যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৬ষ্ঠ কিস্তি)

(লেখক : ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব)…..

তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ বিষয়ক রচনাবলী

৪. ছহীহ ও যঈফ আদাবুল মুফরাদ : ইমাম বুখারী (রহঃ) সংকলিত আল-আদাবুল মুফরাদ থেকে যঈফ হাদীছগুলো[1] বাদ দিয়ে কেবল ছহীহগুলো নিয়ে তিনি উক্ত সংকলনটি রচনা করেন। অতঃপর যঈফগুলো নিয়ে পৃথক একটি গ্রন্থ সংকলন করেন। উক্ত সংকলনে তিনি কেবল ছাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন, প্রত্যেক হাদীছের নীচে হাদীছের হুকুম সংক্ষেপে পেশ করেছেন এবং প্রখ্যাত মিসরীয় বিদ্বান ফুয়াদ আব্দুল বাক্বী[2] কৃত তাখরীজ ও তা‘লীক্বসমূহ ইলমী গুরুত্বের বিবেচনায় রেখে দিয়েছেন।

হাদীছ এবং আছার মিলে মোট ৯৯৩টি বর্ণনা নিয়ে ‘ছহীহুল আদাবিল মুফরাদ’ এবং ২১৭টি বর্ণনা নিয়ে ‘যঈফুল আদাবিল মুফরাদ’ প্রকাশ করেন।[3]

৫. ছহীহ ও যঈফুল জামেঈছ ছাগীর ওয়া যিয়াদাতুহূ : ‘আল-জামি‘ঊছ ছাগীর’ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (রহঃ)[4] রচিত হাদীছের একটি প্রসিদ্ধ সংকলন। আর زيادة الجامع الصغير তাঁর রচিত আরেকটি সংকলন, যা তিনি পূর্ববর্তী সংকলনের সাথে যুক্ত করার জন্য রচনা করেন। কিন্তু সংযোজনের পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে শায়খ ইউসুফ নাবহানী (১৮৪৯-১৯৩২) এই অতিরিক্ত অংশকে মূল কিতাবের সাথে সংযোজন করে পুরো বইটি নতুনভাবে বিন্যস্ত করেন। আলবানী নাবহানীর উক্ত সংকলনটি তাহক্বীক্ব করেন এবং এর মধ্যকার যঈফ ও জাল হাদীছসমূহ পৃথক করে ‘ছহীহুল জামে‘ ও যঈফুল জামে‘ নামে পৃথকভাবে সংকলন করেন।[5] এখানে তিনি সনদ বাদ দিয়ে আরবী বর্ণমালার ধারাবাহিকতায় প্রথমে হাদীছের মতন উল্লেখ করেন। অতঃপর তার নীচে হাদীছটির হুকুম পেশ করেন। ছহীহ সংকলনটিতে মোট ৮২০২টি ছহীহ ও হাসান হাদীছ এবং যঈফ সংকলনটিতে মোট ৬৪৬৮টি যঈফ, যঈফ জিদ্দান ও মাওযূ‘ হাদীছ সংকলন করেন।[6]

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি গ্রন্থটি পুনরায় পরিমার্জন করেন। এতে কিছু ভুল সংশোধন হয় এবং কিছু হাদীছের হুকুম পরিবর্তন হয়।[7] এছাড়া পরবর্তীতে শায়খ যুহাইর শাবীশ ছহীহুল জামে‘-এর হাদীছসমূহকে ফিক্বহী অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ অনুসারে ভাগ করেন, যা ১৪০৬ হিজরীতে আল-মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে প্রকাশিত হয়।

৬. ছহীহ ও যঈফ সুনানে আরবা‘আ : তিনি সুনানে আরবা‘আ তথা সুনান আবূদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ-এর সংক্ষিপ্ত তাখরীজ করেন। প্রত্যেক গ্রন্থকে তিনি ছহীহ ও যঈফ দু’ভাগে ভাগ করেন। অভূতপূর্ব এই কাজের জন্য তিনি বহু মানুষের সমালোচনার শিকার হন। এমনকি সমসাময়িক অনেক মুহাদ্দিছ বিদ্বানও তাঁর এই পৃথকীকরণের সমালোচনা করেন। কিন্তু সবকিছুর পরেও তিনি স্বীয় মতে দৃঢ় থাকেন এবং যুক্তি পেশ করেন এ মর্মে যে, ‘আমার লক্ষ্য হ’ল মুসলিম উম্মাহর হাতে ছহীহ সুন্নাহকে পৌঁছে দেওয়া। তাই এরূপ পৃথকীকরণ আমার উদ্দেশ্যের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল’।

