ঘুমানোর পূর্বে করণীয় এবং দো‘আ ও যিকির

ঘুম মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের পুনরুদ্ধার, মস্তিষ্কের কার্যক্রম এবং সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু, আপনি কি জানেন যে, কত ঘণ্টা ঘুমানো উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর আপনার বয়স, জীবনযাত্রার ধরন এবং শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। শিশুদের শরীর দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তাদের শারীরিক এবং মানসিক উন্নয়ন ঘটে। এজন্য তাদের অধিক সময় ঘুমানো দরকার। (ক) ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ১০-১৩ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এই বয়সে ঘুম তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং শরীরের বৃদ্ধিতে সহায়ক। (খ) ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ৯-১১ ঘণ্টা ঘুম দরকার। স্কুল, পড়াশোনা, খেলা এবং অন্যান্য কার্যকলাপের জন্য এই সময়টা আদর্শ। (গ) ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জন্য ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম করা উচিত। এই বয়সে শরীর এবং মন দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, তাই পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। (ঘ) প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭-৯ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। এই বয়সে ঘুমের গুরুত্ব আরও বেশি হয়ে উঠে, কারণ এটি শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধার এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ঘুমের অভাব মানসিক চাপ, অস্থিরতা, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং আমরা যে যতটুকু ঘুমাতে চাই তা হতে হবে সুন্নাতী পদ্ধতিতে। বিশেষ করে রাতের ঘুমানোর পূর্বে কিছু করণীয়, দোআ ও যিকির রয়েছে যা জানা আমাদের জন্য অতিব আবশ্যক। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-

ক. ওযূ করে ঘুমাতে যাওয়া :

(১) আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,  مَنْ بَاتَ طَاهِرًا بَاتَ فِي شِعَارِهِ مَلَكٌ، لاَ يَسْتَيْقِظُ سَاعَةً مِنْ لَيْلٍ إِلاَّ قَالَ الْمَلَكُ : اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فُلاَنٍ، فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِرًا. ‘যে ব্যক্তি ওযূ করে শয্যাগ্রহণ করে, তার শরীরের সাথে থাকা বস্ত্রের মাঝে একজন ফেরেশতা রাত্রি যাপন করেন। যখনই সে ব্যক্তি জাগ্রত হয়, তখন ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! আপনি অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয়ই সে ওযূ করে শয়ন করেছে’।১ 

অন্যত্র তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

طَهِّرُوْا هَذِهِ الأَجْسَادَ طَهَّرَكُمُ اللهُ، فَإِنَّهُ لَيْسَ عَبْدٌ يَبِيْتُ طَاهِرًا إِلاَّ بَاتَ مَلَكٌ فِيْ شِعَارِهِ لاَ يَنْقَلِبُ سَاعَةً مِّنَ اللَّيْلِ إِلاَّ قَالَ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِرًا.

‘তোমাদের শরীরকে পবিত্র রাখ। আল্লাহ তোমাদেরকে পবিত্র করবেন। যে ব্যক্তি পবিত্রার সাথে (ওযূ অবস্থায়) রাত অতিবাহিত করবে, অবশ্যই একজন ফেরেশতা তার সঙ্গে রাত অতিবাহিত করবেন। রাতে যখনই সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই সে ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! আপনার এই বান্দাকে ক্ষমা করুন। কেননা সে পবিত্রাবস্থায় ঘুমিয়েছে’।২

(২) মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَبِيْتُ عَلَى ذِكْرٍ طَاهِرًا فَيَتَعَارُّ مِنَ اللَّيْلِ فَيَسْأَلُ اللهَ خَيْرًا مِنَ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهُ. ‘যে কোন মুসলমান রাতে দো‘আ ও যিকির পাঠ করে এবং ওযূ করে শয়ন করে, সে যদি রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোন কল্যাণ আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে, তাহ’লে আল্লাহ তাকে তা দান করেন’।৩

