জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনের সুফল (শেষ পর্ব)

১২. ফেৎনা ও অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকা :  ফেৎনা ও অকল্যাণ কোন মানুষের কাম্য নয়। কিন্তু আমরা নিজেরাই অকল্যাণ ও মন্দ কামনা করি। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। আর আল্লাহ যখন কোন জাতির প্রতি মন্দ কিছু ইচ্ছা করেন, তখন তাকে রদ করার কেউ নেই। আর আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নেই’ (রা‘দ ১৩/১১)

জামা‘আতবদ্ধভাবে জীবন যাপন করলে ফেৎনা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। আর বর্তমানে আমরা ফেৎনার যুগে অবস্থান করছি। মানুষ মানুষকে নানা উপায়ে ঠকাতে চায়, চায় ধোঁকা দিতে। এককভাবে সৎ ও আমানতদার মানুষ চেনা তাই খুব কঠিন। জামাআতবদ্ধ জীবন তাই সঠিক ব্যক্তি ও পথ চেনাতে সহায়তা করে, যা তাকে নিজের অজান্তে ফেৎনায় পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। 
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سَيَأْتِى عَلَى النَّاسِ سَنَوَاتٌ خَدَّاعَاتٌ يُصَدَّقُ فِيهَا الْكَاذِبُ وَيُكَذَّبُ فِيهَا الصَّادِقُ وَيُؤْتَمَنُ فِيهَا الْخَائِنُ وَيُخَوَّنُ فِيهَا الأَمِينُ وَيَنْطِقُ فِيهَا الرُّوَيْبِضَةُ قِيلَ وَمَا الرُّوَيْبِضَةُ قَالَ الرَّجُلُ التَّافِهُ فِى أَمْرِ الْعَامَّةِ. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘অচিরেই লোকদের উপর প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির যুগ আসবে। তখন মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী হিসাবে গণ্য করা হবে। আমানতের খিয়ানতকারীকে আমানতদার, আমানতদারকে খিয়ানতকারী হিসাবে গণ্য করা করা হবে এবং রুওয়াইবিযা হবে বক্তা। জিজ্ঞাসা করা হলো রুওয়াইবিযা কি? তিনি বলেন, নীচ প্রকৃতির লোক জনগণের হর্তাকর্তা হবে’।[1]
ফেৎনা থেকে সাধ্যমত বেঁচে থাকার জন্য রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ خَالِدِ بْنِ عُرْفُطَةَ قَالَ قَالَ لِى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَا خَالِدُ إِنَّهَا سَتَكُونُ بَعْدِى أَحْدَاثٌ وَفِتَنٌ وَاخْتِلاَفٌ فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُونَ عَبْدَ اللَّهِ الْمَقْتُولَ لاَ الْقَاتِلَ فَافْعَلْ খালেদ বিন উরফুত্বাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হে খালেদ! আমার পরে বহু অঘটন, ফেৎনা ও মতানৈক্য সৃষ্টি হবে। সুতরাং তুমি পারলে সে সময় আল্লাহর নিহত বান্দা হও এবং হত্যাকারী হয়ো না’।[2]  
আর ফেৎনা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দিলে ফেৎনা থেকে আত্মরক্ষার জন্য রাসূল (ছাঃ) কাঠের তরবারী বানিয়ে নিতে বলেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, سَتَكُونُ فِتَنٌ وَفُرْقَةٌ فَإِذَا كَانَ ذَلِكَ فَاكْسِرْ سَيْفَكَ وَاتَّخِذْ سَيْفاً مِنْ خَشَبٍ- ‘ভবিষ্যতে ফেৎনা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেবে। সুতরাং সে সময় এলে তুমি তোমার তরবারি ভেঙ্গে ফেলো এবং কাষ্ঠের তরবারি বানিয়ে নিয়ো’।[3]  ফেৎনা দেখা দিলে সর্বোত্তম কাজ হলো নিজ গৃহে অবস্থান করা। হাদীছে এসেছে, আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ফেৎনার সময় মানুষের নিরাপত্তার উপায় তার স্বগৃহে অবস্থান।[4]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَبِى بُرْدَةَ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى مُحَمَّدِ بْنِ مَسْلَمَةَ فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتْنَةٌ وَفُرْقَةٌ وَاخْتِلاَفٌ فَإِذَا كَانَ كَذَلِكَ فَأْتِ بِسَيْفِكَ أُحُدًا فَاضْرِبْهُ حَتَّى يَنْقَطِعَ ثُمَّ اجْلِسْ فِى بَيْتِكَ حَتَّى تَأْتِيَكَ يَدٌ خَاطِئَةٌ أَوْ مَنِيَّةٌ قَاضِيَةٌ. আবু বুরদাহ বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অচিরেই কলহ, অনৈক্য, বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধ ছড়িয়ে পড়বে। এ অবস্থা চলাকালে তুমি তোমার তরবারিসহ উহুদ পাহাড়ে আসো, তাতে আঘাত করো, যাতে তা ভেঙ্গে যায়। অতঃপর তুমি তোমার ঘরে বসে থাকো, যতক্ষণ না কোন বিদ্রোহী বা অনিষ্টকারী তোমাকে হত্যা করে বা তোমার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়’।[5]