তিনি বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর পূর্বে আমি যখন ছহীহ ও যঈফ আবূদাঊদ এবং এরূপ অন্যান্য কাজগুলো করতে শুরু করি, তখন কিছু সম্মানিত ব্যক্তি এরূপ পৃথকীকরণের ব্যাপারে একমত ছিলেন না। …নিঃসন্দেহে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। …কিন্তু উপরোক্ত পৃথকীকরণের যে উপকার, তাও অস্বীকার করা যায় না। বরং এটা সাধারণ, বিশেষ সকল শ্রেণীর মুসলমানের জন্য অধিক উপকারী। কেননা স্বাভাবিকভাবে সর্বজনবিদিত যে, উপরোক্ত পৃথকীকৃত হাদীছসমূহ (ছহীহ ও যঈফ) একই কিতাবের মধ্যে সংকলিত হ’লে সব ধরনের মানুষের পক্ষে তা মুখস্থ করা স্বভাবগতভাবেই অসম্ভব। বরং অধিকাংশের জন্যই তা দুঃসাধ্য। তবে (তা সম্ভব হবে) যদি ছহীহগুলো একটি কিতাবে এবং যঈফগুলো আরেকটি কিতাবে সংকলিত হয়। …অতএব আল্লাহর নিকট বিনীত প্রার্থনা- তিনি যেন আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন’।[8]

মূলতঃ ‘মাকতাবাতুত তারবিয়াতিল ‘আরাবিইয়াহ লি দুওয়ালিল খালীজ’-এর অনুরোধক্রমে তিনি সুনানুল আরবা‘আর কাজটি সম্পন্ন করেন। তিনি প্রত্যেকটি হাদীছের সনদসহ হুকুম পেশ করলেও প্রকাশনীর পক্ষ থেকে কেবল হুকুমটুকু রেখে সনদ বাদ দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

উপরোক্ত চারটি সুনানের ক্ষেত্রে তিনি যে নীতি অবলম্বন করেছেন তা হ’ল- (১) প্রত্যেক হাদীছের নীচে তার হুকুম পেশ করেছেন এবং স্বীয় তাহক্বীক্বকৃত কোন গ্রন্থে তা সংকলিত থাকলে তা উল্লেখ করেছেন (২) হাদীছের সাথে কোন টীকা পেশ করেননি। এরপরেও যেসব টীকা সেখানে উদ্ধৃত হয়েছে তা প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে সংযুক্ত (৩) স্বীয় অন্য কোন গ্রন্থে তাখরীজ করা হয়নি, এরূপ হাদীছের ক্ষেত্রে হাদীছ শাস্ত্রের নীতি অনুযায়ী কেবল ঐ সনদের উপর হুকুম পেশ করেছেন। পরবর্তীতে অন্য কোন গ্রন্থে যখন ঐ হাদীছের পূর্ণাঙ্গ তাখরীজ পেশ করেছেন, তখন কোন কোন ক্ষেত্রে শাওয়াহেদ ও মুতাবা‘আতের ভিত্তিতে হুকুম পরিবর্তন করেছেন। ফলে উভয় হুকুম কখনো পরস্পর বিরোধী মনে হ’লেও বিষয়টি তেমন নয়।

উল্লেখ্য যে, ছহীহ ও যঈফ পৃথকীকরণের কাজটি আলবানী নিজে করেননি। বরং মাকতাবাতুল ইসলামীর স্বত্বাধিকারী প্রফেসর যুহাইর শাবীশ কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ১৪০৬ হিজরীতে ‘মাকতাবাতুত তারবিয়াহ’ থেকে ছহীহ ও যঈফ পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশিত হ’লেও ১৪১৭ হিজরীতে চারটি গ্রন্থ পৃথক পৃথকভাবে ছহীহ ও যঈফ একত্রে পুরাতন ক্রমিক ঠিক রেখে রিয়াদের ‘দারুল মা‘আরেফ’ থেকে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এই সংস্করণটিই অধিক প্রচলিত।[9]

৭. ছহীহ ও যঈফ সুনান আবী দাঊদ (উম্ম) : সুনান আবূদাঊদের এই সংস্করণটি তিনি ভিন্ন মানহাজে সিলসিলা ছহীহাহ বা যঈফাহ-এর মত বিস্তারিত তাহক্বীক্বসহ বৃহদাকারে সংকলন করতে শুরু করেছিলেন এবং ছহীহ ও যঈফ মিলে ৩২৯৫টি হাদীছ তথা ‘কিতাবুল জানায়েয’ পর্যন্ত তাহক্বীক্ব সম্পন্ন করেন। এছাড়া একটি দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রচনা করেন। কিন্তু তিনি তা শেষ করতে পারেননি। ২০০২ সালে কুয়েতের ‘মুআসসাতু গার্রাস’ থেকে ছহীহ আবূদাঊদটি ৮ খন্ডে এবং যঈফ আবূদাঊদটি ২ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

৮. মিশকাতুল মাছাবীহ : উক্ত গ্রন্থটি আলবানী ২ বার তাহক্বীক্ব করেন। প্রথম তাহক্বীক্বে সমসাময়িক মুহাদ্দিছ আব্দুল ক্বাদের আরনাউত্ব এবং মুহাম্মাদ আছ-ছাববাগ তাকে সাহায্য করেন। এখানে মোট ৬২৯৪টি হাদীছের তাহক্বীক্ব করা হয়। যা তিন খন্ডে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘আল-মাকতাবুল ইসলামী’ থেকে প্রকাশিত হয়। তবে এতে তথ্যসূত্রের ঘাটতি থাকায় আলবানী সন্তুষ্ট ছিলেন না। এছাড়া পরবর্তীতে এতে বেশ কিছু ভুল পরিলক্ষিত হওয়ায় তিনি পুনরায় এটি তাহক্বীক্ব করেন, যা মিশকাত তাহক্বীক্ব ছানী নামে পরিচিত। কিন্তু তা পৃথকভাবে আর প্রকাশিত হয়নি।

