোঁকাগ্ৰস্ত হতে থাকবে। আর মুমিনদের মাঝে নূর বন্টিত হয়ে যাবে। (ইবনে কাসীর)।
তারা আল্লাহকে সিজদা দিতে অপারগ হবে :
আল্লাহ তা’আলা তার পায়ের নলা উন্মোচিত করে দিবেন। মুমিনেরা তা দর্শন মাত্রই চিনতে পারবেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহে বা অনুমতিসাপেক্ষে সিজদায় পড়ে যাবেন। এ সময় মুনাফিক অপরের দ্বারা প্রভাবিত, রিয়াকার ইত্যাদি ব্যক্তিরাও সিজদার চেষ্টা করবে কিন্তু সিজদাহ করতে গিয়ে পিছনের দিকে উল্টে পড়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, “সেদিন পায়ের গোছা উন্মুক্ত করা হবে এবং লোকেদের সিজদার প্রতি আহ্বান করা হবে, তখন তারা সিজদাহ্ দিতে পারবে না।” (আল কলাম ৬৮/৪২)
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসের মাধ্যমে অনেকে ধারণা করে যে, মুনাফিকরাও আল্লাহকে দেখবে, যেহেতু তারা মুমিনদের সাথেই রয়ে গেছে; অতঃপর আল্লাহ সিজদার মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা গ্রহণ করবেন। যে সিজদাহ্ করতে পারবে সে খাটি মু’মিন, আর যে তাতে সক্ষম হবে না সে হবে মুনাফিক্ব (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, হা. ২৯৯)।
আর আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে, তখন তারা বলবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রব আমাদের কাছে না আসেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ স্থানে অপেক্ষা করব। যখন আমাদের রব আসবেন, তখন আমরা তাকে চিনতে পারব। আর আবূ সাঈদ (রাঃ)-এর বর্ণনাতে আছে, আল্লাহ তআলা প্রশ্ন করবেন, তোমাদের এবং তোমাদের প্রভুর মধ্যে এমন কোন চিহ্ন আছে কি, যাতে তোমরা তাকে চিনতে পারবে? তারা বলবে, হ্যা, তখন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পায়ের নলা উন্মোচিত করবে। তখন যে ব্যক্তি সচ্ছতার সাথে আল্লাহ তা’আলাকে সিজদাহ্ করত, শুধু তাকেই আল্লাহ তা’আলা সিজদার অনুমতি দেবেন। আর যারা কারো প্রভাবে বা ভয়ে কিংবা মানুষকে দেখানোর জন্য সিজদাহ্ করত, তারা থেকে যাবে। তাদের মেরুদণ্ডের হাড়কে আল্লাহ তা’আলা একটি তক্তার মতো শক্ত করে দেবেন, বরং যখনই সিজদাহ্ করতে চাবে, তখনই পিছনের দিকে চিৎ হয়ে পড়ে যাবে। অতঃপর জাহান্নামের উপর দিয়ে পুলসিরাত পাতা হবে এবং শাফা’আতের অনুমতি দেয়া হবে। তখন নবী-রাসূলগণ (স্ব-স্ব উম্মতের জন্য) এ ফরিয়াদ করবেন, হে আল্লাহ! নিরাপদে রাখ! নিরাপদে রাখ! এ পুলসিরাতের উপর দিয়ে মু’মিনদের কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ পাখির গতিতে এবং কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে আবার কেউ উটের গতিতে অতিক্রম করবে। কেউ নিরাপদে বেঁচে যাবে। আবার কেউ এমনভাবে পার হয়ে আসবে যে, তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হবে এবং কেউ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে জাহান্নামে পড়বে………… (বুখারী হা/৮০৬, মুসলিম হা/২৯৯, মিশকাত হা/৫৫৭৯)।
মুনাফেক্ব কিয়ামতের মাঠে বিভিষিকার মধ্যে থাকবে। এই জাতি দুভাগে বিভক্ত। যথা-
১। বিশ্বাসগত বা আক্বীদাগত মুনাফেকী৷
২৷ আমলগত বা কর্মগত মুনাফেক্বী।
তন্মধ্যে আক্বীদাগত বা বিশ্বাসগত মোনাফেকী ছয় প্রকার, এর যে কোন একটা কারো মধ্যে পাওয়া গেলে সে জাহান্নামের সর্বশেষ স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে।
১. রাসূল (ছাঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
২. রাসূল (ছাঃ) যা নিয়ে এসেছেন তার সামান্যতম অংশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
৩. রাসূল (ছাঃ)-কে ঘৃণা বা অপছন্দ করা।
৪. রাসূল (ছাঃ) যা নিয়ে এসেছেন তার সামান্যতম অংশকে ঘৃণা বা অপছন্দ করা।
৫. রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বীনের অবনতিতে খুশী হওয়া।
৬. রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বীনের জয়ে অসন্তুষ্ট হওয়া। আর কার্যগত মুনাফেকীঃ এ ধরণের মুনাফেকী পাঁচ ভাবে হয়ে থাকেঃ এর প্রমাণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীঃ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘মুনাফিকের নিদর্শন হলো তিনটি, কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে’। (বুখারী হা/৩৩; মুসলিম হা/৫৯)।
আমলগত মুনাফেক্ব সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয় এবং নিফাক্বী থাকার কারণে পাপীও হবে। তবে তা তাওবার মাধ্যমে ক্ষমাও হবে। যেমন- কোন ব্যক্তি এশা ও ফযরের সালাতের জামাআতে অনুপস্থিত থাকতে সে কর্মগত মুনাফেক্ব। কিন্তু সে জামাআতের সওয়াব পাবে না এবং জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থানের মত পাপীও নয়।
সুতরাং আমরা আক্বীদাগত মুনাফেক্বী থেকে নিজেকে মুক্ত রাখি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং এর উপর অবিচল রাখুন, আমীন।