হাদীছে আরো এসেছে,
عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُوْنَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم  عَنِ الْخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِىْ فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! إِنَّا كُنَّا فِىْ جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللهُ بِهَذَا الْخَيْرِ، فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ؟ قَالَ: نَعَمْ. قُلْتُ: وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ؟ قَالَ: نَعَمْ، وَفِيْهِ دَخَنٌ؟  قُلْتُ: وَمَا دَخَنُهُ؟ قَالَ: قَوْمٌ يَهْدُوْنَ بِغَيْرِ هَدْيِيْ، تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ. قُلْتُ: فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ؟ قَالَ: نَعَمْ، دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوْهُ فِيْهَا. قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! صِفْهُمْ لَنَا. قَالَ: هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا، وَيَتَكَلَّمُوْنَ بِأَلْسِنَتِنَا. قُلْتُ: فَمَا تَأْمُرُنِىْ إِنْ أَدْرَكَنِىْ ذَلِكَ؟ قَالَ: تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ : فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ: فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ، حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ، وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকজন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করত, আর আমি তাঁকে অকল্যাণের বিষয়াবলী জিজ্ঞেস করতাম এ ভয়ে যে, যেন অকল্যাণ আমাকে না পেয়ে বসে। একদা আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা তো অজ্ঞতা ও অকল্যাণের মাঝে ছিলাম। এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ কল্যাণের মাঝে নিয়ে আসলেন। এ কল্যাণের পর আবারও কী অকল্যাণ আসবে? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, এ অকল্যাণের পর কী আবার কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে এর মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল থাকবে। আমি বললাম, এর ধুম্রজাল কেমন? তিনি বললেন, তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা আমার হেদায়াত ব্যতীত অন্য পথে পরিচালিত হবে। তাদের পক্ষ থেকে সম্পাদিত ভাল কাজও দেখবে এবং মন্দ কাজও দেখবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে কল্যাণের পর কী আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা জাহান্নামের দিকে আহবান করবে। যে ব্যক্তি তাদের ডাকে সাড়া দিবে তারা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাদের কাছে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, তারা আমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি বললাম, যদি এমন অবস্থা আমাকে পেয়ে বসে তাহ’লে আমাকে কী করার নির্দেশ দেন? তিনি বললেন, তুমি মুসলমানদের জামা‘আত ও তাদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, তখন যদি মুসলমানদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, ‘তখন সকল দলমত ত্যাগ করে সম্ভব হ’লে কোন গাছের শিকড় কামড়িয়ে পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না সে অবস্থায় তোমার মৃত্যু উপস্থিত হয়’।[6]   
