লিলবর আল-বারাদী
ভূমিকা:
তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রাসূরকে প্রেরন করেছেন হিদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ সকল দিনের শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য। (সূরা সাফফাত-৯ ও ফাতহ-২৮)। দ্বীন ইসলাম সুপ্রতির্ষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রত্যেক জাতির জন্যে যুগে যুহে নবী রাসূল প্রেরিত হয়েছে । আমাদের আখেরী নবী (ছাঃ) উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য রহমত স্বরুপ। (আম্বিয়া-১০৭)। দ্বীন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম, অমানুষিক নির্যাতন, অকথ্য নির্যাতন নিরবে নিভৃতে সহ্য করেছেন । যদিও এ ব্যপারে মহান আল্লাহ হুঁসিয়ার উল্লেখ করে বলেন, আমি তো তোমাকে সমাত্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রুপে প্রেরন করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না (সাবা-২৮) কারোও উপর চড়াও হয়ে জবরদস্ত পূর্বক দ্বীন ইসলাম চাপিয়ে দেয়ার মত তাঁর আদর্শ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল (আরাফ-১৫৮) । অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাক, কেননা তুমি উপদেশকারী বৈ আর কিছুই নও, তোমাকে তকাদের উপর জবরদস্তকারী করে প্রেরণ করা হয়নি (গাশিয়া)।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রুর পরিণাম আলোচনার পূর্বে নবী (ছাঃ) এর চরিত্র ও নবুওয়াত সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
রাসূলের চরিত্র মাধূর্য্যঃ
রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) এর চরিত্র হল কুরআন। মহান আল্লাহ বলেন- রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে। (আহযাব-২১) রাসূলের চরিত্র সম্পর্কে ফ্রান্সের প্রফেসর সেডইউ বলেন, নবী (ছাঃ) ছিলেন হাস্যমুখ ও মিশুক স্বভাবের। তিনি প্রায়ই নীরব থাকতেন এবং অধিকংশ সময় আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকতেন। বাজে কথা হতে তিনি দুরে থাকতেন এবং অশ্লীললতাকে তিনি ঘৃনা করতেন। তিনি ছিলেন সঠিক মত ও উত্তম জ্ঞানের অধিকারী।
অধিকাংশ নবীগন বিভিন্ন প্রকার মুজিযা প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) এর মুজিযা ছিল তাঁর চরিত্র। তিনি মানুষের অন্তরসরূহে পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতেন এবং আত্মাকে পবিত্র দিতেন চরিত্রের মাধূর্য দিয়ে। এ সম্পর্কে শাহ ওয়ালী উল্লাহ লিখেছে, “যে কোন ব্যক্তি যখন নবী (ছাঃ) এর সামনে এক বার আসত, সে ভীত হয়ে পড়ত। আর যে কেউ পাশে এসে বসতো সে প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে যেত।
তাঁর পবিত্র ব্যাক্তিত্বে যে উত্তম চরিত্র বিদ্যমান তা অধিকাংশ নবীদের চরিত্র মাধূর্যের নির্যাস। হযরত মূসা (আঃ) এর মত শাসনকর্তা, হারুনের ন্যায় ইমামতের অধিকারী, নূহের মত দ্রুততা, ইব্রাহীমের ন্যায় অন্তরের কোমলতা, ইউসুফের মত ক্ষমাশীলতা, দাউদের ন্যায় অসংখ্য বিজয়, ইয়াকুবের মত বিনয় নম্রতা, ইয়াহইয়ার ন্যায় সাধুতা, ইসমাঈলের মত আত্মার পবিত্রতা, ইত্যাদি গুণের একত্র সমাবেশ ঘটেছিল।
রাসূলের নবুওয়াতের সার্বিক মাহাত্ম্যঃ-
যে ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ) এর পবিত্র জীবনী নিয়ে চিন্তা গবেষনা করবে, সে তাঁর নবুওয়াতের মধ্যে সমস্ত নবীর মাহাত্ম্য দৃষ্টিগোচর হবে। তিনি ঈসা (আঃ) এর মত অবিশ্বাসকৃত ও অত্যাচারের শিকার হন এবং আল্লাহ্র ঘরের মর্যাদা নতুন ভাবে জাগিয়ে তোলেন। ইয়াহইয়ার মত লোকালয়ে ও মরুভূমিতে আল্লাহর আওয়াজ পৌঁছে দেন। আইয়্যুবের ধৈর্য্য ও সহনশীলতার সাথে শাবে আবু তালিবে তিন বছর পর্যন্ত বন্ধীত্বের জীবন যাপন করেন। নূহের মত স্বীয় সম্প্রদায়ের ধর্মদ্রোহী লোকদের কাছে গোপনে ও প্রকাশ্যে নির্জনে ও সমাবেশে , পাহাড়ে ময়দানে ইসলামের দাওয়াতে পৌছাতে থাকেন এবং জনগনের মনে তাদের দুষাকর্মের প্রতি ঘৃনা সৃষ্টি করেন। ইবরাহীম (আঃ) এর ন্যায় অবাধ্য সম্প্রদায় হতে পৃথক হয়ে যায় এবং মরুভূমি ত্যাগ করে আসলামের পবিত্র বৃক্ষ রোপনের উদ্দেশ্যে হিজরত করেন এবং দাউদ (আঃ) এর মত শত্রুদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। ইউনুস (আঃ) যেমন মাছের পেটে তিনদিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। সারে সত্তর পর্বতের গুহায় তিনদিন থেকে তিনি মদিনায় পৌঁছে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মূসা (আঃ) যেমন বনী ইসরাঈলকে মিসরের ফেরাউনের দাসত্ব হতে মুক্ত করেছিলেন, তেমনি উত্তর আরবকে তিনি কন্স্টান্টিনোপলের শাসনের নাগপাশ হতে পূর্ব আরবকে ইরানের বাদশাহ্ কিস্রার গোলাপী হতে মুক্ত করেন। সুলাইমান (আঃ) যেমন ফিলিস্তিনে আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঘর নির্মান করেন, তেমনি তিনিও মদীনায় আল্লাহর ঘর তৈরী করেন। আল্লাহ ও তাঁর শত্রুদের শেষ পরিনতি সম্পর্কে নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইন্শায়াল্লাহ।
আবু লাহাব ও তার পরিবার কর্তৃক নির্যাতনঃ
আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) কম বেশী সকল কাফের মুশরেক নেতাদের পক্ষ থেকে নির্যাতিত হয়েছে। কন্মদ্ধে আবু লাহাব অন্যতম। আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আব্দুল ওয্যা। সে ছিল আব্দুল মোত্তালিবের অন্যতম সন্তান। গৌর বর্নের কারনে তার নাম হয়ে যায় আবু লাহাব। পবিত্র কুরআনে তার আসল নাম বর্জন করা হয়েছে। কারণ সেটা মুশরিক সূলভ আচরণ। তাছাড়া আবু লাহাবের ডাক নামের মধ্যে জাহান্নামের সাথে বেশ মিলও রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর আপন চাচা ও ঘনিষ্ট প্রতিবেশীও। তার পরেও সে নবী (ছাঃ) কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ নান রকম যন্ত্রনাদায়ক নির্যাতনের ব্যবস্থা করত।
একদা নবী (ছাঃ) সা’ফা পাহাড়ের উপর উঠে আওয়াজ দিরেন যে, ইয়া ছাবাহাহ্ অর্থাৎ হায় সকাল। এ আওয়াজ শুনে কোরারেশ গোত্রসমূহ তাঁর কাছে সমবেত হল। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে। নবী করিম (ছাঃ) পাহাড়ের উপর আরহন করে আওয়াজ দিলেন, হে বনি ফিহর, সকল নেতৃস্থানীয় লোক একত্রিত হ’ল। যে পরেনি সে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে কি ব্যাপার জানার জন্য। কোরায়েশরা এসে হাজির হ’ল, আবু লাহাবও তাদের সাথে ছিল। এরপর তিনি নবী (ছাঃ) বললেন, তোমরা বলো যদি আমি বলি যে, পাহাড়ের ওদিকের প্রান্তরে একদল ঘোড়া সওয়ার আত্ম গোপন করে আছে। ওরা তোমাদের উপর হামলা করতেদ চায়, তোমরা কি সে কথা কিশ্বাস করবে? সকলে বলল হ্যাঁ বিশ্বাস করব, কারণ আপনাকে আমরা কখনও মিথ্যে বলতে শুনিনি। নবী (ছাঃ) বললেন শোন, আমি তোমাদেরকে ভয়াবহ আযাবের ব্যাপারে সাবধান করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।
আবু লাহাব বলল, তুমি ধ্বংশ হও। তুমি আমাদের কে একথা বলার জন্য এখানে ডেকেছে।
আবু লাহাবের একথা বলার পর আল্লাহ তা’আলা সূরা লাহাব নায়িল করেন। এতে বরা হয় আবু লাহাবের দু’টি হাত ধ্বংশ হোক এবং সে নিজেও ধ্বংশ হোক।
অন্যত্র রয়েছে. সা’ফা পাহাড়ের পাদদেশে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর নবী (ছাঃ) কে মারার জন্য আবু লাহাব আকটি পাথরও তুলেছিল।
ওাসূল (ছাঃ) এর নবুওয়াত পাওয়ার পূর্বে আবু লাহাব তার দুই পুত্র ওতবা ও ওতাইবাকে নবী (ছাঃ) এর তনয়াদ্বয় রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) নবুওয়াত পাওয়ার পর ও দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের শুরুতে (রাসূল (ছাঃ) কে কষ্ট দিতে) আবু লাহাব দুই নবী কন্যাকে ত্বালাক্ব দিতে তার পুত্রদ্বয়কে বাধ্য করেছিলেন।
ওাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহর ইন্তে কালের পর আবু লাহাব এত বেশী খুশি হয়েছিল এবং গদগদ করে বলেছিল যে, মোহাম্মদ অপুত্রক হয়ে গেছে।
আবু লাহাব হজ্ব মৌসূমে নবী (ছাঃ) কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার জন্য বাজারে এবং বিভিন্ন জনাসমাবেশে তাঁর পেছনে লেগে থাকত। তারেক ইবনে আব্দুল্লাহ মুহাবেরীর বর্ননা মতে, আবু লাহাব নবী (ছাঃ) এর কথা মিথ্যা প্রমান করার জন্যই শুধু ব্যস্ত থাকত না বরং তাঁকে পাথরও নিক্ষেপ করত। এতে তাঁর পায়ের গোড়ালী রক্তাক্ত পয়ে যেত।
আবু লাহাবের মৃত্যু অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক ও জঘন্য। বদর যুদ্ধের সাত দিন পর তার গলায় প্লেগর ফোঁড়া দেখা যায় সংক্রমনের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে নির্জন জায়গায় ছেড়ে আসে। শেষ পর্যন্ত তার মরাদেহ কেউ স্পর্ষ করেনি। পঁচতে শুরু করলে চাকর বাকর দ্বারা পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে গিয়ে মাটিতে পূঁতে ফেলা হয়।