পরবর্তীতে আলবানীর মৃত্যুর এক বছর পূর্বে আলবানীর প্রিয় ছাত্র জর্দানের সালাফী বিদ্বান আলী আল-হালাবী তাঁর নিকটে লেবাননের ‘মাকতাবা হামীদিইয়াহ’য় সংরক্ষিত মিশকাতুল মাছাবীহের তাখরীজে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) রচিত ‘হেদায়াতুর রুওয়াত’ গ্রন্থটির পান্ডুলিপি তাহক্বীক্ব করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এতে তিনি খুশী হন এবং উক্ত তাহক্বীক্ব ছানীর মূল পান্ডুলিপিটি তাকে সমর্পণ করেন। অতঃপর হালাবী ‘হেদায়াতুর রুওয়াত’ গ্রন্থটি তাহক্বীক্ব সম্পন্ন করেন এবং এর সাথে আলবানীর তাহক্বীক্ব সংযুক্ত করেন।[10]

৯. ছহীহুস সীরাতিন নববীইয়াহ : এটি হাফেয ইবনু কাছীর রচিত আস-সীরাতুন নববীইয়াহ-এর তাহক্বীক্ব হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী সংশ্লিষ্ট ছহীহ বর্ণনাসমূহ সংকলন করেছেন। এছাড়া ইবনু কাছীরের সীরাতের উপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী পেশ করেছেন। তিনি মাক্কী জীবনের শেষভাগ তথা ইসরা ও মি‘রাজ অধ্যায় পর্যন্ত আলোচনা করতে সমর্থ হন। অতঃপর কাজটি সমাপ্ত করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে ১৪২১ হিজরীতে মাকতাবুল ইসলামী থেকে এটি এক খন্ডে প্রকাশিত হয়।

১০. ফিক্বহুস সীরাহ : মিসরীয় বিদ্বান মুহাম্মাদ আল-গাযালী (১৯১৭-১৯৯৭ খৃ.) লিখিত উক্ত গ্রন্থটি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। এখানে লেখক ধারাবাহিকভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন চিত্র অংকন করেছেন এবং বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আলবানী এর বর্ণনাসমূহ তাখরীজ করেন। ফলে এটি পাঠক সমাজের নিকটে আরো গ্রহণযোগ্য স্থান করে নিতে সক্ষম হয়।

১১. যিলালুল জান্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ : ২ খন্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিতে ইমাম আবূবকর আহমাদ ইবনু আবী আছেম শায়বানী[11] রচিত ‘কিতাবুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে সংকলিত হাদীছসমূহের তাহক্বীক্ব ও সনদ সম্পর্কিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। তবে কাজটি তিনি পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি। বরং এখানে সংকলিত ১৫৫৯টি হাদীছের মধ্যে ১২০৮টি হাদীছের তাহক্বীক্ব করেছেন। এছাড়া গ্রন্থটির পরবর্তী মুহাক্কিক[12] প্রফেসর ড. বাসেম-এর বক্তব্য অনুযায়ী আলবানী গ্রন্থটির তাহক্বীক্ব শেষ করার পূর্বে তাঁর অজান্তেই বইটি প্রকাশিত হয়। সেকারণ এখানে কোন টীকা, ভূমিকা ও সূচীপত্র নেই। এছাড়া আলোচনার মাঝে মারাত্মক কিছু ভুল পরিলক্ষিত হয়। যেমন কোন স্থানে রাবীর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, কোন স্থানে একটি হাদীছের তাখরীজ অন্য হাদীছে যুক্ত হয়ে গেছে, হাদীছের কিছু অংশ বাদ পড়ে গেছে ইত্যাদি।[13]

১২. আত-তা‘লীকাতুল হিসান ‘আলা ছহীহ ইবনি হিববান : ১২ খন্ডে প্রকাশিত বৃহদায়তন এই গ্রন্থটি আলবানী শেষ জীবনের কর্ম হিসাবে গণ্য করা হয়। আলবানী ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে কাজটি শুরু করেন এবং মোট ৭৪৪৮টি হাদীছ তাখরীজ করেন। ১৪২৩ হিজরীতে তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

১৩. ছহীহ মাওয়ারিদিয যামআন ইলা যাওয়াইদে ইবনে হিববান : ইমাম ইবনু হিববান স্বীয় গ্রন্থে বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ ব্যতীত অন্য যে হাদীছসমূহ সংকলন করেছেন, তা নিয়ে হাফেয হায়ছামী (রহঃ) উক্ত গ্রন্থটি হাদীছের সনদ ব্যতীত অধ্যায়ভিত্তিক সংকলন করেছেন। আলবানী ছহীহ ইবনু হিববানের তাখরীজ করলেও গুরুত্ব বিবেচনায় এই গ্রন্থটিও তাখরীজ করেন। অনেকে সন্দেহ করে থাকেন যে, তা‘লীকুল হিসান গ্রন্থটি আলবানী নিজে তাহক্বীক্ব করেননি বরং পরবর্তীতে তাঁর ছাত্রবৃন্দ কাজটি সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু গ্রন্থটির উপর আলবানী নিজ হস্তলিখিত পান্ডুলিপি প্রমাণ করে যে উভয়টি তিনি নিজ হাতেই সম্পন্ন করে গেছেন। 