খ. বিছানা ঝেড়ে পরিস্কার করা :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا أَوَى أَحَدُكُمْ إِلَى فِرَاشِهِ فَلْيَنْفُضْ فِرَاشَهُ بِدَاخِلَةِ إِزَارِهِ ، فَإِنَّهُ لاَ يَدْرِى مَا خَلَفَهُ عَلَيْهِ، ثُمَّ يَقُولُ بِاسْمِكَ رَبِّ وَضَعْتُ جَنْبِى ، وَبِكَ أَرْفَعُهُ ، إِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِى فَارْحَمْهَا ، وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا تَحْفَظُ بِهِ الصَّالِحِينَ. ‘যদি তোমাদের কোন ব্যক্তি শয্যাগ্রহণ করতে যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির ভেতর দিক দিয়ে নিজের বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ, সে জানে না যে, বিছানার উপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোন কিছু আছে কিনা। তারপর পাঠ করবে, أَللَّهُمَّ إِنْ أَمْسَكْتَهَا فَارْحَمْهَا وَإِنْ أَرْسَلَتْهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا حَفِظْتَ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِينَ. অর্থাৎ, ‘হে আমার প্রভু! আপনারই নামে আমার শরীরটা বিছানায় রাখলাম এবং আপনারই নামে আবার উঠবো। যদি আপনি ইতোমধ্যে আমার জান কব্য করে নেন তা হ’লে, তার উপর রহম করবেন। আর যদি তা আমাকে ফিরিয়ে দেন, তবে তাকে এমনভাবে হিফাযত করবেন, যেভাবে আপনি আপনার নেক বান্দাদের হিফাযত করে থাকেন’।৪

গ. ঘুমানোর দো‘আ :

أَللهم بِاسْمِكَ أَمُوْتُ وَأَحْيَا.

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা বিস্মিকা আমূতু ওয়া আহ্ইয়া।

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি মরি ও বাঁচি। অর্থাৎ, তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমার দয়াতে আমি পুনরায় জাগ্রত হবো’।৫ 

ফযীলত : হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন বিছানায় ঘুমাতে যেতেন, তখন এ দো‘আ পাঠ করতেন, أَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا. অর্থাৎ, ‘তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমারই দয়ায় আমি পুনরায় জাগ্রত হবো’। আর তিনি যখন ঘুম থেকে জেগে উঠতেন তখন বলতেন, أَلْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَحْيَا نَفْسِى بَعْدَ مَا أَمَاتَهَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ. ‘সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ্র জন্য, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দানের পর জীবিত করলেন এবং ক্বিয়ামতের দিন তাঁর দিকেই সকলকে ফিরে যেতে হবে’।৬

ঘ. সকাল-সন্ধ্যা ও ঘুমানোর দো‘আ :

أَللهم عَالِمَ الغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ، رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَّمَلِيْكَهُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِيْ ، وَمِنْ شَرِّ الشَّيْطاَنِ وَشِرْكِهِ،

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ‘আ-লিমাল গাইবি ওয়াশ শাহা-দাতি, ফা-ত্বিরাস সামা-ওয়াতি ওয়াল আরযি, রাব্বা কুল্লি শাই’ইন ওয়া মালীকাহু, আশহাদু আল্ লা ইলা-হা ইল্লা আন্তা, আ‘ঊযু বিকা মিন শাররি নাফসী, ওয়ামিন শাররিশ শাইত্বা-নি ওয়াশিরকিহী।

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞাতা, প্রত্যেক বস্তুর রব ও মালিক! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া আর কোন  সত্য ইলাহ নেই। আমার মনের কু-প্রবৃত্তি, শয়তানের কুমন্ত্রণা ও তার র্শিকী হ’তে আপনার নিকট আশ্রয় চাইছি’।৭ 