অন্যত্র আছে, আবু রাফে বলেন, আমি বললাম আল্লাহর কসম বদর যুদ্ধের মাঠে ফেরেশতা ছিলেন। এ কথা শুনে আবু লাহাব আমার গালে সজোরে চড় দিল। আমি তার সাথে লেগে গেলাম। সে আমাকে তুলে আছাড় দিল। এরপর প্রহার করতে লাগলেন। আমি ছিলাম দুর্বল। ইতিমধ্যে উ¤মূল ফযল উঠে তাঁবুর একটি কঞ্চি দিয়ে আবু লাহাবকে প্রহার করতে লাগলেন। আবু লাহাব আঘাত পেল। উ¤মূল ফযল তাকে আঘাত করতে করতে বলছিলেন। ওর কোন মালিক নেই এজন্য তাকে দুর্বল মনে করছ? আবু লাহাব অপমানিত হল এবং চলে গেল। এই ঘটনার পর মাত্র সাত দিন পর আবু লাহাব প্লেগে আক্রান্ত হল এবং সে রোগে প্রাণ ত্যাগ করল। প্লেগের গুটিকে আরবে অপয়া মনে করা হত। মৃত্যুর পর তিনদিন পর্যন্ত আবু লাহাবের লাশ পড়ে রইল। তাঁর সন্তানেরাও তার কাছে গেল না। কেহ তার দাফনের ব্যবস্থা করেনি। তার সন্তানরা তিন দিন পর ভেবে দেখল যে, এভাবে মৃত দেহ পড়ে থাকলে অন্য লোকেরা তাদের নিন্দা সমালোচনা করবে। তখন তারা একটি গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তে কাঠের মাধ্যমে ধাক্কা দিয়ে লাশ ফেলে দিল। তারপর দুর থেকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিল।
আবু লাহাবের স্ত্রীও রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) কে অনেক গালমন্দ করেছে। এ জন্যে শত্রুতার সোত্রে তার স্বামীর চেয়ে সে কোন অংশে কম ছিল না। তার নাম ছিল আবওয়া, ডাক নাম উম্মে জামিল। হাবর ইবনে উমাইয়ার কন্যা ও আবু সুফিয়ানের বোন ছিল। এই মহিলা মহানবী (ছাঃ) এর চলার পথে এবং তার দরজায় কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। অত্যন্ত অশ্লীল ঝগড়াটে স্বভাবের ছিল।
আবু লাহাবের স্ত্রী যখন জানতে পারল যে, তার স্বামীর নিন্দা করে কুরআন নাযিল হয়েছে, তখন সে রাসূল (ছা:) কে খুঁজতে-খুঁজতে কাবা শরীফের কাছে এলো। সে সময় নবী (ছাঃ) কাবা ঘরের সামনে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে হযরত আবু বকরও ছিলেন। আবু লাহাবের স্ত্রীর হাতে এক মুষ্ঠি পাথর ছিল। আল্লাহর রাসূলের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুলে আল্লাহ তাআলা তার দৃষ্টি কেড়ে নেন। সে নবী (ছাঃ) কে দেখতে পাচ্ছিল না । কিন্তু আবু বকর (রাঃ) কে দেখতে পাচ্ছিল। তাঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল যে, তোমার সাথী কোথায়। আমি শুনেছি, তিনি আমার নামে নিন্দা করছেন। আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে পেয়ে যাই, তবে তাঁর মুখে এ পাথর ছুঁড়ে মারব। আল্লাহর শপথ আমি াকেজন কবি। এরপর সে কবিতা শুনাল ‘মুযাম্মাম’ এর অবাধ্যতা করছি, তাঁর কাজকে সমর্থন করিনি এবং তাঁর দ্বীনকে ঘৃনা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। এরপর সে চলে গেল।
হযরত আবু বকর (রাঃ) নবী কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? জবাবে তিনি বললেন না দেখতে পায়নি। আল্লাহ আমার জন্য তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে ছিলেন।
আবু বকর রাযযারও এ ঘটনা বর্ননা করেছেন। তিনি একটু সংযোজন করেছেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রীহযরত আবু বকর (রাঃ) এর সামনে গিয়ে একথাও বলেছিল যে, আপনার সঙ্গি আমার নিন্দা করেছেন। আবু বকর (রাঃ) বললেন, এ কথা ঠিক নয়। এই ঘরের প্রতিপালকের শপথ, তিনি কবিতা রচনা করেন না এবং কবিতা মুখেও উচ্চারণ করেন না। আবু লাহাবের স্ত্রী বলল আপনি ঠিকই বলেছেন।
তারা রাসুল (ছাঃ) এর প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নানা প্রকার কষ্ট দিত। রাসুল (ছাঃ) যখন সালাত আদায় করতেন তখন বকরির নাড়িভূড়ি এমনভাবে ছুঁড়ে মারত যে, সেসব গিয়ে তাঁর গায়ে পড়ত। আবার কখনও কখনও উনুনের ওপর হাঁড়ি চাপানো হলে সে হাঁড়িতে নিক্ষেপ করত। রাসূল (ছাঃ) তাদের অত্যাচারে ঘরের ভেতরে নিরাপদে সালাত আদায় করার জন্য একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন। রাসুল (সাঃ) তাদের নিক্ষিপ্ত নাড়িভূড়ি একটি কাঠির মাথায় নিতেন এবং দরজায় দাঁড়িয়ে বলতেন, হে বনু আবদে মান্নাফ এটা কেমন ধরনের প্রতিবেশী সূলভ ব্যবহার। এরপর নাড়িভূড়ি ফেলে দিতেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদেরকে কষ্ট দেয়ার জন্য আবু লাহাবের স্ত্রী পরোক্ষ নিন্দা কাজের সাথে জড়িত ছিল। শুষ্ক কাঠ একত্রিত করে যেমন কেউ অগ্নি সংযোগের ব্যবস্থা করে, পরোক্ষ নিন্দা কাজটিও তেমন। সে জাহান্নামের যাক্কুম বৃক্ষ থেকে লাকড়ি এনে জাহান্নামে তার স্বামীর উপর নিক্ষেপ করবে। যাতে অগ্নি আরও প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে। যেমন দুনিয়াতেও সে স্বামীকে সাহায্য করে তার কুফর ও যুলুম বাড়িয়ে দিত।
একদিন আবু লাহাবের পুত্র ওতাইবা রাসূল (ছাঃ) এর কাছে এসে বলল- নমাত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সাথী পথ ভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি (নাজমঃ১-২)। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হল। অতিব নিকটে গেল। এরপর ওতাইবা রাসূল (ছাঃ) এর উপর অত্যাচার শুরু করল। তাঁর জামা ছিঁড়ে দিল এবং তাঁর পবিত্র চেহারা লক্ষ্য করে থুথু নিক্ষেপ করল। কিন্তু থুূথু রাসুল (ছাঃ) এর চেহারা মোবারকে পড়েনি। সে সময় নবী (ছাঃ) বদ দোয়া দিলেন। তিনি বলেছিলেন “ হে আল্লাহ! ওর উপর তোমার কুকুর সমূহের মধ্যে হতে এক কুকুর লেলিয়ে দাও।” তাঁর এ বদদোয়া কবুল হয়েছিল।
ওতাইবা একবার কোরায়েশ বংশের কয়েকজন লোকের সাথে একসময় সিরিয়া যাচ্ছিল। যারকা নামক জায়গায় তারা এক রাত্রী যাপনের জন্য তাঁবু স্থাপন করল। সে সময় একটি বাঘকে ঘোরাফেরা করতে দেখে ওতাইবা বলল, হায়রে আমার ধ্বংশ। আল্লাহর শপথ! অনিবার্য এই বাঘ আমাকে খাবে। মোহাম্মদ (ছাঃ) আমার উপর বদ দোয়া করেছেন। দেখো আমি সিরিয়ায় আছি। অথচ তিনি মক্কায় বসে আমাকে মেরে ফেলছেন। সতর্কতা হিসেবে সফর সাথিরা তখন ওতাইবাকে নিজেদের মাঝখানে রেখে শয়ন করলে রাত্রীকালে বাঘ এলো এবং সবাইকে ডিঙ্গিয়ে ওতাইবার কাছে গেল ও তার ঘাড় মটকাল। এভাবে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের শত্রুদের কে ধ্বংস করেছিল।
আবু জেহেল কর্তৃক অত্যাচারের পরিণতিঃ
ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রুট্টবিশ্ব বিখ্যাত তাগুত। এ উম্মতের ফেরাউন হল আবুজেহেল। তার মূল নাম আমর ইবনে হিশাম। জাহেলিয়াতের যুগের জাহেলরা (মূর্খরা) তার উপাধি দিয়েছিল আবুল হাকাম। অর্থাত জ্ঞানীর পিতা। অবশেষে তার নির্বুদ্ধিতা আচরনের কারনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার নাম রাখেন আবু জেহেল। অর্থাত মূর্খের পিতা।
আবু জেহেল প্রথম দিনে নবী করিম (ছাঃ) কে ছালাত আদায় করতে দেখে তাঁকে ছালাত থেকে ফিরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। একবার রাসূল (ছাঃ) মাকামে ইবরাহীমের কাছে ছালাত আদায় করছিলেন। আবু জেহেল সে পথে যাচ্ছিল এবং বলল, হে মোহাম্মদ! আমি কি তোমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করিনি? সাথে সাথে সে হুমকিও দিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হুমকি দিয়ে জবাব দিলেন। এরপর আবু জেহেল বলল, মোহাম্মদ আমাকে কেন ধমক দিচ্ছে? দেখনা এই মক্কায় আমার মজলিস সবচেয়ে বড়। নবী (ছাঃ) আবু জেহেলের গলার কাছের চাদর ধরে বললেন, “দুর্ভোগ, তোমর জন্য দুর্ভোগ। আবারও দৃর্ভোগ তোমার জন্য দুর্ভোগ। একথা শুনে আবু জেহেল দাম্ভিকতার সুরে বলল, হে মোহাম্মদ! আমাকে হুমকি দিচ্ছ? করতে পারবে না। মক্কার উভয় পাহাড়ের মাঝে চলাচলকারীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কোরায়েশ সরদারদের নিকটে একদিন আবু জেহেল বলল, মোহাম্মদ আপনাদের সামনে নিজের চেহারায় ধূলো লাগিয়ে রাখে কি? কোরায়েদের সরদাররা বলল-হ্যাঁ। আবু জেহেল বলল, রাত ও ওযযার শপথ; আমি যদি তাঁকে এ অবস্থায় দেখি তবে তাঁর ঘাড় ভেঙ্গে দেব, তাঁর চেহারা মাটিকে হেঁচড়াব। এরপর রাসূল (ছাঃ) কে ছালাত আদায় করতে দেখে তাঁর ঘাড় মটকে দেয়ার জন্য সে অগ্রসর হল। কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখল যে, আবু জেহেল চিৎপাত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছে এবং চিৎকার করে বলছে বাঁচাও বাঁচাও। তার পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, আবুল হাকাম তোমার কি হয়েছে? সে বলল আমি দেখলাম আমার ও মোহাম্মাদের মধ্যখানে আগুনের একটি পরিখা। ভয়ভহ সে আগুনের পরিখায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। রাসূল (ছাঃ) এ কথা শুনে বললেন, যদি সে আমার কাছে আসত তবে ফেরেশতা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিড়ে ফেলত।