‘মাওয়ারেদুয যামআনে’র শুরুতে তিনি ৮৩ পৃষ্ঠার এক বিশাল ভূমিকা রচনা করেছেন। যেখানে তিনি মাওয়ারেদুয যামআন ও ছহীহ ইবনু হিববানের মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেছেন। সাথে সাথে ইবনু হিববান-এর ‘ছিক্বাত’ গ্রন্থটি নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে তিনি বিস্তারিত দলীল পেশ করে ইবনু হিববান যে স্বীয় গ্রন্থে রাবীদের মান নির্ধারণে শৈথিল্যবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন, তা প্রমাণ করেছেন।

১৪. গায়াতুল মারাম ফী তাখরীজি আহাদীছিল হালাল ওয়াল হারাম : গ্রন্থটি ড. ইউসুফ আল-কারযাবী রচিত ‘হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম’ (ইসলামে হালাল ও হারামের বিধান)[14]-এর তাখরীজ। এখানে তিনি সর্বমোট ৪৮৪টি হাদীছের তাখরীজ করেছেন। এখানে মূলতঃ সংক্ষেপে হুকুম পেশ করা হ’লেও অনেক ক্ষেত্রে বিস্তারিত তাখরীজ ও তা‘লীক্ব সংযোজন করেছেন। অনেক মাসআলায় তিনি কারযাবীর বিরোধিতাও করেছেন। গ্রন্থটির নাম গায়াতুল মারাম বা ‘চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা’ রাখার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কারণ আল্লাহর নিকটে আমার একটাই চাওয়া যে, তিনি যেন আমার এই কাজটি কেবল তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কৃত হিসাবে কবুল করে নেন এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মুসলমান এবং মুহাক্কিক আহলে ইলম উপকৃত হন।[15] উল্লেখ্য, উক্ত গ্রন্থে আলবানী মোট ৯০টি হাদীছ যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর অন্যান্য গ্রন্থে ২৬টি হাদীছের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ছহীহ বা হাসান সাব্যস্ত করেছেন।

১৫. ইকতিযাউল ইলমিল আমাল : খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হি.) রচিত উক্ত গ্রন্থটিতে ‘জ্ঞানের চাহিদা হ’ল তদনুযায়ী আমল করা’ সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে অনেক হাদীছ, আছার, সালাফে ছালেহীনের মন্তব্য, কবিতা ইত্যাদি জমা করেছেন এবং জ্ঞানান্বেষীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশমালা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। মূল পান্ডুলিপি থেকে অনুলিখনের পর আলবানী এতে সংকলিত মোট ২০১টি হাদীছ ও আছারের তাহক্বীক্ব করেছেন এবং টীকা সংযোজন করেছেন। সাথে সাথে আলোচনার শুরুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা যোগ করেছেন। যেখানে তিনি খত্বীব বাগদাদী (রহঃ) ছহীহ-যঈফ হাদীছ সম্পর্কে উঁচু পর্যায়ের আলেম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আলোচ্য গ্রন্থটিসহ অন্যান্য গ্রন্থে এত বেশী যঈফ হাদীছ সংকলিত হ’ল কেন তার জবাব দিয়েছেন।[16]

১৬. তামামুল মিন্নাহ ফীত তা‘লীকি ‘আলা ফিক্বহিস সুন্নাহ : মিসরের প্রখ্যাত বিদ্বান শায়খ সাইয়েদ সাবিক (রহঃ)[17] রচিত ‘ফিক্বহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থটি কিতাব ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে রচিত মাযহাবী গোঁড়ামিমুক্ত অনন্য ও পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ। দলীলভিত্তিক আলোচনা, সুন্দর অধ্যায় বিন্যাস, সাবলীল রচনাপদ্ধতি এবং জটিলতামুক্ত শব্দচয়নের কারণে গ্রন্থটি সর্বমহলে জনপ্রিয়তা লাভ করে। গ্রন্থটির গুরুত্ব বিবেচনায় আলবানীসহ সমসাময়িক জ্ঞানপিপাসু ছাত্র ও শিক্ষকগণ তা থেকে ইলমী ফায়েদা হাছিল করতেন। তবে এর মধ্যে কিছু যঈফ হাদীছের সমাবেশ এবং ফিক্বহী ভুল-ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হ’লে আলবানী এর উপর তা‘লীক্ব পেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গ্রন্থটির ‘পবিত্রতা’ অধ্যায় থেকে ‘ছিয়াম’ অধ্যায় পর্যন্ত তথা এক-চতূর্থাংশের তা‘লীক্ব সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ইচ্ছা থাকলেও তার পক্ষে আর তা করা সম্ভব হয়নি। মূলতঃ তিনি এখানে সংকলিত হাদীছসমূহের প্রয়োজনীয় তাখরীজ ও বিভিন্ন মাসআলাগত ভুল-ত্রুটি, পরস্পর বিরোধী হাদীছের মাঝে সমন্বয় সাধন, ফিক্বহী জটিলতার সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এছাড়া গ্রন্থের শুরুতে ৪০ পৃষ্ঠাব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা সংযোজন করেছেন। যেখানে উছূলুল হাদীছ ও উছূলুল ফিক্বহের ১৫টি কায়েদা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করা হয়েছে।