ফযীলত : আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) নিকট বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ مُرْنِى بِكَلِمَاتٍ أَقُولُهُنَّ إِذَا أَصْبَحْتُ وَإِذَا أَمْسَيْتُ  ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আমাকে এমন কিছু কালিমা শিখিয়ে দিন যা আমি সকাল-সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে বলবো। তিনি বলেন, قُلْهَا إِذَا أَصْبَحْتَ وَإِذَا أَمْسَيْتَ وَإِذَا أَخَذْتَ مَضْجَعَكَ. ‘হে আবূ বাকর! তুমি উপরোক্ত কথাগুলো সকাল-সন্ধ্যা ও শোয়ার সময় বলবে’।৮

ঙ. আয়াতুল কুরসী পাঠ করা :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে ফিতরার মাল পাহারায় নিযুক্ত করলেন। এমন সময় আমার নিকট এক ব্যক্তি এসেই অঞ্জলি ভরে খাদ্যশস্য উঠাতে লাগল। আমি তাকে ধরে ফেললাম ও বললাম, আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে যাব। সে বলল, আমি একজন অভাবী লোক। আমার অনেক পোষ্য। আমি নিদারুণ কষ্টে আছি। তিনি বলেন, আমি তখন তাকে ছেড়ে দিলাম। ভোরে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, يَا أَبَا هُرَيْرَةَ مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ الْبَارِحَةَ. ‘হে আবূ হুরায়রা! তোমার হাতে গত রাতে বন্দী লোকটির কী অবস্থা?’ আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রসূল! বন্দীটি তার নিদারুণ অভাব ও বহু পোষ্যের অভিযোগ করল। তাই আমি তার ওপর দয়া করলাম এবং তাকে ছেড়ে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বললেন, أَمَا إِنَّهُ قَدْ كَذَبَكَ وَسَيَعُودُ. ‘শুনো! সে তোমার কাছে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে’।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর বলার কারণে বুঝলাম অবশ্যই সে আবার আসবে। আমি তার অপেক্ষায় রইলাম। ঠিক তাই, (পরের রাতে) সে আবার ফিরে এলো। দু’হাতের কোষ ভরে খাদ্যশস্য উঠাতে লাগল এবং আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে নিয়ে যাবো। সে বলল, তুমি আমাকে এবারও ছেড়ে দাও। আমি বড্ড অভাবী মানুষ। আমার পোষ্যও অনেক। আমি আর আসব না। এবারও আমি তার ওপর দয়া করলাম এবং ছেড়ে দিলাম। ভোরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, يَا أَبَا هُرَيْرَةَ ، مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ.  ‘হে আবূ হুরায়রা! তোমরা বন্দীর খবর কী?’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সে খুবই অভাবী।  আবারও বহু পোষ্যের অভিযোগ করল। তাই আমি তার প্রতি দয়া প্রদর্শন করলাম এবং ছেড়ে দিলাম। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন, أَمَا إِنَّهُ قَدْ كَذَبَكَ وَسَيَعُودُ. ‘শুনো তোমার কাছে সে মিথ্যা বলেছে। সে আবারও আসবে’।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি বুঝলাম, সে আবারও আসবে। তাই আমি তার অপেক্ষায় থেকে তাকে ধরে ফেললাম এবং তাকে বললাম, আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে যাব। এটা তিনবারের শেষবার। তুমি ওয়া‘দা করেছিলে আর আসবে না। এরপরও তুমি এসেছ। সে বলল, এবারও যদি আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে এমন কয়টি বাক্য শিখিয়ে দেব, যে বাক্যের দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন। তুমি শোবার জন্য বিছানায় গেলে আয়াতুল কুরসী পড়বে, ‘আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূম….। তাহ’লে আল্লাহ্র তরফ থেকে সব সময় তোমার জন্য একজন রক্ষী থাকবে এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান ঘেঁষতে পারবে না।