একবার আবু জেহেল বলেছিল, হে কোরায়েশ ভায়েরা, আপনারা লক্ষ্য করেছেন, মোহাম্মদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা ও উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না। আমাদের পিতা ও পিতামহকে সারাক্ষন গালমন্দ দিয়েই চলেছে। এ কারনে আমি আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আমি একটি ভারী পাথর নিয়ে বসে থাকব, মোহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে, তখন সে পাথর দিয়ে তাঁর মাতা চূর্ন বিচূর্ন করে দেব। এরপর যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত। ইচ্ছে হলে আপনারা আমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবেন, ইচ্ছে হলে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। এরপর আবদে মান্নাফ আমার সাথে যেরূপ ইচ্ছে ব্যাবহার করবে এতে আমার কোন পরোয়া নেই। কোরায়েশরা ক্ষ প্রস্তাব শুনার পর বলল, কোন ব্যাপারে আমরা তোমাকে বান্বধবহীন অবস্থায় ফেলে রেখেছি? তোমাকে পূর্নাঙ্গ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তুমি যা করতে চাও করতে পার। সকালে আবু জেহেল একটি ভারি পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর অপেক্ষায় বসে থাকল। কোরায়েশরা একে একে সমবেত হয়ে আবু জেহেলের কর্মতৎপরতা দেখার জন্য উৎকন্ঠিত হয়ে রইল। রাসূল (ছাঃ) যথারীতি হাযির হয়ে ছালাত আদায় করতে শুরু করলেন। তিনি যখন সেজদায় গেলেন, তখন আবু জেহেল পাথর নিয়ে অগ্রসর হল। কিন্তু পরোক্ষনে ভীত সন্ত্রস্থ অবস্থায় ফিরে এলো, তার হাত যেন পাথরের সাথে আটকে রইল।
কোরায়েশদের কয়েকজন লোক তার কাছে এসে বলল, আবুল হাকাম তোমার কি হয়েছে? সে বলল আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম তা করকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পৌঁছাতে দেখতে পেলাম মোহাম্মদ এবং আমার মাজখানে একটা উট এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর কসম, কখনো অত বড় লম্বা ঘাঁড় ও দাঁতবিশিষ্ট উট দেখনি। উটটি আমার উপর হামলা করতে চাচ্ছিল।
এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, উটে ছদ্দবেশে তিনি ছিলেন হযরত জিব্রাইল (আঃ)। আবু জেহেল যদি কাছে আসত তবে তাকে পাকড়াও করা হত।
আবু জেহেল একদিন সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গালমন্দ করে ও শাসিয়ে দেয়। রাসূল (ছাঃ) নিরব রইলেন, কোন কথা বললেন না। দুর্বৃত্ত আবু জেহেল এরপর নবী (ছাঃ) এর মাথায় এক টুকরো পাথর নিক্ষেপ করলো। এতে মাথা ফেটে রক্ত বের হল। আবু জেহেল এরপর কাবার সামনে গিয়ে কোরায়েশদের মজলিসে গিয়ে বসল। আব্দুল্লাহ্ ইবনে জুদয়ানের একজন দাসী এ দুশ্য প্রত্যক্ষ করল। হযরত হামযা শিকার করে ফিরছিলেন। সেই দাসী তাঁকে সব কথা শুনালেন। হযরত হামযা (রাঃ) সবকথা শুনে ক্রোধে অস্তির হয়ে উঠলেন। তিনি ছিলেন কোরায়েশদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক। তিনি দেরী না করে সামনে পা বাড়িয়ে বললেন, আবু জেহেলকে যেখানে পাব সেখানেই আঘাত করব। এরপর তিনি সোজা কা’বা ঘরে আবু জেহেলের সামনে গিয়ে বললেন, ওরে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু ত্যাগকারী তুই আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছিস, অথচ আমিও ও তো তাঁর প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী। এ কথা বলে হাতের ধনুক দিয়ে আবু জেহেলের মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে মাথা বিশ্রি ধরনের জখম হয়ে গেল। এ ঘটনার সাথে সাথে আবু জেহেলের গোত্র বনু মাখযুম এবং হযরত হামযা (রাঃ) এর গোত্র বনু হাশেমের লোকেরা পরষ্পরের বিরুদ্ধে খড়গোহস্ত হয়ে উঠলো। আবু জেহেল সকলকে এই বলে থামিয়ে দিল যে, আবু আমারকে কিছু বললা আমি তাঁর ভাতিজাকে আসলেই খুব খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছিলাম।
আবু জেহেল এত নির্লজ্জ ছিল যে, হযরত আম্মারের মা সুমাইয়া (রা:) এর লজ্জা স্থানে সে বর্শা নিক্ষেপ করে। এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম মহিলা শহীদ।
আবু জেহেল রাসূল (ছাঃ) কে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করার পরিণাম বদর প্রান্তরে এমন ভয়াবহ হবে তা ভাবতে পারেনি। দুর্বৃত্ত নেতার চারিদিকে ছিল তীর ও তলোয়ার বাহিনীর পাহারা। মুসলিম মুজাহিদের প্রচ হামলায় সেই পাহারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মুসলমানরা লক্ষ করলেন যে, আবু জেহেল একটি ঘোড়ার পিঠে সোয়ারী। তার মৃত্যু তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল।
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন বদর যুদ্ধের দিনে আমি মুসলমানদের কাতারের মধ্যে ছিলাম। হটাৎ লক্ষ্য করে দেখি আমার ডানে বাঁয়ে দুজন আনসার কিশোর। তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আমি চিন্তা করছিলাম। হটাৎ একজন চুপিসারে বলল, চাচাজান আবু জেহেল কে? তা আমাকে দেখিয়ে দেন। আমি বললাম, তুমি তার কি করবে? সে বলল, আমি শুনেছি সে নাকি প্রিয় নবীকে গালি দিয়ে কষ্ট দেয়। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, যতক্ষন পর্যন্ত তার সাথে লড়ে যাব।
বর্নণাকারী একথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন। অন্য আনসার কিশোর চুপিসারে একই কথা বলল। কয়েক মূহুর্ত পরে আমি আবু জেহেলকে রোকদের মাঝে বিচরন করতে দেখছিলাম। আমি আনসার কিশোরদ্বয়কে বললাম, ঐ দেখো তোমাদের শিকার। যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ। এ কথা শুনামাত্র উভয়ে আবু জেহেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে ফেলল।
এরপর তারা নবী করিম (ছাঃ) এর নিকটে এসে উপস্থিত হলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমদের মধ্যে কে আবু জেহেলকে হত্যা করেছ? উভয়ে বলল, আমি করেছি, আমি হত্যা করেছি। তিনি (ছাঃ) বললেন, তোমরা কি তরোয়ারের রক্ত মুছে ফেলেছ? তারা বলল না মুছে ফেলেনি। নবী (ছাঃ) তাদের তলোয়ার দেখে বললেন, তোমরা উভয়েই হত্যা করেছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু জেহেলের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র আ’ম ইবনে আমর উবনে জামুহ কে প্রদান করলেন। উভয় কিশোরের নাম ছিল মা’য ইবনে আমর ইবনে জামুহ-কে প্রদান করলেন। উভয় কিশোরের নাম ছিল মা’য ইবনে আমর ইবনে জামুহ ও অপর জনের নাম মাউয ইবনে আরফা।
অন্যত্র আছে, মায ইবনে আমর ইবনে জামুহ বলেছেন, আবু জেহেল কাফেরদের তীর তলোয়ার দুর্বেদ্য পাহারার ভেতর বিচরন করছিলেন। কাফেররা বলছিল, আবু জেহেলের নিকটে কেউ যেন পৌঁছাতে না পারে। মা’য ইবনে আমর বলেন একথা শুনে আবু জেহেলকে চিনে রাখলাম এবং তার কাছাকাছি থাকতে লাগলাম। সুযোগ পাওয়া মাত্রই আমি তার উপর হামলা করলাম। আর সেই আঘাতে তার পা হাটুর নীচে দিয়ে আলাদা হযে গেল। এ দিকে আবু জেহেলকে আঘাত করলাম, ওদিকে তার পুত্র একরামা আমার কাঁধ বরাবর তরবারি দিয়ে আঘাত করলো। কর্তিত হাত পেছনে রেখে অপর হাতে তরবারি চালিয়ে গেলাম। কিন্তু এতে বেশ অসুবিধা হতে লাগল। তখন আমি হাতের কর্তিত অংশ পায়ের নিচে রেখে এক ঝটকায় হাত থেকে পৃথক করে ফেললাম। এরপর আবু জেহেলের নিকটে মাউস ইবনে আফরা পৌঁছলেন। তিনিও ছিলেন আহত। তিনি আবু জেহেলের উপর এমন আঘাত করলেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমন সেখানেই ঢরে পড়লো। আবু জেহেলের শেষ নিঃশ্বাস তখনও বেরিয়ে যাইনি। শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল করছিল। এরপর হযরত মাউস ইবনে আফরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেল।
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আবু জেহেলের শেষ পরিনাম কে দেখবে দেখে এসো। সাহাবারা তখন আবু জেহেলের সন্ধান করতে লাগলো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আবু জেহেলকে এমতাবস্থায় পেলেন যে, তার নিঃশ্বাস চলাচল করছিল। তিনি তার দেহ হতে মাথা আলাদা করার জন্য দাড়ি ধরে বললেন, ওরে আল্লাহর দুশমন, শেষপর্যন্ত মহান আল্লাহ তোকে অপমান অসম্মান করলেন তো? আবু জেহেল বলল, কিভাবে আমাকে অসম্মান করলেন? তোমরা যাকে হত্যা করেছ তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কেউ আছে নাকি? তার চেযে আর বড় কে? আহ্ আমাকে যদি কৃষক ছাড়া ান্য কেউ হত্যা করত। এরপর বরতে রাগল বরতো আজ বিজয়ী হয়েছে কারা? ইবনে মাসউদ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল। তিনি আবু জেহেলের কাঁধে পা চাপা দিয়ে ছিলেন। আবু জেহেল তাঁকে বলল, ওরে বকরির রাখাল তুই অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে গেছিস।
এসব কথোপকথনের পর হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আবু জেহেলের মাথা কেটে রাসূল (ছাঃ) এর সামনে হাযির করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এই হচ্ছে আল্লাহ্র দুশমন আবু জেহেলের দ্বিখন্ডিত মাথা। নবী (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ সত্যই সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ব্যতিত কোন মা’আবুদ নেই। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা সুমহান। সকল প্রসংশা কেবল তাঁরই জন্য নিবেদিত। তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি সত্য করে দেখিয়েছেন এবং নিজের বান্দ দের সাহায্য ও একাকী সকর দলকে পরাজিত করেছেন।
এরপর নবী (ছাঃ) বললেন, চলো আমাকে তার লাশ দেখাও। আমরা রাসূল (ছাঃ) কে আবু জেহেলের লাশের নিকটে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ও হচ্ছে এই উম্মাতের ফেরাউন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু জেহেল, ওতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওলীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং উকবা ইবনে আবু মুঈত্বসহ অন্যান্য কাফেরের নাম ধরে ধরে বদদোয়া করেছিলেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এর সকল কাফেরের নাম উচ্চারন করে বদদোয়া করেছিলেন। আমি দেখেছি বদরের কুয়ায় তাদের সবার লাশ পড়ে আছে।
