১. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ- ‘রামাযানের পরে সর্বোত্তম ছিয়াম হ’ল মুহাররম মাসের ছিয়াম অর্থাৎ আশূরার ছিয়াম এবং ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাতের নফল ছালাত’ অর্থাৎ তাহাজ্জুদের ছালাত।[1]
২. আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وصِيَامُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ، ‘আশূরা বা ১০ই মুহাররমের ছিয়াম আমি আশা করি আল্লাহর নিকটে বান্দার বিগত এক বছরের (ছগীরা) গোনাহের কাফফারা হিসাবে গণ্য হবে’।[2]
৩. আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘জাহেলী যুগে কুরায়েশগণ আশূরার ছিয়াম পালন করত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা পালন করতেন। মদীনায় হিজরতের পরেও তিনি পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করতে বলেছেন। কিন্তু (২য় হিজরী সনে) যখন রামাযান মাসের ছিয়াম ফরয হ’ল, তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা কর আশূরার ছিয়াম পালন কর এবং যে ব্যক্তি ইচ্ছা কর তা পরিত্যাগ কর’।[3]
৪. মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাঃ) মদীনার মসজিদে নববীতে খুৎবা দানকালে বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,إِنَّ هَذَا يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ ولَمْ يَكْتُبِ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ وأَنَا صَائِمٌ فَمَنْ شَاءَ فَلْيَصُمْ ومَنْ شَآءَ فَلْيُفْطِرْ- ‘আজ আশূরার দিন। এদিনের ছিয়াম তোমাদের উপরে আল্লাহ ফরয করেননি। তবে আমি ছিয়াম রেখেছি। এক্ষণে তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছা কর ছিয়াম পালন কর, যে ইচ্ছা কর পরিত্যাগ কর’।[4]
৫. (ক) আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশূরার ছিয়াম রাখতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, ‘এটি একটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ পাক মূসা (আঃ) ও তাঁর কওমকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরা‘আঊন ও তার লোকদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আঃ) এ দিন ছিয়াম পালন করেছেন। অতএব আমরাও এ দিন ছিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের চাইতে আমরাই মূসা (আঃ)-এর (আদর্শের) অধিক হকদার ও অধিক দাবীদার। অতঃপর তিনি ছিয়াম রাখেন ও সকলকে রাখতে বলেন’ (যা পূর্ব থেকেই তাঁর রাখার অভ্যাস ছিল)।[5]
(খ) আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, আশূরার দিনকে ইহুদীরা ঈদের দিন হিসাবে মান্য করত। এ দিন তারা তাদের স্ত্রীদের অলংকার ও উত্তম পোষাকাদি পরিধান করাতো’।[6]
(গ) ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ইহুদী ও নাছারাগণ ১০ই মুহাররম আশূরার দিনটিকে সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ ছিয়াম রাখব’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়।[7]
৬. আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,صُوْمُوْا يَوْمَ عَاشُوْرَآءَ وَخَالِفُوا الْيَهُوْدَ وَصُوْمُوْا قَبْلَهُ يَوْمًا أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا- ‘তোমরা আশূরার দিন ছিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের খেলাফ কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন ছিয়াম পালন কর’।[8]
উপরোক্ত হাদীছ সমূহ পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন-
(১) আশূরার ছিয়াম ফের‘আঊনের কবল থেকে নাজাতে মূসার (আঃ) শুকরিয়া হিসাবে পালিত হয়।
(২) এই ছিয়াম মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদী শরী‘আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশূরার ছিয়াম পালিত হ’ত।
(৩) ২য় হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ছিয়াম সকল মুসলমানের জন্য পালিত নিয়মিত ছিয়াম হিসাবে গণ্য হ’ত।
(৪) রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পরে এই ছিয়াম ঐচ্ছিক ছিয়ামে পরিণত হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত এই ছিয়াম ঐচ্ছিক হিসাবেই পালন করতেন। এমনকি মৃত্যুর বছরেও পালন করতে চেয়েছিলেন।
(৫) এই ছিয়ামের ফযীলত হিসাবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। এত বেশী নেকী আরাফার দিনের নফল ছিয়াম ব্যতীত অন্য কোন নফল ছিয়ামে নেই।
(৬) আশূরার ছিয়ামের সাথে হুসায়েন বিন আলী (রাঃ)-এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসায়েন (রাঃ)-এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কূফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে হয়।[9] মোটকথা আশূরায়ে মুহাররমে এক বা দু’দিন স্রেফ নফল ছিয়াম ব্যতীত আর কিছুই করার নেই। শাহাদতে হুসায়েনের নিয়তে ছিয়াম পালন করলে ছওয়াব পাওয়া যাবে না। কারণ কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহি-র আগমন বন্ধ হয়ে গেছে।
[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৯ ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৯৪১।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৯৪৬।
[3]. বুখারী ফাৎহুল বারী সহ (কায়রোঃ ১৪০৭/১৯৮৭), হা/২০০২ ‘ছাওম’ অধ্যায়।
[4]. বুখারী, ফাৎহসহ হা/২০০৩; মুসলিম, হা/১১২৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।
[5]. মুসলিম হা/১১৩০।
[6]. মুসলিম হা/১১৩১; বুখারী ফাৎহ সহ হা/২০০৪।
[7]. মুসলিম হা/১১৩৪।
[8]. বায়হাক্বী ৪র্থ খন্ড ২৮৭ পৃঃ। বর্ণিত অত্র রেওয়ায়াতটি ‘মারফূ’ হিসাবে ছহীহ নয়, তবে ‘মাওকূফ’ হিসাবে ‘ছহীহ’। দ্রঃ হাশিয়া ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২০৯৫, ২/২৯০ পৃঃ। অতএব ৯, ১০ বা ১০, ১১ দু’দিন ছিয়াম রাখা উচিত। তবে ৯, ১০ দু’দিন রাখাই সর্বোত্তম।
[9]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ আল-ইস্তী‘আব সহ (কায়রোঃ মাকতাবা ইবনে তায়মিয়াহ, ১ম সংস্করণ, ১৩৮৯/১৯৬৯), ২য় খন্ড, পৃঃ ২৪৮, ২৫৩।