১৭. মুখতাছারুল ‘ঊলূ লিল ‘আলিইয়িল ‘আযীম : হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী রচিত মূল গ্রন্থটি আল্লাহ তা‘আলার আরশে অবস্থান সম্পর্কে রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। আলবানী গ্রন্থটি সংক্ষিপ্ত করেছেন, হাদীছ ও আছার সমূহ তাহক্বীক্ব, তাখরীজ করে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়েছেন, যঈফ বর্ণনাসমূহ বাদ দিয়েছেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ টীকা সংযোজন করেছেন। এছাড়া অর্থগত দিক থেকে কুরআন-হাদীছের বিপরীত কিছু ইসরাঈলী বর্ণনা এবং মূল ছাহাবী বা তাবি‘ঈর নাম ব্যতীত বাকী সনদ বাদ দিয়েছেন। সাথে সাথে গ্রন্থটির প্রথমে এ বিষয়ে সালাফে ছালেহীনের মানহাজ তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত একটি ভূমিকা লিপিবদ্ধ করেছেন।[18] বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে আলবানী বলেন, এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক একটি বিষয়। যে বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যেকার বহু মানুষ পথচ্যুত হয়েছেন। গ্রন্থটিতে এমন একটি মাসআলা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেটা মু‘তাযিলা মতবাদের উদ্ভবের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বাসগত দিক দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকর।[19]

১৮. আছ-ছামারুল মুসতাত্বাব ফী ফিক্বহিস সুন্নাহ ওয়াল কিতাব : ছহীহ দলীলের সমর্থনে রচিত ফিক্বহী গবেষণাপূর্ণ উক্ত গ্রন্থটি ফিক্বহের ময়দানে তাঁর হাদীছভিত্তিক রচনাসমূহের মধ্যে প্রথম রচনা হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানে তিনি ‘কিতাবুত ত্বাহারাত’ থেকে ‘ছালাতে ক্বিবলামুখী হওয়া’ অধ্যায় পর্যন্ত ধারাবাহিক আলোচনা পেশ করেছেন। মৃত্যুর ২ বছর পর তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরী থেকে মূল পান্ডুলিপিটি উদ্ধার করে কুয়েতের ‘মুআসসাসাতু গার্রাস’ দুই খন্ডে প্রকাশ করে।

১৯. বেদায়াতুস সূল ফী তাফযীলির রাসূল : প্রখ্যাত বিদ্বান ইয ইবনু ‘আব্দিস সালাম[20] রচিত উক্ত বইটিতে রাসূল (ছাঃ)-এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে চমৎকার আলোচনা পেশ করা হয়েছে। আলবানী এতে বর্ণিত হাদীছসমূহ তাখরীজ করেছেন এবং বিস্তারিত তা‘লীক্ব সংযুক্ত করেছেন। সাথে সাথে বইটির শুরুতে ২৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী ভূমিকা রচনা করেছেন। যেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত পরিসরে রাসূল (ছাঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনায় অধিকাংশ ছহীহ হাদীছ সংকলিত হওয়ায় আলোচ্য বইটির প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে সনদবিহীন ও কুরআনের আয়াত এবং ছহীহ হাদীছ বিরোধী বহু যঈফ ও জাল বর্ণনা সংকলিত হওয়ায় একই বিষয়ে ইমাম সুয়ূত্বী (রহঃ)-এর লিখিত তিন খন্ডের বৃহৎ গ্রন্থ ‘আল-খাছাইছুল কুবরা’-এর সমালোচনা করেছেন এবং সেখান থেকে এরূপ অনেক উদাহরণ তুলে ধরেছেন। অথচ সুয়ূত্বী (রহঃ) বইটির ভূমিকাতে সকল প্রকার জাল ও বাতিল বর্ণনা থেকে তা মুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। আলোচনার শেষে আলবানী রাসূল (ছাঃ) নামে প্রচলিত জাল-যঈফ হাদীছসমূহ পরিত্যাগ করে বিশুদ্ধ হাদীছ অনুসরণের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।

২০. আল-আয়াতুল বাইয়েনাত ফী ‘আদমি সিমাঈল আমওয়াত : মৃত ব্যক্তিরা যে কোন কিছু শুনতে পায় না সে ব্যাপারে কুরআন-হাদীছ ও বিশেষত হানাফী ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য তুলে ধরে ইরাক্বী বিদ্বান মাহমূদ আলূসী (১৮৩৬-১৮৯৯ খৃ.) রচিত উক্ত সমৃদ্ধ রিসালাটি পান্ডুলিপি আকারে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল। আলবানী গ্রন্থটির অনুলিপি করেন এবং বিস্তর পরিমার্জনের পর তা প্রকাশ করেন। তিনি সেখানে সংকলিত হাদীছসমূহের তাখরীজ ও তাহক্বীক্ব করেন এবং কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে টীকা সংযোজন করেন। বইটির ভূমিকায় তিনি মাযহাবী গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন। অতঃপর ‘মৃত সৎ ব্যক্তিগণ যে মানুষের ওযর-আবদার শুনতে পান এবং তা পূরণ করতে পারেন’ এই শিরকী আক্বীদা অপনোদনে ৫৩ পৃষ্ঠা ব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা পেশ করেছেন।[21]