এভাবে আবু জেহেলের মত চরম দুর্বৃত্তের শেষ পরিণতি ঘটে। দুনিয়ার জীবন মৃত্যু আচ্ছাদন করে পরোকালীন জাহান্নামের ভয়াভহ জীবনের সূচনা ঘটে।
খলফের পুত্রদ্বয় কর্তৃক কটুক্তি ও নীপিড়নঃ
উমাইয়া ও উবাই ছির খারফের পুত্রদ্বয়। তারা নানাভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে কষ্ট দিত। উমাইয়ার অভ্যাস ছিল যে যখন রাসূল (ছাঃ) কে দেখত, তখনই কটুক্তি করত, তাঁকে অভিশাপ দিত। মহান আল্লাহ্ তার সম্পর্কে বলেন, “ধূর্ভোগ প্রত্যেকের যে সামনে ও পেছনে লোকের নিন্দা করে।” ইবনে হিশাম বলেন, হুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগালি দেয এবং চোখ বাঁকা করে ইশারা করে।“হুমাযা” সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে পশ্চাতে মানুষের নিন্দা করে এবং কষ্ট দেয়।
উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস ছিলেন হযরত বেলাল (রাঃ)। ইসলাম গ্রহনের পর উমাইয়া বেলালের গলায় দড়ি বেঁধে উশৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত। বালকেরা তাঁকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেত। এরকম করার ফলে তাঁর গলায় দড়ির দাগ পড়ে যেত। উমাইয়ানিজেও তাঁকে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করত। এরপর উত্তপ্ত বালিকার উপর জোর করে শুইয়ে রাখত। এ সময়ে তাঁকে অনাহারে রাখা হত। এমনকি কখন কখন তাঁকে দুপুরের তীব্র রোদে মরু বালুকার উপর শুইয়ে বুকের উপর ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখত।
একবার হযরত সা’দ ইবনে মোয়ায (রাঃ) মক্কায় উমাইয়া ইবনে খালফকে বরেছিলেন; হে উমাইয়া আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, মুসলমানরা তোমাকে হত্যা করবে। একথা শুনে উমাইয়া ভীষন ভয়ঙ পেয়ে গেল। এ ভয় তার সব সময় চিল। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ককনও মক্কার বাইরে যাবে না। বদরের যুদ্ধের আবু জেহেলের পীড়াপিড়িতে উমাইয়া যুদ্ধে অংশ গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর, সবচেয়ে দ্রুতগামী উঠ ক্রয় করল। যাতে করে বিপদের আশংকার সময় খুব দ্রুত পালিয়ে আসতে পারে।
যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সময় তার স্ত্রী তাকে বলছিল, আবু সফয়ান আপনার ইয়াসরেবী ভাই যে কথা বলেছেন আপনি কি সে কথা ভূলে গেছেন? সে বলল না ভূলিনি, আমি তো ওদের সাথে কিছুদুর যাব।
মক্কায় জাহেলিয়াতের সময় থেকেই হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ও উমাইয়া ইবনে খালফের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব চিল। বদর যুদ্ধের দিনে উমাইয়া তার সন্তান আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ তার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কয়েকটি বর্ম নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে তাঁকে দেখে উমাইয়া বলল আমি কি তোমার প্রয়োজনে রাগতে পারি? তোমার বর্মগুলোর চেয়ে আমরা উত্তম। আজকের মত দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। তোমাদের কি দুধের প্রয়োজন নেই? এ কথা শুনে হযরত আব্দুর রহমান বর্মগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং উমাইয়া ও তার পটুত্রকে বন্দী করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন।
হযরত আব্দুর রহমান আওফ বলেন, আমি তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময হযরত বেলাল (রা) উমাইয়াকে দেখে ফেললেন। তিনি তাকে দেখে বললেন, ওহে কাফেরদের সরদার উমাইয়া ইবনে খারফ, হয়ত আমি বেঁচে থাকব নতুবা সে বেঁচে থাকবে। এরপর উচ্চস্বরে বললেন, ওহে আল্লাহর আনসাররা এই দেখো কাফেরদের সরদার উমাইয়া ইবনে খালফ, এবার হয়ত আমি থাকব নতুবা সে থাকবে।
বর্ণনাকারী বলেন, ততক্ষনে লোকেরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছেন। আমি তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু একজন ছাহাবী তলোয়ার তুলে উমাইয়ার পুত্র আলীর পায়ে আঘাত করলেন। সাথে সাথে সে ঢলে পড়ল। এদিকে উমাইয়া এমন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে যে, আমি এত বিকট শব্দ কথনও শুনিনি। আমি বললাম পালাও-পালাও। কিন্তু আজতো পালানোর পথ নে। আল্লাহর শপথ আজ আমি তোমার কোন উপকারে আসতে পারব না।
হয়ত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন উত্তেজিত সাহাবারা উমাইয়া ও তার পুত্র আলীকে ঘিরে ফেলে আঘ তে আঘাতে
হত্যা করে ফেলল।
অন্যত্র আছে, আব্দুর রহমান (রাঃ) উমাইয়া ইবনে খালফকে বললেন, হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়–ন। সে তাই করল। তিনি তার দেহের উপর ঝুঁকে পড়ে আড়াল করে রাখলেন। কিন্তু সাহাবারা নিচে থেকে তরবারী চালিয়ে উমাইয়াকে হত্যা করলেন। একজন ছাহাবীর তরবারীর আঘাতে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ক্ষ পা কেটে গিয়েছিল।
উমাইয়া ইবনে খালফ ও তার পুত্রকে ছাহাবারা হত্যা করলে আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! হযরত বেলালের (রাঃ) উপর রহমত দান করুন। আমার বর্ননাগুলোও গেল, আমার বন্দীদের ব্যাপারেও তিনি আমাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে দিলেন।
উবাই ইবনে খালফ উমাইয়ার ভাই। উকবা ইবনে আবু মুঈত্বের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। উকবা উবায়ের কথা মত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে থুথু নিক্ষেপ করেছিল।
উবাই ইবনে খালফ একবার একটি পুরানা হাড়গুড়া করে সেই হাড়গুড়া বাতাসের মধ্যে ফুঁ দিয়ে নবী করিম (ছাঃ) এর প্রতি উড়িয়ে দেয় এবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কে দেখে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত এবং হত্যার হুমকিও দিত। নবী (ছাঃ) মক্কায় থাকা কালে দেখা হলে সে গর্বভারে বলত, “হে মোহাম্মদ! আমার কাছে আওদ নামের একটি ঘোড়া রয়েছে; ওকে আমি প্রতিদিন তিন সা’আ (সাড়ে সাত কিলোগ্রাম) খাবার খাওয়াচ্ছি। সেই ঘোড়ার পিঠে বসে একদিন আপনাকে হত্যা করব। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলতেন, উল্টাও হতে পারে। ইনশাআল্লাহ আমিই তোমাকে হত্যা করব।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহুদের যুদ্ধ ময়দানে পৌঁছার পর উবাই ইবনে খালফ একথা বলে সামনে অগ্রসর হ’ল যে, মোহাম্মদ কোথায়? হয়ত আমি থাকব নতুবা তিনি থাকবেন। সাহাবারা রাসূল (ছাঃ) কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? নবী করিম (ছাঃ) বললেন, ওকে আসতে দাও। এই দুর্বৃত্ত কাছে এলে রাসূল (ছাঃ) হযরত হারেছ ইবনে ছাম্মার (রাঃ) নিকট থেকে ছোট একটি বর্শা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। এটা ছিল ঠিক তেমনি, যেমন গায়ে মাছি বসলে উট একটু খানি ঝাঁকুনি দেয় এতে মাছি উড়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) এরপর উবাইয়ের মুখোমুখি গেলেন, ইবনে খালফের শিরপ্রাণ ও বর্মের মাঝামাঝি একটুখানি যায়গা (গলার কাছে) খালি ছিল। নবী (ছাঃ) সেই মহান লক্ষ্য করে হাতের বর্শা নিক্ষেপ করলেন। এত উবাই ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল এবং তার মিত্রদের কাছে ফিরে গেল।
তার গলার কাছে সামান্য চটে গিয়েছিল বটে, কিন্তু রক্ত বের হয়নি। আঘাত ও তেমন ছিল না। তবুও সে চিৎকার করে বলতে লাগল, আল্লাহ্র শপথ! মোহাম্মদ আমাকে হত্যা করেছেন। লোকেরা তাকে বলল, কিজে বাজে বকছ, তোমার আঘাত তো তেমন গুরুতর নয়। গলার সামান্য আঁচড় লাগার সত দেখা যাচ্ছে। উবাই বলল, তিনি মক্কায় আমাকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে হত্যা করব। কাজেই আল্লাহর শপথ আমার প্রাণ চলে যাবে।
সে গাভীর মত চিৎকার করে বলত সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রান, আমি যে যন্ত্রনা অনুভব করছি, সেই কষ্ট যন্ত্রনা যদি যিল-মাযাযের অধিবাসীরা অনুভব করতো তা’হলে তারা সবায় মারা যেত। অন্যত্র আছে, সে বারবার বলছিল, মোহাম্মদ মক্কায় বলছিলেন, আমিই তোমাকে হত্যা করব তিনি যদি আমাকে থুথুও নিক্ষেপ করতেন তবুও আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত।
অবশেষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রু উবাই ইবনে খালফ মক্কায় ফেরার পথে ছারফ নামক স্থানে মারা যায়।
উকবা ইবনে মুঈত্ব কর্তৃক নির্যাতনঃ
উকবা ইবনে আবু মুঈত্ব ছিল জঘন্য দুবৃত্তপনা ও দু®কৃতিতে ওস্তাদ। হযরত মাসউদ (রাঃ) বর্ননা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা’বা ঘরের পার্শ্বে ছালাত আদায় করছিলেন। আবু জেহেল ও তার কয়েক বন্ধু সেখানে বসেছিল। এমন সময় একজন অন্যজনকে বলল, কে আছ ওমুকের উটের নাড়িভূড়ি এনে মোহাম্মদ যকন সেজদায় যাবে তখন তাঁর পিঠে চাপিয়ে দিতে পারবে?