অন্যত্র এসেছে, قُلْتُ فَهَلْ مِنْ وَرَاءِ ذَلِكَ الْخَيْرِ شَرٌّ قَالَ: نَعَمْ. قُلْتُ: كَيْفَ؟ قَالَ: يَكُوْنُ بَعْدِىْ أَئِمَّةٌ لاَ يَهْتَدُوْنَ بِهُدَاىَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِىْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالٌ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِىْ جُثْمَانِ إِنْسٍ. قَالَ: قُلْتُ: كَيْفَ أَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنْ أَدْرَكْتُ ذَلِكَ، قَالَ: تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلأَمِيْرِ وَإِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَأُخِذَ مَالُكَ فَاسْمَعْ وَأَطِعْ ‘আমি বললাম, এ কল্যাণের পর কী আর কোন অকল্যাণ থাকবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, অবস্থা কেমন হবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন একদল শাসক হবে, যারা আমার হেদায়াত ও সুন্নাত অনুযায়ী চলবে না। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের মানব দেহে শয়তানের হৃদয় বিরাজ করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আমি সেই অবস্থার সম্মুখীন হই তাহ’লে কী করব? তিনি বললেন, ‘তুমি আমীরের কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে। যদিও তোমার পিঠে চাবুকের আঘাত পড়ে এবং তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়। তবুও তার কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করবে’।[7]
১৩. দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারণ : 
ইসলামকে সর্বত্র পৌঁছে দিতে দাওয়াত ও তাবলীগের বিকল্প নেই। প্রচারের কাজটি যত সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হয়, প্রসারের কাজটিও তত সহজ হয়। কুরআন ও হাদীছে এ বিষয়ে ব্যাপক তাকীদ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلْتَكُنْ مِّنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা প্রয়োজন, যারা (মানুষকে) কল্যাণের পথে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হবে সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِيْنَ ‘হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার নিকট যা নাযিল হয়েছে তা পৌঁছে দিন। আপনি যদি এরূপ না করেন, তাহ’লে আপনি রিসালাতের বাণী পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের নিকট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের পথ দেখান না’ (মায়েদা ৪/৬৭)। অন্যত্র বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘তোমরা নেকী ও কল্যাণের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর, কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে কাউকে সহযোগিতা কর না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’ (মায়েদা ৫/২)
যারা জানে অথচ মানুষকে জানায় না তাদের উপর আল্লাহ লা‘নত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَـئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ ‘আমি যে সমস্ত সুস্পষ্ট বিষয় ও হেদায়াতের বাণী মানুষের জন্য নাযিল করেছি, কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার পরও যারা (মানুষ থেকে) গোপন রাখে তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত’ (বাক্বারাহ ২/১৫৯)
এ ব্যাপারে হাদীছেও বিভিন্নভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اَلدِّيْنُ اَلنَّصِيْحَةُ قُلْنَا لِمَنْ قَالَ لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُوْلِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَامَّتِهِمْ ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা বা উপদেশ দেয়ার নাম। আমরা (ছাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ, তাঁর রাসূল, মুসলিম নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের জন্য’।[8]
উল্লেখ্য, আল্লাহর কল্যাণ কামনা দ্বারা তাঁর প্রতি খালেছ ঈমান আনা ও ইবাদত করা বুঝায়। রাসূলের কল্যাণ কামনার অর্থ হ’ল রাসূলের আনুগত্য করা। মুসলমান নেতাদের কল্যাণ কামনার মাধ্যমে ভাল কাজে তাদের আনুগত্য করা ও তাদের বিদ্রোহ না করা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ কামনা দ্বারা তাদের উপদেশ দেয়া বুঝায়। অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى إِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ছালাত প্রতিষ্ঠা, যাকাত প্রদান, নেতার আদেশ শোনা ও তাঁর আনুগত্য করা এবং প্রত্যেক মুসলমানকে উপদেশ দেয়ার শপথ গ্রহণ করলাম’। [9]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَلاَ حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ- ‘একটি আয়াত হ’লেও তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও। বনী ইসরাঈলের নিকট থেকে বর্ণনা কর, কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার উপরে মিথ্যারোপ করবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল’।[10] হাদীছটিতে দাওয়াতের গুরুত্ব ফুটে ওঠেছে। সেই সাথে এ বিষয়েও সাবধান করা হয়েছে যে, তাতে যেন মিথ্যার লেশমাত্র না থাকে। নতুবা তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।