২১. রাফঊল আছতার লি ইবতালি আদিল্লাতিল ক্বাইলীনা ফানাইন নার : আল্লামা ছান‘আনী (১০৯৯-১১৮২ হি.) লিখিত উক্ত গ্রন্থটিতে যেসব ওলামায়ে কেরাম ‘জাহান্নাম এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে’ বলে মত প্রকাশ করেছেন, তাদের সিদ্ধান্ত বিভিন্ন দলীল প্রমাণের মাধ্যমে খন্ডন করা হয়েছে। সালাফে ছালেহীনের কেউ কেউ এ ব্যাপারে মত প্রকাশ করলেও বিস্ময়কর হ’ল যে, একই মত প্রকাশ করেছেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ ও তাঁর বিখ্যাত ছাত্র ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)। শায়খ আলবানী এর তাহক্বীক্ব ও তা‘লীক্ব করেছেন এবং শুরুতে ৪৭ পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকা লিখেছেন। সেখানে তিনি তাঁদের এই সিদ্ধান্তকে ভুল সাব্যস্ত করে একে ইজতিহাদী ভুল হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাঁদের মহান খেদমতের তুলনায় এই ভুলকে খুবই সামান্য বলে মত প্রকাশ করেছেন।

২২. ছহীহ ইবনু খুযায়মা : গ্রন্থটি সমকালীন মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ মুছত্বফা আ‘যমী[22] তাহক্বীক্ব করেছেন এবং আলবানী এর হাদীছসমূহর পুনর্নিরীক্ষণ করেছেন। আ‘যমী আলবানীর তাহক্বীক্ব সম্পর্কে বলেন, আমি বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ ব্যতীত ইবনু খুযায়মায় সংকলিত অন্য হাদীছসমূহের উপর ছহীহ, হাসান, যঈফ-এর হুকুম লাগানোর পর এ ব্যাপারে আরও আশ্বস্ত হওয়ার মনস্থ করি। তাই আমি প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ উস্তায মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানীর নিকটে বইটি পুনর্নিরীক্ষণ করার জন্য বিশেষত আমার সংযুক্ত টীকাসমূহ দেখার জন্য অনুরোধ জানাই। আল্লাহর শুকরিয়া তিনি আমার চাওয়া গ্রহণ করেন। এজন্য আল্লাহ তাকে উত্তম জাযা দান করুন! যেখানে উস্তাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী ছহীহ বা যঈফ সাব্যস্তকরণের ক্ষেত্রে আমার বিপরীত করেছেন, তখন আমি তাঁর সিদ্ধান্তকেই গ্রহণ করেছি। কারণ তাঁর ইলম ও দ্বীনদারীর ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। এছাড়া ইলমী আমানত রক্ষার্থে তাঁর বক্তব্যের পাশে বন্ধনীর মাঝে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেন আমার ও তাঁর বক্তব্যের মাঝে পার্থক্য করা যায়।[23]

এছাড়া তিনি আরো বহু গ্রন্থের তাহক্বীক্ব, তাখরীজ ও তা‘লীক করেছেন। যেমন শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) লিখিত আল-ইহতিজাজ বিল ক্বাদর, আল-ঈমান, দো‘আ বিষয়ক ছহীহুল কালিমিত ত্বাইয়েব, হিজাবুল মারআতি ওয়া লিবাসিহা, ইবনু হামদান আল-হার্রানী (রহঃ)-এর ছিফাতুল ফৎওয়া ওয়াল মুফতী; ইবনু আবীল ‘ইয হানাফী রচিত শারহুল আক্বীদাতিত ত্বহাবিইয়াহ; ইমাম নববী-এর রিয়াযুছ ছালেহীন; ইবনুল জাওযীর ছায়দুল খাত্বের; ইবনু হাজার আসক্বালানীর নুযহাতুন নযর; ইবনুল ক্বাইয়িম-এর ইগাছাতুল লাহফান; ছিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালীর আর-রাওযাতুন নাদিইয়াহ; ইমাম জামালুদ্দীন ক্বাসেমী (রহঃ)[24]-এর ইছলাহুল মাসাজিদ মিনাল বিদঈ ওয়াল ‘আওয়াইদ; ড. ইউসুফ আল-কারযাবীর মুশকিলাতুল ফিকার ওয়া কাইফা ‘আ-লাজাহাল ইসলাম; ইমাম ছান‘আনীর সুবুলস সালাম; আল্লামা রশীদ রিযার হুকূকুন নিসা ফিল ইসলাম, শায়খ হাসানুল বান্না সংকলিত আল-মারআতুল মুসলিমাহ; মাওলানা আবুল আ‘লা মওদূদীর আল-মুছত্বলাহাতুল আরবা‘আহ ফীল কুরআন প্রভৃতি। (চলবে)