এরপর উকবা ইবনে আবু মুঈত্ব উঠে দাঁড়ালো এবং উটের নাড়িভূড়ি এনে অপেক্ষা করতে লাগল। নবী (ছাঃ) সেজদায় যাওয়ার পর সেই নাড়িভূড়ি তাঁর উভয় কঁধের দুদিকে ঝুলিয়ে দিল।
আমি সব কিছু দেখলাম, কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলাম না। কিয়ে ভালহত হায় যদি আমার মধ্যে তাঁকে রক্ষা করার শক্তি থাকত। এরপর দুর্বৃত্তরা হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছিল। এদিকে রাসূল (ছাঃ) সেজদায় পড়ে রইলেন শাথা তুললেন না। হযরত পাতেমা (রাঃ) খবর পেয়ে ছুটে এলেন এবং নাড়িভূড়ি সরিয়ে ফেললেন।
এরপর তিনবার বললেন হে আল্লাহ! কোরায়েশদের দ্বায়িত তোমার উপর। এই বদ দোআ শুনে তারা নাখোশ হ’ল। কেননা তারা একথা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করত যে, এই শহরে তাঁর দো’আ কবুল হয়ে থাকে। এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নাম ধরে ধরে বদদো’আ করলেন, হে আল্লাহ আবু জেহেলকে পাকড়াও কর। ওতবা ইবনে খালফ ও উকবা ইবনে আবু মুঈত্বকে পাকড়াও কর।
এই লোকটিই রাসূল (ছাঃ) কে গলায় চাঁদর ফেঁচিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। একদা নবী করিম (ছাঃ) কা’বা শরীফের (পশ্চিম পার্শ্বে) হিজর নামক স্থানে ছারাত আদায় করছিলেন। তখন উকবা ইবনে আবু মুঈত্ব আসল এবং তাঁর চাঁদর দিয়ে নবী (ছাঃ) এর কণ্ঠনালী চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলল। তখন আবু বকর (রাঃ) এগিয়ে এসে তাঁর কাঁধে ধরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এর নিকট হতে সরিয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমরা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করতে চাও যিনি বলেন, আল্লাহ আমার রব।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেন কোরায়েশদের অত্যাচারের, আমার দেখা ঘটনাসমূহের মধ্যে এ ঘটনা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক।
অন্যত্র আছে আসমা (রাঃ) বলেন, পৌত্তলিকরা রাসূল (ছাঃ) কে ছেড়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনি বাড়ী ফিরে আসার পর আমরা তাঁর মাথার চুলের যেখানেই হাত দিলাম, চুল আমাদের হাতে উঠে আসছিল।
উবাই ইবনে খালফ ছিল উকবার ঘনিষ্ট বন্ধু। উকবা একদিন নবী (ছাঃ) এর নিকটে বসে ইসলামের কিছু কথা শুনে ছিল। উবাই একথা শুনে উকবার সমালোচনা করল এবং নির্দেশ দিলেন যে, যাও তুমি গিয়ে মুহাম্মদের মুখে থুথু দিয়ে এসো। উকবা তাই করল।
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উকবা ইবনে আবু মুঈত্বকে বদর যুদ্ধে বন্ধী করেন এবং মদীনায় ফেরার পথে উজকুক জাবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে এই দুর্বৃত্তকে হত্যার নির্দেশ দিলে সে বলল, ওহে মোহাম্মদ, সন্তানদের জন্য কে আছে? তিনি বললেন, আগুন।
হযরত আসেম ইবনে ছাবেত আলছারী (রাঃ) অপর এক বর্ণনায় বলেন, হযরত আলী (রাঃ) উকবা ইবনে আবু মুঈত্বের শিরচ্ছেদ করেন। আর এভাবেই আল্লাহ্র দুশমন দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে কাম‘আর আঘাতের পরিণতিঃ
ত্বালহা ও সা‘দ ব্যতীত যখন রাসূলের পাশে আর কেউ নেই। তখন এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করার জন্য কাফেররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ঠিক সেই সময় ছিল রাসূল (রাঃ) এর জীবনের চরম সংকটময় মূহুর্ত। কাফেরদের জন্য সেটা ছিল সুবর্ণ সুযোগ। প্রকৃত পক্ষে কাফেররা সেই সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে কোন অলসতা করেনি। তারা নবী (ছাঃ) এর উপর সর্বাত্তক হামলা চালিয়ে ছিল এবং তাঁকে দুনিয়া থেকে চির বিদায় করে দিতে চেয়েছিল। সেই সময়ে প্রথমে সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছের ভাই উৎবাহ বিন আবী ওয়াকক্বাছ রাসূলের চেহারা লক্ষ্য করে সজোরে পাথর নিক্ষেপ করে। তাতে রাসূলের ডান দিকের নীচের ‘রুবাঈ দাঁত’ ভেঙ্গে যায় ও নীচের ঠোটটি আহত হয়। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী এগিয়ে এসে তাঁর ললাটে তরবারির আঘাত করে যখম করে দেয়। এরপর আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ নামক এক দুধর্ষ অশ্বারোহী এসে তার কাঁধের উপরে ভীষণ জোরে তরবারির আঘাত করে। যা তাঁর লৌহবর্ম ভেদ করতে না পারলেও তার ব্যথা ও কষ্ট তিনি এক মাসের অধিক সময় অনুভব করেন। তারপর সে দ্বিতীয় বার আঘাত করে। যাতে তাঁর শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চোখের নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে থেকে যায়। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাচ্ছিল্য করে আব্দুল্লাহ বলে خذ هذا وأنا ابن قمئة ‘এটা লও। আমি ক্বামআহর (টুকরাকারিণীর) বেটা’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) তাকে বদ দো‘আ করে বলেন, أقمأك الله ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’।
মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের এই দোআ কবুল করেছিলেন। প্রথম হামলাকারী উৎবাহ বিন আবী ওয়াক্ক্বাছ যার নিক্ষিপ্ত পাথরে রাসূলের দান্দান মুবারক শহীদ হয়, তার ভাই সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) এর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ তার পিছে ধাওয়া করে এক আঘাতেই তার মস্তক দেহচ্যুত করে ফেলেন এবং তার ঘোড়া ও তরবারি দখল করে নেন। অন্যত্র আছে, হযরত সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) নিজের ভাই ওতবাকে হত্যা করার সুযোগ খুঁজছিলেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হযরত হাতেব (রাঃ) অর্জন করলেন।
দ্বিতীয় হামলাকারী আব্দুল্লাহ বিন শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূলের ললাট দেশ যখম হয়, তার পরিণতি জানা যায়নি।
তৃতীয় আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বামআহ, যার তরবারির আঘাতে রাসূলের শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে যায় এবং যাকে রাসূল (ছাঃ) ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন’ বলে বদদো‘আ করেছিলেন, তার পরিণতি হয়েছিল এই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলের দো‘আ কবুল করেন এবং তার উপরে তার বকরীদের বিজয়ী করে দেন। ঘটনা ছিল এই যে, যুদ্ধ হ’তে মক্কায় ফিরে সে তার বকরী পালের খোঁজে পাহাড়ের দিকে যায় এবং তার বকরীগুলিকে পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পায়। অতঃপর সে সেখানে উঠে বকরী খেদিয়ে আনতে গেলে হঠাৎ শক্তিশালী পাঁঠা ছাগলটি তাকে শিংয়ের প্রচন্ড গুঁতা মেরে ফেলে দেয়। অতঃপর তাকে পাহাড় থেকে নীচে ফেলতে ফেলতে এবং শিংয়ের গুঁতা মারতে মারতে টুকরা টুকরা করে ফেলে। এভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শত্রু দুনিয়া হতে চির বিদায় নিয়ে দোযখের অধিবাসী হয়।
বয়কট দলিল ছিন্নকরাঃ
ইসলামের প্রচারের প্রাথমিক কালে মক্কার পৌত্তলিকরা দিন দিন অস্থির হয়ে উঠলো। অস্থির হবে না কেন? তারা বুঝতে পেরেছিলযে, এখন যদি মুহাম্মদকে হত্যা করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা হলে তাঁকে রক্ষা করার জন্য যে রক্তপাত হবে এতে মক্কা পান্তর লালে রন্জিত হয় যাবে। তাদের নিজেদের গোষ্ঠির মধ্যে ধ্বংশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। এ কারনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে হত্যা করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে পৌত্তলিকরা অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতনের নতুন পথ আবিষ্কার করল। আর এই পরিকল্পনা ছিল ইতোপূর্বে গৃহিত সকর পদক্ষেপের চেয়ে আরও বেশী মারাত্মক।
সর্বাত্মক বয়কট দলিল রিখেছিল মনছুর ইবনে আমের ইবনে হাশেম। কারে কারে মতে নযর ইবনে আমের ইবনে হারেছ লিখেছেল। কিন্তু সঠিক মত হলো, এই দলিল বোগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম লিখেছিল।
বয়কট দলিল লিখিত হওয়ার পর কা’বা ঘরে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো। এই দলিলের ফলে আবু লাহাব ব্যতিত বনু হাশেম ও বনু মোতালেবের মুসলিম অমুসলিম নারী, পুরুষ, শিশু, সকলের শা’বে তালেব নামক স্তানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এ ঘটনা ছিলবুওয়াতের ৭ম বছরের ঘটনা।
এ বয়কটের ফলে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠল। খাদ্য সামগ্রীর আগমন বন্ধ হয়ে গেল। মক্কায় যে সমস্ত খাদ্য পাণীয় আমদানী হত তা পৌত্তলিকরা তড়িঘড়ি ক্রয় করে নিত। ক্ষুধার কষ্ট এত মারাক্তক ছিল যে, ক্ষুধার্ত নারী শিশুর কাতর কান্নায় আবু তালিবের ঘাঁটির বাইরে থেকে শোনা যেত। এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় গাছের বাকল ও লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারন করতেন।
