আত্ম-সম্মানবোধ

আত্মসম্মানবোধ বলতে বোঝায় আপনি নিজেকে যে সম্মানটা দেন সেটা। একজন মানুষ হিসেবে আপনি আবশ্যই সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত থাকবেন যে কোন বিষয়গুলো ঠিক আর কোনগুলো ভুল এবং কোন বিষয়গুলো করার মাধ্যমে আপনি সকলের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হবেন। সেক্ষেত্রে সেসকল ভালো কাজ করার মাধ্যমে সকলের সামনে নিজের সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেওয়া, নিজের সুরুচিগুলো অন্যের কাছে তুলে (অবশ্যই সেটা একান্তই কাজের মাধ্যমে, কোনো কথা বা অন্যকে ছোট করার মাধ্যমে নয়) ধরা এবং সকল ধরনের অন্যায়, খারাপ ও অসম্মানজনক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার নামই আত্মসম্মানবোধ।

অপরদিকে, আপনার যদি কোনো গুন বা অর্জন থাকে(রূপ, মেধা, ধন-সম্পত্তি, চরিত্র) এবং তা যদি অপরের কাছে তুলে ধরে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে চান বা নিজেকে অন্যদের চেয়ে ভালো/সেরা হিসেবে উপস্থাপন করতে চান, তাহলে সেটা হলো আত্ম-অহংকার।

আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)-এর মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, لِلۡفُقَرَآءِ الَّذِیۡنَ اُحۡصِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ ضَرۡبًا فِی الۡاَرۡضِ ۫ یَحۡسَبُهُمُ الۡجَاهِلُ اَغۡنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ ۚ تَعۡرِفُهُمۡ بِسِیۡمٰهُمۡ ۚ لَا یَسۡـَٔلُوۡنَ النَّاسَ اِلۡحَافًا ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیۡمٌ ‘(দান-ছাদাক্বাহ) সেসব দরিদ্রের জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় আটকে গিয়েছে, তারা যমীনে চলতে পারে না। (আত্মসম্মানবোধে বা লজ্জায়) না চাওয়ার কারণে অনবগত ব্যক্তি তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদেরকে চিনতে পারবে তাদের চি‎হ্ন দ্বারা। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে চায় না। আর তোমরা যে সম্পদ ব্যয় কর, অবশ্যই আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী’ (বাক্বারাহ ২/২৭৩)

ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল মূর্তিগুলো কে ভেঙ্গেছে? তখন তিনি বলেন, فَجَعَلَهُمۡ جُذٰذًا اِلَّا کَبِیۡرًا لَّهُمۡ لَعَلَّهُمۡ اِلَیۡهِ یَرۡجِعُوۡنَ ‘অতঃপর সে মূর্তিগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল তাদের বড় মূর্তিটি ছাড়া, যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে (আম্বিয়া ২১/৫৮)।

কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এখানে ‘তার দিকে’ বলে- كبيرهم বা তাদের প্রধান মুর্তিকে বোঝানো হয়েছে। অর্থ এই যে, তারা ফিরে এসে যখন সবগুলো মুর্তিকে খণ্ড বিখণ্ড এবং বড় মুর্তিকে আস্ত অক্ষত ও কাঁধে কুড়াল রাখা অবস্থায় দেখবে, তখন সম্ভবত: এই মুর্তিটির দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে এবং তাকে জিজ্ঞেস করবে যে, এরূপ কেন হল? আর তারা মনে করবে যে, বড় মূর্তিই বোধ হয় নিজের আত্মসম্মানবোধের কারণে ছোট ছোট মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে ফেলেছে। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

আসমা বিনত আবূ বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন যুবায়র (রাঃ) আমাকে শাদী করলেন, তখন তার কাছে কোন ধন-সম্পদ ছিল না, এমন কি কোন স্থাবর জমি-জমা, দাস-দাসীও ছিল না; শুধু মাত্র কুয়ো থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তাঁর উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম; কিন্তু ভাল রুটি তৈরি করতে পারতাম না। তাই আনসারী প্রতিবেশী মহিলারা আমার রুটি তৈরিতে সাহায্য করত। আর তাঁরা ছিল খুবই উত্তম নারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবায়রা (রাঃ) কে একখণ্ড জমি দিয়েছিলেন। আমি সেখান থেকে মাথায় করে খেজুরের আটি বহন করে আনতাম। ঐ জমির দূরত্ব ছিল প্রায় দু’মাইল। একদিন আমি মাথায় করে খেজুরের আটি বহন করে নিয়ে আসছিলাম। এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাত হল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কয়েকজন আনসারও ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে তাঁর উটের পিঠে বসার জন্য তাঁর উটকে আখ্‌! আখ্‌! বললেন, যাতে উটটি বসে এবং আমি তাঁর পিঠে আরোহণ করতে পারি।

আমি পরপুরুষের সাথে একত্রে যাওয়াকে লজ্জাবোধ করতে লাগলাম এবং যুবায়র (রাঃ) এর আত্মসম্মানবোধ এর কথা আমার মনে পড়ল। কেননা, সে ছিল খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যাক্তি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারলেন, আমি খুব লজ্জিত বোধ করছি। সুতরাং তিনি এগিয়ে চললেন। আমি যুবায়র (রাঃ) এর কাছে পৌঁছলাম এবং বললাম, আমি খেজুরের আটির বোঝা মাথায় নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আমার দেখা হয় এবং তাঁর সাথে কিছু সংখ্যক সাহাবী ছিলেন। তিনি তাঁর উটকে হাঁটু গেড়ে বসালেন, যেন আমি তাতে সওয়ার হতে পারি। কিন্তু আমি তোমার আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে লজ্জা অনুভব করলাম। এ কথা শুনে যুবায়র (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! খেজুরের আটির বোঝা মাথায় বহন করা তাঁর সাথে উটে চড়ার চেয়ে আমার কাছে বেশি লজ্জাজনক। এরপর আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর ঘোড়া দেখাশোনার জন্য আমাকে সাহায্যার্থে একজন খাদেম পাঠিয়ে দিলেন। এরপরই আমি যেন রেহাই পেলাম’ (বুখারী হা/৫২২৪)

আল্লাহর মধ্যে যে সকল গুণাবলী রয়েছে মানুষের মধ্যেও তা কম-বেশী রয়েছে। তাই তিনি আত্মসম্মনবোধ ব্যক্তি পছন্দ করেন। মুগীরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সা’দ ইবনু উবাদা (রাঃ) বলেছেন, যদি আমি আমার স্ত্রীর সাথে কোন পরপুরুষকে দেখি তাহলে আমি তাকে তরবারীর ধারালো দিক দিয়ে আঘাত করব। তার এ উক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে পৌছল। তখন তিনি বললেনঃ ‏ “‏ أَتَعْجَبُونَ مِنْ غَيْرَةِ سَعْدٍ، لأَنَا أَغْيَرُ مِنْهُ، وَاللَّهُ أَغْيَرُ مِنِّي ‏”‏‏.‏ তোমরা কি সা’দ এর আত্নমর্যাদাবোধে বিস্মিত হচ্ছ? আমি ওর চেয়েও বেশি আত্মসম্মানী। আর আল্লাহ আমার চেয়েও বেশি আত্নসম্মানের অধিকারী। (বুখারী হা/৬৮৪৬)

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলের আত্ম-মর্যাদা যথপোযুক্ত এবং সঠিক বুঝ দান করুন, আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top