এবারও আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। ভোরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ الْبَارِحَةَ. ‘তোমার বন্দীর কী হ’ল?’ আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে আমাকে এমন কয়টি বাক্য শিখিয়ে দিয়েছে, যার দ্বারা আল্লাহ আমার উপকার করবেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, أَمَا إِنَّهُ قَدْ صَدَقَكَ وَهُوَ كَذُوبٌ ، تَعْلَمُ مَنْ تُخَاطِبُ مُنْذُ ثَلاَثِ لَيَالٍ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ. ‘এবার সে তোমাকে সত্য বলেছে অথচ সে খুবই মিথ্যুক। তুমি কি জানো, তুমি এ তিন রাত কার সাথে কথা বলেছ, হে আবূ হুরায়রা?’ আমি বললাম, জি-না। তখন তিনি বললেন, ذَاكَ شَيْطَانٌ. ‘এ ছিল একটা শয়তান’।৯ 

চ. সূরা বাক্বারাহর শেষ দু’টি আয়াত পাঠ করা :

(১) ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الآيَتَانِ مِنْ آخِرِ سُورَةِ الْبَقَرَةِ مَنْ قَرَأَ بِهِمَا فِى لَيْلَةٍ كَفَتَاهُ.  ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারাহর শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে, তা তার জন্য যথেষ্ঠ হবে’।১০ 

(২) নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ كِتَابًا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِأَلْفَىْ عَامٍ أَنْزَلَ مِنْهُ آيَتَيْنِ خَتَمَ بِهِمَا سُورَةَ الْبَقَرَةِ وَلاَ يُقْرَآنِ فِى دَارٍ ثَلاَثَ لَيَالٍ فَيَقْرَبُهَا شَيْطَانٌ. ‘আল্লাহ আসমান যমীন সৃষ্টির দুই হাযার বছর পূর্বে একটি কিতাব লিখেছেন। সেই কিতাব থেকে দু’টি আয়াত নাযিল করা হয়েছে। সেই দু’টি আয়াতের মাধ্যমেই সূরা আল-বাক্বারাহ সমাপ্ত করা হয়েছে। যে ঘরে তিন রাত এ দু’টি আয়াত তিলাওয়াত করা হয়, শয়তান সেই ঘরের সামনে আসতে পারে না’।১১

ছ. সূরা ফালাক্ব, নাস ও ইখলাছ তিনবার পাঠ করা :

আয়িশা (রাঃ) বলেন,

 أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ كُلَّ لَيْلَةٍ جَمَعَ كَفَّيْهِ ثُمَّ نَفَثَ فِيهِمَا فَقَرَأَ فِيهِمَا (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) وَ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِهِ يَبْدَأُ بِهِمَا عَلَى رَأْسِهِ وَوَجْهِهِ وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِهِ يَفْعَلُ ذَلِكَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ. 

‘আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দু’হাত একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যতদূর সম্ভব দেহে দু’হাত বুলাতেন। এভাবে তিনবার করতেন’।১২

জ. সূরা কা-ফিরূণ পাঠ করা :

(১) ফারওয়া বিন নওফেল স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে গেলাম এবং তাঁকে বললাম, নিদ্রাকালে কি বলব তা আমাকে শিক্ষা দিন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, إِقْرَأْ (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ) ثُمَّ نَمْ عَلَى خَاتِمَتِهَا فَإِنَّهَا بَرَاءَةٌ مِنَ الشِّرْكِ. ‘তুমি ‘কুল ইয়া আইয়্যুহাল কা-ফিরূণ’ সূরাটি পড়ে ঘুমাবে। কেননা এটি হ’ল শিরক হ’তে মুক্তি ঘোষণার সূরা।১৩

ঝ. তাসবীহ, তাহমীদ ও তাকবীর পাঠ করা :

রাতে ঘুমানোর পূর্বে ‘সুবহা-নাল্লা-হ (৩৩ বার)। আলহাম্দুলিল্লা-হ (৩৩ বার)। আল্লা-হু আকবার (৩৪ বার)’ পাঠ করা।

ফযীলত :

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কোন মুসলিম ব্যক্তি দু’টি অভ্যাস আয়ত্ত করতে পারলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেই দু’টি অভ্যাস আয়ত্ত করাও সহজ, কিন্তু এ দু’টি আমলকারীর সংখ্যা কম। তা হ’ল-

 (১) يُسَبِّحُ اللَّهَ فِى دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ عَشْرًا وَيُكَبِّرُ عَشْرًا وَيَحْمَدُهُ عَشْرًا. فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَعْقِدُهَا بِيَدِهِ، فَذَلِكَ خَمْسُونَ وَمِائَةٌ بِاللِّسَانِ وَأَلْفٌ وَخَمْسُمِائَةٍ فِى الْمِيزَانِ.