হাকিম ইবনে হাজাম ছিলেন হযরত খাদিজা (রাঃ) ভ্রাতুপুত্র। মাঝে মধ্যে তিনি তাঁর ফুফুর জন্য গম পাঠাতেন। একবার গম পাঠানোর উদ্যোগ নিতেই আবু জেহেল বাঁধা দেয়। আবু বাখতারি এসে হাকিম ইবনে হাজামের পক্ষ নিয়ে গম পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। এই বয়কট পূর্ন দুদির্ন কেটে যায় একে একে তিন বছর। এরপর নবুওয়াতের দশম বছর মহরম মাসে দলিল ছিন্ন করার ঘটনা ঘটে। কোরায়েশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ধরনের অবরোধ ব্যাবস্থার বিরোধী থাকায় তারা অবরোধ বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলিল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হিশাম ইবনে আমের। হিশাম রাত্রীকালে অতিচুপিসারে খাদ্যদ্রব্য পাঠিযে আবু তালিব ঘাটির অসহায় লোকদের সাহায্য করতেন। প্রথমে হিশাম যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখযুমির কাছে যান। যুহাইর মা অ তেকা ছিলেন আব্দুল মোত্তালেবের কণ্যা, আবু তালেবের বোন। হিশাম তাকে বললেন, যুহাইর তুমি চাও যে, তোমরা মজা করে পেট পুরে পানাহার করবে অথচ তোমার মামা ও অন্যরা অনাহারে ধূকে ধূকে মারা যাবে? তারা কি আবস্থায় রয়েছে সেটা কি তুমি জানোনা? যুহাইর বললেন, আফসোস সেটা তুমি জানোনা। যুহাইর বললেন, আফসোস আমি একা কি করতে পারি? যদি আমার সাথে আরও কেউ এগিয়ে আসে তবে আমি সে দলিল বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি। হিশাম বললেন, অন্য একজন রয়েছেন। যুহাইর জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কে? হিশাম বললেন আমি হিশাম ইবনে আমের। যুবাইর বললেন, আচ্ছা তবে তৃতীয় কাউকে খুঁজে বের করো। একথা শোনার পর হিশাম মোতরাম ইবনে আদীর কাছে গেলেন এবং বনু হাশেম ও বনু মোত্তালেবের দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করে তার সহায্য চাইলেন। তারা যে তার নিকট আত্মীয় সে কথাও বললেন। মোতায়েম বললেন আমি একা কি করতে পারি? হিশাম বললেন, আরও একজন আছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কে সে? হিসাম বললেন, আমি। মোতায়াম বললেন, আচ্ছা তৃতীয় একজন খুঁজে নাও। তিনি বললেন সেটাও করেছি। মোতায়াম বললেন, তিনি কে হিশাম বললেন, তিনি হচ্ছেন জুবাইর ইবনে উমাইয়া। এভাবে হিসাম আবুল বাখতারি, জামায়া ইবনে আছোয়াদ ইবনে মোতালেব ইবনে আছাদের কাছে গেলেন এবং তাদের মতামত একত্রিত করলেন। উল্লেখিত সকলে হাজুন নামক স্থানে একত্রিত হয়ে দলিল বিনষ্ট করার অঙ্ঘীকারাবদ্ধ হলেন। যুবাইর বললেন, প্রথমে আমি কথা তুলবো। সকাল বেলা নিয়মানুযায়ী সকলে মজলিসে একত্রিত হল। যুবাইর দামী পোশাক পরিধান করে সেজে গুজে উপস্থিত হল। প্রথমে কা’বা ঘর সাতবার তওয়াফ করে সবাইকে সম্বোধন করে বলল, মক্কাবাসীরা শোন আমরা পানাহার করব, পোশাক পরিধান করব আর বনু হাশেম ধ্বংশ হয়ে যাবে। তাদের কাশে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না তাদের নিকটে থেকে কেনাও হচ্ছে না। আল্লাহর কসম এ ধরনের অমানবিক দলিল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি নিরব থাকতে পারি না। আমি চাই এ দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হোক।
আবু জেহেল বলল, তুমি ভূল বকছো। আল্লাহর শপথ এ দলিল ছিন্ন করা যাবে না।
হামজা ইবনে আছোয়াদ বললেন, আল্লাহর শপথ তুমিই ভূর বকছো। এ দলিল যখন লেখা হয়েছিল তখনও আমি রাজি ছিলাম না। আমি এটা মেনে নিতে প্রস্তুত নই।এরপর মোতায়েম ইবনে আদি বললেন, তোমরা দুজনে ঠিকই বলেছ। আমরা এ দলিলে যা কিছু লেখা রয়েছে তা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। হিসাম ইবনে আমরও এধরনের কথা বললেন।
এ অবস্থা দেখে আবু জেহেল বলল হুঁহ রাত্রি কালেই এধরনের ঐক্যমত হয়েছে। এ পরামর্শ এখানে নয় বরং অন্য কোথাও করা হয়েছে।
সে সময় আবু তালেবও অদুরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোরায়েশদের বললেন, আমার ভাতিজা আমাকে আপনাদের কাছে এ কথা বলে পাঠিয়েছেন যে, আপনাদের অঙ্গিকার পত্রটি মহান আল্লাহ একরকম পোকা পাঠিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। শুধুমাত্র আল্লাহ নামটি সেখানে অবশিষ্ট আছে। যদি এ কথা মিথ্যা হয় তাহলে আমি তাঁর ও আপনাদের মাঝে থেকে সরে দাঁড়াব এবং আপনার যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আর যদি সত্য বলে প্রমানিত হয় তাহলে বয়কটের মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অন্যায় করেছেন তা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবে কুরায়েশরা সর্বসম্মত হল। এ বিষয়ে আবু জেহেল ও অন্যদের মাঝে তর্কবিতর্ক শেষ হলে মুতয়েম ইবনে আদী অঙ্গিকারপত্র ছিড়তে গিয়ে দেকলেন যে, সত্যি সত্যি আল্লাহর নাম লেখা অংশ ছাড়া বাঁকি অংশ পোকায় খেয়ে ফেলেছে। এরপর অঙ্গিকার পত্রটি ছিঁড়ে ফেলা হলে বয়কটের অবসান হল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও অন্য সকলে শোয়াবে আবু তালিব থেকে বেরিয়ে এলেন।
উল্লেখ্য বয়কট দলিল লেখকের জন্য নবী (ছাঃ) বদদো‘আ করেছিলেন এবং তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল।
আরবের পৌত্তলিকরা নবুওতের বিষ্ময়কর এ নিদর্শন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিল এবং নিজেদের কুফুরীর পথে আরো কয়েক কদম অগ্রসর হল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, আর তারা কোন মোজেযা দেখে, তখন টার বাহানা করে এবং বলে এ তো যাদু।
কা’ব ইবনে আশরাফের পরিণামঃ
৩য় হিজরীর ১৪ই রবীউল আউয়াল কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। সে ছিল একজন খ্যাতনামা ইহুদী পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তার দুর্গটি ছিল মদীনার পূর্ব-দক্ষিণে দু’মাইল দূরে বনু নাযীর গোত্রের পশ্চাদভূমিতে। বদর যুদ্ধে কুরায়েশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়তে থাকে এবং রাসূলের ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে ও কুরায়েশ নেতাদের প্রশংসা করে কবিতা বলতে থাকে। কিন্তু তাতে তার ক্ষোভের আগুন প্রশমিত না হওয়ায় সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। সে যুগে কবিতাই ছিল সাহিত্যের বাহন এবং কারু প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করার প্রধান হাতিয়ার। কোন বংশে কোন কবি জন্মগ্রহণ করলে সে বংশ তাকে নিয়ে গর্ব করত এবং তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হ’ত। আবু সুফিয়ান এবং মক্কার নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করলأديننا أحب إليك أم دين محمد وأصحابه وأي الفريقين أهدى سبيلا؟ ‘আমাদের দ্বীন তোমার নিকটে অধিক প্রিয় না মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দ্বীন? এবং এ দু’টি দলের মধ্যে কোন দলটি অধিক সুপথপ্রাপ্ত? সে বলল, أنتم أهدى منهم سبيلا وأفضل ‘তোমরাই তাদের চাইতে অধিক সুপথ প্রাপ্ত ও উত্তম’। এ প্রসঙ্গে সূরা নিসা ৫১ আয়াতটি নাযিল হয়। এরপর সে মদীনা ফিরে এসে একই রূপ আচরণ করতে থাকে। এমনকি ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা রটনা করতে থাকে ও নানাবিধ ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বলতে থাকে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, من لكعب بن الأشرف فإنه أذى الله ورسوله- ‘কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে আছ? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে’। তখন আউস গোত্রের মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহর নেতৃত্বে আববাছ বিন বিশর ও কা‘ব বিন আশরাফের দুধভাই আবু নায়েলাহ সহ পাঁচ জন প্রস্তুত হয়ে গেলেন। দলনেতা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ কার্য সিদ্ধির জন্য কিছু প্রতারণামূলক কথা ও কাজের আশ্রয় নেবার অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে অনুমতি দেন।
সে মোতাবেক প্রথমে মুহাম্মাদ ও পরে আবু নায়েলা কা‘বের কাছে গিয়ে রাসূলের বিরুদ্ধে অনেক কথার মধ্যে একথাও বলল যে, এ লোক আমাদেরকে দারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। এই ব্যক্তি আমাদের কাছে ছাদাক্বাহ চাচ্ছে। আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের কষ্ট নিবারণের জন্য আপনার নিকটে কিছু খাদ্য-শস্য কামনা করছি। কা‘ব কিছু বন্ধকের বিনিময়ে দিতে রাযী হ’ল। প্রথমে নারী বন্ধক, অতঃপর পুত্র বন্ধক, অবশেষে অস্ত্র বন্ধকের ব্যাপারে নিষ্পত্তি হ’ল। আবু নায়েলাহ বলল, আমারই মত কষ্টে আমার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আছে। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনি তাদেরও কিছু খাদ্য-শস্য দিয়ে অনুগ্রহ করুন। অতঃপর পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখের চাঁদনী রাতে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ তার দলবল নিয়ে কা‘বের বাড়ীতে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বাকী‘এ গারক্বাদ পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং বলেন, انطلقوا على اسم الله اللهم أعنهم- ‘আল্লাহর নামে অগ্রসর হও। হে আল্লাহ তুমি এদের সাহায্য কর’। অতঃপর তিনি বাড়ী ফিরে এসে ছালাত ও দো‘আয় রত হ’লেন।