[1]প্রশ্ন আসতে পারে যে, আল-আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থটি ইমাম বুখারী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে যঈফ বর্ণনা থাকার কারণ কি? এর উত্তর হ’ল- ইমাম বুখারী ছহীহুল বুখারী সংকলনের ক্ষেত্রে যেসব কঠিন শর্তসমূহ আরোপ করেছিলেন, আল-আদাবুল মুফরাদ বা তাঁর অন্যান্য গ্রন্থে সেসব শর্ত আরোপ করেননি। ফলে সেখানে অনেক যঈফ হাদীছ স্থান পেয়েছে, যা পৃথক করা তাঁর জীবদ্দশায় সম্ভব হয়নি। তাই তিনি নিজ থেকে সেগুলোর ছহীহ-যঈফ হওয়ার ব্যাপারে কোন হুকুম পেশ করেননি। বরং প্রত্যেকটি হাদীছ সনদসহ বর্ণনা করেছেন। যাতে পরবর্তী মুহাদ্দিছগণ সনদের উপর গবেষণা করে ছহীহ-যঈফ বাছাই করে নিতে পারেন। দ্র. মাসিক আত-তাহরীক (রাজশাহী : ১৯তম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০১৬ খ্রি.), প্রশ্নোত্তর নং ৩৭/১৯৭।

[2]. মিসরীয় বিদ্বান মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাক্বী (১৮৮২-১৯৬৭ খৃ.) হাদীছে নববীর তাহক্বীক্ব, তাখরীজ ও সূচীপত্র তৈরীর ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি হাদীছের শব্দসমূহ আরবী বর্ণমালার ধারাবাহিকতায় সাজিয়ে এক অনন্য সাধারণ সূচীপত্র তৈরী করেন। তিনি যেসব হাদীছ ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয়ে স্ব স্ব কিতাবে সংকলন করেছেন, সেগুলো নিয়ে বিখ্যাত সংকলন ‘আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান ফীমা ইত্তাফাক্বা আলাইহিশ শায়খান’ গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি কুরআনের দুর্বোধ্য শব্দসমূহ নিয়ে ‘মু‘জামু গারীবিল কুরআন’ রচনা করেন। এছাড়া তিনি ছহীহ মুসলিম, মুওয়াত্ত্বা ইমাম মালিক, সুনানু ইবনি মাজাহ, ফাৎহুল বারী প্রভৃতি গ্রন্থের সূচীপত্র তৈরী করেন এবং সূক্ষ্মভাবে পরিমার্জন করে তা প্রকাশ করেন। দ্বীনী ইলমের ময়দানে প্রভূত খেদমত আঞ্জাম দিলেও বাহ্যিকভাবে তিনি ছিলেন দাড়িবিহীন, মোটা গোফধারী এবং আপাদমস্তক ইংরেজ বেশভূষায় অভ্যস্ত। স্বীয় কর্মকান্ডের ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সদা কর্মচঞ্চল, ইখলাছপূর্ণ নিয়তের অধিকারী, স্বল্পাহারী অনন্য প্রতিভাধর এই মানুষটি নিষিদ্ধ দিনগুলো ব্যতীত সারা বছর ছিয়াম পালন করতেন। দ্র. আল-আ‘লাম, ৬/৩৩৩; ছহীহুল আদাবিল মুফরাদ (সঊদী আরব : মাকতাবাতুদ দালীল, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ২৯, টীকা দ্র.; উইকিপিডিয়া।

[3]. আলবানী, ছহীহুল আদাবিল মুফরাদ, পৃ. ২৮-৩২; জুহূদুশ শায়খ আলবানী ফিল হাদীছ, পৃ. ৬৪।

[4]. বহু গ্রন্থপ্রণেতা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (১৪৪৫-১৫০৫ খৃ.) মিসরের রাজধানী কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি হিজায, শাম, ইয়ামন, ভারত, মরক্কো প্রভৃতি দেশে সফর করেন। শাসক শ্রেণী প্রদত্ত কোন উপহার তিনি গ্রহণ করতেন না এবং তাদের কোন আহবানে সাড়া দিতেন না। তাফসীর, ফিক্বহ, হাদীছ, উছূলে হাদীছ, ব্যাকরণ, ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছয় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। দ্র. আল-আ‘লাম, ৩/৩০২।

[5]. জুহুদুশ শায়খ আলবানী ফিল হাদীছ, পৃ. ৬৫।

[6]. আলবানী, ছহীহুল জামে‘ঈছ ছগীর ওয়া যিয়াদাতুহু (বৈরূত : আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ৬-৮।

[7]. নাছিরুদ্দীন আলবানী : মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ৮৫।

[8]. আলবানী, যঈফুল আদাবিল মুফরাদ (সঊদী আরব : মাকতাবাতুদ দালীল, ৪র্থ প্রকাশ, ১৯৯৮ খ্রি.), ভূমিকা, পৃ. ৬।

[9]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী : মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ পৃ. ৮৬-৮৮; আলবানী, সুনানুত তিরমিযী (ছহীহ ও যঈফ) (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, তাবি), পৃ. ৫-৬।

[10]. ইবনু হাজার, হেদায়াতুর রুওয়াত ইলা তাখরীজি আহাদীছিল মাছাবীহ ওয়াল মিশকাত (মিসর : দারু ইবনি আফফান, ১ম প্রকাশ, ২০০১ খ্রি.), ভূমিকা, পৃ. ৩-৮।