 (২) وَإِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ سَبَّحَ وَحَمِدَ وَكَبَّرَ مِائَةً فَتِلْكَ مِائَةٌ بِاللِّسَانِ وَأَلْفٌ فِى الْمِيزَانِ. فَأَيُّكُمْ يَعْمَلُ فِى الْيَوْمِ أَلْفَيْنِ وَخَمْسَمِائَةِ سَيِّئَةٍ. 

এক. প্রত্যেক ছালাতের পর ১০ বার ‘সুবহা-নাল্লা-হ’, ১০ বার ‘আলহামদু লিল্লা-হ’ ও ১০ বার ‘আল্লা-হু আকবার’ বলবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তা হাতের আঙ্গুলে গণনা করতে দেখেছি। আর যবানে এর সংখ্যা ১৫০ বার, কিন্তু মীযানে তা ১৫০০ বারের সমান।

দুই. অতঃপর রাতে যখন ঘুমাতে যাবে, তখন ৩৩ বার ‘সুবহা-নাল্লা-হ’, ৩৩ বার ‘আলহামদু লিল্লা-হ’ এবং ৩৪ বার ‘আল্লা-হু আকবার’, বলবে। তা যবানে এর সংখ্যা ১০০ বার, কিন্তু মীযানে তা ১০০০ বারের সমান। বস্তুত তোমাদের এমন কে আছে যে প্রত্যহ ২৫০০ গুনাহ করবে’?

ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! অভ্যাস দু’টো সহজ হওয়া সত্ত্বেও আমলকারীর সংখ্যা কম কেন? তিনি বললেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ছালাতে দাঁড়ায়, তখন শয়তান তার কাছে এসে বলে- অমুক অমুক বিষয় স্মরণ করো, এমনকি তখন সে ছালাতের কথা ভুলে যায়। আবার যখন সে বিছানায় ঘুমাতে যায়, তখন শয়তান এসে তাকে এমনভাবে ভুলিয়ে দেয় যে, অবশেষে সে ঘুমিয়ে পড়ে’।১৪

ঞ. ইহতিসাব পর্যালোচনা করা এবং অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ না রেখে ক্ষমা করা:

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মসজিদে নব্বীতে উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় তিনি বললেন, ‘তোমাদের সামনে একজন জান্নাতী মানুষ আগমন করবে’। অতঃপর একজন ছাহাবী আগমন ঘটল। তাঁর দাঁড়ি থেকে ওযূর পানির ফোটা ঝরে পড়ছিল। তিনি বাম হাতে জুতা নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। দ্বিতীয় দিনেও রাসূল (ছাঃ) অনুরূপ কথা বললেন এবং প্রথম দিনের মতই সেই ছাহাবী আগমন করলেন। তৃতীয় দিনেও যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই একই কথা আবারও বললেন এবং যথারীতি সেই ছাহাবী পূর্বের অবস্থায় আগমন করলেন। রাসূল (ছাঃ) যখন আলোচনা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তখন আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রাঃ) সেই ছাহাবীকে অনুসরণ করে তাকে বললেন, আমি আমার পিতার সাথে ঝগড়া করে শপথ করেছি, তিনদিন পর্যন্ত তার ঘরে যাব না। এই তিনদিন আমাকে যদি আপনার ঘরে থাকার সুযোগ করে দিতেন, তবে আমি সেখানে অবস্থান করতাম। সেই ছাহাবী বললেন, আপনি থাকতে পারেন।