দুধ ভাই আবু নায়েলাহ কা‘বের দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে ডাক দিল। এ সময় কা‘বের নববধূ তাকে বাধা দিয়ে বলল, أسمع صوتا كأنه يقطر منه الدم ‘আমি এমন এক ডাক শুনলাম, মনে হ’ল তা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে’। কিন্তু কা‘ব কোনরূপ সন্দেহ না করে বলল, এরা তো আমার ভাই। তাছাড়া إن الكريم لو دعى إلى طعنة أجاب- ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যদি তরবারির দিকেও আহুত হন, তথাপি তিনি তাতে সাড়া দিয়ে থাকেন’। অতঃপর সে বেরিয়ে এলো। তারপর সকলে মিলে কিছু দূর এগিয়ে যেতেই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তাকে শেষ করে ফেলা হ’ল।
কাজ সেরে তার মাথা নিয়ে বাক্বীয়ে গারক্বাদে ফিরে এসে তারা জোরে তাকবীর ধ্বনি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাকবীর ধ্বনি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং খুশী হয়ে বলেন, أفلحت الوجوه ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’। তারাও বললেন, ووجهك يا رسول الله ‘এবং আপনার চেহারাও হে আল্লাহর রাসূল’! এ সময় ঐ দুষ্টের কাটা মাথাটা তার সামনে রাখা হ’লে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করেন।
অন্যত্র আছে, তৃতীয় হিজরী ১৪ই রবিউর আওয়াল মাসের চাঁদনী রাতে কা’ব ইবনে আশরাফের উপর হামলা করার পরিকল্পনায় এই ছোট দল আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এর নিকটে অভিন্ন উদ্দেশ্যে হাজির হলেন। নবী (ছাঃ) বাকিঈ গারকাদ পর্যন্ত তাদের সঙ্গ দিলেন। এরপর বললেন যাও বিসমিল্লাহ! হে আল্লাহ! ওদেরকে সাহায্য করুন। রাসূল (ছাঃ) এরপর গৃহে ফিরে এলেন এবং ছালাত ও যিকিরে মসগুল হলেন।
সাহাবারা কা’বের বাড়ির সামনে যাওয়ার পর আবু নায়েলা উচ্চস্বরে তাকে ডাক দিলেন। আওয়াজ শুনে কা’ব উঠে দাঁড়ালে তার নব পরিনীতা স্ত্রী বলল, এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ? আমি এমন আওয়াজ শুনেছি যা থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে।কা’ব বলল ওরা তো আমার ভাই মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা ও দুধ ভাই আবু নায়েলা। সম্ভ্রান্ত লোকদের যদি বর্শার আঘাতের দিকেও ডাকা হয়, তবুও তার সে ডাকে সাড়া দেয়। এরপর কা’ব বাইরে এলো। তার মাথা থেকে সুবাস ভেসে আসছিল।
কা’ব আসার পর কিছুক্ষন বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা হ’ল। এরপর আবু নায়েলা বললেন, কা’ব চলো না আজুজ ঘাঁটি পর্যন্ত যাই। আজ রাত কথা বলেই কাটাতে চাই। কা’ব বলল তোমরা যদি চাও তবে চলো। ্বে কথার পর সবাই চললো। আবু নাযেরা বললেন, আজকের মতো, এমন মাতানো সুবাস কখনো শুঁকিনি। একথা শুনে কা’বের মন অহংকারে ভরে উঠলো। সে বলল, আমার কাছে আরবের সবচেয়ে সুবাুসনী অধিক সুগন্ধ ব্যবহহারকারী মহিরা আছে। সে বলল, হ্যাঁ অবশ্যই।
আবু নায়েলা কা’বের মাথার চুলে হাত দিয়ে তার চুলের ঘ্রান নিলেন এবং সঙ্গিদেরও সে চুলের ঘ্রান শুঁকতে দিলেন। খানিক্ষন পরে আবু নায়েলা বললেন, আর একবার শুকতে চাই ভাই। কা’ব নিশ্চিতভাবে বলল,হ্যাঁ হ্যাঁ। আবু নায়েলা পুনরায় কা’বের মাথার চুরের ঘ্রান নিলেন। কা’ব তখন বেশ প্রফুল্ল ও পুরোপুরি নিশ্চিত।
আরো কিছুপথ হাঁটার পর আবু নায়েলা কা’ব ইবনে আশরাফের মাথার চুলের ঘ্রান নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। কা’ব বলল ঠিক আছে। একথা বলে খানিকটা ঝুঁকে পড়লে আবু নায়েলা কা’বের মাথা নিজের নিয়ন্ত্রনে এনে সঙ্গিদের বললেন, এবার নিয়ে নাও আল্লাহর দুশমনকে। সাথে সাথে তার উপর তরবারির আঘাত করা হ’ল। কিন্তু কোন কাজ হলো না। এ অবস্থা দেখে মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা সক্রিয় হলেন এবং অস্ত্র তুলে এমন আঘাত করলেন যে, আল্লাহর দুশমন সেখানেই লুটিয়ে পড়ে শেষ হয়ে গেল। তার উপর আঘাত করার পর সে এমন জোরে চিৎকার করল যে, আশে পাশে হৈ চৈ পড়ে গেল। সকল বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে সবায় উৎকন্ঠিত হ’ল। কিন্তু এতে কিছুই হলো না। কা’ব ইবনে আশরাফের উপর হামলা করার সময় হযরত হারেছ ইবনে আগুসের দেহে অসতর্কভাবে একজন সঙ্গির তরবারির সামান্য আঘাত লেগে যায়। এতে তিনি আহত হন। তাঁর দেহ থেকে রক্ত ঝরছিল। ফেরার পথে হোররা আরিজ নামক জায়গায় পৌঁছার পর তারা লক্ষ্য করলেন, হারেছ সঙ্গে নেই। তাঁর জন্য সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষন পর হারেছ এসে পৌঁছুলেন। এরপর তাঁরা সকলেই বাকিঈ গারকাদ নামক জায়গায় পৌঁছুলেন এবং উচ্চস্বরে তাকবির ধ্বনী দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই তাকবীর ধ্বনী শুনতে পেলেন। এতে তিনি অনুভব করলেন অভিযান সফল হয়েছে। নবী (ছাঃ) ও আল্লাহু আকবার ধ্বনী দিলেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই চেহারাগুলো কামিয়াব হোক। সাহাবারা বললেন, আপনার চেহারাও হে আল্লাহর রাসূল। একথা বলার পর অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা কা’ব ইবনে আশরাফের কর্তিত মস্তক আল্লাহর রাসূলের সামনে পেশ করলেন। দুবৃত্ত নেতা কা’বের হত্যাকান্ডে আল্লাহর প্রসংশা করলেন এবং হারেছের ক্ষতস্থানে থুথু লাগিয়ে দিলেন। এতে তিনি সুস্থ্য হয়ে গেলেন। সে ক্ষতে আর কখনো ব্যথা হয়নি।
অন্যান্য শত্রুর পরিণামঃ
এক) সালাম ইবনে আবুর কুনিয়াত নাম আবু রাফে। এই লোকটি কা’ব ইবনে আশরাফের মত ইহুদীদের সেই সব বিশিষ্ট অপরাধীর অন্যতম যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বদা সড়যন্ত্র করত এবং অর্থ সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছিল। এছাড়া আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেও সর্বদা কষ্ট দিত। এসব কারনে মুসলমানরা বনু কোরায়যা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বনু খাযরাজ গোত্রের কয়েকজন সাহাবা আবু রাফেকে হত্যার অনুমতি চাইরেন। এরআগে আওস গোত্রের কয়েকজন সাহাবা কা’ব ইবনে আশরাফকে হত্যা করেছিল। তারাও ওদের মত কৃতিত্বের পরিচয় দেয়ার জন্য আবু রাফেকে হত্যা করার জন্য রাসূলের নিকটে অনুমতি চাইলেন।
পাঁচজন সাহাবার সমন্বয়ে একটি দল গঠন করা হ’ল। তাদের দলপতি ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আতিক। রাসূল (ছাঃ) সতর্ক করে বললেন, তোমরা শিশু ও নারী হত্যা করনা।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আতিক বলেন, আমি আমি ভেতরে প্রবেশ করে আত্মগোপন করে রইলাম। আবু রাফে দোতলায় একটি কামরায় থাকতো। রাত্রি নিঝুম হলে সঙ্গিদের ভেতরে ডাকলাম। একসময়ে আবু রাফের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, কিন্তু ছেলেমেয়েদের নিয়ে সে একটি ঘরে শুয়ে ছিল। অন্ধকার থাকার জন্য আবু রাফেকে আওয়াজ দিলাম। সে বলল কে ডাকে? আমি দ্রুত আওয়াজা লক্ষ্য করে তরবারি দিয়ে আঘাত করলাম। কিন্তু উত্তেজনা বশত আঘাত লক্ষ্যচ্যুত হলো। এদিকে আবু রাফে চিৎকার দিল। আমি দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বললাম, আবু রাফে কিসের আওয়াজ শুনলাম? সে বলল তোমার মা বরবাদ হোক, একজন লোক এখনই আমাকে এ কামরায় তরবারি দিয়ে আঘাত করেছে। এবার তার কাছে গিয়ে পুনরায় আঘাত করলাম। এ আঘাত লক্ষভ্রষ্ট হলো না, ফলে আবু রাফে রক্তাক্ত হয়ে গেল। কিন্তু তখনও তাকে হত্যা করতে পারিনি। এ কারণে তরোয়ারের মাথা তাঁর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। তলোয়ার পিঠ ভেদ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল।
জোৎস্না রাত ছিল, নীচে নামতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি মচকে গিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজের হাত ছুঁয়ে দিলেন, সাথে সাথে মনে হ’ল আমার পায়ে কোন ব্যাথা ছিল না।
দুই) ষষ্ঠ হিজরী শাওয়াল মাসে হযরত কারজ ইবনে জাবের ফাহরীরের নেতৃত্বে কতক ধর্মান্ডরিতকে হত্যা করা হয়েছিল। আকল ও উরাইনা গোত্রের কিছু সংখ্যক লোক মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাদের প্রতিকূল হলে তারা অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) তাদেরকে কয়েকটি উটসহ এক চারণ ভূমিতে পাঠিয়ে দেন এবং উঠের দুধ ও পেশার পান করার নির্দেশ দেন।
এরা সুস্থ্য হওয়ার পর প্রেরিত রাখালকে হত্যা করে উঠগুলোকে নিয়ে উঠাও হয়ে যায়। ইসলাম গ্রহনের পর পুনরায় তারা কুফুরী গ্রহণ করে। ইসলাম গ্রহনের পর পুনরায় তারা কুফুরী গ্রহণ করে। রাসূল (ছাঃ) কারজ ইবনে জাকের ফাহরীর নেতৃত্বে বিশ জন সাহাবার একটি দল প্রেরন করেন এবং এই বলে বদদোআ করেন, “ওদের উপর পথ অন্ধ করে দাও এবং কংকনের চেয়েও সংকির্ন করে দাও।