[11]. বছরার এই প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ (২০৬-২৮৭)-এর পিতা, দাদা ও নানা সবাই স্বীয় যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ছিলেন। তিনি প্রায় তিনশ’ গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫০ হাযার হাদীছ সমৃদ্ধ ‘আল-মুসনাদুল কাবীর’ এবং ২০ হাযার হাদীছ সমৃদ্ধ ‘আল-আহাদ ওয়াল মাছানী’। তবে ‘কিতাবুস সুন্নাহ’ তাঁর প্রসিদ্ধতম গ্রন্থ। দ্র. আল-আ‘লাম, ১/১৮৯।

[12]. আলবানীর মৃত্যুর পর তার ছাত্র রিয়াদের জামি‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ বিভাগের প্রফেসর ড. বাসেম বিন ফয়ছাল আল-জাওয়াবেরাহ গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ ও আরো বিস্তারিত তাহক্বীক্ব ও তা‘লীক্ব সংযোজন করেছেন। দ্র. যিলালুল জান্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ, তাহক্বীক্ব : আলবানী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৪০০ হি.), পৃ. ৫-৭।

[13]আবূ বকর ইবনি আবী আছেম শায়বানী, আস-সুন্নাহ, তাহক্বীক্ব : ড. বাসেম বিন ফয়ছাল আল-জাওয়াবেরাহ (রিয়াদ : মাকতাবাতুছ ছুমাই‘ঈ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ৮-১৩।

[14]. এটি বিশ্বময় জনপ্রিয় একটি গ্রন্থ। বাংলাসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।

[15]. আলবানী, গায়াতুল মারাম ফী তাখরীজিল হালাল ওয়াল হারাম (দামেশক : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ১০-১৩; মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী : মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ পৃ. ৯১-৯২।

[16]. খত্বীব আল-বাগদাদী, ইকতিযাউল ইলমিল আমাল (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০২ খ্রি.), পৃ. ১-৬।

[17]. প্রখ্যাত মিসরীয় বিদ্বান সাইয়েদ সাবিক্ব (১৯১৫-২০০০ খৃ.) আযহার বিশ্ববিদ্যালয়-এর শরী‘আহ বিভাগে অধ্যয়ন করেন। তিনি ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’-এর সাথে জড়িত ছিলেন এবং বিভিন্ন কারণে কয়েকবার কারাবরণ করেন। ১৪৩৪ হিজরীতে ফিক্বহী ময়দানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি বাদশাহ ফয়ছাল পুরস্কার লাভ করেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি মক্কাস্থ উম্মুল ক্বোরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন। দ্র. উইকিপডিয়া।

[18]. আলবানী, মুখতাছার কিতাবুল ‘উলূইল ‘আলী আল-‘আযীম (দামেশক : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ১১-২২।

[19]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, পৃ. ৮৮৩।

[20]. সুলতানুল ওলামা ইযযুদ্দীন আব্দুল আযীয বিন আব্দিস সালাম আস-সুলামী (৫৭৭-৬৬০ হি.) দামেশকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিখ্যাত ও প্রাচীনতম দুই মসজিদ সিরিয়ার উমাইয়া মসজিদ ও মিসরের ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব মসজিদের খত্বীব ছিলেন। তিনি মিসরে কাযী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাতারদের বিরুদ্ধে এবং ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সময় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। শেষ জীবনে তিনি মক্কাস্থ মাসজিদুল হারাম লাইব্রেরীতে দায়িত্বরত ছিলেন। দ্র. আল-আ‘লাম, ৪/২১।

[21]. আলূসী, আল-আয়াতুল বাইয়েনাত ফী আদমে সিমা‘ইল আমওয়াত ‘আলা মাযহাবিল হানাফিইয়াহ আস-সাদাত, (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০৫ খ্রি.), পৃ. ৪-৬৯।

[22]. মুছতবফা আ‘যমী১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের মৌ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে তিনি মিসরে গমন করেন এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি মক্কার উম্মুল ক্বোরা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার মিশিগান, প্রিন্সটন এবং কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সর্বশেষ রিয়াদের কিং সঊদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর এমিরিটাস হিসাবে কর্মরত আছেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামী গবেষণার জন্য তাঁকে সম্মানজনক কিং ফয়ছাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করা হয়। দ্র. সাইয়েদ আব্দুল মাজেদ আল-গাওরী, শায়খ মুছত্বফা আল-আ‘যামী ওয়া মুসাহামাতুহুল ‘ইলমিইয়াহ ফী মাজালিল হাদীছিন নববী (মালয়েশিয়া : মাজাল্লাতুল হাদীছ, ৪র্থ বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, ডিসেম্বর, ২০১৪ খ্রি.), পৃ. ১৮৬-১৯০; উইকিপিডিয়া।

[23]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, তাহক্বীক্ব : ড. মুছত্বফা আ‘যামী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ৩২-৩৩।

[24]. ইমাম জামালুদ্দীন ক্বাসেমী (১২৮৩-১৩৩২ হি.) স্বীয় যুগে সিরিয়ার প্রখ্যাত ইমাম, আলেম এবং সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি তাফসীর জগতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘মাহাসিনুত তা’বীল’-এর রচয়িতা। এছাড়া ক্বাওয়ায়েদুত তাহদীছ মিন ফুনূনি মুছত্বালাহিল হাদীছ তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। দ্র. আল-আ‘লাম, ২/১৩৫।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top