বর্ণনাকারী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রাঃ) বলতেন, তিনি তার সাথে তিন রাত অতিবাহিত করলেন। তিনি তাঁকে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় করতে দেখলেন না। অতঃপর তিনি যখন রাতে ঘুমাতেন, বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করতেন তখনও আল্লাহ্র যিকির করতেন। আর তার মুখ থেকে ভালো কথা ব্যতীত কোনো মন্দ কথা শুনিনি। যখন তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেল এবং তার আমলগুলো সাধারণ মুমিনের আমলের মতই মনে করতে লাগলাম। তাই আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহ্র বান্দা! আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আপনার সম্পর্কে তিন দিন একই কথা বলতে শুনেছি যে, ‘এখনই তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষ আগমন করবে’। উক্ত তিন দিনই আপনি আগমন করেছেন। সুতরাং আমি ইচ্ছা করেছিলাম আপনি কী আমল করেন তা দেখতে আপনার নিকট থাকব। যাতে আমিও তা করতে পারি। আপনাকে তো বেশি আমল করতে দেখিনি। তাহ’লে কোন গুণ আপনাকে এই মহান মর্যাদায় উপনীত করেছে, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন?

সেই ছাহাবী বললেন, তুমি যা দেখেছ ঐ অতটুকুই। আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রাঃ) বলেন, যখন আমি ফিরে আসছিলাম তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। তারপর বললেন, ‘আমার আমল বলতে ঐ অতটুকুই, যা তুমি দেখেছ। তবে আমি আমার অন্তরে কোনো মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তা‘আলা কাউকে কোনো নি‘আমত দান করলে সেজন্য তার প্রতি হিংসা রাখি না’। আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রাঃ) বলেন, এ গুণই আপনাকে এত বড় মর্যাদায় উপনীত করেছে। যা আমরা করতে পারি না। অন্য বর্ণনা মতে, সেই আগন্তুক ছাহাবীর নাম সা‘দ ইবনে ‘আবি ওয়াক্কাছ (রাঃ)।১৫

—–‘‘ফযীলতপূর্ণ দো‘আ ও যিকির’’ বই থেকে নেয়া —–

————————————————-

 ১. ইবনে হিববান হা/১০৫১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫৩৯।

২. জামি‘উছ ছাগীর হা/৭৩৮৩;  ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৯৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫৩৯।

 ৩. আবূ দাঊদ হা/৫০৪২; মিশকাত হা/১২১৫, ছহীহ হাদীছ ।

৪ . বুখারী হা/৬৩২০; মিশকাত হা/২৩৮৪; আবূদাঊদ হা/৫০৫০; আহমাদ হা/৯৫৮৭।

 ৫. বুখারী, মিশকাত হা/২৩৮২; হাসান ছহীহ।

 ৬. বুখারী হা/৬৩১২, মিশকাত হা/২৩৮২; তিরমিযী হা/৩৪১৭; হাসান ছহীহ।

 ৭. আবূদাঊদ হা/৫০৬৭; তিরমিযী হা/৩৫২৯।

 ৮. আবূদাঊদ হা/৫০৬৭; তিরমিযী হা/৩৫২৯; দারেমী  হা/২৭৪৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৬৫।

৯. বুখারী হা/২৩১১; মিশকাত হা/২১২৩।

 ১০. বুখারী হা/৫০৪০; মুসলিম হা/৮০৭; মিশকাত হা/২১২৫।

 ১১. তিরমিযী হা/২৮৮২; মিশকাত হা/২১৪৫; আহমাদ হা/১৮৯১১; আত-তারগীব ২/২১৯।

১২ . বুখারী হা/৫০১৭; মুসলিম, মিশকাত হা/২১৩২।

 ১৩. তিরমিযী হা/৩৪০৩; আবূদাউদ হা/৫০৫৫; আহমাদ হা/২৩৮৫৮; মিশকাত হা/২১৬১।

 ১৪. ইবনু মাজাহ হা/৯২৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫০২; মিশকাত হা/২৩০৬ ।

 ১৫. আহমাদ হা/১২৭২০; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৫৫৯। ইরাক্বী, হায়ছামী ও শু‘আইব আরনাঊত বলেন, এর সনদ ছহীহ’; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৩০৪৮;।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

loader-image

Scroll to Top