সাহাবারা তাদের পাকড়াও করে রাখাল হত্যার শাস্তি হিসেবে তাদের হাত পা কেটে নেয়। এরপর তাদের হারলা নামক এলাকায় ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে তারা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কৃতকর্মের ফল ভোগ করে।
এভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে গাদ্দারী করার পরিনাম ভোগ করে।
তিন) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পারস্য সম্রাট কিমরার কাছে এখখানি চিঠি প্রেরণ করেন। পারভেযকে চিঠি পড়ে শোনানোর পর সে চিঠিখানা ছিড়ে ফেলে এবং অহংকারের সাথে বলে, আমার প্রজাদের মধ্যে একজন সাধারন প্রজা নিজের নাম আমার নামের আগে লিখেছেন। রাসূল (ছাঃ) এ খবর পাওয়ার পর বলেছিলেন, মহান আল্লাহ তার বাদশাহী ছিন্ন ভিন্ন করে দিন। এরপর তাই ঘটেছিল রাসূল (ছাঃ) যা বলেছিলেন।
সম্রাট তাপ ইয়েমনের গভর্নর বাখানকে লিখে পাঠাল যে, তুমি তাগড়া জোয়ান দুজন লোককে আমার কাছে পাঠাও তারা যেন হেজাজ গিয়ে সে লোককে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে। বাখান সম্রাটের নির্দেশ পালনের জন্যে দুজন লোককে চিঠিসহ আল্লাহর রাসূলের নিকটে প্রেরন করে। প্রেরিত দুজন রাসূলের নিকটে গিয়ে বলল, শাহানশাহ্ বাখানকে একখানি চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়েছেন, আপনাকে যেন তার দরবারে হাজির করা হয়। বাদশা বাখান আপনাকে নিয়ে যেতে আমাদের পাঠিয়েছেন, আপনি পারস্য চলুল। সাথে সাথে উভয় আগন্তুক হুমকিপূর্ন কিছু কথাও বলল। রাসূলুল্লাহ্ (ছা:) শান্ত ভাবে তাদের বললেন তোমরা আগামী কাল দেখা করো।
এদিকে পারস্যে খসরু পারভেজের পারিবারিক বিদ্রোহ ও কলহ তীব্ররূপ ধারন করলো। কায়সারের সৈন্যদের হাতে পারস্যের সৈন্যরা একের পর এক পরাজয় স্বীকার করে যাচ্ছিল। পরিনামে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাটের পুত্র শিরওয়াই নিজের পিতাকে হত্যা করে নিজেই ক্ষতা দখল করলো। রাসূল (ছাঃ) অহীর মাধ্যমে এখবর পেয়ে যান। পরদিন সকালে প্রতিনিধিরা এলে এখবর জানালেন। তারা বলল, আপনি এসব কি বলেছেন? আমরা কি আপনার একথা বাদশার নিকটে লিখে পাঠাব? নবী (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ লিখে দাও। সাথে একথাও লিখে দাও আমার দ্বীন ও হুকুমাত সেখানেও পৌঁছুবে। শুধু তাই নয় এমন জায়গায়ও পৌঁছুবে যার পর উঠ বা ঘোড়া যেতে পারবে না।
তাদের লিখিত চিঠির জবাব এলে সকলে জানতে পারল সম্রাট নিহত। চিঠিতে এ নির্দেশেও প্রদান করে যে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তাঁকে নবী (ছাঃ) বিরক্ত করবেন না। এ ঘটনায় ইয়েমেনে উপস্থিত সকলে ইসলাম গ্রহণ করে।
শেষকথাঃ
রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) এর জীবনে যত অন্যায় অত্যাচার অমানুষিক নির্যাতন অকথ্য নীপিড়ন বয়ে গেছে তা আমাদের মত সাধারন মানুষের পক্ষে সহনীয় অকল্পনীয়। তিনি ইচ্ছে করলে তাঁর চরম শত্রুকে উচিৎ শিক্ষা দিতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি তাঁর প্রতিপালকের প্রতি সমস্ত দায় দায়িত্ব সর্পদ করেছেন। আর ক্ষমাশীল মহান নেতা উদারতা দেখিয়ে মক্কা বিজয়ের দিনে সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষনা দিলেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমরা মুক্ত।” একথা বলে তাদেরকে কৃতজ্ঞার শিকলে আবদ্ধ করেন।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) যেদিন এই ধরনীতে ভূমিষ্ট হয়েছেন, সেদিন থেকে নবী-রাসূলের আবির্ভাব বন্ধ হয়ে গেছে। তাই দ্বীনি বিজ্ঞ আলেম সমাজ নবী-রাসূলদের উত্তরশূরী। বিধায় যারা এই বিজ্ঞ আলেমের সাথে অন্যায় অত্যাচারের অযোক্তির নিপীড়ন নির্যাতন করে, তারাও ঐ আবু লাহাব আবু জেহেলের সমকক্ষ। আর তাদের পরিণাম ওদের মত হবে না। তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অতএব সমাধান, “হে মানব সমাজ! দ্বীনি বিজ্ঞ আলেম সমাজের প্রতি অন্যায় আচরণ করে ইসলামের আকাশে মজলুমের আত্মচিৎকারে পবিত্র ধ্বনীতে এই ধরনী দূষিত করে না। ভয় কর, শেষ দিবসের বিচারপতির ফয়সালায় শাস্তির বিধান তোমাদের উপর বর্তিতে পারে। জেনে রেখ, নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান। তিনি ইতোপূর্বে বহু ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী জাতিকে সমূলে ধংস করেছেন। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন, আমিন।
সহায়ক গ্রন্থ ও দলীল:
- রহমাতুল্লিল আলামীন, মূল: মাও: কাযী সুলাইমান মুনসুরপুরী, অনুবাদ: ড. মু. মুজীবর রহমান (মুহাম্মদী প্রকাশনী, সংস্থা, রাজশাহী- ১৯৯৭), ১/২২৫ পৃ:।
- রহমাতুল্লিল আলামীন – ১/২২৬ পৃ:।
- রহমাতুল্লিল আলামীন – ১/২৯-৩০ পৃ:।
- তাফসীর মা‘আরেফুল কুর‘আন-১৪৮১-১৪৮২ পৃ:।
- ছহীহ বুখারী- হা/ , ছহীহ মুসলিম- হা/
- আর রাহীকুল মাখতুম- মূল: ছফিউর রহমান মোবারকপুরী। ভাষান্তর: খাদিজা আখতার রেজায়ী (আল- কোর‘আন একাডেমী লন্ডন, প্রকাশ ঢাকা- ১৯৯০)-১১০ পৃ:
- সায়্যিদ কুতুব, তাফসীর ফি যিলা যিল কুর‘আন, (মিশর: আল মাকতাবাতুল ইসলামী)- ৩/২৮২পৃ:।
- আর রাহীকুল মাখতুম- ১১০ পৃ:।
- তদেব।
- তাফসীর মা‘আরেফুল কুর‘আন-১৪৮২ পৃ:।
- আর রাহীকুল মাখতুম- ২৫২-২৫৩ পৃ:।
- পৌত্তলিকরা রাসূল (ছা:) কে মুহাম্মাদ না বলে মুযাম্মাম বলত। মুহাম্মাদ অর্থ প্রশংসিত, অথট মুযাম্মাম অর্থ বিপরীত। অর্থাৎ যার নিন্দা করা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে এই উপমহাদেশে বিদ‘আতীরা আহলেহাদীছদের নানা প্রকার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।
- সীরাতে ইবনে হিশাম- ১/৩৩৫-৩৩৬।
- আর রাহীকুল মাখতুম- ১১১ পৃ:।
- ইবনে হিশাম- ১/৪১৬ পৃ:।
- ইবনে কাছীর, তাফসীর মা‘আরেফুল কুর‘আন-১৪৮২-১৪৮৩ পৃ:।
- মোখতাছার সীরাতে রাসূল, শেখ আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ (মৃ: ১২৪২হি:), ১/১৩৫ পৃ:।
- তাফসীর ফি যিলা যিল কুর‘আন, ৩০ পারা, ২০৮ পৃ:
- আর রাহীকুল মাখতুম- ১১৪ পৃ:।
- ছহীহ মুসলিম-
- ইবনে হিশাম- ১/২৯৮-২৯৯ পৃ:।
- এ ঘটনার পর ৬ষ্ঠ বছরের শেষ দিকে জিলহজ্জ মাসে হযরত হামযা (রা:) ইসলাম গ্রহণ করেন।
- রহমাতুল্লিল আলামীন- ১/৫৩ পৃ:, ইবনে হিশাম-১/২৯১-২৯২ পৃ:।
- ইবনে হিশাম- ১/৩২০ পৃ:।
- ছহীহ বুখারী- হা/ মেশকাত- হা/
- তিনি হযরত উসমান (রা:) এর খেলাফত কাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
- ইবনে মাসউদ (রা:) মক্কাতে থাকা অবস্থায় ছাগল চরাতেন।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ২৪৭ পৃ:।
- ছহীহ বুখারী- হা/৩৮৫৪, আনসারদের মর্যাদা অধ্যায়। ফাৎহুল বারী- হা/৩৮৫৪।
- ইবনে হিশাম- ১/৩৫৬-৩৫৭ পৃ:।
- রহমাতুল্লিল আলামীন- ১/৪৫ পৃ:।
- ছহীহ বুখারী- ২/৫৬৩, আর-রাহীকুল মাখতুম- ১৪৮ পৃ:।
- যে ব্যক্তি আমাকে বন্দী করতে মুক্তিপণ হিসাবে আমি তাকে অনেক দুধেল উটনী দেব।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ২৪৯ পৃ:।
- যাদুল মা‘আদ, হাফেয ইবনে কাইয়্যম (মিশর: আল মিশরিয়া-১৩৪৭ হি:)- ২/৮৯৬ পৃ:।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ২৪৯ পৃ:।
- ইবনে হিশাম, ১/৩৬১-৩৬২ পৃ:।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ৪৮ নং টিকা, ৩০৪ পৃ:।
- যাদুল মা‘আদ- ২/০৭ পৃ:।
- মুখতাছার সীরাতুর রাসূল, শেখ আব্দুল্লাহ (মৃ:১২৪২ হি:), ২৫০ পৃ:।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ১৪৭ পৃ:।
- ইবনে হিশাম, ২/৮৪ পৃ:।
- ছহীহ বুখারী- হা/৩৮৫৪, আনছারদের মর্যাদা অধ্যায়, ফাৎহুল বারী- হা/৩৮৫৪।
- ছহীহ বুখারী- হা/৩৮৫৬, আনছারদের মর্যাদা অধ্যায়, ফাৎহুল বারী- হা/৩৮৫৬।
- ইবনে হিশাম- ১/২৯০ পৃ:।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ১২৮ পৃ:।
- ইবনে হিশাম- ১/৩৬১ পৃ:।
- সুনানে আবু দাউদ-
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ২৫৫ পৃ:।
- বুখারী হা/৪০৬০, ২/৫৮১, ১/৫১৭।
- ফাৎহুল বারী ৭/৪৩২, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায়, ২৪ অনুচ্ছেদ।
- আর-রাহীকুল মাখতুম- ৩০১ পৃ:।
- ফাৎহুলবারী ৭/৪৩২।
- যাদুল মা‘আদ- ২/৪৬ পৃ:।
- ছহীহ বুখারী- রহমাতুল্লিল আলামীন০১/৫৪ পৃ:।
- আর-রাহীকুল মাখতুম-১৩৭ পৃ:।
- বুখারী হা/৪০৩৭ ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ।
- ছহীহ বুখারী- ৪/৩৭৩৫; ইবনে হিশাম- ২/৫১-৫৭ পৃ:।
- ফাৎহুল বারী- ৭/৩৪৩ পৃ:;
- ছহীহ বুখারী- আর-রাহীকুল মাখতুম-৩৫২-৩৫৩ পৃ:।
- এই সেই কারজ ইবনে জাবের ফারহারীর, যিনি বদরের যুদ্ধের আগে সফওয়ানের সামরিক অভিযানে মদীনায় পশুপালের উপর খেলা করেছে। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কায় বিজয়ের সময় শাহাদত বরণ করেন।
- যাদুল মা‘আদ- ২/১২২ পৃ:।
- সিলসিলা ছহীহা- হা/১৪২৯।
- ফাৎহুল বারী- ৮/১২৭ পৃ:।