বিদায় হজ্জের ভাষণেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একই নির্দেশ প্রদান করে বলেন, أَلَا لِيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ ‘উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়’।[11]
মানুষকে আল্লাহ্্র পথে আনার জন্যে নিজেদের মধ্যে আকাংখা থাকতে হবে। এজন্যে আল্লাহর তাওফীক প্রয়োজন। যাতে হক্বপন্থী ব্যক্তি মানুষকে হেদায়াতের পথে ডাকার জন্য নিজের ভিতর থেকেই উৎসাহ পান ও তাকীদ অনুভব করেন। এই সহজাত আকাংখা (Instinct) না থাকলে শত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি সমাজ সংস্কারে ব্যর্থ হবে।[12] দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভয় করা বা সংশয় রাখা যাবে না। কারণ মহান আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন মর্মে তিনি বলেন,لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى  ‘তোমরা ভয় করো না। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি সব কিছু শুনি ও দেখি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)
আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দানের বহুবিধ ফযীলত রয়েছে। যেগুলো পড়লে বা শুনলে মুমিন হৃদয় দাওয়াত দানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, শত ঝঞ্ঝাট উপেক্ষা করেও দাওয়াতী ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে উদ্বুদ্ধ হয়। দাওয়াতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ ‘কোন ব্যক্তি যদি ভালো কাজের পথ দেখায়, সে ঐ পরিমাণ নেকী পাবে, যতটুক নেকী পাবে ঐ কাজ সম্পাদনকারী নিজে’।[13]
খায়বার যুদ্ধের সেনাপতি আলী বিন আবু তালিবকে নছীহতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَوَاللهِ لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِداً خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম! তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটা তোমার জন্য লাল উটের (কুরবানীর) চেয়েও উত্তম হবে’।[14] 
উট ছিল আরব মরুর উৎকৃষ্ট বাহন ও উত্তম সম্পদ। তন্মধ্যে লাল উট ছিল আরো মূল্যবান। এজন্য হাদীছে লাল উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيئاً، وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ، لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئاً. ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে মানুষকে ডাকে তার জন্য ঠিক ঐ পরিমাণ ছওয়াব রয়েছে, যে পরিমাণ ছওয়াব পাবে তাকে অনুসরণকারীগণ। এতে অনুসরণকারীগণের ছওয়াব সামান্যতম কমবে না। আর যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার পথে কাউকে ডাকবে সে ঠিক ঐ পরিমাণ গোনাহ পাবে, যে পরিমাণ গোনাহ পাবে তাকে অনুসরণকারীগণ। এতে অনুসরণকারীদের গুনাহ সামান্যতম হ্রাস করা হবে না’।[15] 
১৪. ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির সোপান : 
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَإِنَّ هَذِهِ الأُمَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، يَعْنِي اَهْلَ الاَهْوَاءِ، كُلُّهاَ فِى النَّارِ اِلاَّ وَاحِدَةً وَهِىَ الْجَمَاعَةُ ‘নিশ্চয়ই এ উম্মত তিয়াত্তরটি দলে বিভক্ত হবে অর্থাৎ প্রবৃত্তির অনুসারীরা। একটি দল ব্যতীত তাদের সবগুলো জাহান্নামে যাবে। আর সেটি হ’ল জামা‘আত’।[16]  সুনান ইবনে মাজাহতে আওফ বিন মালেক আশজাঈ হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন,وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَتَفْتَرِقَنَّ أُمَّتِيْ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ فِرْقَةً، وَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِي النَّار،ِ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ! مَنْ هُمْ؟ قَالَ: الْجَمَاعَةُ ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন রয়েছে তাঁর কসম করে বলছি, ‘অবশ্যই আমার উম্মত তিয়াত্তরটি দলে বিভক্ত হবে। তার মধ্যে একটি দল জান্নাতে যাবে আর বাহাত্তরটি জাহান্নামে যাবে। বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তারা কারা? তিনি বললেন, জামা‘আত’।[17]
বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের চেয়ে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অধিকতর কল্যাণকর। আর এতে দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও পরকালে চিরস্থায়ী লাভবান হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحَبَّ دُنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ وَمَنْ أَحَبَّ آخِرَتَهُ أَضَرَّ بِدُنْيَاهُ فَآثِرُوا مَا يَبْقَى عَلَى مَا يَفْنَى ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, সে তার আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে ভালবাসবে, সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অতএব তোমরা ধ্বংসশীল বস্ত্তর উপরে চিরস্থায়ী বস্ত্তকে অগ্রাধিকার দাও’।[18]
শেষ কথা :
এ জগৎ সংসার ফেৎনা ও ফেৎনাবাজদের আড্ডাখানা। ধর্মীয় ফেৎনা, রাজনৈতিক ফেৎনা, অর্থনৈতিক ফেৎনাসহ নানামুখী ফেৎনায় এ সমাজ জর্জরিত। ফেৎনায় ফেৎনায় শান্তিময় পৃথিবী অশান্তির অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়েছে। বর্তমান যুগের ইলেকট্রনিক্স ফেৎনার কথা ভাবলে গা শিউরে উঠে। আসলকে নকল বানানোর বাস্তব সম্মত ফেৎনার যুগ এটি। দুনিয়াবী তুচ্ছ স্বার্থকে কেন্দ্র করে হানাহানি, রাহাজানি, ধোঁকাবাজি, মুনাফাখোরী, আমানতে খেয়ানত, পরস্পরে সন্দেহ এবং ধর্মীয় কোন্দল এখন চরমে। এমতাবস্থায় জামা‘আত বিহীন জীবনযাপন হলো ফেৎনাকে আলিঙ্গন করা এবং ধ্বংসের আস্তেকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া। নিশ্চয়ই একজন সচেতন মুমিন মুসলমানের জন্য এমনটি কখনো কাম্য নয়। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন!
——————————————-
[1]. আহমাদ হা/৭৯১২; ইবনে মাজাহ হা/৪০৩৬; হাকেম হা/৮৪৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৫০।
[2]. আহমাদ হা/২২৫৫২, ২২৪৯৯; হাকেম হা/৮৫৭৮; ত্বাবরানী হা/১৭০৩।
[3]. আহমাদ হা/২০৬৭১,২০৬৯০।
[4]. দাইলামী, ছহীহুল জামে হা/৩৬৪৯।
[5]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬২; আহমাদ হা/১৭৫২১; সিলসিলা ছহীহাহ  হা/১৩৮০।
[6]. বুখারী হা/৩৬০৬,৭০৮৪; মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[7]. মুসলিম হা/১৮৪৭; ছহীহাহ হা/২৭৩৯; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[8]. মুসলিম হা/১৯৬; আহমাদ হা/১৬৯৪; তিরমিযী হা/১৯২৬।
[9]. বুখারী হা/৫৭, ‘ঈমান’ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৯৯; আহমাদ হা/১৯১৯১।
[10]. বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া হা/৩৪৬১; আহমাদ হা/৬৪৮৬।
[11]. বুখারী হা/৬৫, ৪০৫৪, ৫১২৪, ৬৮৯৩।
[12]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত, পৃষ্ঠা নং- ২৭।
[13]. মুসলিম হা/৪৮৯৯, ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়; রিয়াযুছ ছালেহীন (বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ২০০০) ১/১৪৯, হা/১৭৩।
[14]. বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৭৫।
[15]. মুসলিম হা/৬৮০৪; রিয়াযুছ ছালেহীন ১/১৪৯, হা/১৭৪।
[16]. আবুদাউদ হা/৪৫৯৭; তিরমিযী হা/২৬৪১; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; ছহীহাহ হা/২০৩; ছহীহুল জামে‘ হা/১০৮২; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১২৪৩৫; মিশকাত হা/১৭১।
[17].  ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; ছহীহাহ হা/১৪৯২; যিলালুল জান্নাহ হা/৬৩।
[18].  আহমাদ হা/১৯৭১২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২৪৭; মিশকাত হা/৫১৭৯।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top